বাংলাদেশ রাইফেলস স্কুলে থাকাকালীন সে সবচেয়ে বেশী ভয় পেতো গণিত স্যারকে। স্যারের নাম ছিলো আবুল হোসেন। দেখতে মিচমিচে কালো এবং কিছুটা মোটাসোটা টাইপের স্যার। তবে গণিতে সেই স্যারকে তার খুবই জিনিয়াস মনে হতো। তার কাছে মনে হতো এই মোটা স্যারটা এতো অংক পারে কি করে!!
ছেলেটা আরও একটা স্যারকে খুবই ভয় পেতো। ভয় বললে মনে হয় কিছুটা ভুল হবে, ছেলেটার কাছে স্যারটাকে খুবই অদ্ভুদ মনে হতো। তিনি ছিলেন মালেক স্যার। পুরো নাম আব্দুল মালেক। তিনি ইসলাম শিক্ষার শিক্ষক ছিলেন। মুখভর্তি কাঁচাপাকা দাড়ি, চোখে একটা বড় সাইজের চশমা, মাথায় সাদা টুপি আর সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবী, এটাই যেনো ছিলো মালেক স্যারের জাতীয় ড্রেস। হাঁটার সময় তিনি রাজকীয় ভঙ্গিতে রাস্তায় দু’পাশে দু’পা রেখে হাঁটতেন।
বিডিআর এর পাঁচ নম্বর গেট দিয়ে যাওয়ার সময় অনেকেই স্যারকে উদ্দেশ্য করে মালেকা হামীরা, মালেকা হামীরা বলে চিৎকার করে উঠতো। যারা অনেক আগে বিটিভিতে প্রচারিত আলিফ লায়লা দেখতেন তারা অবশ্যই ”মালেকা হামীরা” অথবা ”কেহেরমানকে” চিনে থাকবেন। স্যার ঠিকই বুঝতে পারতেন যে তাকে ”মালেকা হামীরা” বলা হচ্ছে, কিন্তু তিনি এমন একটা ভাব করতেন যেনো তিনি কিছুই শুনতে পান নি।
একদিন স্কুলের অনেকগুলো ছেলে স্কুল ড্রেস পরে দরবার হলের সামনের মাঠে ক্রিকেট খেলছিলো। মালেক স্যার মাঠের সামনের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ কেউ একজন স্যারকে দেখে চিৎকার করে বলে উঠলো মালেকা হামীরা! মালেকা হামীরা! যে চিৎকার করছিলো সে স্যারের স্কুলের ছাত্র ছিলোনা। কিন্তু সে জানতো যে স্যারকে মালেকা হামীরা বলে চেতানো হয়। স্কুলের ছেলেগুলোর এতোটা সাহস ছিলোনা যে স্কুল ড্রেস পড়ে স্যারকে মালেকা হামীরা বলে। কিন্তু অবাক বিষয় হলো মালেক স্যার মনে হয় ঐবার না শোনার ভান করেও শুনেছিলেন। স্কুলের ছাত্ররা দেখতে পাচ্ছিলো যে স্যার পথ পরিবর্তন করে এদিকেই আসছেন। তারা কিছুটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। তারা কি করবো ঠিক বুঝতে পারছিলো না। হঠাৎ তারা স্বস্তি পেলো, কেনোনা স্যার তাদেরকে কিছুই না বলে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো।
স্কুলের টিফিন পিরিয়ডে সাধারণত সব ছাত্ররাই লাফালাফি ঝাপাঝাপি করেই নিচে নামে; কেউ খেলার জন্য, কেউবা টিফিন খাওয়ার জন্য। যথারীতি চারতলা থেকে নিচে নামছিলো সেই ছেলেটি। তৃতীয় তলায় এসে মালেক স্যারের সাথে তার দেখা। স্যারকে দেখে সে তার গতি কমিয়ে দিলো এবং হাত উচিয়ে স্যারকে বললো, “আসসালামু আলাইকুম”। এই ছেলেটা কখনোই ”স্লামালাইকুম” বলতোনা। সম্ভবত এখনো বলে না। স্যার সালামের উত্তর দিয়ে বললেন ”কি নাম বাবা? কোন ক্লাসে পড়ো?” এই বলে স্যার ঐ ছেলের মাথায় হাত রাখলেন, তারপর খুব কাছে টেনে নিলেন। ছেলেটি বুঝতে পারছিলো না যে স্যার হঠাৎ এতো আদার করছেন কেনো! ছেলেটি যখনি উত্তর দিতে যাচ্ছিলো তখনই স্যার খুব জোড়ে একটা চড় দিয়ে তার সেই কমন ডায়ালগটা দিলেন, “কানে কানে, কুমড়া কুমড়া!! কানে কানে হাত. . .”
ছেলেটি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো এবং কিছুই বুঝতে না পেরে স্যারের কথায় কানে হাত দিলো। স্যার যখন রেগে যেতেন তখন অদ্ভুদ ভঙ্গিতে ডান হাতটা হাত পাখার মতো নাড়াতেন, আর বলতেন কানে কানে, মানে কানে হাত দিতে হবে। এই দৃশ্যে অভ্যস্ত ছিলো স্কুলের ছাত্ররা, তাই অনেকেই দূর হতে এই দৃশ্য দেখে মুচকি মুচকি হাসছিলো। কিন্তু ছেলেটির এই করুন অবস্থায় কিছু ছাত্র হয়তো তাকে স্বান্তনা দেয়ার জন্যই স্যারের সামনেই ভিড় করছিলো।
“আর কোনোদিন এরকম হবে? কানে কানে. . .”
”না স্যার।”
”মনে থাকবেতো?”
”জ্বি স্যার।”
ছেলেটি তখন কিছুই না বুঝে হ্যাঁ-না করেছিলো। তার চোখে সামান্য ঝাপসা করা জলও হয়তো এসেছিলো। আর যারা স্বান্তনা দিচ্ছিল হয়তো তাদের কারনে কয়েক ফোঁটা জল বাংলাদেশ রাইফেলস স্কুল ও কলেজের সিড়িগুলোতেও পড়েছিলো। এখন হয়তো সেই জল খুঁজে পাওয়া যাবে না, কিন্তু অনুভবে সেই ছেলেটা অনুভব করে সে জল এখন অস্পষ্টভাবে সেখানটায় শুঁকিয়ে আছে। তবে সে জলের কোনো ক্ষোভ নেই, কোনো আক্ষেপ নেই, আছে তৃপ্তি, স্মৃতিকাতরতার তৃপ্তি। তাছাড়া এই ধরনের ঘটনা ইতিহাসেও বিরল। ছেলেটি আরও কয়েক বছর ঐ স্কুলে ছিলো, কিন্তু কোনোদিনও ঐ স্যারকে তার সালাম দেয়া হয়নি।
----------------------------------------------------------------------