somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হুমায়ুন আজাদ

০৩ রা অক্টোবর, ২০০৯ সকাল ৮:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

তুমি জানো না, কোনোদিন জানবে না, কেমন লাগে একটি নড়োবড়ো বাঁশের পুলের ওপর দাঁড়িয়ে কালো জলের দিকে তাকিয়ে থাকতে। তুমি শিশির দেখো নি, কুয়াশা দেখো নি, কচুরি ফুল দেখো নি। তুমি ধানের শীষ দেখেছো টেলিভিশনে, চিল দেখেছো ছবির বইতে। নালি বেয়ে ফোঁটাফোঁটা খেজুরের রস ঝরতে দেখো নি, পুকুরে দেখো নি মাছের লাফের দৃশ্য। তুমি জানো না কেমন লাগে উথাল-পাতাল ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে, আর কেমন লাগে একটি পাখির পেছনে ছুটে ছুটে সকালকে দুপুরের দিকে গড়িয়ে দিতে। আমি জানি;-না আমি জানতাম।

বিষয়টি অতীত হয়ে গেছে এই কারণে যে, এখন তো আমি জড়িয়ে আছি শহরে; আমার পায়ের নিচে শক্ত কংক্রিট, চোখে নিঅন আলো, চারদিকে গোঁ গোঁ করা ট্রাকের উল্লাস। কতো দিন আমি, তোমর মতোই চাঁদ দেখি নি। শহরে কি চাঁদ ওঠে? কুয়াশা নামতে দেখি নি দুধের সরের মতো, পদ্মার পারে দেখি নি ধবধবে কাশফুলের সাদা মেঘ। কতো দিন দেখি নি ধানের গুচ্ছ, তারার গুচ্ছের মতো। কিন্তু যখন আমি হাঁটি, বিকেলে বেড়াই, বই পড়ি, ঘুমোতে যাই, গড়াই স্বপ্নের কথা ভেবে ভেবে, তখন আমি একটি ফুলের গন্ধ পাই। সে-ফুল আমার গ্রাম, সে-ফুল আমার গাঁ। আমার ছোটোবেলার গ্রাম। রাড়িখাল।’

উদ্ধৃত কথাগুলো হুমায়ুন আজাদের। কিশোরদের জন্য লেখা ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’ বইটিতে তিনি এসব কথা লিখেছেন তার মেয়ে মৌলিকে উদ্দেশ করে। এখানে উল্লেখিত রাড়িখাল গ্রামটির অবস্থান বিক্রমপুরে।

এই সেই গ্রাম যেখানে হুমায়ুন আজাদ ১৯৪৭ সালের ২৮ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেছিলেন। রাড়িখালকে তিনি খুব ভালোবাসতেন। সুযোগ পেলেই চলে যেতেন রাড়িখালে। গোলাপের চেয়ে তাকে বেশি টানত কচুরি ফুল। শৈশবের নানা স্মৃতি যেমন পুকুরের টলমলে জল, পৌষের খেজুরের রস আর কার্তিকের মাছ ধরা, ইত্যাদি তাকে তাড়িত করত। শুধু রাড়িখালকে নয়, তিনি মূলত বাংলাদেশকেই ভালোবাসতেন। আর তাই তো এডিনবরায় পিএইচডি শেষ করেই স্ত্রী লতিফা কোহিনূরকে বললেন, চলো, কালই চলে যাব দেশে। স্ত্রী আরও কিছুদিন থেকে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করার পর হুমায়ুন আজাদের উত্তরটা ছিল এরকম: না। আমি এখানে থাকতে আসিনি। চাকরি করতে আসিনি। এসেছি পড়তে। পড়া শেষ। তাই এ দেশে থাকাও শেষ।

