somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: মেয়েটা

১৫ ই অক্টোবর, ২০০৯ বিকাল ৫:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ইস্তিয়াক সব সময়ই অন্যদের সাসপেন্সের মধ্যে রাখতে ভালোবাসে। সকালে ফোন করেছিল। ঠিক দশটার সময় চারুকলার সামনে অপেক্ষা করতে বলল । এখন এগারোটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। ইস্তিয়াকের খবর নেই। লালমাটিয়ার দিকে থাকে ইস্তিয়াকরা, জ্যামে পড়ল কি? নতুন ফিয়াট কিনেছে ইস্তিয়াক, ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার: তাছাড়া একটা দৈনিকে পার্ট টাইম জবও করে। ইনকাম ভালোই; গতমাসের শেষে ইন্ডিয়া গিয়েছিল; কাল রাতে ফিরেছে।
বাড়িতে ভালো লাগছিল না শিহাবের । সাড়ে নটার মধ্যেই আর্ট কলেজের সামনে চলে এসেছে। পরিচিত জনরা হাত নাড়ছে। এই কলেজ থেকেই সে পাস করে বেরিয়েছে। অবশ্য এখনও তেমন ভালো চাকরি জোটাতে পারেনি। সেই উদ্বেগ এবং কিছুটা লজ্জ্বা।
দূর থেকে ইস্তিয়াকের নীলরঙের ফিয়াটটা দেখে শিহাব এগিয়ে যায়। গাড়িটা থামল। ইস্তিয়াকের বাঁ পাশে একটা মেয়ে। ফরেনার? কে মেয়েটা? শিহাবকে দেখে হাসল।
ইস্তিয়াকের ইঙ্গিতে শিহাব পিছনের সিটে উঠে বসে। মিস্টি গন্ধ পেল। শিহাবের চিত্রকরের চোখ-এরি মধ্যেই বিদেশি মেয়েটার ঈষৎ বাদামী চুল, ফরসা ডিম্বাকৃতির মুখ, টানা টানা চোখ ধনুকের মতো বাঁকানো ভুরু ও চোখের মনির খয়েরি রং দেখে ফেলেছে।
গাড়িটা আবার স্টার্ট দিয়ে ইস্তিয়াক বলল, শিহাব, এ হচ্ছে অ্যাঞ্জেলা, অ্যাঞ্জেলা শেরম্যান। আমার ফ্রেন্ড।
শিহাব মাথা নাড়ে। ঘাড় ফিরিয়ে অ্যাঞ্জেলাও হাসল। থুতনির কাছটা মিষ্টি। তত লম্বা না। সাদা শার্ট পরে আছে। ইস্তিয়াক ইন্ডিয়া গিয়েছিল-ওখানেই কি মেয়েটার সঙ্গে পরিচয়? হতে পারে। সেসব নিয়ে ভাবতে ভালো লাগছিল না শিহাবের। গতকাল মা রুমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল। রুমার কি হয়েছে বলছে না। কেবলি মা-মেয়ের মধ্যে ফিসফাস। মেয়েলি সমস্যা সম্ভবত। রুমা কাঁদছে। এ নিয়েও ভীষণউদ্বিগ্ন সে। আর মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মত শিহাবদের এখনই আট লাখ টাকা দরকার, নৈলে ওদের খিলগাঁওয়ের বাড়িটা হাতছাড়া হয়ে যাবে। এসব ভেবে শিহাব অস্থির বোধ করে।
গাড়িটা দোয়েল চত্তর পেরিয়ে গেল। ইস্তিয়াক বলল,অ্যাঞ্জেলা আমার কাছে বুড়িগঙ্গার ছবি দেখেছে। নদীটা ও দেখতে চায় ।
ও।
ফরাশগঞ্জের দিকে ইস্তিয়াকের এক স্কুল ফ্রেন্ড থাকে । ফারুক। আটা-ময়দার ব্যবসা আছে। তারই জিম্মায় গাড়িটা রেখে ঘাটে এসে নৌকার দরদাম করে ইস্তিয়াক। এক ফাঁকে ইস্তিয়াক শিহাবকে বলে:অ্যাঞ্জেলা ব্রিটিশ। লন্ডনের কাছে বাসিলডনে থাকে। হায়দ্রাবাদে পরিচয় । পড়াশোনা শেষ করে ঘুরতে বেড়িয়েছে। বাংলাদেশটাও ঘুরে দেখতে চায়। অ্যাঞ্জেলাও তোর মতন ছবি আঁকে রে।
তাই নাকি? বলে কিছুটা অবাক হয়েই অ্যাঞ্জেলার দিকে তাকালো শিহাব। নদীর দিকে তাকিয়ে রয়েছে মেয়েটা। নদীতে কালো পানি। দুপাশে ঘিঞ্জি ঘরবাড়ি, ডকইয়ার্ড, খেয়া নৌকার ভিড়, লঞ্চ। অ্যাঞ্জেলার হাতে একটা ১২.১ মেগাপিক্সেলের ক্যানন পাওয়ার শট ডি-টেন। একটা লঞ্চ এদিকেই আসছিল। ছবি তুলল মেয়েটা।
