২.
সাধারণ মেয়ে
আমি অন্ত:পুরের মেয়ে,
চিনবে না আমাকে।
তোমার শেষ গল্পের বইটি পড়েছি, শরৎবাবু
'বাসি ফুলের মালা'।
তোমার নায়িকা এলোকেশীর মরণদশা ধরেছিল
পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে।
পঁচিশ বছর বয়সের সঙ্গে ছিল যার রেষারেষি-
দেখলেম তুমি মহদাশয় বটে,
জিতিয়ে দিলে তাকে।।
নিজের কথা বলি।
বয়স আমার অল্প।
একজনের মন ছঁয়েছিল
আমার এই কাঁচা বয়সের মায়া।
তাই জেনে পুলক লাগত আমার দেহে-
ভুলে গিয়েছিলাম অত্যন্ত সাধারণ মেয়ে আমি,
আমার মতো এমন আছে হাজার হাজার মেয়ে,
অল্প বয়সের মন্ত্র তাদের যৌবনে।।
তোমাকে দোহাই দিই,
একটি সাধারণ মেয়ের গল্প লেখো তুমি।
বড়ো দু:খ তার।
তারও স্বভাবের গভীরে
অসাধারণ যদি কিছু তলিয়ে থাকে কোথাও
কেমন করে প্রমাণ করবে সে-
এমন কজন মেলে যারা তা ধরতে পারে।
কাঁচা বয়সের জাদু লাগে ওদের চোখে,
মন যায় না সত্যের খোঁজে-
আমারা বিকিয়ে যাই মরীচিকার দামে।।
কথাটা কেন উঠল তা বলি।
মনে করো , তার নাম নরেশ।
সে বলেছিল , কেউ তার চোখে পড়ে নি আমার মতো।
এতবড়ো কথাটা বিশ্বাস করব সে সাহস হয় না,
না করব যে এমন জোর কই।।
একদিন সে গেল বিলেতে।
চিঠিপত্র পাই কখনো বা।
মনে মনে ভাবি, রাম রাম, এত মেয়েও আছে সে দেশে,
এত তাদের ঠেলাঠেলি ভিড়।
আর, তারা সবাই কি আবিষ্কার করেছে এক নরেশ সেনকে
স্বদেশে যার পরিচয় চাপা ছিল দশের মধ্যে।।
গেল মেল'এর চিঠিতে লিখেছে,
লিজির সাঙ্গে গিয়েছিল সমুদ্রে নাইতে-
(বাঙালি কবিতা ক'লাইন দিয়েছে তুলে,
সেই যেখানে উর্বশী উঠেছে সমুদ্র থেকে।)
তার পরে বালির 'পর বসল পাশাপাশি-
সামনে দুলছে নীল সমুদ্রের ঢেউ,
আকাশে ছড়ানো নির্মল সূর্যালোক।
লিজি তাকে খুব আস্তে আস্তে বললে,
'এই সেদিন তুমি এসেছ, দুদিন পরে যাবে চলে-
ঝিনুকের দুটি খোলা,
মাঝখানটুকু ভরা থাক্
একটি নিরেট অশ্রুবিন্দু দিয়ে-
দুর্লভ , মূল্যহীন।'
কথা বলার কি অসামান্য ভঙ্গি!
সেই সঙ্গে নরেশ লিখেছে,
'কথাগুলো যদি বনানো হয় দোষ কী,
কিন্তু চমৎকার-
হীরে-বসানো সোনার ফুল কি সত্য, তবু কি সত্য নয়?'
