বান্দরবানের পাহাড় ও প্রকৃতির নয়নাভিরাম সৌন্দর্য দেখার লোভ ছিল অনেকদিনের। সে অনুযায়ী প্রস্তুতিও নেয়া ছিল। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৫ সেপ্টেম্বর রাত ১২টায় হাজির হলাম ঢাকার আরামবাগের সোহাগ পরিবহনের ভলবো কাউন্টারে। দলে আমি ও নোঙর টুরিজমের গাইড কামরুল ভাই ছাড়াও আরো ১০ জন। তাদের মধ্যে ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ চিকিৎসক দম্পতি এবং তাদের ২ মেয়ে। বাস ছাড়ল সাড়ে ১২টায়। একবার যাত্রা বিরতি শেষে ভোর ৭টায় চট্টগ্রাম পৌঁছলাম। ঢাকা থেকে সরাসরি বান্দরবানের গাড়ি থাকলেও আমরা বিশ্রামের জন্য চট্টগ্রাম থামলাম। চট্টগ্রাম থেকে মাইক্রোবাসে করে বান্দরবান যেতে সময় লাগবে সর্বোচ্চ দুই ঘণ্টা। মাইক্রোবাসে চড়ে সবুজ পাহাড় পাশ কাটিয়ে সকাল ৯টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম বান্দরবানের অন্যতম পর্যটন স্পট মেঘলায়। এখান থেকে বান্দরবান শহর ৪ কিলোমিটার দূরে। আমাদের থাকার ব্যবস্থা ছিল মেঘলার বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের মোটেলে। রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে মোটেলের রেস্টুরেন্টে গেলাম সবাই। এরমধ্যেই গাড়ি (স্থানীয় ভাষায় চাঁন্দের গাড়ি) এসে পৌঁছেছে। গাইড কামরুল ভাই জানালেন, প্রথমদিন আমরা দেখবো নীলগিরি, চিম্বুক ও শৈলপ্রপাত। মোটেল থেকে নীলগিরির দূরত্ব ৪৯ কিলোমিটার, সমতল থেকে প্রায় ২ হাজার ২শ ফুট উঁচুতে। নীলগিরির উদ্দেশে আঁকাবাঁকা, উঁচু-নিচু পথ ধরে গাড়ি ছুটে চলার সময় নজরে এলো শৈলপ্রপাত ও চিম্বুক। রাস্তার দুপাশে যতদূর চোখ যায় শুধু পাহাড় আর পাহাড়। এ যেন ভয়ংকর সৌন্দর্যের এক অপার সমারোহ। সত্যিই, আমাদের দেশটা যে অপরূপ সুন্দরের আধার- তার প্রমাণ মিলল আবারো। চান্দের গাড়ি কখনোবা রাস্তা ধরে পাহাড়ের উপরে উঠছে, আবার কখনোবা নামছে। আড়াই ঘণ্টার জার্নি শেষে আমরা নীলগিরি পৌঁছলাম। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এখানে একটি রেস্টুরেন্টও পাওয়া গেল। দেখা মিলল আমাদের মতো আরো অনেক পর্যটকের।
এরমধ্যেই আমার সঙ্গে থাকা ডাক্তার দম্পতিরা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ছবি তোলা নিয়ে। এমন নয়নাভিরাম স্থানে তাদের পদচিহ্নের স্মৃতি থাকবে না তা কি হয় কখনো? কামরুল ভাই নীলগিরি সম্পর্কে আমাদের ছোট্ট করে বিফ্রিং দিলেন। নীলগিরির একপাশে মিয়ানমার, অন্যপাশে দাঁড়ালে বঙ্গোপসাগর দেখা যায়। নীলগিরির পেছনে সাঙ্গু নদী। সবই হলো কিন্তু বৃষ্টি না থাকায় আমাদের মেঘ ছোঁয়া হলো না।
দুঘণ্টা নীলগিরি দেখে এবার চিম্বুক যাওয়ার পালা। এখান থেকে চিম্বুকের দূরত্ব ১৮ কিলোমিটার। চিম্বুকে বেশিক্ষণ ছিলাম না। রওনা দিলাম শৈলপ্রপাতের উদ্দেশে। পর্যটকদের কেউই শৈলপ্রপাতের ঠাণ্ডা পানিতে গা ভেজাতে ভুল করছেন না। শৈলপ্রপাতে অনেকক্ষণ কাটিয়ে পড়ন্ত বিকালে মোটেলে ফিরলাম।