নৌকা ছাড়তে ছাড়তে রোদ মুছে গেল । মেঘ করে এল। তখন গরম লাগছিল। এখন ঠান্ডা হাওয়া বইতে লাগল। তবে মনে হয় না বৃষ্টি হবে। বুড়িগঙ্গার পানিতে কেমন দুর্গন্ধ। ইস্তিয়াক বিব্রতবোধ করে এবং কৈফিয়তের সুরে বলে, পনির রং আগে এরকম ছিল না অ্যাঞ্জেলা ।
অ্যাঞ্জেলা মাথা ঝাঁকায়। যেন কালো নদীর পচা গন্ধে কিছু যায় আসে না।
গলুইয়ের ওপর বসে শিহাব সিগারেট ধরিয়েছে। শিহাব নদী কিংবা অ্যাঞ্জেলাকে দেখছিল না। কেবলি নিজের ভিতরে উদ্বেগ টের পায়। রুমা কাল সন্ধ্যার পর থেকে ঘর বন্ধ করে আছে। মার মুখ থমথমে। মেয়ের শরীরের কথা ভেবে উদ্বিগ্ন। শিহাবের ভয়টা অন্য জায়গায়। রুমাকে পছন্দ করে ইস্তিয়াক। ছেলে হিসেবে ইস্তিয়াককে মাও পছন্দ করে। আগামী বছর রুমার ফাইনাল পরীক্ষাটা হয়ে গেলেই বিয়ে। ইস্তিয়াক সব শুনলে যদি পিছিয়ে যায়? শিহাব দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে।
অ্যাঞ্জেলা মিষ্টি হেসে বলল, শুনেছি বাংলাদেশের মানুষ খুব ভালো আর ভীষণ সহজ সরল হয় ।
হ্যাঁ। বলে ইস্তিয়াক জিজ্ঞেস করল, দেখতে চাও- বাংলাদেশের মানুষ কত ভালো আর সহজ সরল
?
সিওর।
নৌকার মাঝিটি বুড়ো। মাথায় ছোট ছোট করে ছাঁটা পাকা চুল, গায়ের রং তামাটে, লুঙ্গি আর ময়লা ছেঁড়া গেঞ্জিটা পরে রয়েছে। ইস্তিকাক মাঝিকে জিজ্ঞেস করল, বুড়ামিঞা আপনার বাড়ি কই?
শুভাড্যা।
লন, আপনাগো বাইত যাই।
মাঝি খুশি হয়ে বলল, চলেন।
শিহাব খেয়াল করল অ্যাঞ্জেলার মুখটি ঝলমল করে উঠল। মাঝি যা বলল তা অ্যাঞ্জেলা বাংলা না জানলেও বুঝে গেছে। কথায় কথায় জানা গেল মাঝির নাম সনাতন মন্ডল। নদীর একেবারে ধারেই তার বাড়ি । ঘাটের পরেই ছোট্ট উঠান; সেই উঠান ঘিরে মাটির মেঝে আর বেড়ার চারটে ঘর। বিদেশিনীকে দেখে সনাতন মন্ডলের পরিবারের লোকজন বেরিয়ে এল। অ্যাঞ্জেলা মিটমিট করে হাসছে আর ছবি তুলছে। ব্যাগ থেকে চকোলেট বের করে বাচ্চাদের দিল। বাচ্চারা চকোলট পেয়ে খুশি হয়, হাসে; অ্যাঞ্জেলার চোখ চিকচিক করে ওঠে। ইস্তিয়াকের হাতে একটি ক্যানন ইওএস ফিফটি ডি। ওটা দিয়ে সনাতন মন্ডলের ছোট ছেলের এগারো মাসের নাতনিটি স্থানকালপাত্র ভুলে খিলখিল করে হেসে মায়ের কোল থেকে ঝুঁকে অ্যাঞ্জেলার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়তে যাওয়ার মুহূর্তটি ক্যামেরাবন্দী করে নিল ইস্তিয়াক । সনাতন মন্ডলের বড় ছেলের নাম শুধাংশু। সে কোত্থেকে ডাব পেরে আনল। ঘরে অতিথি এসেছে, ভালোমন্দ না খাওয়ালে কেমন দেখায়?। সনাতন মন্ডল বাজারে যাবে, মাছ কিনবে। ব্যাপারটা টের পেয়ে ইস্তিয়াক আর শিহাবও সনাতন মন্ডলের পিছন পিছন গেল।
সিগারেট ধরিয়ে ইস্তিয়াক বলল, অ্যাঞ্জেলার বাবা রিচার্ড শেরম্যান জার্মানির ওপেল কোম্পানির ইংল্যান্ড ব্রাঞ্চের চিফ মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ। হেবি রিচ নাকি। তবে ভদ্রলোক বেশ উদার। ওয়াল্ড ওয়াইড বেশ কটি চ্যারিটি অর্গানাইজেশনের সঙ্গে জড়িত।
ও।
বাংলাদেশে একটা কমিউনিটি ক্লিনিক করার কথা ভাবছে অ্যাঞ্জেলা । এখানে করতে বললে কেমন হয় বল তো?
মাথা নেড়ে শিহাব বলল, ভালো।

