somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ডিটেকটিভ গল্প: ওয়াইম্যাক্স - পর্ব ৩, ৪

০৫ ই অক্টোবর, ২০০৯ দুপুর ১২:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আগের পর্বগুলো:
পর্ব ১, ২ (Click This Link)



ঘুম ভাঙার সাথেসাথেই সারা শরীরের ভয়ানক ব্যাথা টের পায় তোজাম্মেল , কিন্তু এত ব্যাথা কেন তা ঠিক মনে করে উঠতে পারেনা। ধীরে ধীরে ঘুমভাব কাটে, টের পায়, পেরিয়েছে একটি বিশেষ রাত -- জীবনের প্রথম হাজতবাসের প্রথম রাত। গতকাল রাতের কথাও মনে পড়ে, রাতের খাবার খাওয়ার পর সোফায় বসে বসে টিভির বস্তাপচা টাইপের কোন নাটক (যথাযথ কারণেই নাম মনে নেই) দেখতে দেখতে নেতিয়ে পড়া মুড়ি চিবুচ্ছিলো সে। আধঘন্টাও পেরোয়নি, এমন সময়েই ডিবির দুই দশাসই ধরনের লোক এসে প্রায় কিছু না বলে কয়েই তাকে ধরে নিয়ে গেলো বাসা থেকে। ওয়ারেন্ট নামে কি একটা কাগজ তারা কোন একফাঁকে তাকে একনজর দেখিয়েছিলো বটে, তবে সেখানে কি লেখা আছে বা সেটা আসলেই তার নামের ওয়ারেন্ট কিনা সেটা ভালোমতো পড়ে দেখার কোন সুযোগ তাকে দেয়া হয়নি বা দেয়ার প্রয়োজন বোধ করা হয়নি। কিল, ঘুষি, কলারে আর মাথায় অবশিষ্ট পাতলা চুলে পুলিশের গব্দা সাইজের হাতের পর্যায়ক্রমিক টান খেতে খেতে গাড়ীতে ওঠার সময় রাজ্যের খিস্তিখেউড় থেকে মোটামুটি যা সে পাঠোদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিলো তাতে বোঝা যায় যে তাকে কোন এক খুনের দায়ে গ্রেফতার করা হয়েছে, এবং পরিপাটিভাবে খুনের কাজটি সম্পন্ন করে বাসায় এসে কোন সাহসে সে আরামে মুড়ি চিবুচ্ছিলো এর কৈফিয়তটাও পুলিশের কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণই। যতবারই "স্যার আপনারা কি বলছেন কিছুই বুঝতে পারছিনা" বলার নিয়ত বা চেষ্টা করেছে সে, ততবারই ক্রুদ্ধ-বিক্ষুব্ধ পুলিশ অফিসারের ডান ও বাঁহাতের যুগপৎ চাটি সেটাকে অংকুরেই বিনষ্ট করে ফেলেছিলো।

পুরো ঘটনাকে মোটামুটি কয়েক মিনিটের আকস্মিক এক টর্ণেডো বলে চিন্তা করা যায়, কি থেকে কি হচ্ছে কিছুই বোঝার উপায় নেই। পুলিশের গাড়ীতে আরো কি কি ঘটেছিলো, ঘটনার আকস্মিকতায় তার বিশেষ কিছু আর তোজাম্মেল হকের মনেও নেই। শুধু মনে আছে, হাজতে এনে ঢোকানোর আধঘন্টার মধ্যেই ডিবির লোকদুজন এসে তাকে ধরে নিয়ে গেছে এক বিশেষ অন্ধকার রূমে, যেখানে প্রায় কিছুই দেখা যায়না, এবং সেই অন্ধকারের মধ্যেই ঈর্ষনীয় দক্ষতার সাথে তাদের একজন, অথবা দুজনও হতে পারে তবে সেটা বোঝার মতো আলোও সেখানে ছিলোনা, মোটাসোটা ওজনদার একটি লাঠি দিয়ে ক্রমাগত তার পশ্চাৎদেশ আর দুহাঁটুর কাফ-মাসলে পিটিয়ে গেছে। এই মুহূর্তের অনুভূত ব্যাথা যে মূলত সেই পিটুনী খাওয়া অঞ্চল থেকেই উৎসরিত, এটাও সে এখন মোটামুটি নিশ্চিত। তাও সব কেমন যেন ঘোলা ঘোলা অনুভব হয়।

সকালের নাশতা করার পর ধীরে ধীরে সমস্ত স্মৃতি ফিরে আসে তোজাম্মেলের। গতরাতে রেড ড্রাগন বারে এক কোটিপতির স্ত্রী, আলমা খন্দকার নাম, পানীয়তে সায়নাইড ধরনের বিষের প্রতিক্রিয়ায়খুন হয়েছেন ; যার জন্য দায়ী করা হচ্ছে তাকে। শুধু তাই না, সপ্তাহখানেক আগে রেড ড্রাগনেই খুন হওয়া আরেকজন কোটিপতির স্ত্রী মিসেস সিনথিয়া বক্সের মৃত্যুর পেছনেও তার হাত রয়েছে বলে পুলিশ বিশ্বাস করছে। যেজন্য সেই মামলার আলামতও আবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছে তারা। এই পরিস্থিতিতে গতকাল রাতে তাকে পেটাতে পেটাতে পুলিশ শুধু একটিই দাবী করেছে যে, সে যে খুনী তা স্বীকার করে নিতে। কেবল তাহলেই নাকি তার খুনের মোটিভ নিয়ে তারা নিরুপদ্রবে দ্রুত কাজ করতে পারবে। পুলিশ এও বলে রেখেছে যে যদি সে সব স্বীকার না করে তাহলে যে পিটুনি তার কপালে আছে সেটার একটা ভগ্নাংশের ভগ্নাংশই নাকি গতকাল তার কপালে জুটেছিলো। সেকথা মনে হতেই আতংকে সংকুচিত হয়ে পড়ে (আক্ষরিক অর্থেই) তোজাম্মেল, যদিও লম্বায় সে পাঁচ ফুট দশের কম না!

