somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মর্জিনা-২

০৪ ঠা অক্টোবর, ২০০৯ দুপুর ১:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মর্জিনা-১

অনেকক্ষণ ধরে চলতে থাকে ওদের টেলিভিশন দেখা। বড়রা দোকানের বেঞ্চিতে বসে থাকে আর চারপাশে ভীড় করে দাঁড়িয়ে থাকে ছোটরা। কোন কোন বালিকার কোলে তার ছোট ভাই বা বোন দেখা যায়। সবাই মনযোগ দিয়ে দেখতে থাকে সাদাকালো পর্দার চলমান ছবি। বিজ্ঞাপনগুলোও সবাই মনযোগ দিয়ে দেখে। এখানে থেকে ওরা জানতে পারে কেয়া সাবান মাখলে ত্বক ফর্সা হয়। আবার কেউ তর্ক শুরু করে তিব্বত সাবানে ত্বক বেশী ফর্সা হয়। এই ধরনের তর্কগুলো বালিকারাই বেশী করে থাকে। বালকদের এ নিয়ে তেমন একটা মাথা ব্যাথা নেই। সবার সাথে মিলে দোকানদারও মনযোগ দিয়ে টেলিভিশন দেখে। বিজ্ঞাপনের ফাকে কোন কাষ্টমারকে অভিযোগ করে, কে তার কাছ থেকে গত এক মাস ধরে বাকী নিয়ে এখনো বাকী শোধ করেনি। কে টাকা মেরে দিয়ে দেশে চলে গেছে। কত টাকা লস হয়েছে এ মাসে ইত্যাদি ইত্যাদি। কোন বাচ্চা হয়তো তার বাবার কাছে একটা লজেন্স খাবার জন্য আবদার করে। মন মেজাজ আর পকেটের অবস্থা ভাল থাকলে বাবা কিনে দেয়। নতুবা বলে, টাকা নাই। কোন কোন বাচ্চা বেশী আবদার করলে বাবা বাকীতে কিনে দেয় নতুবা একটা ধমক লাগিয়ে দেয়। প্রায় রাত এগারোটা পর্যন্ত চলে এই দোকান উৎসব। তারপর সবাই ঘরে চলে যায়। ফালতু সময় নষ্ট করার মত সময় সবার হাতে নেই। ঘুম দিতে হবে ঘুম। শক্তির ঘুম। না ঘুমুলে চলবে না। পরদিন কাজের শক্তি পাওয়া যাবে না। চাল কেনার পয়সা জুটবে না। ঘুমটা তাই বড় প্রয়োজনীয়। এই বাড়ীর কেউ কেউ রাত্রের শিফটে ডিউটি করে। রাত্রের শিফটের ডিউটিগুলো হয় বিভিন্ন গার্মেন্টসে। যারা রাত্রের কাজ করে তারা রওয়ানা হয় তাদের গন্তব্যের দিকে। আর বাকীরা ঘমিয়ে পড়ে। কর্মময় ঘুম।

মর্জিনাও ঘুমিয়ে পড়ে। তার স্বামীও ঘুমিয়ে পড়ে। তাদের সাথে ঘুমিয়ে পড়ে তাদের ছেলেটাও। আবার শুরু হয় আরেক রান্নাঘরের ভোর। বেঁচে থাকার তাগিদে আবার ছোটাছুটি। সবাই ব্যাস্ত। কত কম খেয়ে কত বেশী কাজ করা যায় তার আত্মপ্রতিযোগিতা। কারন প্রায় সবারই দেশের বাড়ীতে টাকা পাঠাতে হয়। অপচয়ের সুযোগ এখানে নেই। কঠোর পরিশ্রম কর, নয়তো বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় জীবিকা থেকে। মর্জিনাও তাই কঠোর পরিশ্রম করে। নিজের জন্য, সন্তানের জন্য, স্বামীর জন্য। পরিশ্রমলব্ধ ক্ষীণকায় শরীর তার। হাতের হাড় আর চামড়া একসাথে লেগে থাকে। কিন্তু তার প্রাণশক্তির অভাব নেই। প্রাণশক্তির জোরে সে বেচে রয়েছে। গার্মেন্টসের যন্ত্রপাতি তার প্রাণশক্তি শুষে শুষে বের করে জমা করছে বড় বড় কার্টনে। তারপর সেই প্রাণশক্তি রপ্তানী হচ্ছে সমুদ্রের ওপাশে।