সেভেন আপের গ্লাসে ছোট্ট চুমুক দিয়ে সাদিয়া জানতে চাইল, তোর ব্যাপারটা কি ইস্তি ভাই জানে?
রুমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, না। এখনও বলিনি।
সাদিয়া বলল, চেপে রাখিস না। এক সঙ্গে ঘর করবি যখন।
রুমা কফি খাচ্ছে না। চামচ দিয়ে নাড়ছে কেবল। বলল, আমার আর ইস্তির সঙ্গে ঘর করা আর হবে না।
সাদিয়া হাত নেড়ে বলল, ধুরও। এসব এখন আরলি স্টেজে কোনও ব্যাপারই না। বীণা খালারও লাম্প হয়েছিল। ঠিকমতো ট্রিটমেন্ট করাতে সেরে গেছে। রে নিতে হয়নি।
রুমা বলে, না, না। সে জন্য না।
সাদিয়া অবাক। সেভেন আপের ঠান্ডা গ্লাসে ওর হাতটা থেমে যায়। তাহলে?
ইস্তির ওপর মা বিরক্ত।
বিরক্ত? কেন?
ইস্তি ইন্ডিয়া থেকে বিদেশি একটা মেয়েকে ধরে নিয়ে এসেছে। মেয়েটার সঙ্গে এখানে-ওখানে ঘুরছে। শিহাব ভাইও কেমন। মেয়েটাকে এনে বাসায় তুলেছে। বাঙালি কালচার দেখবে। বাঙালি কালচার না ছাই। সিগারেট টানে, হাফপ্যান্ট পরে, ব্রা পরে না। ছিঃ।
ও, অ্যাঞ্জেলা।
হ্যাঁ।
সাদিয়ার মুখে কে যেন কালি ছিটিয়ে দিল। রুমার মুখোমুখি ও গ্রিনরোডের একটা কফিশপে বসে আছে । বেলা এগারোটার মতন বাজে। কফিশপের ভিতরে তেমন ভিড় নেই। রুমার মুখের দিকে তাকালো সাদিয়া। এসির ভিতরে বসেও রুমা ঘামছিল। ওর সুন্দর মুখটা থেকে আগেকার লাবণ্য কে যেন শুষে নিয়েছে। সাদিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দুজন একটা প্রাইভেট ইউনিভারসিটিতে একসঙ্গে পড়ছে। ইউনিভারসিটিতেই রুমার সঙ্গে প্রথম দেখা, তারপরে রুমার মাধ্যমেই রুমার ভাই শিহাবের সঙ্গে পরিচয়, প্রেম। যখনই ওরা কোনও সমস্যায় পড়ে এই কফি হাউজে মিট করে। রুমাই আজ ফোন করেছিল আসতে। সাদিয়া বলল, কাল তো ওরা মানিকগঞ্জ গেল। অ্যাঞ্জেলা গ্রাম দেখবে।
গ্রাম দেখতে না ছাই! মুখ বাঁকিয়ে রুমা বলল।
সাদিয়া চুপ করে থাকে। রুমা ক্ষেপে উঠে বলল, আমি আর ইস্তি ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখব না।
সাদিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বিদেশি একটা মেয়ের সঙ্গে শিহাবের মেলামেশার ব্যাপরটা সাদিয়াও ঠিক মেনে নিতে পারছে না। শিহাবের মুখে অ্যাঞ্জেলার কথা শোনার পর থেকেই শিহাবের প্রতি ওর অনুভূতিগুলিও কেমন ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে। কেমন এমন হচ্ছে? কাল সন্ধ্যার পর শিহাবকে ফোন করেছিল সাদিয়া । এ্যাই, তুমি এখন কোথায়?