তোজাম্মেলের কিছু পরিচয় দেয়া যাক। প্রথমতঃ সে একা থাকে, বিয়ে থা করেনি, বয়স পেরিয়ে যাওয়ায় সে ইচ্ছেও তার আর নেই। দু'চারবার যে বিয়ের কথা এগোয়নি তা না, তবে যেই পাত্রীপক্ষ শুনেছে যে পাত্রের পেশা শখের গোয়েন্দা, অমনি মেয়ে বিয়ে দেবার শখও তাদের মিটে গেছে। তবে এ নিয়ে বিশেষ একটা দুঃখ তোজাম্মেলের নেই, যতটা না দুঃখ আছে তার শখের গোয়েন্দাগিরি ক্যারিয়ারের ক্রমাগত পতন নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করতে পারা নিয়ে। বিশেষ করে গত মাসে যখন এক ভদ্রমহিলা খুব শংকিত মুখে তাঁর কাছে রহস্যউদঘাটনের অনুরোধ করলেন, এবং বিনিময়ে সম্মানী হিসেবে এক হালি মুরগীর ডিম তাও আবার পঁচা ডিম পড়লে পাল্টে দেবেননা এই শর্তে প্রদানের অঙ্গীকার করলেন, তখন তোজাম্মেল হোসেনের কিছুক্ষণের জন্যও মনে হয়েছিলো যে এর চেয়ে বিয়ে করলেই বেশী ভালো হতো। তবে ভদ্রমহিলাকে সে দোষ দেয়না, কারণ, পরপর চার-পাঁচদিন খোঁয়াড়ের মুরগীর ডিম উধাও হয়ে যাবার রহস্য সমাধানের জন্য এর চেয়ে বেশী আর কিইবা দিতে পারতেন তিনি।

তোজাম্মেলের গোয়েন্দা ক্যারিয়ারের পতন হঠাৎ করে না। একসময় ঝানু গোয়েন্দা হিসেবে তার খ্যাতি ছিলো, বিশেষ করে তার বুদ্ধিবৃত্তীয় উৎপাতে শহরের ধনিকশ্রেনীর ভদ্রলোকদের সময় থাকতেই রাতে বাড়ী ফিরতে হতো এবং সে কারণে ধনিকশ্রেনীর নারীমহলে তার একধরনের জনপ্রিয়তাও ছিলো। কিন্তু সেই সুনাম সে ধরে রাখতে পারেনি, একের পর এক আপডেট এসেছে অপরাধজগতে, শার্লক হোমস বা ফেলুদা পর্যায়ের জ্ঞান দিয়ে এযুগের অপরাধীদের আর বাগে আনা যায়না। তারওপর মোজাম্মেল হকের মতো চতুর এবং একই সাথে নিষ্ঠুর লোক যখন একই শহরে গোয়েন্দাগিরিতে নাম লেখালো, তখন ধীর ধীরে সে দেখতে পেলো যে এ শহরের গোয়েন্দাবৃত্তিতে একদা স্বগর্বে বিরাজমান তোজাম্মেল নামের 'ত' অক্ষরটি ক্রমেই 'ম'-এ রূপান্তরিত হচ্ছে।

তবে এটা সত্য যে, ঠিক এই মুহূর্তে সে যে সমস্যায় পড়েছে তাতে তার গোয়েন্দা ক্যারিয়ার অধঃপতনে কেন, গোল্লায় গেলেও তার কিছু যায় আসেনা। পুলিশ ঠিক কি কারণে তাকে সন্দেহ করেছে তা সে জানেনা, তবে কোন কারণ ছাড়া যে দৈবচয়নের ভিত্তিতেও তাকে পুলিশ ধরে আনতে পারে এ সম্ভাবনাটিকেও সে নাকচ করে দিতে পারছেনা। সেজন্যই এখন তার করণীয় হচ্ছে আসলে কি ঘটেছে তা জানা, তারপর কোনভাবে উকিল-টুকিল ধরে জামিন নেয়া, আর সবশেষে এই সমস্যার হাত থেকে তাকে রক্ষার জন্য মোজাম্মেল হক বা সেরকম কারো দ্বারস্থ হওয়া। যদিও মোজাম্মেলকে এখনও সে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বীই ভাবতে পছন্দ করে, তবে হাজতে এহেন পিটুনী খাওয়ার পর মাথা কাজ না করাটাই স্বাভাবিক এমন কোন অজুহাতের ভিত্তিতে মোজাম্মেলের কাছে যাওয়াটাকে সে মনে মনে সিদ্ধ করে নেয়। 'লোকে কি ভাববে' এধরনের দুশ্চিন্তা যে তার মাথায় আসেনি তা না, তবে সেটাকে এই মুহূর্তে পাত্তা না দেয়ার সিদ্ধান্তেই সে অটল থাকে।

হাজতকক্ষে উবু হয়ে বসে এহেন নানারকম চিন্তায় যখন মশগুল ছিলো তোজাম্মেল, তখনই পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। আবারও ডিবি, তবে আজ ভিন্ন দু'জন। এদের চেহারা দেখে ঠিক এই মুহূর্তে বোঝার উপায় নেই যে গতকাল রাতের দুই সীমারের চেয়ে এরা বেশী নাকি কম নিষ্ঠুর । তবে দুজনের মধ্যে বস্ বা সিনিয়র গোছের যে লোকটি সে যখন নিজেকে হাসনাইন মাহমুদ এবং তার সহযোগীকে রাজু আহাম্মেদ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেবার মতো সৌজন্য দেখালো তখন বুকে কিছুটা হলেও বল ফিরে পায় তোজাম্মেল। মনে মনে ভাবে, পুলিশের ছত্রিশ ঘা যাতে কাল রাতেরটাই হয়, আজ যেন আঠারো, না দশ ঘাতেই পার হয়। বিধাতার লীলা বোঝা বড়ই কঠিন, এতদিন যখন সে একটা স্ট্যান্ডার্ড কেসের জন্য বসে বসে প্রার্থনা করতো তিনি মুখ ফিরিয়ে চাননি, আর আজ এই হাজতেই যেন তিনি মুখ ফিরিয়ে দেখলেন! কারণ, তোজাম্মেলকে অবাক করে দিয়ে ডিটেকটিভ হাসনাইন শুধু নিজেদের পরিচয় দেবার সৌজন্যতাই দেখায়নি, ইনভেস্টিগেশন রুমে নিয়ে যেতে যেতে সে এও বলে রেখেছে যে, 'তোজাম্মেল সাহেব, আপনার কোন ভয় নেই, আমরা আপনাকে প্রশ্ন করবো, আপনার ইচ্ছে হলে উত্তর দেবেন, ইচ্ছে না হলে দেবেননা; তবে একটা কথা, কোন মিথ্যা বলবেননা, মিথ্যে ধরা পড়লে শাস্তি অনেক বেড়ে যাবে'। ডিবি ইন্সপেক্টরের মুখে 'সাহেব', 'আপনি' এসব সম্বোধন শুনে কিছুটা অপটিমিস্টিক হবার সাহস পায় তোজাম্মেল, সহসা পিটুনি খেতে হবেনা নিজেনিজেই এরকম একটি সম্ভাবনা কল্চনা করে নিয়ে ভেতরে ভেতরে খুশীতে সে আটখানা, তবে সে আনন্দ তো আর প্রকাশ করা যায়না তাই খানিকটা ভয়মিশ্রিত মূলতঃ নির্লিপ্ত মুখেই থাকতে হয় তাকে। দড়ি ধরা সেন্ট্রির পাশে তাই দীর্ঘদেহী তোজাম্মেলকে ঋজুভঙ্গিতে হেঁটে যেতে দেখা যায়, পেছন পেছন আসে হাসনাইন রাজুকে নিয়ে আর ভাবতে থাকে কিভাবে প্রশ্ন করলে দ্রুত কথা আদায় করা যেতে পারে তা নিয়ে।

