somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ক্ষয়িষ্ণু সময়ের গল্প

০৮ ই অক্টোবর, ২০০৯ রাত ১০:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আকাশে চাঁদ উঠছে । পূর্ণিমার অকৃপণ আলোয় ভরে যাচ্ছে চারপাশ । নিভৃত পল্লির শ্যামলিমা জুড়ে প্রাণের শিহরন । আমি প্রস্তুতি নিচ্ছি মৃত্তিকা মা’র কোলে শেষবারের মত মাথা রাখব বলে । প্রাণের মুকুরে স্পন্দিত স্বদেশ ! তোমার আকাশ -বাতাস জুড়ে দুষ্টুমিভরা হাসির হেঁয়ালীতে কাঁপন তুলবনা আর । শিশিরভেজা শরতের শরীরে আর আঁকবনা ছিপছিপে পায়ের এলোমেলো নকশা ।

আমিও বাঁচতে চেয়েছিলাম । জ্ঞানের আলোয় ভরে দিতে চেয়েছিলাম আমার ক্ষুদ্র ভূবন । কিন্তু জীবনের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সময়গুলো গোলকধাঁধায় কেমন করে হারিয়ে গেল বুঝতেই পারিনি । যখন বুঝলাম- আমার আলোকিত সময়গুলোকে যারা অন্ধকার করে দিয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে নালিশ জানালাম তোমার সর্বোচ্চ বিবেক 'আদালতে' ! কিন্তু তোমার আদালত আমাকে কী রায় দিয়েছিল জান! বলেছিল-“এটা কোন পৌরাণিক আদালত নয় যে চাইলেই মানুষকে তার হারানো দিন ফেরৎ দিতে পারে !” আমি কাঁদব না হাসব বুঝতে পারছিলামনা ! জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া চারটি বছর ফেরৎ পেতে হারালাম আরো দুটো বছর । ততদিনে আমার স্বল্প আয়ের বাবা নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়ে আমার বাবা হওয়ার যন্ত্রনা পুরোপুরি বুঝে গেছেন । ততদিনে আমার আইনজীবী, যিনি সহস্র মামলা জেতা একজন স্বনাম ধন্য ব্যরিস্টার, নিজস্ব নিয়মে বিবেকের জঠরে পদাঘাত করে ভরে নিয়েছেন নিজের থলিটুকু ।

তোমার সবুজাভ প্রান্তরে বেড়ে ওঠা এই আমি আর কোন স্বপ্ন বুনতে চাইনা । তবু তোমাকে বলে যেতে চাই, আমার নিভৃত প্রস্থানের নেপথ্য কথা ।

তখন সদ্য কৈশোর পেরোনো এক প্রাণোচ্ছল তরুনী আমি । ইন্টারমিডিয়েট দিয়ে মেডিকেলে ভর্তীর জন্য জান-প্রাণ দিয়ে লড়ছি । পরীক্ষার আগে কোচিংয়ের সুত্রে জানলাম প্রশ্নপত্র ফাঁসের কথা। দুই লাখে বিকোচ্ছে আমার ভবিষ্যৎ ! ঐ বয়সে, বিশ্বাস করো, অতটা অসৎ হতে পারিনি। আমার ভেতর রাজ্যের অহংকারী, জেদী আর সৎ মানবীটি বাঁধা দিল । আমি রাজী হলাম না । পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে জানলাম নীলক্ষেতের দোকানে ঐ প্রশ্ন দু'শতেও পেয়েছে কেউ কেউ ।আমার মেডিকেলের শিঁকে ছিঁড়লনা সেবার।

তবু হাল ছাড়লাম না । পূর্ণোদ্যমে আবার শুরু করলাম । আমার দিন আর রাত গুলো কিভাবে যে পার করেছিলাম আজ আর মনে করতে পারছিনা । চোখে তখন একটাই স্বপ্ন মেডিকেলে ভর্তী হব । স্বল্প আয়ের বাবা বেসরকারী মেডিকেলে পড়াতে পারবেন না জানতাম, তাই সরকারী মেডিকেলই ছিল একমাত্র ভরসা ।

এমন সময় একজন গোয়েন্দা অফিসারের সাথে পরিচয় । সব শুনে তিনি এর একটা বিহিত করার আশ্বাস দিলেন । আমিও আশায় বুক বাঁধলাম । উপযাচক হয়ে অনেক তথ্য জোগালাম । একটা সময় তার আগ্রহে ভাটা পড়ল । তিনি যেন প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি বেমালুম ভুলে যেতে চাইলেন । তবু আমার পীড়াপীড়িতে একদিন বিরক্ত হয়ে বললেন, “দেখো এর চেয়ে অনেক বড় বড় বিষয় নিয়ে আমাদের ব্যস্ত থাকতে হয় । এ সব ছোট বিষয়ে নজর দেবার সময় কোথায় ? আর তাছাড়া আমাদের হাত-পা বাঁধা । চাইলেও আমরা অনেক কিছু করতে পারিনা ।”