তারপরও মর্জিনার অভিযোগের কিছু ছিলনা। সে তার জীবন চালিয়ে নিচ্ছিল। জীবনের কঠোরতা তাকে তেমন আঘাত করতে পারেনি। সে এগিয়ে যাচ্ছিল একটার পর একটা কর্মময় ভোর। সে অপারেট করছিল তাকে বরাদ্দ করা বিভিন্ন যন্ত্রপাতি। দেশের অর্থনীতিতে সে কতটুকু অবদান রাখছিল তা সে জানত না ঠিকই তবে নিজের জন্য যে সে প্রতিদিনের চাল, ডাল, আলু, লবণ, তেল, পেয়াজ, লাকড়ির ব্যাবস্থা করতে পারছিল এটা সে জানত। কিন্তু এ জানা বেশীদিন টিকল না। শীঘ্রই তার কর্মস্থানে কিছু ছাটাই হল। এ রকম ছাটাই প্রায়ই হয়। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। মর্জিনাদের জীবনে এ রকম ছাটাই বহুবার আসে। তারা এক বিল্ডিং থেকে আরেক বিল্ডিং এ ভীড় করে। তৈরী হয় আরেকবার ছাটাই হওয়ার জন্য। এ নিত্যদিনের সাধারণ চিত্র।

মর্জিনা তার ছাটাই নিয়ে বাড়ী ফিরে আসে। বকেয়া বেতন পরে দেবে বলে ম্যানেজার জানিয়ে দিয়েছে। সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী এ বেতন যাবে ম্যানেজারের পেটে। অতএব এর আশা না করাই ভাল। তবুও কষ্টের টাকা। তাই মর্জিনারা বারবার ছুটে যায় সাবেক কারখানার গেটটাতে। দাঁড়িয়ে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা। ম্যানেজার সাহেবের প্রায়ই সময় হয় না। যেদিন হয় সেদিন বলেন পরের মাসে আসতে। মর্জিনারা জানে তারা তাদের এই বকেয়া পাবে না। তবুও আশা ছাড়তে পারে না। কারণ বড় কষ্টের টাকা ঐগুলো। নিজের রক্ত ঘাম বানিয়ে উপার্জন করা টাকা। ঘন্টার পর ঘন্টা মেশিনের সাথে বসে বা দাঁড়িয়ে থেকে নিজের শরীরের সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে পরিশ্রমের চিহ্ন রয়ে গেছে টাকাগুলোতে। তাই এর মায়া সহজে ছাড়া যায় না। মাসের পর মাস তাই তারা নিয়মিত টাকার সন্ধানে সাবেক কারখানার গেটে হাজিরা দেয়। একসময় কোন দয়ালু(!) ম্যানেজার হয়তো বলে, "টাকা পুরোডা পাবি না, অর্ধেক পাবি, পুরাডা পাইতে হইলে পরের মাসে আয়"। ভাগ্যবানেরা সেই অর্ধেক নিয়ে ফিরে আসে। দূর্গাভারা একসময় যাতায়াত বন্ধ করে দেয়। কারন এখানে জীবন চলমান।

মর্জিনা আগেও কয়েকবার চাকরী হারিয়েছে। কয়েকবার সে নিজেই চাকরী ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু এবারের মত উদ্বিগ্ন আগে কখনো হয় নি। কারণ পাশের ঘরের শেফালী আর সামনের ঘরের সুমীর মা মাসখানেক হল চাকরী থেকে ছাটাই হয়েছে। প্রতিদিন সকালে তারা চাকরীর খোজে বের হয়। ওরা এখনো চাকরী পায় নি। ইদানিং অবস্থা ভাল না। প্রায়ই বিভিন্ন কারখানা থেকে ছাটাইয়ের খবর আসছে। নতুন লোক নিচ্ছে এমন কোন কারখানার খবর পাওয়া যাচ্ছে না। মর্জিনার তার স্বামীর উপর ভর করলে চলে না। কারণ তাদের একজন না, দুজনের আয়ে সংসার চলে। আজকে মর্জিনা তার ছেলেটার অতিরিক্ত দুষ্টামীর জন্য ছেলেটার গালে একটা থাপ্পর বসায়।

চলবে.........
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জানুয়ারি, ২০১২ রাত ১২:২৭
৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×