গতকালের অন্ধকার কামরার তুলনায় অনেক পরিপাটি আজকের জেরাকক্ষ। একটি টেবিল আর তিনটি চেয়ার ঘরের ভেতর, টেবিলের দরজার দিকটায় ইন্সপেক্টরের বসার জায়গা, পাশে আরেকটি চেয়ার আর তার সামনে একটি টাইপরাইটার। টেবিলের অন্যপাশের চেয়ারের পেছনেই বিশাল জানালা, এই জানালার শিকেই তোজাম্মেলকে বেঁধে রাখা দড়ির আরেকপ্রান্ত বেঁধে তাকে বসিয়ে দেয়া হয়েছে চেয়ারে। দরজার ওপাশেই করিডোরে সারাক্ষণ দুজন সশস্ত্র গার্ড পায়চারী করছে, মোট আটটি কক্ষে চলা জেরার আসামীরা যাতে কোন অঘটনা না ঘটায় তার দায়িত্ব এদু'জনের। এসবই তোজাম্মেলকে দেখিয়ে নিয়েছে হাসনাইন, যাতে নিজের ক্ষতি বাড়ে এরকম কোন কুমতলব তার মনে উঁকি না দেয়।

চেয়ারে বসে থিতু হয় দুই গোয়েন্দা, হাসনাইন নিজে একটি সিগারেট ধরিয়ে আরেকটি বাড়িয়ে দেয় রাজুকে, তারপর তাকায় তোজাম্মেলের দিকে, বলে, 'সিগারেট খান?খাবেন?'
বিস্ময়ে দুচোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম হয় তোজাম্মেলের! দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, 'দিন স্যার, খাই। তবে স্যার বীয়ার হলে কিন্তু জমতো!'
'কি জমতো?'থতমত খায় হাসনাইন।
'এই যে এই আলোচনাটা।' তোজাম্মেল যেন হঠাৎ অনেক সাহস পেয়ে বসে।
'আপনি কি মস্করা করছেন?' স্মিতহাসি ঝুলিয়ে রেখেই জিজ্ঞেস করে হাসনাইন। রাজুর দু'চোখ বিস্ফারিত হয়ে থাকে তোজাম্মেলের দিকে, আগুণ বেরিয়ে আসতে চাইছে যেন প্রায়।
বেশী বলে ফেলেছে বুঝতে পারে তোজাম্মেল, ডিবির মুড যাতে নষ্ট না হয়ে যায় তাই তাড়াতাড়ি বলতে থাকে মোজাম্মেল, 'না স্যার, ঠিক তা না। তবে গতকালের চেয়ে আজ অনেক ফ্রেন্ডলি পরিবেশ তো, সেজন্যই সাহস করে বলে ফেললাম। ঠিক আছে স্যার, অসুবিধা নেই, সিগারেটেই হবে।'
'ওহ, সেটা বলুন। ইনভেস্টিগেশনের সময় এ্যালকোহল নিষিদ্ধ। আর হাজতেও।' হাসনাইন গুছিয়ে বলার চেষ্টা করে।
'তাই নাকি! জানতামনা তো!!' তোজাম্মেলের কন্ঠে আড্ডাবাজির সূর।
'ঐ ব্যাটা তোরে কি জামাই আদরে রাখবো হাজতে!'পাশে বসা রাজু আহাম্মেদ আর দমিয়ে রাখতে পারেনা নিজেকে, ক্ষেপে গর্জে ওঠে; হাসনাইন হাতের ইশারায় থামায় তাকে, বুঝতে পারে, শীগগিরই আসল কাজ শুরু করা দরকার।



