somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মর্জিনা-১

৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ দুপুর ১২:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ছাপড়া ঘর। সাত ফুট বাই আট ফুট। টিনের দেয়াল। টিনের একচালা ছাঁদ। বাশের খুটির গাথুনী। বৃষ্টির সময় কোন অসুবিধা হয় না। কিন্তু চৈত্রের রোদের সময় প্রচন্ড উত্তাপে ঘর বাহির সমান হয়ে যায়। এই ছাপড়া ঘরে মর্জিনার বসবাস। একসাথে আরো কিছু ছাপড়া ঘর আছে। সেখানে বসবাস করে মর্জিনার মত আরো কিছু গার্মেন্টস কর্মী। এরা সবাই একসাথে থাকে। একজন আরেকজনের সাথে খোশ গল্প করে, ঝগড়া করে আবার খোশ গল্প করে। একটা কলতলা পুরো বাড়ীটাতে। একটা টানাকল। কলের পানি পরিষ্কার ও সুমিষ্ট। কলতলার সাথে দুটো পায়খানা। মোটামুটি পরিষ্কার। একটা রান্নাঘর আছে। সেখানে তিনটা মাটির চুলা। লাকড়ীর স্তুপ বা ঝুট কাপড়ের স্তুপ দেখা যায় রান্নাঘরের ভিতরে। রান্নাঘরের পাশে একটা ছোট ডোবার মত গর্ত। কলতলার পানি সেখানে জমা হয়। যাবতীয় আবর্জনাও ফেলা হয় সেখানে। ঘন কালটে রঙ ধারণ করে আছে ডোবার পানি। সবসময় সেখানে তিন চারটে বড় বড় কোলা ব্যাঙ্গের দেখা পাওয়া যায়। রান্নাঘর থেকে আসা আবর্জনা খেয়ে তাদের স্বাস্থ্য বেশ উন্নত। মাটির উঠোনের এই বাড়ীতে ঘরগুলো বেশ উচু উচু। কারন বৃষ্টিতে প্রায়ই পানি জমে যায়। রোদ বৃষ্টির জীবন এভাবেই চলে এখানে।

মর্জিনা তার স্বামী আর একটা ছোট ছেলে নিয়ে থাকে এই ঘরটাতে। ঘর ভাড়া মাসে চারশ টাকা। তার স্বামী কাজ করে একটা পাঊডার ফ্যাক্টরীতে। মর্জিনার ছেলেটার বয়স চার বছর। এখনো স্কুলে যাওয়া শুরু করেনি। তবে তার একটা অ আ, এ বি সি ডি শেখার বই আছে। মর্জিনা নিরক্ষর নয়। সে লিখতে পড়তে পারে। সে প্রায়ই তার ছেলেকে নিয়ে বসে এ বি সি ডি শেখাতে। ছেলেকে স্কুলে পড়াবে সে। তার স্বামীরও ইচ্ছা ছেলে স্কুলে পড়বে।

স্বামী স্ত্রী দুজনে মিলে কাজ করে। ঘর ভাড়া দিতে কোন সমস্যা হয় না। থাকা খাওয়া নিয়ে ওরা মোটামুটি ভালভাবেই একজন সাধারণ গার্মেন্টস কর্মী বা ফ্যাক্টরী ওয়ার্কারের জীবন যাপন করছে। ঘরে চালের অভাব নেই। আলুভর্তা আর ভাত, এতেই ওদের সন্তুষ্টি। সকাল সাতটায় মর্জিনার কাজ শুরু হয়। তাই সে ভোর সাড়ে পাচটার দিকে উঠে পড়ে। রান্নাঘরে একটা মাটির চুলায় লাকড়ী বা ঝুটের কাপড় জ্বালিয়ে ভাত বসিয়ে দেয়। মূলত এই বাড়ীর সকাল শুরু হয় ভোর পাচটায়। সবাই ঘুম থেকে উঠে পড়ে। রান্নাঘরে লাইন পড়ে যায়। কলতলায় সবাই মুখ ধুতে থাকে। রান্না শেষ হলে সবাই খাওয়া সেরে রওয়ানা করে যার যার কর্মস্থলের দিকে। যারা একটু দুরের কারখানায় কাজ করে তারা টিফিন ক্যারিয়ারে করে ভাত আর ভর্তা নিয়ে নেয় দুপুরের খাবারের জন্য। আর যাদের কারখানা কাছে তারা দুপুরে এসে খেয়ে যায়। এখানে সবাই কর্মী। নারী পুরুষ সবাই কাজ করে। তবে রান্না বান্নার অতিরিক্ত দায়িত্বটা মেয়েদের কাধে বর্তায়।