ঝিটকা। খুব সুন্দর জোছনা ফুটেছে।
সাদিয়া চিৎকার করে বলে, কোন্ আক্কেলে তুমি ঐ বিদেশি মেয়ের সঙ্গে ঘুরাফিরা করতেছ? তুমি জান না ওরা ভালো হয় না।
কি বলতেছে তুমি!
আমি বিদেশি এক ছেলের সঙ্গে ঝিটকা গেলে তুমি ...তুমি মেনে নিতে পারতে? বল! বল! বল!
শিহাব চুপ করে থাকে। তারপর বলে, ছিঃ সাদিয়া, তুমি এত নিচ!
হ্যাঁ। আমি নিচ! নিচ! নিচ! ঐ বিদেশি মেয়েটা তোমার ঘরে থাকে। কেন! কেন! কেন!
শিহাব চুপ করে থাকে। তার মুখোশ কিংবা খোলশটি খুলে যেতে থাকে। এব সে বলে, আমরা গরিব মাঝির বাড়ি থাকলাম। তারা মাউন্ড খাইল না আর তোমাগে এত মাইন্ড কিসের?
সাদিয়া চিৎকার করে বলে, গরীর মাঝির মেয়ে তো আর তোমাকে বিয়ে করবে না, করলে আর তোমাদের এক ঘরে থাকতে দিত না।
আমরা এক ঘরে থাকিনি।
জানি। বলে সাদিয়া ফোন রেখে দিল। দিয়ে কাঁদল। শিহাবের সঙ্গে সম্পর্ক হওয়ার পর থেকে সাদিয়া কাঁদেনি। কাঁদার অপেক্ষায় ছিল। আজ কাঁদল। কেননা সাদিয়া জানে শিহাবকে ও হারিয়ে ফেলবে।
কাল রাতে যখন গাঢ় জোছনার আলোয় সিগারেট টানতে টানতে শিহাব ও অ্যাঞ্জেলার সঙ্গে ইস্তিয়াক ঝিটকার চরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল তখন রুমাও ফোন করেছিল । খুব ঘুরে বেড়াচ্ছ না?
হ্যাঁ।
উলটা-পালটা মেয়ের সঙ্গে ঘুরতে লজ্জ্বা করে না তোমার!
কে উলটা-পালটা?
ঐ অ্যাঞ্জেলা না কি নাম-
ইস্তিয়াকের মাথায় রক্ত উঠে যায়। অ্যাই। সাবধানে কথা বল।
কি! আমাকে ধমক দিচ্ছ! প্রেমিকা থাকতে অন্য মেয়ের সঙ্গে ঘুরতে লজ্জ্বা করে না!
অ্যাঞ্জেলা আমার ফ্রেন্ড।
ফ্রেন্ড না ছাই! বাজে মেয়ে, হাফপ্যান্ট পরে, সিগারেট টানে।
তুমি ... তুমি এত মিন মাইন্ডেড রুমা?
আমি মিন মাইন্ডেড না তুমি মিন মাইন্ডেড?
ছিঃ, রুমা। অ্যাঞ্জেলা এনগেজড। ওর সঙ্গে যার বিয়ে হবে তার নাম অ্যারন। বারোদায় সেতার শেখে, ওর ক্লাস চলছে, নইলে আমাদের সঙ্গে আসত। আগামী বছর জুনে অ্যাঞ্জেলার সঙ্গে অ্যারনের বিয়ে হবে।
বিয়ে না ছাই!
ইস্তিয়াক বিরক্ত হয়ে ফোন অফ করে দেয়।