'মিঃ তোজাম্মেল, আপনি জানেন তো আপনাকে কেন গ্রেফতার করা হয়েছে।' হাসনাইন জেরার কাজ শুরু করে।
'স্যার শুধু জানি যে আলমা খন্দকার নামে এক কোটিপতির স্ত্রীকে হত্যা করার দায়ে আমাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু তিনি কে ..'
'আমি সেটা জানতে চাইনি। আপনাকে যা যা প্রশ্ন করবো সেটার উত্তর দেবেন।'
'স্যরি স্যার, ঠিক আছে, যেভাবে বলবেন সেভাবেই হবে।'
'গুড! এখন বলুন এই খুন সম্পর্কে আপনি কি কি জানেন।'
'আমি! আমি স্যার কিছুই জানিনা!'
'একটু আগেই না আপনি ভদ্রমহিলার নামধাম বললেন! এখন বলেন কিছুই জানেননা? হাউ ফানি!' মিটিমিটি হাসে হাসনাইন।
'না স্যার, মানে গতকাল রাতে পিটুনী খেতে খেতে যা যা শুনেছি তাই জানি।'
'বলুন, সেটুকুই বলুন।'
'স্যার, গতকাল সন্ধ্যায় রেড ড্রাগনবারে আলমা খন্দকার খুন হয়েছেন। তাঁর ড্রিংকসে নাকি সায়নাইড জাতীয় বিষ মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। এবং আমাকে বলা হয়েছে সপ্তাখানেক আগে সিনথিয়া বক্স নামের আরেকজন ভদ্রমহিলা যে খুন হয়েছেন রেডড্রাগনে সেজন্যও পুলিশ আমাকেই সন্দেহ করছে।'
'সিনথিয়া বক্স কিভাবে খুন হয়েছে আপনার মনে আছে?'
'হ্যাঁ স্যার, টিভিতে অনেকবারই রক্তাক্ত ছুরি, খুনের স্পট দেখানো হয়েছে। আর যেহেতু রেড ড্রাগনে আমি মাঝেমাঝে যাই, সেখানকার বাথরুমটি ছবি দেখেই চিনে ফেলেছি।'
'বাহ, আপনি তো একেবারে গোয়েন্দাদের মতো করে কথা বলছেন! ওহ তাইতো, আপনি নিজেও তো ফ্রিল্যান্স গোয়েন্দা ছিলেন।'
'ছিলাম না, এখনও আছি।' কন্ঠস্বর দৃঢ় হয় তোজাম্মেলের।
'ওহ স্যরি স্যরি, তা আপনাদের ফ্রিল্যান্স গোয়েন্দাদের অপরাধ দমনের সুনামের পাশামপাশি হিটম্যান হিসেবে ভাড়া খাটার বদনামটাও যে ছড়িয়ে পড়ছে, তা থেকে আপনাকে আলাদা করে দেখবো কোন হিসেবে, মিঃ তোজাম্মেল?'
'স্যার, আলাদা করার তো উপায় নেই। তবে এটুকু বলে রাখি স্যার, এই গোয়েন্দাগিরির জন্য আমি আমার পুরো জীবনটাই উৎসর্গ করেছি স্যার, বিয়ে করতে পারিনি, চাইলে চাকুরী একটা যে যোগাড় করতে পারতামনা অতটা নিষ্কর্মা আমি নই। তারওপর, বাবাও ত্যাজ্য করেছেন আমায় আজ পনেরো বছর, কাছের এক বন্ধুর অপরাধ ফাঁস করে দিতে হয়েছে নৈতিকতার দায়ে, কাজের কাজ যা হয়েছে, পুরো বন্ধুমহলই হারিয়েছি। আমার গোয়েন্দা ক্যারিয়ারের রেকর্ডই স্যার আমার পক্ষে কথা বলে। আমি মোজাম্মেলদের মতো পেশাদার নই।'
'পেশাদার মানে!'
'পেশাদার মানে পেশাদার, সে যেমন টাকার জন্য রহস্য উদঘাটন করে তেমনি টাকা পেলে রহস্য চাপাও দিয়ে ফেলতে। কাহিনীর মোড় ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দেয়। হাড়ে হাড়ে বজ্জাত একটা!'
'হিটম্যানের কাজ করেনা?'
'না স্যার, সেরকম কখনও শুনিনি।'
'আচ্ছা, একটা প্রশ্ন আমার মনে খচখচ করছে, জিজ্ঞেস করেই ফেলি, আপনারা শহরের দুজন সবচেয়ে বিখ্যাত গোয়েন্দা, ঠিক আছে, তা আপনাদের নামের এত মিল হলো কিভাবে?' হাসনাইন কথা ঘোরায়।
'সেটা আমি কিভাবে বলবো?' বিরক্তি প্রকাশ করে তোজাম্মেল, 'নিশ্চয়ই আমার নাম নকল করে রেখেছে, আপনি লোকজনকে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারবেন, ওর অনেক আগে থেকেই আমি এ শহরে গোয়েন্দাগিরি করি। আমি যখন স্কুলে পড়ি তখন থেকেই কিশোরগোয়েন্দা ছিলাম, ত্রিশ বছর আগের কথা!'
'কিন্তু মোজাম্মেল যে বলে ও আপনার চেয়ে বয়েসে বড় ...' হাসনাইনের কথা শেষ না হতেই রীতিমতো গর্জে ওঠে তোজাম্মেল, 'বললেই হলো নাকি! বয়েসে ও আমার কমসেকম দশ বছরের ছোট হবে, সেদিনের পিচ্চি ছোকড়া! আমার নাম শহরের লোক আগে জেনেছে।'
জেরা কক্ষে বসে ইন্সপেক্টরকে যেভাবে ঝাড়ি দিয়ে কথা বলে যাচ্ছে তা বুঝতে পেরে হঠাৎনিজেই অবাক হয়ে যায় তোজাম্মেল! একবার ভাবে নিজেকে চিমটি দিয়ে দেখে এ কি স্বপ্ন কিনা। অবশ্য অতদূর যেতে হয়না, ইন্সপেক্টরের পাশে বসা সহযোগীর হিংস্র-ক্ষুব্ধ চেহারা দেখে পরমুহূর্তেই সে নিজের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে যায়।

'যাই হোক নামের মিল বড় কথা না' বলে হাসনাইন আবারও জেরা শুরু করে। জিজ্ঞেস করে, 'আর কিছুই জানেননা?'
'না স্যার!'
'কাল রাতে রেড ড্রাগনে মিসেস খন্দকার আর তার খুনী যে একসাথে ড্রিংক করছিলো সেটা জানেন?'
'স্যার কি করছিলো তা তো বিশদ শুনিনি, তবে যেহেতু ড্রিংকসে বিষ মিশিয়ে দেয়া হয়েছিলো তাই ধরে নেয়া যায় যে পাশাপাশি বসেই ড্রিংক করছিলেন হয়তো। অবশ্য ডান্সের সময়ও হাতে গ্লাস থাকা রিস্কি। সহজেই পাশের কেউ বিষ মিশিয়ে দিতে পারে।' বলেই নিজেকে থামিয়ে ফেলে তোজাম্মেল। 'কি বলতে কি বলে ফেলি!গাধাগুলো সেখান থেকে কোন ধরনের ক্লু বের করে কে জানে!' মুহূর্তের ভাবনা কাজ করে তোজাম্মেলের, হাসনাইনদের আচরণ যতই ভদ্র হোক, তাদের বুদ্ধিবৃত্তি নিয়ে এখনও তোজাম্মেলের সন্দেহটা থেকেই যায়।
'থেমে গেলেন যে!' ক্রুর হাসি হাসে হাসনাইন।
'না, স্যার, এমনি।' আমতা আমতা করে তোজাম্মেল, 'না জেনে আন্দাজে আন্দাজে আর কি বলবো বলুন!'
'আচ্ছা এখন বলুন খুনের সময় আপনি কি করছিলেন?' প্রসঙ্গ পাল্টায় হাসনাইন।
'স্যার খুনের সময়টা আমি আসলে প্রিসাইজলি জানিনা। কাল রাতে হয়তো শুনেছিলাম, কিন্তু আকস্মিক এই বিপদে এতটাই বিস্মিত হয়ে পড়েছি যে অনেক কিছুই মনে করতে পারছিনা।'
'বাহ্, অভিনয় তো ভালোই পারেন মনে হচ্ছে। আচ্ছা বলছি, গত রাত আটটা বিশ থেকে আটটা পঁয়ত্রিশের মধ্যে।' বলতে বলতে হাসনাইন তার ল্যাপটপ খোলে, ওয়াইম্যাক্সের কল্যাণে খুব দ্রুত থানার ডেটাবেসে ঢোকে।
'স্যার, গতকাল পুরো সন্ধ্যেটাই আমি বাসায় ছিলাম, টিভিই দেখেছি শুধু, আর রাতের খাবার রেঁধেছি। ঠিক কোন সময়ে কি করছিলাম খুঁটিনাটি তো মনে নেই, তবে সম্ভবতঃ ঐ সময়টায় রান্না করছিলাম।'
'আপনার কোন এ্যালিবাই বা প্রমাণ আছে? কেউ সাক্ষী দিতে পারবে?'
'স্যার, আমি তো একা থাকি। কে সাক্ষী দেবে?'
'এই ধরুন বাসার দারোয়ান বা পাশের বাসার লোক।'
'আমার বাড়িওলার তো দারোয়ান নেই স্যার, পাশের বাসার লোকজনের সাথেও আমার তেমন জানাশোনা নেই।'
'কারো সাথে ফোনে কথা বলেছেন?'
'না স্যার, আমি কোথাও ফোন করিনি। ওহ, তবে এক ভদ্রমহিলা ফোন করেছিলেন, তাঁর মুরগীর ডিমচোর ধরা পড়েছে এই খবর জানাতে, আমি তাঁকে অভিনন্দনও জানিয়েছি।'
রাজুর বাড়িয়ে দেয়া চার্জশিটের খসড়ায় চোখ বুলায় হাসনাইন, গতরাতেই তোজাম্মেলের মোবাইল ফোনে আসা একমাত্র কলের কলার আইডি থেকে নিশ্চিত করেছে পুলিশ, মুরগীর ডিম চুরি হওয়া নিয়ে বিপদগ্রস্ত জনৈকা মহিলাই ফোন করেছেন তোজাম্মেলকে, তবে সেটা সোয়া সাতটার দিকে। সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে হাসনাইন।