মর্জিনার রান্না শেষ হলে স্বামী স্ত্রী একসাথে খেয়ে নেয়। ছেলেটাকে ঘুম থেকে তুলে খাইয়ে দেয়। তারপর স্বামী স্ত্রী যার যার কাজের জায়গায় রওয়ানা দেয়। যাবার সময় ছেলেকে বাইরে রেখে ঘরে তালা মেরে যায়। কারন চুরির ভয় আছে। বাড়ীর অন্যান্য ছেলেপেলের সাথে মর্জিনার ছেলেটাও সারাদিন বাড়ীর সাথের খোলা মাঠটাতে খেলাধুলা করে, মারামারি করে। বিকালের দিকে মর্জিনা বাড়ী ফিরে। তার স্বামী ফিরে রাত্রের দিকে। বিকেলের দিকে অধিকাংশ মেয়েরাই বাড়ী ফিরে। কলতলায় তারা গোসল করে। কিছু নাইলনের বস্তা দিয়ে কলতলাটা আব্রু দেয়া থাকে তখন। বিকেলের দিকে কোন পুরুষ কলতলায় যায় না। কারন তখন মেয়েদের গোসল করার সময়। গোসল শেষ করে মর্জিনা রান্না বসিয়ে দেয়। বাড়ীর অন্যান্য মেয়েদের সাথে খোশ গল্প করে। মর্জিনার ছেলেটার খেলা তখনো শেষ হয় না। সন্ধ্যা নামার পর যখন চারদিক অন্ধকার হয়ে যায় তখনো বাড়ীর ছেলেপেলেরা দৌড়াদৌড়ি করতে থাকে। মর্জিনা তার রান্না শেষ করে। রাত আটটার দিকে মর্জিনার স্বামী বাড়ী আসে। তখন তার সারা শরীরে থাকে পাঊডারের প্রলেপ। যে কেউ দেখলে বলবে এক বস্তা পাউডার ঢেলে দেওয়া হয়েছে তার উপর। বাড়ী ফিরে সে প্রথমে ঘরে ঢোকে না, ঢোকে কলতলায়। গোসল করে পরিষ্কার হয়ে সে ধরে ঢুকে সাথে সাথে খেতে বসে। মর্জিনার ছেলেটাও তার বাবার সাথে খেতে বসে। খাওয়া শেষ হলে বাড়ীর পাশের চায়ের টং দোকানটায় গিয়ে বসে মর্জিনার স্বামী। সেখানে একটা ষ্টার বা নেভী সিগারেটের সাথে তার মত অন্যান্য শ্রমিকদের সাথে আড্ডায় যোগ দেয়। আড্ডার বেশীরভাগ বিষয় থাকে কোন কারখানায় কি হল, বেতন বাড়ল কোথায়, কোথায় শ্রমিক ছাটাই হয়েছে, এলাকার মেম্বার চেয়ারম্যান আজকে কি করেছে, তাকে কোথায় দেখা গেছে, এলাকার কোন রংবাজ নেতা আজকে কোথায় গিয়ে কি করেছে, কার বউ কার সাথে ভেগে গেল, কে নতুন বিয়ে করেছে, কার চাকরীর অবস্থা খারাপ এইসব। তাদের পারিপার্শ্বিক জীবন নিয়েই তাদের আলোচনা। কেউ কেউ একটা পান খায় বা এক কাপ চা খায় যদি পকেটে পাচটা টাকা বেশী থাকে।

মর্জিনা এই সময়টায় তার ছেলেকে পড়াতে বসে। ছেলেটা পড়তে চায় না। ছেলেটার চোখ শুধু ঘরের দরজার বাইরে চলে যায়। সে দেখে অন্যান্য ছেলেপেলারা কি করছে। মর্জিনা প্রায়ই চড় বসায় ছেলেটার মুখে। চড় খেয়ে ছেলেটা কাদে না। শুধু একটু সময়ের জন্য বইয়ের দিকে তাকায়। আবার তার চোখ চলে যায় ঘরের বাইরে। বাড়ীর কোন এক ঘরে হয়তো উচ্চস্বরে টেপ ছাড়া হয়। সেখান থেকে মুজিব পরদেশীর গান বাজতে থাকে উচ্চস্বরে। কারোর কোন অভিযোগ নেই এই উচ্চশব্দের গান বাজানোতে। একসময় মর্জিনা ক্ষান্ত দেয় ছেলের পড়াতে। ছেলে এক দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে অন্যান্যদের সাথে যোগ দেয়। তারপর সব ছেলেপেলেরা কোন এক দোকানের সামনে জড়ো হয় যেখানে টেলিভিশন আছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবাই নাটক সিনেমা দেখতে থাকে। মোটামুটি উৎসব উৎসব ভাব থাকে একটা সবসময় তাদের মধ্যে।


চলবে.................................
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জানুয়ারি, ২০১২ রাত ১২:২৭
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৩:০৬

অবশেষে মিল্টন সমাদ্দারকে গ্রেফতার করেছে ডিবি। এবং প্রেস ব্রিফিংয়ে ডিবি জানিয়েছে সে ছোটবেলা থেকেই বদমাইশ ছিল। নিজের বাপকে পিটিয়েছে, এবং যে ওষুধের দোকানে কাজ করতো, সেখানেই ওষুধ চুরি করে ধরা... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×