বুঝতেই পারছ
একটা তুলনার সংকেত ওর চিঠিতে অদৃশ্য কাঁটার মতো
আমার বুকে কাছে বিধিয়ে দিয়ে জানায়-
আমি অত্যন্ত সাধারণ মেয়ে।
মূল্যবানকে পুরো মূল্য চুকিয়ে দিই
এমন ধন নেই আমার হাতে।
ওগো, না হয় তাই হলো,
না হয় ঋণীই রইলেম চিরজীবন।।
পায়ে পড়ি তোমার, একটা গল্প লেখো তুমি শরৎবাবু ,
নিতান্ত সাধারণ মেয়ের গল্প-
যে দুর্ভাগিনীকে দূরের থেকে পাল্লা দিতে হয়
অন্তত পাঁচ-সাতজন অসামান্যের সঙ্গে-
অর্থাৎ সপ্তরথিনীর মার।
বুঝে নিয়েছি আমার কপাল ভেঙেছে,
হার হয়েছে আমার।
কিন্তু, তুমি যার কথা লিখবে
তাকে জিতিয়ে দিয়ো আমার হয়ে-
পড়তে পড়তে বুক যেন ওঠে ফুলে।
ফুলচন্দন পড়ুক তোমার কলমের মুখে।।
তাকে নাম দিয়ো মালতী।
ওই নামটা আমার।
ধরা পড়বার ভয় নেই।
এমন অনেক মালতী আছে বাংলাদেশে,
তারা সবাই সামান্য মেয়ে,
তারা ফরাসি জার্মান জানে না,
কাঁদতে জানে।।
কী করে জিতিয়ে দেবে?
উচ্চ তোমার মন, তোমার লেখনী মহীয়সী।
তুমি হয়তো ওকে নিয়ে যাবে ত্যাগের পথে
দু:খের চরমে, শকুন্তলার মতো।
দয়া করো আমাকে।
নেমে এসে আামার সমতলে।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে রাত্রির অন্ধকারে
দেবতার কছে যে অসম্ভব বর মাগি
সে বর আমি পাব না,
কিন্তু পায় যেন তোমার নায়িকা।
রাখো-না কেনো নরেশকে সাত বছর লন্ডনে,
বারে বারে ফেল করুক তার পরীক্ষায়,
আদরে থাক্ আপন উপসিকামন্ডলীতে ।
ইতিমধ্যে মালতী পাশ করুক এম.এ.
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে,
গণিতে হোক প্রথম তোমার কলমের এক আঁচড়ে।
কিন্তু ওইখানে যদি থামো
তোমার সাহিত্যসম্রাট নামে পড়বে কলঙ্ক।
আমার দশা যাই হোক,
খাটো করো না তোমার কল্পনা-
তুমি তো কৃপণ নও বিধাতার মতো।
মেয়েটাকে দাও পাঠিয়ে য়ুরোপে।
সেখানে যারা জ্ঞানী, যারা বিদ্বান, যারা বীর,
যারা কবি, যারা শিল্পী , যারা রাজা
দল বেঁধে আসুক ওর চার দিকে।
জ্যিাতির্বিদের মতো আবিষ্কার করুক ওকে-
শুধু বিদুষী বলে নয়, নারী ব'লে;
ওর মধ্যে যে বিশ্ববিজয়ী জাদু আছে
ধরা পড়ুক তার রহস্য- মুঢ়ের দেশে নয়-
যে দেশে আছে সমজদার, আছে দরদি,
আছে ইংরেজ, জার্মান, ফরাসি।
মালতীর সম্মানের জন্য সভা ডাকা হোক-না-
বড়ো বড়ো নামজাদার সভা।
মনে করা যাক সেখানে বর্ষণ হচ্ছে মুষলধারে চাটুবাক্য,
মাঝখান দিয়ে সে চলছে অবহেলায়-
ঢেউয়ের উপর দিয়ে যেন পালের নৌকা।
ওর চোখ দেখে ওরা করছে কানাকানি-
সবাই বলছে, ভারতবর্ষের সজল মেঘ আর উজ্জ্বল রৌদ্র
মিলছে ওর মোহনী দৃষ্টিতে।
(এইখানে জনাস্তিকে বলে রাখি
সৃষ্টিকর্তার প্রসাদ সত্যই আছে আমার চোখে।
বলতে হল নিজের মুখেই-
এখনো কোন য়ুরোপীয় রসজ্ঞের
সাক্ষাৎ ঘটে নি কপালে।)
নরেশ এসে দাড়াক সেই কোণে,
আর তার সেই অসামান্য মেয়ের দল।।
আর তারপরে?
তার পরে আমার নটেশাকটি মুড়োল।
স্বপ্ন আমার ফুরোল।
হায় রে সামান্য মেয়ে,
হায় রে বিধাতার শক্তির অপব্যয় ।।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই অক্টোবর, ২০০৯ দুপুর ২:৪৫