দিনের বেশির ভাগ সময়ই মিসেস ইকবাল ড্রইংরুমে বসে টিভি দেখেন। রান্নাবান্না কাজ করে মনির মা । আজকাল আর টিভির অনুষ্ঠানে মন বসে না। ড্রইংরুমের সোফায় উদ্বিগ্ন হয়ে বসে থাকেন। টিভিতে মন বসে না। ওতটুকু মেয়ে-বুকে লাম্প হল। ডাক্তার বলেছেন আরলি স্টেজ, সেরে যাবে। যদি না সারে। মেয়েকে বিয়ে দিতে হবে। তাছাড়া চিকিৎসার খরচও আছে। বাড়িটা ব্যাঙ্কে মর্টগেজ । ছেলেটা এখনও ভালো চাকরি পেল না। ছেলেবেলা থেকে ভালো ছবি আঁকত বলেই শিহাব আর্ট কলেজে পড়েছে। এসব ভেবে ভেসে অস্থির বোধ করেন মিসেস ইকবাল। ড্রইংরুমের দেওয়ালে শিহাবের বাবার ছবি টাঙ্গানো। সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
ফোন এল। নকিয়াটা তুলে নিলেন মিসেস ইকবাল। রওশন আরা- মিসেস ইকবাল এর অনেক দিনের পুরনো বান্ধবী। কলাবাগান থাকেন। মাঝেমাঝে ফোন করে খোঁজখবর নেন। কিছুটা উত্তেজিত স্বরে রওশন আরা বললেন, আমার একটা ভালো খবর আছে রে হুসনা।
মিসেস ইকবাল দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। একেই বলে কারও সর্বনাশ কারও পৌষমাস। তিনি নিস্তেজ কন্ঠে বললেন, কি ভালো খবর বল?
আমাদের কলাবাগানের জমিটা শেলটেক নিতে রাজী হয়ে। গলির ভিতর হলেও দাম ভালোই পাব। আজই ফাইনাল হল। বিদেশ থেকে ভাইয়েরা সব এসে গেছে।
ভালো।
তা তোদের খবর কী। রওশন আরা জিজ্ঞেস করলেন।
খবর আর কী। নানান সমস্যায় ডুবে আছি। গতকাল ব্যাঙ্ক থেকে আবার চিঠি এসেছে। তারা লোন শোধ করার জন্য চাপ দিচ্ছে। ইস্, তখন কি কুক্ষণেই না রুমার বাবা বাড়িটা মর্টগেজ দিয়ে বেকারি করার জন্য লোন নিয়েছিল, বেকারির ব্যবসা মার খেল, বাড়ির দলিল ব্যাঙ্কের কাছে। টাকা শোধ না হলে ফেরত দেবে না।
রওশন আরা আন্তরিক সুরে বললেন, তোদের জন্য আমি কিছু করতে পারছি না। আমার খুব খারাপ লাগছে রে হুসনা।
তুই আর কি করবি-তোরও তো অনেক জ্বালাযন্ত্রণা। খবর নিচ্ছিস-এই তো অনেক। আপন ভাই বোনেরা তো একটা খবরও নেয় না।
রওশন আরা চুপ করে থাকেন। এসব সময়ে চুপ করে থাকতে হয়। মিসেস ইকবাল বললেন, বিপদের কি শেষ আছে। রুমার বুকে লাম্প তৈরি হয়েছে।
রওশন আরা আঁতকে ওঠেন। বলিস কি! ডাক্তার দেখাচ্ছি তো?
হ্যাঁ। এখনও আরলি স্টেজ।
ও।
আমাদের এইসব ঝামেলা ...আর শিহাব রাস্তা থেকে এক গেষ্ট ধরে এনে ঘরে ঢুকিয়েছে।
রওশন আরা কৌতূহলী হয়ে উঠলেন। কে? কার কথা বলছিস তুই?
আর বলিস না। একটা বিদেশি মেয়ে। শিহাবের সামনেই হাফ প্যান্ট পরে ঘুরঘুর করে, সিগারেট খায়। শিহাবের কাছে কী সব ছবি আঁকা শিখে। শিহাবের ঘরেই শোয়। কত করে বললাম রুমার ঘরে শুতে। রাজী হল না। রুমার সামনে নাকি সিগারেট খাবে না। এই নিয়ে আমার টেনশানের শেষ নেই।
ও।
আর বলিস না। শিহাব সেদিন জিঞ্জিরার কোন্ এক পরিবারকে ধরে এনে দাওয়া করে খাওয়াল। চিনি না জানি না; চৌদ্দজন লোকের জন্য আট পদ রাঁধতে হল। ময়নার মায়ের ছুটি ছিল, গ্রামে গেছে। জানিসই তো আমার ডায়াবেটিস, প্রেশার ...এমন পাগলামীর মানে হয়। দুদিন পর ব্যাঙ্ক থেকে বাড়ি ক্রোকের নোটিশ আসবে। কই, সংসার বাঁচাতে চাকরি খুঁজবি-না ...

