somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঈদ এই প্রবাসে

২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ রাত ১:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


অবশেষে এলো সেই ক্ষণ।কাল ই হবে ঈদ। সব অভিযোগ অনুযোগের অবসান।মুহূর্তেই মন থেকে উবে গেল সেই বিড়াম্বনা, কিভাবে কাজে,বাচ্চার স্কুলে বলব আমার বিশেষ ধর্মীয় ছুটি দরকার তবে তা যে কবে ঠিক আগের দিন রাত ছাড়া আর জানা যাবেনা।আমার এক বন্ধু আমাকে ফোন করে প্রথম জানালো চাঁদ দেখা গিয়েছে। ঈদ মোবারক। আমি আর ও জোরে চিৎকার করে আমার হাসবেন্ড আর মেয়েকে জানালাম সে খবর। ওর কথা তখন ও শেষ হয়নি। নামাজ সাড়ে আট টা য় ছুটির দিনে হচ্ছে তাই সবাই যাচ্ছে। ফোর্টিনথ স্ট্রীটের মসজিদে সবচেয়ে বড় জ়ামাত হবে।অবশ্য অন্যান্য ছোট ছোট মসজিদ গুলোতে ও হবে। ওখানেই আমাদের বন্ধু বান্ধবরা সব যাচ্ছে।ও যাচ্ছেনা। ওর বাসায় কাল দুপুরে সবাইকে আসতে বলছে ।ও একজ়ন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ। ঢাকা মেডিকেল থেকে পাশ করেছে।আমি বরিশাল মেডিকেল এর। এখানেই আলাপ। আমি ওর এক বছরের জুনিয়র , তুমি করেই ডাকি।ওর বর একজন নেফ্রলজিষ্ট। এত ব্যস্ত দুজনেই। তারপর গত সপ্তাহে যখন ফোন করে বলল, আমি পটলাকের কথা বলেছিলাম,সবাই একটা করে ডিস নিয়ে আসব। নামাজের পর সবাই এক জায়গায় হওয়াটা ই তো মুখ্য। আমি যখন ফ্লোরিডায় ছিলাম, ওখানকার একটি মসজিদে, মূলত ওয়েষ্ট ইন্ডিজ়ের মুসলমানই বেশী যেত ।অল্প কিছু অন্যান্য দেশের মুসলিম।প্রতিদিন ক’য়েক শত লোক একসাথে ইফতারী করত , রাতের খাবার, তারাবী ।একেক দিন একেকজ়ন খাবার সরবরাহ করত। ঈদের দিন সকালে নিয়ে আসত সবাই। আমি একবার তন্দুরি চিকেন ক’রে নিয়েছিলাম। আমাকে নির্ধারিত ক’রে দেয়া হ’য়েছিল নাকি আমি ফাঁকিবাজ ব’লে সহজ রান্না বেছে নিয়াছিলাম মনে পড়ছেনা। যা ই হোক, ও রাজী হ’ল না।ও একাই সব করবে। এবারে তো রোববারে ঈদ, আমেজ ই অন্যরকম।আর যদি না হয় ? সে ব্যাবস্থা ও করা আছে। সন্ধ্যায় আসবে সবাই। চাইলেইতো আর সবাই সোমবারে ছুটি নিতে পারবেনা। তাহ’লে ওর বাসায় হবে চাঁদ রাত। মেহেদি পড়বে। আমার ছোটবেলায় চাঁদরাতের এমন অস্তিত্ত ছিলনা। এখানে এসেই দেখলাম অন্যান্য অনেক দেশের মুসলিমরা বেশ ধুম ধাম করে করে চাঁদরাত। মেয়েদের ই অনুষ্ঠান মূলত, অবশ্য ছেলেদের মানি ব্যাগ অংশগ্রহণ করে।বিভিন্ন জায়গায় আবার শাড়ী গয়নার স্টল ও বসে যায়! ছোট একটি মেহেদীর দাওয়াত ও অবশ্য পেলাম তখন ই ।না ততটা তাগিদ অনুভব করলাম না। রান্না বান্না বাজার আর ঈদ হবে কি হবে না এই দুশ্চিন্তায় ক্লান্ত আমি। আশে পাশে কয়েক টি ইন্ডিয়ান পাকিস্তানীদের দোকান থেকে সেমাই কেনা গেলেও আলদিনের লাচ্ছা সেমাইর জন্য বাংলাদেশী দোকানে যেতেই হবে। বেশ দূর।৪৫ মাইল ড্রাইভ। তাছাড়া আমি দেশী লোকের দোকান থেকেই কেনাকাটা করতে চেষ্টা করি।দেশী ব্রান্ডের মসলা।একবার দেশী ব্রান্ডের মরিচের গুঁড়া কিনে ধরা। তারপর শুনলাম ওদের মরিচ নিয়ে এমন অভিজ্ঞতা অনেকেরই হয়েছে। কি আর করা। দেশের জন্য কিছু করতে পারার আনন্দ এবং তাড়নায় মরিচ ছাড়া অন্য সব মশলা ওই ব্রান্ডের ই কিনি।
সারাটা সপ্তাহ জুড়ে ই বৃষ্টি আর বৃষ্টি। এমন বৃষ্টি নাকি আটলান্টায় গত ২০ বছরে হয়নি। ২০ ইঞ্চি বৃষ্টি হয়েছে। ঈদের সকালে ঝরছে অঝোর ধারায়।হাজার হাজার লোকের ঈদের জামাত,পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ,বিভিন্ন বর্ণের, সংস্কৃতির মুসলমান আসবে নাজ আদায় করতে। করবে কোলাকুলি। গাড়ী ও ্যে হবে কত! পুলিশ মোতায়ন করতে হয় ট্রাফিক কন্ট্রোলের জন্য।গাড়ী পার্ক করে বেশ কিছুটা হাঁটতে হবে।আমার এ আড়াই বছরের ছোট মেয়ে নিয়ে যেতে সাহস করলাম না। মনটা খারাপ হ’য়ে গেল। অবাক হ’য়ে গেলাম। ছোট বেলায় আমি আর মামণি কখনো ই ঈদের জামাতে যেতাম না। আব্বা রিপন শোভন, আমার দু’ভাইকে নিয়ে যেত।আমি মনের আনন্দে ঘর গুছাতাম। এখন খারাপ লাগছে। টিভিতে দেখলাম বাংলাদেশে ও চাঁদ দেখা গিয়েছে। ফোন করলাম আব্বাকে আমার শাশুড়ীকে। ওঁরা দুজনেই দেশে একা।ছেলেমেয়ে ছাড়া ঈদ।শাশুড়ী একফাঁকে
জিজ্ঞেস করলেন কি রান্না করেছি। মুখের কথা মাটিতে পড়তে না দিয়েই বললাম লাসসা সেমাই, তার ছেলের প্রিয় খাবার।তারপর আস্তে আস্তে সেমাইর জর্দা, গাজরের হালুয়া এটা সেটা বললাম একে একে।