'স্যার একটা কথা বলি?' ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে তোজাম্মেল।
'করুন'
'আমাকে আপনারা সন্দেহ করছেন কিসের ভিত্তিতে?'
'মিঃ তোজাম্মেল, আপনাকে এই শহরে ডিটেকটিভ তোজাম্মেল ছাড়াও আরো একটি নামে চেনে সবাই, বলুনতো সেটা কি?'
'হ্যাটপরা ডিটেকটিভ! এতে সন্দেহের কি আছে?'
'আর আপনার কালোরঙের বিশালাকায় বুটজুতোটিও লোকে চেনে, জানেননা হয়তো।'
'জানবোনা কেন স্যার, আমার জুতোটি যথেষ্ট বিখ্যাত। ওটা নিয়ে তিন বছর আগে দক্ষিণ ঠাটারিপুরের নিউজলেটারে আর্টিকেলও ছেপেছিলো ছেলেরা। কিন্তু আমার হ্যাট আর জুতো কি করেছে স্যার?'
'তোজাম্মেল সাহেব, অভিনয় করবেননা, ওটা আমি পছন্দ করিনা। খুনীকে আমরা সিসিটিভির ফুটেজে সনাক্ত করেছি। যদিও তার চেহারা মোটেও দেখা যাচ্ছিলোনা অন্ধকারে, তবে তার হ্যাট আর জুতোর আদল এবং বড় বড় গোঁফ -- এসবের ছায়া কিন্তু স্পষ্টই ধরা পড়েছে।' হাসনাইনের কন্ঠ গম্ভীর হতে থাকে। সে ল্যাপটপ টেবিলে রেখে ওয়াইম্যাক্সের মাধ্যমে তোজাম্মেলকে দেখায় ভিডিও ফুটেজের কিছু অংশ, কত সহজ হয়ে গেছে জেরা করা এই ওয়াইম্যাক্সের কল্যাণে -- ভাবে হাসনাইন। রাজুর দিকে তাকিয়ে বলে, 'ওয়াই-ম্যাক্স জিনিসটা অসাধারণ? এই খুপরীর মতো জেরার ঘরেও কাজ করে!'
রাজু সাথে করে আনা ছবির হার্ডকপি প্রিন্টও বাড়িয়ে দেয় তোজাম্মেলের দিকে। কিছুটা সামনের দিকে ঝুঁকে হনহন করে হেঁটে যাচ্ছে একটি ছায়ামূর্তি, তার মতোই পাঁচফুট দশ ইঞ্চির কাছাকাছি লম্বা। বিস্ময়ে নীল হয়ে যায় সে, মুহূর্তেই সব ভুলে নির্লিপ্ত হয়ে যেতে ইচ্ছে করে তোজাম্মেলের; ছবিতে যে ছায়াটা দেখা যাচ্ছে তা তো অবিকল সে নিজেই!

হাসনাইন গভীরভাবে লক্ষ্য করে তোজাম্মেলকে, যদি সে অপরাধী না হয়, তাহলে ছবিগুলো দেখার মুহুর্তেই ক্ষুব্ধ হবার চেয়েও অনেক বেশী অসহায় বোধ করার কথা তার। ক্ষোভটা আসার কথা প্রাথমিক বিস্ময়টুকু কাটবার পরে। আর, সে অপরাধী হলে ভিন্ন কথা, তখন নিজের বোকামীর জন্য নিজের ওপর রাগ হবে শুরু থেকেই। তোজাম্মেলর চেহারায় ক্ষোভের প্রকাশ পায় অনেক দেরীতে, এবং সেটাই স্বাভাবিক কারণ হাসনাইন আর রাজু না জানলেও আমরা জানি যে সে খুনী নয়। যাই হোক, তোজাম্মেলের সেই মুখোভঙ্গি হাসনাইনকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত করে যে হয় সে নিরপরাধ, না হলে সে অপরাধী এবং একই সাথে বিরাট অভিনেতা। তবে এই মুহূর্তে তার হাতে যে প্রমাণ আছে তাতে যে দ্বিতীয়টির সম্ভাবনাই তার কাছে অনেক বড় হয়ে দেখা দেয়।