হুমায়ুন আজাদ বাংলাদেশের প্রধান প্রথাবিরোধী সত্যনিষ্ঠ বহুমাত্রিক লেখক। ১৯৯৫ সালের ১৯ নবম্বেরে সরকার নিষিদ্ধ করে তার বিখ্যাত ধ্রুপদী গ্রন্থ ‘নারী’। দীর্ঘদিন আইনি লড়াই শেষে ২০০০ সালের মার্চ মাসে ‘নারী’ বইটির ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। হুমায়ুন আজাদ একই সঙ্গে কবি, ঔপন্যাসিক, ভাষাবিজ্ঞানী, সমালোচক, রাজনীতিক ভাষ্যকার ও কিশোর সাহিত্যিক। তার রচনার পরিমাণ বিপুল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের কৃতী ছাত্র, যুক্তরাষ্ট্রের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞানে ডক্টরেট হুমায়ুন আজাদ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও সভাপতি। তার বইগুলোর মধ্যে রয়েছে- কবিতা: ‘অলৌকিক ইস্টিমার’ (১৯৭৩), ‘জ্বলো চিতাবাঘ’ (১৯৮০), ‘সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’ (১৯৮৫), ‘যতোই গভীরে যাই মধু যতোই ওপরে যাই নীল’ (১৯৮৭), ‘আমি বেঁচেছিলাম অন্যদের সময়ে’ (১৯৯০), ‘হুমায়ুন আজাদের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ (১৯৯৪), ‘কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু’ (১৯৯৮), ‘কাব্য সংগ্রহ’ (১৯৯৮) ‘পেরুনোর কিছু নেই’; কথাসাহিত্য : ‘ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল’ (১৯৯৪), ‘সবকিছু ভেঙে পড়ে’ (১৯৯৫), ‘মানুষ হিসেবে আমার অপরাধসমূহ’ (১৯৯৬), ‘যাদুকরের মৃত্যু’ (১৯৯৬), ‘শুভব্রত, তার সম্পর্কিত সুসমাচার’ (১৯৯৭), ‘রাজনীতিবিদগণ’ (১৯৯৮), ‘কবি অথবা দ-িত অপুরুষ’ (১৯৯৯), ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’ (২০০০), ‘ফালি ফালি ক’রে কাটা চাঁদ’ (২০০১); সমালোচনা: ‘রবীন্দ্রপ্রবন্ধ/রাষ্ট্র ও সমাজ চিন্তা’ (১৯৯৩), ‘শামসুর রাহমান/নিঃসঙ্গ শেরপা’ (১৯৮৩), ‘শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ ও অন্যান্য প্রবন্ধ’ (১৯৮৮), ‘ভাষা-আন্দোলন : সাহিত্যিক পটভূমি’ (১৯৯০), ‘নারী’ (১৯৯২), ‘প্রতিক্রিয়াশীলতার দীর্ঘ ছায়ার নিচে’ (১৯৯২), ‘নিবিড় নীলিমা’ (১৯৯২), ‘মাতাল তরণী’ (১৯৯২), ‘নরকে অনন্ত ঋতু’ (১৯৯২), ‘জলপাই রঙের অন্ধকার’ (১৯৯২), ‘সীমাবদ্ধতার সূত্র’ (১৯৯৩), ‘আধার ও আধেয়’ (১৯৯৩), ‘আমার অবিশ্বাস’ (১৯৯৭), ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম : সবুজ পাহাড়ের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হিংসার ঝরনাধারা’ (১৯৯৭), ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’ (১৯৯৮), ‘নির্বাচিত প্রবন্ধ’ (১৯৯৯), ‘মহাবিশ্ব’ (২০০০); ভাষাবিজ্ঞান : ্তুচৎড়হড়সরহধষরুধঃরড়হ রহ ইবহমধষর্থ (১৯৮৩), ‘বাঙলা ভাষার শত্রুমিত্র’ (১৯৮৩), ‘বাক্যতত্ত্ব’ (১৯৮৪), ‘বাঙলা ভাষা’ (১৯৮৪, প্রথম খ-), ‘বাঙলা ভাষা’ (১৯৮৫, দ্বিতীয় খ-), ‘তুলনামূলক ও ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান’ (১৯৮৮), ‘অর্থবিজ্ঞান’ (১৯৯৯); কিশোর সাহিত্য : ‘লাল নীল দীপাবলী বা বাঙলা সাহিত্যে জীবনী’ (১৯৭৬), ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’ (১৯৮৫), ‘কতো নদী সরোবর বা বাঙলা ভাষার জীবনী’ (১৯৮৭), ‘আব্বুকে মনে পড়ে’ (১৯৮৯), ‘বুক পকেটে জোনাকি পোকা’ (১৯৯৩), ‘আমাদের শহরে একদল দেবদূত’ (১৯৯৬); অন্যান্য : ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ (১৯৯৪, সম্পাদনা), ‘হুমায়ুন আজাদের প্রবচনগুচ্ছ’ (১৯৯২), ‘সাক্ষাৎকার’ (১৯৯৪), ‘আততায়ীদের সঙ্গে কথোপকথন’ (১৯৯৫), ‘বহুমাত্রিক জ্যোতির্ময়’ (১৯৯৭), ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রধান কবিতা’ (১৯৯৭)। হুমায়ুন আজাদ ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় বাংলা একাডেমীর বইমেলা থেকে ফেরার সময় আততায়ীদের আক্রমণে গুরুতর আহত হয়ে কয়েকদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে জীবনে ফিরে আসেন। তার পর ওই বছরই চঊঘ-এর আমন্ত্রণে কবি হাইনরিশ হাইনের ওপর গবেষণা বৃত্তি নিয়ে জার্মানি যান। এর পাঁচদিন পর ১২ আগস্ট ২০০৪ মিউনিখস্থ ফ্ল্যাটের নিজ কক্ষে তাঁকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×