দ্বিতীয় কিস্তি
ভাষার ইতিহাসে আর একটি চিত্তাকর্ষক বিবর্তন ঘটেছে রুশ ভাষার। এককালে বর্তমান ইউক্রেন এর রাজধানী কিয়েভ ছিল রুশ সংস্কৃতির কেন্দ্র। কিয়েভের প্রিন্স বাকি সকল শাসককে পর্যুদস্ত করে কেন্দ্রীয় শাসক বা জার হয়েছিলেন। মোঙ্গল আক্রমণে কিয়েভ বিপর্যস্ত হলে রুশ জাতি তাদের অধীনস্ত হয়। বহু পরে মস্কোর প্রিন্স মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন, তাদের রুশভূমি ত্যাগ করতে হয়। এবার নতুন কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায় মস্কো, কিয়েভ শিগগীরই তার অধীনস্ত হয়। এবার কিন্তু মস্কোতে ঘাঁটি গাড়া জার ইউক্রেনী ভাষা ও সংস্কৃতিকে দমন করতে রীতিমতো নির্যাতনের আশ্রয় নেন। বিশাল এক ভূ-সাম্রাজ্যে পরিণত হয় রাশিয়া। ইউরোপের উত্তর ও পূর্ব অংশ মধ্য এশিয়ার অনেকগুলো জাতিকে অধীনস্ত করে সে। এহেন রুশ ভাষার পরবর্তী পরিণতি হয় অধীনস্ততা, কিছুটা পরেই আমরা সে আলোচনায় ফিরছি।
রাজনৈতিক মতার বাহন হিসেবে একটি ভাষার বিকাশের পরও বহু েেত্রই আর একটি ঘটনা বহুবার আমরা দেখতে পাই। সেটা হলো কোন কারণে কেন্দ্রীয় মতার ভাঙন ও দুর্বলতার সাথে সাথে আঞ্চলিক শক্তিগুলোর বিকাশ এবং প্রায়শঃই সেই আঞ্চলিক শক্তিগুলোর নিজেদের মতাকে দৃঢ় করার চেষ্টায় কথ্যভাষাগুলোকে গূরুত্ব প্রদান। এ ঘটনা মধ্যযুগে ইউরোপে পোপের কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে রাজাদের উত্থানে সবচেয়ে দৃষ্টিগ্রাহ্য। এ সময়েই সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা, সঙ্গীত ও সংস্কৃতি দরবার ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা পেতে থাকে। রাজনৈতিক সংঘর্ষই ভাষাকেন্দ্রিক জাতিগুলোর বিকাশে এভাবে সহায়তা করেছে। এ ধারাতেই ইংরেজি, জার্মান, ফরাসীসহ আধুনিক ইউরোপীয় ভাষাগুলো মতার কেন্দ্রে হাজির হয়েছে।
উপনিবেশ পর্বে কিন্তু একেবারে নতুন ধরনের ঘটনা ঘটল।উপনিবেশের প্রযুক্তি আর উৎপাদন পদ্ধতির জেরে পরাধীন জাতিগুলো তাদের স্বস্থিতি হারাল। এর আগের যত ধরনের রাজ্যাধিকার আমরা দেখেছি, প্রতিটিতেই অধীনস্ত জাতির উৎপন্ন উদ্বৃত্ত হরণ (খাজনা) আদায়ই ছিল শোষণের মূল ধরন। এবার কিন্তু নতুনতর ধটনা ঘটল। এমনকি সনাতন অর্থে উপনিবেশ বা কলোনি বলতে নতুন নতুন এলাকায় বাড়তি জনগোষ্ঠীকে স্থাপিত করাই বোঝাত। কিন্তু সপ্তাদশ-অষ্টাদশ শতকের উপনিবেশন প্রক্রিয়া বলতে গেলে এক একটা অঞ্চলের মর্মমূলে আঘাত শুরু করে। পূর্ব এশিয়া, ভারত ও আফ্রিকার উপনিবেশগুলো থেকে তারা শুল্ক ও মুনাফা রূপে অধীনস্ত জাতির উৎপন্নের বৃহদাংশ সরাসরি পাচার শুরু করে। স্থানীয় জীবন ও জীবীকার সকল স্বাভাবিক পন্থাকে উচ্ছেদ করে; বস্ত্র-লবন-চিনিসহ প্রতিদ্বন্দ্বী সকল কুটির শিল্প ধ্বংস করে তারা নিজেদের মুনাফা নিশ্চিত করে। এ কথা ভাবা অন্যায় যে, ইউরোপীয় শিল্প সর্বদা গুনে শ্রেষ্ঠত্ব ও সুলভ মূল্যের জোরে বাজার দখল করেছিল। বরং প্রতিকূল আইন (লবন উৎপাদন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, শ্রেষ্ঠ জমিগুলোকে নীল চাষে বাধ্য করা হয়েছিল) ও বিপুল হারে করের দায় (নিন্মমানের মিলের কাপড় বাজারে প্রচলনের জন্য স্থানীয় কাপড়ের ওপর বিপুল অঙ্কের কর বসান হয়েছিল, তাঁতশিল্প এমনভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল যে, তাঁতীদের নগর ঢাকার লোকসংখ্যা বিপুল হারে কমে গিয়েছিল উনিশ শতকের শুরুর অর্ধে) চাপিয়েই কেবল তারা এটা হাসিল করতে পেরেছিল।