আবারও তোজাম্মেলই নীরবতা ভাঙে, বলে, 'স্যার, এমন হতে পারেনা যে কেউ আমাকে ফাঁসিয়ে দেবার জন্য এরকম সাজ নিয়ে খুন করেছে?'
'অবশ্যই হতে পারে, কিন্তু সেটা কেন করবে? আপনার সাথে কি কারো মনোমালিন্য আছে?'
'সেরকম তো কিছু মনে পড়ছেনা স্যার।'
'তাহলে বলুন, শুধু শুধু আপনাকে কেউ ফাঁসাতে যাবে কেন কেউ?'
'তাও বটে!' অজান্তেই বলে ফেলে তোজাম্মেল।
চিন্তার গোলকধাঁধায় পরে যায় তোজাম্মেল, তবে সে ধাঁধা কাটতে না কাটতেই হাসনাইনের কন্ঠ শোনা যায়,
'আচ্ছা তোজাম্মেল সাহেব, আপনি কি ডান হাতি না বাঁহাতি?'
'ডানহাতি, স্যার।'
'গ্লাস ধরলে ডানহাতেই ধরেন?'
'অবশ্যই!' জিজ্ঞাসাবাদের ঢংয়ের দীর্ঘসূত্রিতায় খানিকটা অধৈর্য্য বোধ করে সে।
'আপনি কি জানেন, যে গ্লাসটি থেকে মিসেস খন্দকার সায়নাইড বিষযুক্ত পানীয় খেয়েছেন, সেটিতে আপনার হাতের ছাপ আছে?'
'কী! কি বললেন স্যার? উনার গ্লাসে সায়নাইড মেশানো হয়নি?'
'না, এবারের খুনী একটি চমৎকার সাইকোলজিকাল গেম খেলেছে, এবং সেটা খুব বুদ্ধিমান লোকের পক্ষেই করা সম্ভব। তোজাম্মেল সাহেব, ঘটনাস্থলে পাওয়া সবগুলো প্রমাণই বলছে খুনী আপনিই। আপনার কোন এ্যালিবাইও নেই, খুনীর পোশাক আর দৈহিক গড়নের যতটুকু ধরা পড়েছে সিসিটিভিতে, এবং বারটেন্ডার কাবিলের ভাষ্যতেও আমরা যতটুকু জেনেছি তাতে সন্দেহের তীরটা আপনার দিকেই যায়। তারপর যখন সায়নাইডযুক্ত হুইস্কির গ্লাসে পাওয়া আঙুলের ছাপগুলো আমাদের ডেটাবেসে মিলিয়ে দেখা গেলো যে সেগুলো হয় মিসেস খন্দকার অথবা আপনার আঙুলের ছাপের সাথে মিলে যাচ্ছে, তখন আর সন্দেহের উর্ধ্বে আপনি থাকেন কি করে?'
'স্যার আমি কিছুই বুঝছিনা! কিভাবে এটা সম্ভব? আমি কিছুই জানিনা স্যার! আমার গোয়েন্দা ব্যবসা গত তিনবছর ধরে খুব খারাপ যাচ্ছে। আগের কেইসগুলোতে যাদের উপকারে এসেছিলাম তাদের কাছে হাত পেতেটেতে খুব নিদারুণ দিন যাচ্ছে আমার স্যার! আমি এসবে এখন আর উৎসাহিতও নই।'
'আপনার অভাব আছে দেখেই তো আমরা আপনাকে আরো বেশী সন্দেহ করতে পারি, তাইনা তোজাম্মেল সাহেব?' মিটিমিটি হাসে হাসনাইন, বলে, 'একজন গোয়েন্দা যিনি অপরাধের খুঁটিনাটি জানেন তিনি অভাবে পড়লে প্রথমেই কোন কাজটি করতে পারেন বলে ভাবা যায়, বলুনতো?'
'আগের ক্লায়েন্টদের কাছে হাত পাতা।' নির্লিপ্ত জবাব তোজাম্মেলের।
'আমি তা মনে করিনা' গলাখাকারি দিয়ে বলে হাসনাইন, 'আমার মতে সে খুব সূক্ষ্ম কোন অপরাধের পরিকল্পনা করবে, কারণ ওসব নো-হাউ তার খুব ভালো জানা থাকার কথা।'

দ্বিমতের ভঙ্গি করে তোজাম্মেল, বলে,'স্যার, একটা কথা বলি। আপনি যা বললেন, সেটা নির্ভর করবে সে গোয়েন্দাটি কি মানুষ হিসেবে ভালো না খারাপ তার ওপর। স্যার, শুধুই রোবটের মতো কোন ঘটনার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে রহস্য উদঘাটনের ক্ষমতা থাকলেই একজন গোয়েন্দা হওয়া যায়না। গোয়েন্দা হতে হলে যেটা সবচেয়ে বেশী জরূরী তা হলো একটা হৃদয়, যে হৃদয় সত্য সম্পর্কে নিশ্চিত হবার জন্য মরিয়া, যে হৃদয় নিরপরাধ মানুষকে বাঁচানোর এবং একই সাথে অপরাধীকে ধরার জন্য মরিয়া। সত্যিকারের গোয়েন্দা অপরাধ করতে পারেনা স্যার।'
খানিকটা বিব্রত হয় হাসনাইন, সত্যি বলতে কি, এই মুহূর্তে তোজাম্মেল নামের এই ভদ্রলোকের কথাগুলো তাকে ভীষনভাবে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। আসলেই তো! শুধু বুদ্ধি থাকলেই তো গোয়েন্দা হওয়া যায়না, সত্য প্রকাশিত হবার আগ পর্যন্ত সে বুদ্ধিটুকু যাতে নিরলস কাজ করে যেতে পারে সে অনুপ্রেরণাটা আরো বেশী দরকার, এবং সেটার জন্য হৃদয় বা মনের তাড়না থাকা চাই।

তোজাম্মেলের জন্য খানিকটা মায়াই হয় হঠাৎ হাসনাইনের, লোকটা সম্পর্কে সে খোঁজ নিয়ে এসেছে জেরার আগে। অনেকদিন ধরে শখের গোয়েন্দা সে বটে, তবে তার বুদ্ধিমত্তা নিয়ে শহরে এখন অনেক সংশয়। বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে অপরাধীরা যেভাবে নিজেদেরকে যন্ত্রপাতির ব্যবহার, যুগের হাওয়ার সাথে আপডেট করে নিয়েছে সেটা করে নিতে পারেনি তোজাম্মেল। ফলে তার পসারও কমতে কমতে প্রায় শূণ্যের কোঠায় নেমে এসেছে। সত্যি বলতে কি, খুনের আলামতগুলো দেখার পর হাসনাইন প্রথম যখন জেনেছে যে ধরা পড়া অপরাধী একজন শখের গোয়েন্দা, তখন তার পেট ফেটে হাসি পাচ্ছিলো এই ভেবে যে একজন শখের গোয়েন্দা কিভাবে এরকম জায়গায় জায়গায় প্রমাণ রেখে আসবে। পরে যখন তোজাম্মেল সম্পর্কে সে বিশদ জেনেছে, তখন সে বুঝেছে যে তোজাম্মেলের মতো বোকা গোয়েন্দা হলে এটা সম্ভব হতেও পারে। হয়তো সিসিটিভির ব্যাপারটিই তার মাথায় আসেনি; হয়তো পুলিশ ডেটাবেস যে খুব সহজেই হাতের আঙুলের ছাপ থেকে সম্ভাব্য অপরাধী সনাক্ত করতে পারে -- এটাই সে জানেনা অথবা কখনও শুনে থাকলেও ভুলে গেছে। সে হয়তো ধারনা করে আছে, এখনও পুলিশ একজন একজন করে সাসপেক্ট ধরে নিয়ে হাতের আঙুলের ছাপ নিয়ে নিয়ে পরীক্ষা করে মেলাবে ঘটনাস্থলে পাওয়া ছাপের সাথে।