বিমানবন্দরে বৃষ্টি।
অ্যাঞ্জেলা বলল, বাংলাদেশ অনেক অনেক সুন্দর দেশ । আমি আবার আসব।
শিহাব মলিন হাসে। আড়চোখে চেয়ে দেখল, ইস্তিয়াকের চোখও ছলছল করছে।
ফেরার পথে গাড়িতে ইস্তিয়াক গম্ভীরভাবে বলল, দোস, এখন থেকে আর বিদেশি লোকজনের সঙ্গে ঘনিষ্ট ভাবে মিশব না।
শিহাব সিগারেট ধরিয়েছিল। একমুখ ধোঁওয়া ছেড়ে বলে, কেন?
চলে যাওয়ার সময় কষ্ট হয়।
ও। বাইরের বৃষ্টির ভিতর সাদিয়ার মুখটা যেন দেখতে পেল শিহাব। ওর চলে যাওয়ার সময়ও কি অনেক কষ্ট হবে?

কদিন পর । মনির মার জ্বর। সকালবেলায় রুমার জন্য স্যুপ রাঁধছিলেন মিসেস ইকবাল । মেয়েটার আজকাল ঘন ঘন জ্বর আসে। এমন সময় রওশন আরার ফোন এল।
হ্যালো।
রওশন আরা বললেন, কাল কলাবাগানের জমির বন্দোবস্ত ফাইনাল হয়ে গেল। বেশ কিছু টাকা পেলাম।
ভালো।
তো তোদের যখন টাকাপয়সার এত ক্রাইসিস, আমি তোদের কিছু টাকা দিতে পারব। টাকাটা ব্যাঙ্কে দিয়ে ওদের বুঝ দে।
মিসেস ইকবাল বললেন, নারে, আমাদের আর টাকা লাগবে না।
টাকা লাগবে না? কেন? শিহাবের কি চাকরি হয়েছে?
না রে। সব টাকা সেই মেয়েটা দিয়ে গেছে।
কোন্ মেয়েটা? কার কথা বলছিস।
ঐ যে ... একটা মেয়ে ... আমাদের বাড়ি এসে কিছুদিন থাকল না-শিহাবের বন্ধু, অ্যাঞ্জেলা।
ওহ্। ক্ষাণিকক্ষণ চুপ করে থেকে রওশন আরা বললেন, রুমার বুকে লাম্প ধরা পড়েছে বললি- তারও তো চিকিৎসার খরচ আছে।
ঐ মেয়েটা সে টাকাও দিয়ে গেছে।









সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই অক্টোবর, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬:০৬
২০টি মন্তব্য ২০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায়

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ২৩ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:১৪


কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায়
আমার বাবা-কাকারা সর্বমোট সাত ভাই, আর ফুফু দুইজন। সবমিলিয়ে নয়জন। একজন নাকি জন্মের পর মারা গিয়েছেন। এ কথা বলাই বাহুল্য যে, আমার পিতামহ কামেল লোক ছিলেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বেনজিরের হালচাল

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৩ শে মে, ২০২৪ রাত ১০:০৫

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের সম্পত্তি ক্রোকের আদেশ দিয়েছেন আদালত।




স্ত্রী জিশান মির্জা এবং দুই মেয়ে ফারহিন রিশতা বিনতে বেনজীর ও তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীরের নামে অঢেল... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙালী মেয়েরা বোরখা পড়ছে আল্লাহর ভয়ে নাকি পুরুষের এটেনশান পেতে?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৩ শে মে, ২০২৪ রাত ১১:২০


সকলে লক্ষ্য করেছেন যে,বেশ কিছু বছর যাবৎ বাঙালী মেয়েরা বোরখা হিজাব ইত্যাদি বেশি পড়ছে। কেউ জোর করে চাপিয়ে না দিলে অর্থাৎ মেয়েরা যদি নিজ নিজ ইচ্ছায় বোরখা পড়ে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমকে হত্যা করায় আপনার কেন দুঃখিত হওয়া উচিত নয়।

লিখেছেন তানভির জুমার, ২৪ শে মে, ২০২৪ রাত ১২:০৮

সোহান ছিল ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের ঈশ্বরা গ্রামের মহাসিন আলীর ছেলে ও স্থানীয় শহিদ নূর আলী কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। ২০১৬ সালের ১০ এপ্রিল বিকেল ৫টার দিকে ঈশ্বরবা জামতলা নামক স্থানে তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেন্ডার ও সেক্স

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২৪ শে মে, ২০২৪ সকাল ৯:৫২

প্রথমে দুইটা সত্যি ঘটনা শেয়ার করি।

২০২২ সালে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ দিতে জেলা পর্যায়ে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। মৌখিক পরীক্ষার ঘটনা। দুজন নারী প্রার্থী। দুজনই দেশের নামকরা পাবলিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×