এখন আমাদের বিবেচনা করা দরকার, ভাষার অগ্রগণ্যতার প্রশ্নটি সর্বদাই মতার প্রশ্নের সাথে সম্পর্কিত। এর পূর্বের প্রতিটি েেত্রই স্থানীয় ভাষাগুলো দরবারে গূরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে কেন্দ্রের মতাকে ছিন্ন বা গৌণ করে। কিন্তু উপনিবেশের আমলে অধীনস্ত দেশগুলোর গোটা উৎপাদন পদ্ধতিই উপনিবেশের সাথে এমন ভাবে বিন্যস্ত হয়েছে যে, অধিকাংশ সাবেক উপনিবেশে তার জের এমনকি রক্তাক্ত স্বাধীনতা সংগ্রামের পরও কাটেনি। ভাষার প্রশ্নটা সেইখানে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে। উপনিবেশের গোটা কালটা জুড়ে যে জাতিগুলো নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল ক্রমশঃ, আর ওতোপ্রোতভাবে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর সাথে অধীনস্ততার সম্পর্কে যুক্ত হয়ে গিয়েছিল।
মাতৃভাষার প্রশ্নে প্রায় একই রকম একটা অবস্থায় ইউরোপীয় ভাষাগুলোর মাঝে রুশদের অভিজ্ঞতাই সবচেয়ে সা¤প্রতিক। বিরাট ভূ-সাম্রাজ্য হয়েও অর্থনৈতিকভাবে তারা ছিলেন ফরাসি, জার্মান ও বৃটিশ পুঁজিপতিদের অধীনস্ত। এই অধিনস্ততাই ভাষার েেত্রও অধিনস্ততা নিয়ে এসেছিল। মোটে এক থেকে শতাব্দী আগেকার রুশ উপন্যাসের চরিত্রেরা নিজেদের মাঝে ফরাসি ভাষায় কথা বলে আরাম পেতেন, সামরিক বাহিনীতে জার্মান ভাষার দাপট ছিল জার্মান যুদ্ধকৌশল আর প্রকৌশল বিভাগে তাদের পারঙ্গমতার জন্য। সমকালীন দার্শনিক আলোড়নগুলোর ভক্তদের অনেকেই পছন্দ করতেন ইংরেজি। দাস-দাসী আর নিন্মশ্রেণীর মানুষের সাথেই চলত কেবল রুশভাষা, অর্থাৎ স্বয়ং মাতৃভাষাটি। রুশ ভাষা কি মার্গীয় ভাব প্রকাশে সম? নিত্যদিনের প্রশ্ন ছিল এটি।এই ঘটনাটির একটি বড় পরিবর্তন আসে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের বাকি ইউরোপ ওলট-পালট করে রাশিয়া আক্রমণের ঘটনায়। অভিজাতদের একটা বড় অংশই বোনাপার্টের সমর্থন করেছিলেন ইতিপূর্বে। কিন্তু এ সময়ে ফরাসি ভাষী কিংবা ফরাসি উচ্চারণে রুশ বলা অভিজাতরা রাস্তা-ঘাটে নিগৃহীত হতে শুরু করলেন; আর শেষে রুশ অভিজাতরা বাধ্য হয়ে গৃহশিক রেখে রুশ ভাষা শেখা শুরু করলেন!রুশদেশে অভিজাতরা এরপরও বিদেশী ভাষায় ভাব প্রকাশ অব্যাহত রেখেছিলেন। কিন্তু রুশ জনগণের মাঝে এটা একটা অসাধারণ জাতিয়তাবাদী তাড়নার জন্ম দিল। রুশ চিন্তাবিদ, সাহিত্যিক, তরুণ ছাত্র নিজ ভূমি ও ভাষার সম্ভাবনা উদ্ঘাটনে আগ্রহী হয়ে উঠলেন। এরই ফলাফল অষ্টাদশ ও উনিশ শতকের রুশ সাহিত্য ও বিপ্লবী তৎপরতা।আর এরই শেষ ফলাফল রুশ বিপ্লব। বিপ্লবের পর ভাষা কিন্তু মতারও কেন্দ্র হয়ে উঠল, আর রুশ ভাষায় মৌলিক চিন্তার সীমা সমাজবিজ্ঞান ছাড়িয়ে বিজ্ঞানেও প্রভাব সৃষ্টি করল।
বহু দিক দিয়েই বাংলা ভাষার সঙ্কটি রুশ ভাষার সাথে সমতুল্য। হারিয়ে যাওয়া প্রাণ খুঁজে পেল একটি জাতিগোষ্ঠী।এই নিজেকে হারিয়ে ফেলাকে সংেেপ বর্ণনা করা যায় এভাবে: ক. তার গোটা উৎপন্ন আত্মপুষ্টি সাধনের জন্য আর নয়, বরং অগ্রসর পুঁজিবাদী দেশগুলোর কাঁচামাল রফতানিকারক ও তাদের পাকামাল আমদানীকারক হিসেবে ভূমিকা পালনে ব্যবহৃত হল। খ. তার শিা-সংস্কৃতি-জীবন যাপনে সবকিছুতেই প্রভূদের বৈশিষ্ট্যসমূহ অধিকতর আকাঙ্খিত বলে গণ্য হল। গ. এমন একটি সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র জন্ম নিল, যা এই উৎপাদন ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখা,তাকে পাহারা দেয়ার কাজটি করে এবং পাশাপাশি ভাষা ও সংস্কৃতির েেত্রও সেটাকেই ক্রমাগত পুনরুৎপাদন করে।