এমন সময়েই দরজায় নক হয়, নতুন রিপোর্ট দিয়ে যান থানার সাব ইন্সপেক্টর আসলাম আলী মৃধা। মুখে বলেও যান, 'হাসনাইন ভাই, কেইসে আপডেট আসছে। মিঃ ওয়ালী বক্সের স্ত্রী সিনথিয়া বক্সের ওভার কোটের হাতাতেও আসামী তোজাম্মেলের হাতের ছাপ পাওয়া গেছে। তবে মিসেস আলমা খন্দকার কেইসের ডিএনএ টেস্টের ফল নেগেটিভ। হুইস্কীর গ্লাসে মিসেস খন্দকার ছাড়া আর কারো ডিএনএ পাওয়া যায়নি।' আসলাম দ্রুত চলে যায়।
'তার মানে আপনি শুধু আলমা খন্দকার না, সিনথিয়া বক্সকেও খুন করেছেন' শান্ত কন্ঠে বলে হাসনাইন।
হাসনাইনের কথায় চোখ ঠিকরে বের হয়ে আসার উপক্রম হয় তোজাম্মেলের। যতই আকস্মিক হোক, এতক্ষণ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে ছিলো একটিমাত্র খুনের অভিযোগ-প্রমাণ, আর একরাতের মধ্যেই আরো একটি খুনের প্রমাণ জোগাড় হয়ে গেলো! একসপ্তার মধ্যে কি হবে! সে কি সিরিয়াল কিলার হিসেবে ঘোষিত হবে! পুলিশের এরা আসলে কি করে, এদের পারফরম্যান্সের এত করুণ অবস্থা! প্রায় কাঁদোকাঁদো কন্ঠে সে বলে, 'স্যার আপনারা এসব কি বলছেন? আমি তো কিছুই জানিনা!'
'চোপ!' এতক্ষণে ওপাশ থেকে গর্জে ওঠে রাজু আহাম্মেদ, টেবিলে সজোরে আঘাত করে বলে 'আগে বল কেন খুন করেছিস! কার প্ররোচনায়, কত নিয়ে খুন করেছিস!' হাসনাইন থামাতে চেষ্টা করে রাজুকে। তোজাম্মেল কিছু বলেনা, হা হয়ে তাকিয়ে থাকে, বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে গেছে সে। তবে সেটা দেখে হাসনাইন মনে মনে ভাবে, 'এ লোক গোয়েন্দা হিসেবে এখন ব্যাকডেটেড হয়ে গেলেও, অভিনেতা হিসেবে খেয়ে পরে বাঁচতে পারবে। কোথাও সিনেমা-থিয়েটার করতো কিনা খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে।'

সময় যায়, কিন্তু খুনের মোটিভ বা নেপথ্যের কারণ কি সেটা আর বের হয়না। ঘন্টাদুয়েক নানাভাবে তোজাম্মেলকে বোঝানো হয় যে পাবলিক প্রসিকিউটর অফিসে কেইস ওঠার আগেই অপরাধ স্বীকার করে নিলে কি কি ভাবে সাজা কমে আসতে পারে। তবে সেগুলোর কোনটিতেই কোন কাজ হয়না, 'তোজাম্মেল লোকটা যেরকম নিরপরাধের অভিনয় করে যাচ্ছে তাতে তো মারধোর ছাড়া এই কারণ বের করতে বেশ ঝক্কি পোহাতে হবে', ভাবে হাসনাইন। কিছুটা চিন্তিত ভঙ্গিতেই আবার প্রশ্ন করা শুরু করে হাসনাইন,
"মিঃ তোজাম্মেল, আপনি ড্রিংক করেন?"
খানিকটা ইতস্ততঃ করে তোজাম্মেল, তারপর ধীরে ধীরে মৃদুগলায় বলে "জ্বী স্যার।"
"পছন্দের ড্রিংকস কি?"
"স্যার, বীয়ার। দু'বছর জার্মানীতে ছিলাম স্যার, তখন থেকেই হেইনিকেন আর বাডওয়েইজার।"
"তাই?"
"জ্বী স্যার" একটু লজ্জিত হয় তোজাম্মেল, একটু আগে সিগারেট চাওয়ায় এই ডিটেকটিভ অফিসার তাকে সিগারেট দিয়েছিলো, এই মুহূর্তে বীয়ারের নাম শুনে হঠাৎ তার প্রচন্ড বীয়ারের তৃষ্ণা পায়, বিশেষ করে বরফঠান্ডা চিল্ড বীয়ার। তবে অতটুকু সাহস সে আর করেনা এবার, একটু আগেই একবার বীয়ার চেয়ে বকা খেয়েছে, এখন আবার চাইলে পাছে পরের সিগারেটটুকু পাবার সুযোগ হারায় কিনা; পুলিশের জাত, একবার ক্ষেপলে আর কোনভাবেই তাদের মন গলেনা।

হাসনাইন জিজ্ঞেস করে যায়, "তাহলে সেদিন রেডড্রাগনে মিস খন্দকারের টেবিলে মদের গ্লাসে চুমুকই দিলেননা কেন? হুইস্কী পছন্দ করেননা?"
"স্যার, আপনি কি বলছেন আমি কিছুই বুঝছিনা!"
"অভিনয় ছাড়ুন, অভিনয় ছাড়ুন!!" গর্জে ওঠে হাসনাইন এই প্রথম, "দেখুন, অনেকক্ষণ ধরে আপনার সাথে ভালো ব্যবহার করে যাচ্ছি, কিন্তু আপনি চটুল অভিনয় দিয়ে সেটার মূল্যটাই নষ্ট করে দিচ্ছেন! সময় থাকতেই স্বীকার করে ফেলুন, তা নাহলে কিন্তু আমি আপনাকে দাঙ্গা পুলিশের হাতে তুলে দেবো।"
"স্যার সত্যি বলছি! আমি হুইস্কি খুবই পছন্দ করি, টাকার অভাবে খেতে পারিনা। কিন্তু সেদিন আমি রেড ড্রাগনে ছিলামনা।" প্রাণপণ জবাব তোজাম্মেলের।