সন্ধ্যার পর মোটেলের ছাদে সবাই মিলে জমিয়ে আড্ডা দিলাম। মজার বিষয় হচ্ছে, আমাদের ক্ষুদে সফরসঙ্গী ১২ বছরের নুহা ও ২ বছরের নীলাদ্রি এরমধ্যেই বাংলাদেশের প্রায় সব দর্শনীয় স্থান দেখে ফেলেছে।
পরদিন গেলাম মোটেলের পাশেই অবস্থিত মেঘলা পর্যটন স্পটে। প্রায় আড়াই ঘণ্টা লেগে গেল পুরো পর্যটন স্পটটির লেক, দুটি ঝুলন্ত সেতু, সাফারি পার্ক ও বান্দরবান চিড়িয়াখানা ঘুরে দেখতে। দুপুরের পর রওনা দিলাম স্বর্ণমন্দির ও নীলাচলের উদ্দেশে। যথাসময়ে চান্দের গাড়িতে চড়ে সবাই রওনা দিলাম এবং আধঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম স্বর্ণমন্দিরে। ১০ টাকার টিকিট কেটে বিকাল ৪টা থেকে ৬টা পর্যন্ত স্বর্ণমন্দির ঘুরে দেখতে পারে যে কেউ। এ বৌদ্ধমন্দিরটির রঙ সোনালি হওয়ায় মন্দিরের নাম স্বর্ণমন্দির। পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত এ মন্দিরের বাহারি নকশা ও রূপ দেখে বিমোহিত হবেন যে কেউ। মন্দির প্রাঙ্গণ থেকে পুরো বান্দরবান শহর নজরে এলো।
মন্দির দেখা শেষে রওনা দিলাম নীলাচলের উদ্দেশে। স্বর্ণমন্দির থেকে নীলাচল ২০ মিনিটের পথ। সমতল থেকে ১ হাজার ৮শ ফুট উপরে অবস্থিত নীলাচলে গিয়ে প্রকৃতির রূপে মন জুড়িয়ে গেল। সন্ধ্যার আকাশে সূর্য লাল হয়ে ডুবতে শুরু করল আস্তে আস্তে। সূর্য আমাদের ছেড়ে যেতে চাইছিল না, নাকি আমরা সূর্যকে ছেড়ে? প্রশ্নটির উত্তর মিলল না।
ঘোরাঘুরি হলো। এবার নীড়ে ফেরার পালা। আবার ঢাকার সেই যানজট, পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ নানান সমস্যা। ফিরে যেতে হবে বলে সবার বেশ মন খারাপ। তারপরও যেতে হবে। রাতেই গাড়িতে উঠে ঢাকার উদ্দেশে রওনা। বান্দরবানের অপার সৌন্দর্যে স্মৃতি রোমান্থন হয়ে ঢাকায় ফেরা।
ভ্রমণপিয়াসী যে কেউ ঘুরে আসতে পারেন বান্দরবান। সত্যিই দেখার অনেক কিছু আছে। যারা অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী তারা যেতে পারেন থানচি, বগালেক, তাজিনডং এবং ক্রিওক্রাডং পাহাড়ের মতো স্থানে। এসবই বান্দরবানের আশপাশের এলাকা।
বান্দরবান যাওয়ার কিছু পরামর্শঃ ঢাকার ফকিরাপুল এবং সায়েদাবাদ থেকে বান্দরবানের উদ্দেশ্যে বেশ কয়েকটি পরিবহনের নন-এসি চেয়ার কোচ চলাচল করে। ভাড়া জনপ্রতি ৩৩০-৪০০ টাকা। থাকার জন্য মেঘলার পর্যটন মোটেল ছাড়াও বান্দরবান শহরে রয়েছে ভালোমানের বেশকিছু আবাসিক হোটেল। এসব হোটেলে থাকার খরচ পড়বে ৪০০ থেকে ১৮০০ টাকার মধ্যে। আর খাবার-দাবারের জন্য হোটেলগুলোর পাশেই রয়েছে বিভিন্ন মানের খাবারের রেস্টুরেন্ট। পর্যটন স্পটগুলোতে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন হবে জিপ কিংবা চান্দের গাড়ি। স্পট অনুযায়ী এসব গাড়ির ভাড়া পড়বে ১ হাজার ৫শ থেকে ৪ হাজার টাকা। খরচ কমাতে তাই দল বেধেই বান্দরবান ভ্রমণে বের হওয়া ভালো।
ছবি: নওরোজ ইমতিয়াজ ও শরীফ ফয়সাল
বিদ্রঃ এই লেখাটি আজকের দৈনিক আমাদের সময় (০৯ অক্টোবর ’০৯) পত্রিকায় ০৬ নং পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই অক্টোবর, ২০০৯ সকাল ১১:০৩