ও, হাজার হাজার শিক্ষার্থীর জীবন নষ্ট হয়ে যাওয়া আপনাদের কাছে ছোট বিষয় ? জাতির পরবর্তি প্রজন্মকে মেধাহীন, চোর আর অসৎ বানানোর প্রক্রিয়া আপনাদের কাছে গৌণ !

পরেরবারও একই নাটক মঞ্চায়িত হল । হতাশার চাদরে নিজেকে জড়িয়ে পরীক্ষার হলে গেলাম । এবং যথারীতি আউট ।

একটা সরকারী কলেজে এডমিশন নিলাম । আমার দুঃখের রজনী আরো দীর্ঘায়িত হল । কলেজের শিক্ষকদের সাথে বিভিন্ন দাবী -দাওয়া নিয়ে অচলায়তন শুরু হল । বন্ধুরা যখন থার্ড ইয়ার শেষ করছে আমি তখনো সদ্য অনার্সে ভর্তী হওয়া প্রথম বর্ষের ছাত্রী !

ততদিনে জীবনের মোহ ছেড়ে গেছে আমায় । প্রিয়তম বন্ধুটির সাথেও কথা বলতে ভাল লাগেনা । মা-বাবা-ভাই-বোন প্রত্যেককেই কেমন অসহ্য হতে লাগল । রাঙ্গামাটির উদার প্রকৃতিতে স্কাউট ক্যাম্প করেও মনে আশা জাগাতে পারলামনা । কিছুদিন কবিতায় মজে থাকতে চাইলাম সেখানেও ব্যর্থ হলাম ।

এই কালরাত্রির যবনিকা টানতে যখন প্রস্তুতি নিচ্ছি- একজন কবির সাথে দেখা। তিনি আমাকে বেঁচে থাকার পরামর্শ দিলেন । জীবন জয়ের গান শোনালেন । অথচ তার কবিতার মেয়েদেরকে তিনি বাঁচাতে পারেননি । নীরাকে আত্মহননের পথ বেছে নিতে হয়েছে । আর ঐ যে সেই মেয়েটি, যার জন্মের আগেই বাবা মারা গিয়েছিল, তাকে তো অন্ধ হয়েই বাকীটা জীবন পার করতে হয়েছে । আমার এই সমালোচনায় কবি বললেন, “ওরা তো বাস্তবের কোন চরিত্র নয় । ওরা এই সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ । কিন্তু তুমি তো বাস্তব ! তোমাকে হেরে গেলে চলবে কেন ? তোমাকে লড়াই করতে হবে ।”

প্রিয় স্বদেশ, তোমার আদালত আমাকে পুরাণের চরিত্র বলে ঠাট্টা করেছে আর তোমার কবি আমাকে বলেছে বাস্তবের নারী । কার কথা বিশ্বাস করব আমি ?

দোহাই মাননীয় আদালত, দোহাই মহামান্য কবিবর, দোহাই গোয়েন্দ চীফ, দোহাই ব্যরিস্টার সাহেব আপনারা একটা জাতিকে এভাবে ধ্বংস করে দেবেন না । ভবিষ্যৎ নপুংশক, কাপুরুষ, মেধাহীন জাতি গঠনের এই হীন প্রয়াস আপনারা রুখুন । আমি না হয় পুরাণের নারীর মতই ধীরে ধীরে হারিয়ে যাব অতলে । তবু ভবিষ্যতের হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে নিশ্চিত আত্মহননের পথ থেকে রক্ষা করুন !
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আজ রমনায় ঘুড়ির 'কৃষ্ণচূড়া আড্ডা'

লিখেছেন নীলসাধু, ১৮ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:২৬




আজ বিকাল ৪টার পর হতে আমরা ঘুড়ি রা আছি রমনায়, ঢাকা ক্লাবের পর যে রমনার গেট সেটা দিয়ে প্রবেশ করলেই আমাদের পাওয়া যাবে।
নিমন্ত্রণ রইলো সবার।
এলে দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???



আপনারা যারা আখাউড়ার কাছাকাছি বসবাস করে থাকেন
তবে এই কথাটা শুনেও থাকতে পারেন ।
আজকে তেমন একটি বাস্তব ঘটনা বলব !
আমরা সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×