মেয়েকে ঈদের নতুন সেলোয়ার কামিজ পড়িয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম ওর দিকে।নিজে ও বের করলাম ঈদের শাড়ি।গ্লোবাল মল মানে আটলান্টার দেশী শপিং প্লাজা থেকে কিনেছি। টের পেলাম নিজের ভিতরে শিশুটি আজ ও তেমন ই আছে।ফোনের পর ফোন আসছে। এর মাঝে আমার বর এসে জানতে চাইল পাঞ্জাবী টি একটু লম্বা হ’ল কিনা।এই বৃষ্টিতে চোষ পাজ়ামা পড়বে কিনা। এর পর এলো আসল পর্ব। সে এক দেখার মত দৃশ্য। আমার পতি দেবতা পায়ের কাছে বসে বসে কুচি ঠিক করছে আর আমি সমানে বলে যাচ্ছি।‘আহা এটা কেন ওটা ধরো,সোজা করে ধরো।এলাইনমেনট হচ্ছেনা...’তখনই বাবার দুরাবস্থা দেখে, মেয়ে ও এসে যোগ দিল বাবার সাথে, দিল এক টান কিম্বা শুয়ে পড়ল আঁচলের ওপর।এক এলাহী অবস্থা। অবশেষে সার্থক হয় সেই মহান অভিযান,ঘর থেকে বের হয় শাড়ী পড়া বাঙালী ললনা ।প্রায় ৬০ মাইল দূরে আফরিনের বাসা। আমাকে ড্রাইভ করতে হচ্ছেনা।কিছুদূর যেতেই ফোন বের করলাম। আমার ভাই রিপন কে ফোন করলাম।ক্যালিফোর্ণিয়ায় থাকে।একই দেশে থেকে ও ওর সাথে আমার সময়ের ব্যাবধান ৩ ঘণ্টা। কেবল নামাজ় শেষ ওদের। আনুশা আমার ভাই এর একমাত্র মেয়ে ওর মনটা ভালো নেই।দাঁতে ব্যাথা।মা কাজে, ছুটি পায়নি। মা এলে বিকেলে বেড়াতে যাবে। তারপর ই ফোন করলাম শোভন আমার ছোট ভাই, ওর প্রজেক্ট কানাডায়। মনে হচ্ছে কতদূরে। দেশের বাইরে। কথা হ’ল খালামণির সাথে, মামাতো বোন রত্নার সাথে।ওরা ও লস এঙ্গেলেসেই থাকে।খালামণি ঈদের আগের দিন রত্নার বাসায় চলে এসেছে। এক শহরে আপণ মানুষ থাকলে কত মজা। হঠাৎ দেখলাম একটি এস এম এস,’ঈদ মোবারক’ সাথে সাথে ওটাই ফরোয়ার্ড করে দিলাম ফোনবুকের মোটামুটি সবাইকে।১৫ বছরে ফোনবুক বেশ লম্বা।