টুকরো টুকরো জেরা চলে আরো কিছুক্ষণ, কোন অবস্থাতেই তোজাম্মেলের মুখ থেকে বাড়তি কোন তথ্য বের করা যায়না। 'এমন ঘাঘু অপরাধী!' ভাবতে ভাবতে সেদিনের মতো হাল ছাড়ে হাসনাইন, নিরূপায় মুখে রাজুর দিকে তাকিয়ে বলে, 'রাজু, তোমার যে পরীক্ষাটা করার কথা সেটা করে ফেলো। আজ আর কথা বাড়াইনা।'

সেন্ট্রিকে ডেকে বিশেষ এ্যাপয়েন্টমেন্টে অপেক্ষমান ডাক্তারের কাছে আসামীকে নিয়ে যেতে বলে রাজু, আগের মতোই ধীরপায়ে একইরকম ঋজুভঙ্গিতে হেঁটে যায় তোজাম্মেল, তার নির্লিপ্ততা যেন আরো বাড়ে, অদৃষ্টের কোন খেয়ালের বশে আজ সে এমন বিপদে পড়েছে আর ভাবতেও ইচ্ছে করেনা তার। হাসনাইন আর রাজু দু'জনের চোখেই তোজাম্মেলের চেহারার সেই অসহায়তা ধরা দেয় ঠিকই তবে তার অনুবাদ দাঁড়ায় সম্পূর্ণ উল্টো, কারণ দুজনেই এখনও পুরো নিশ্চিত যে আসামী তোজাম্মেলই। তবে ঠিক সেমুহূর্তেও তারা জানতোনা যে একটু পরেই তাদের একজনের মনে এ নিয়ে কঠিন সন্দেহের বীজ ঢুকে যাবে।

ডাক্তারের ঘরের বাইরেই অপেক্ষায় ছিলো হাসনাইন আর রাজু; ডাক্তারকে দিয়ে যা যা পরীক্ষা করানোর কথা তা হলো তোজাম্মেলের পেটের কাছে, অথবা পাঁজরের আশেপাশে বাহ্যিক বা আভ্যন্তরীন কোন ক্ষত বা আঘাত আছে কিনা সেটা খুঁজে বের করা। প্রায় মিনিট বিশেক পর ডাক্তার বের হয়ে যা রিপোর্ট দিলেন তাতে বোঝা গেল অমন কোন আঘাত তোজাম্মেলের শরীরে নেই। জিজ্ঞাসাবাদ সেদিনের মতো শেষ করে দেয়া হয়, সেন্ট্রীর বাঁধা দড়ির সাথে সাথে দীর্ঘদেহী লোকটি একইরকম বিষন্ন পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে থাকে হাজতঘরের দিকে।

ঋজুপায়ে হেঁটে চলা বিষন্ন তোজাম্মেলের চলে যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই হঠাৎনিজের অজান্তেই রাজু আহাম্মেদ হাসনাইনের কব্জি চেপে ধরে, বলে উঠে, 'হাসনাইন ভাই, সামথিং ইজ ডেফিনিটলি রং!'
'মানে?'
'সেটা পরে বলা যাবে, আগে চলুন সপ্তপুরীতে গিয়ে এককাপ চা খেয়ে আসি।'

(চলবে)
*********************************************
সচলায়তন ব্লগে সুহান রিজওয়ানের লেখা গল্প 'ডিটেকটিভ'র প্লটটির উপর ভিত্তি করে লেখার একটা প্রচেষ্টা ।

বরাবরের মতো এ গল্পটিতেও নানান বিদেশী গল্পের ছায়া পাওয়া যাবে, কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে নিচ্ছি।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই অক্টোবর, ২০০৯ দুপুর ১২:৩৭
১০টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। শেষ মুহূর্তে রাইসির হেলিকপ্টারে কী ঘটেছিল

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২২ শে মে, ২০২৪ রাত ৯:৩২

ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হওয়ার আগে কী ঘটেছিল, সে সম্পর্কে এখন পর্যন্ত খুব কমই জানা গেছে। এবার এ ঘটনার আরও কিছু তথ্য সামনে এনেছেন ইরানের প্রেসিডেন্টের চিফ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছেলেবেলার বন্ধু ও ব্যবসায়িক পার্টনারই মেরেছে এমপি আনারকে।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২২ শে মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


ঝিনাইদহ-৪ আসনের সরকারদলীয় এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ছিল তারই ছোটবেলার বন্ধু ও ব্যবসায়িক পার্টনার আক্তারুজ্জামান শাহীন!

এই হত্যার পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আরেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজকের কিছু উল্টা পালটা চিন্তা !

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২২ শে মে, ২০২৪ রাত ১১:১০

১।
কলকাতা গিয়ে টুকরা টুকরা হল আমাদের এক সন্ত্রাসী এমপি, কলকাতা বলা চলে তার ২য় বাড়ি, জীবনে কতবার গিয়েছেন তার হিসাব কেহ বের করতে পারবে বলে মনে করি না, কলকাতার অলিগলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

মাটির কাছে যেতেই..

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৩ শে মে, ২০২৪ সকাল ৮:৫৬

মাটির কাছে
যেতেই..


ছবি কৃতজ্ঞতাঃ https://pixabay.com/

ঠিক যেন
খা খা রোদ্দুর চারদিকে
চৈত্রের দাবদাহ দাবানলে
জ্বলে জ্বলে অঙ্গার ছাই ভস্ম
গোটা প্রান্তর
বন্ধ স্তব্ধ
পাখিদের আনাগোনাও

স্বপ্নবোনা মন আজ
উদাস মরুভূমি
মরা নদীর মত
স্রোতহীন নিস্তেজ-
আজ আর স্বপ্ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

পর্ণআসক্ত সেকুলার ঢাবি অধ্যাপকের কি আর হিজাব পছন্দ হবে!

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৩ শে মে, ২০২৪ দুপুর ২:২৭



ইন্দোনেশিয়ায় জাকার্তায় অনুষ্ঠিত একটা প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক জিতেছে বাংলাদেশি নারীদের একটা রোবোটিক্স টিম। এই খবর শেয়ার করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপিকা। সেখানে কমেন্ট করে বসেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×