এখানে দেখি আমাদের বন্ধু বান্ধব প্রায় সবাই ই আছে। আটলান্টাস্থ বাংলাদেশী ডাক্তারদের ডাকলেই ৭০-৮০ জ়ন লোক হ’য়ে যায়। তারপর ও আছে অন্যান্য পেশার ও কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধু বান্ধব। একটি পরিবারের মত।সবার মুখে হাসি , ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়।সাজগোজ়। সবাই অবশ্য শাড়ি পড়ে এসেছে। শুধু একজনকেই দেখলাম এবারের ঈদ ফ্যাশন ‘মাসাকালি’ পড়ে এসেছে।আসল সাজগোজ আগামী শনি বার ঈদের বড় পার্টিতে। প্রায় চার পাঁচ শত লোক হবে সেদিন।আন্টি আঙ্কেলদের এক টি গ্রুপ দেখি গল্প করছেন একজায়গায়।কেউ স্থায়ীভাবে ই ছেলে মেয়েদের কাছে থাকেন কেউবা বেড়াতে, চিকিৎসা করাতে।ছেলেরা সবাই পাঞ্জাবী পড়া । ঈদের দিনে ও গল্পের বিষয় রাজনীতি।মূলতঃ ওবামার হেলথ কেয়ার প্লান।মেয়েরা ব্যস্ত ছবি তোলায়। স্মৃতি ধরে রাখায় ।বাচ্চারা বেসমেন্টে খেলছে। ভূড়িভোজ়ণ শেষে যে যার মত বেরিয়ে যাওয়া।আরো দুচারটা বাসায় ঢূঁ মারতে হবে।সন্ধ্যার দিকে মনটা একটু খারাপ লাগলো। ‘আহ। ঈদ শেষ হ’য়ে যাবে’।
সন্ধ্যার পর গেলাম আর এক বন্ধুর বাসায়। আমার বাসা থেকে খুবই কাছে ওর বাসা। ও আর্কিটেক্ট। ওর বাসায় ঢুকলেই সেটা বোঝা যায়।টেবিল ভর্তি খাবার বাড়ি ভর্তি লোক। দেখি এক কোণায় একটি হারমনিয়াম।কিছুক্ষণ পর দেখি হেজাব পড়া রোগা মতন এক বয়স্ক ভদ্রমহিলা গান গাইছেন ‘অলঙ্কারের মূল্য দিয়ে মন কেনা যায় ভেবোনা......’এই বয়সে ও এত সুন্দর গান করেন।আমি চিনতেই পারছিলাম না আন্টিকে। ওনার ক্যান্সারের চিকিৎসা চলছে।চুল পড়ে ,শুকিয়ে একেবারে অন্য মানুষ হয়ে গিয়েছেন।গলায় এখন ও সুর আছে। আমরা মুগ্ধ আর উঁনি সৃষ্টি কর্তার কাছে কৃতজ্ঞ। র্আমাড় এক বন্ধুর মা। তিন বছর আগে ফ্লোরিডা থেকে যখন আটলান্টায় আসি কোন বাঙালী চিনতাম না। খুঁজে খুঁজে এক দেশী রেস্টুরেন্ট থেকে চিকিৎসক ,শিশু বিশেষজ্ঞ এই বন্ধুর ফোণ নম্বর। সেখান থেকেই পেলাম আমার এই সব বন্ধুদের। পেলাম এমন এক ঈদ। পরিবারের থেকে মোটে ও কম নয়।
গানের জলশা শেষ। আমার ঈদ ও শেষ। কাল থেকে শুরু আবার সেই একঘেয়ে জীবন। প্রবাস জীবনে ঈদ শুধু আনন্দ ই না এ যেন হারিয়ে যাওয়া নিজেকে আবার খুঁজে পাওয়া।
নিজের শৈশব আর সংস্কৃতিকে নতুন প্রজন্মের কাছে পৈঁছে দেয়া।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা অক্টোবর, ২০০৯ সকাল ১০:৩৯
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পুরনো ধর্মের সমালোচনা বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেই নতুন ধর্মের জন্ম

লিখেছেন মিশু মিলন, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৭:১৫

ইসলামের নবী মুহাম্মদকে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তিথি সরকারকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একইসঙ্গে তাকে এক বছরের জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে প্রবেশনে পাঠানোর... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডেল্টা ফ্লাইট - নিউ ইয়র্ক টু ডেট্রয়ট

লিখেছেন ঢাকার লোক, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:২৬

আজই শ্রদ্ধেয় খাইরুল আহসান ভাইয়ের "নিউ ইয়র্কের পথে" পড়তে পড়তে তেমনি এক বিমান যাত্রার কথা মনে পড়লো। সে প্রায় বছর দশ বার আগের ঘটনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রিয়ট যাবো,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

চরফ্যাশন

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫৯



নয়নে তোমারি কিছু দেখিবার চায়,
চলে আসো ভাই এই ঠিকানায়।
ফুলে ফুলে মাঠ সবুজ শ্যামলে বন
চারদিকে নদী আর চরের জীবন।

প্রকৃতির খেলা ফসলের মেলা ভারে
মুগ্ধ হয়েই তুমি ভুলিবে না তারে,
নীল আকাশের প্রজাতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×