somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নিঃশব্দ কারাগার

৩১ শে আগস্ট, ২০১৩ বিকাল ৪:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

নিঃশব্দ কারাগার
--মোস্তফা হায়দার

হাসু বিয়ের সাত মাস পরে ঢাকা চলে এলো স্বামীর সাথে। নতুন সংসার। দু কামরার ঘর। হাসুর সেই অনেক দিনের স্বপ্ন। ছিমছাম গোছানো একটা সংসার। শুধু স্বামী আর হাসু থাকবে সংসারে। হাসু রান্না করে রাখবে। স্বামী অফিস থেকে ফিরে এলে দুজনে মিলে খাবে। গল্প করবে। তরকারীতে লবণ কম হলে স্বামী বলবে, এ ছাইপাস কি রান্না কর? মুখে দেয়া যায়না।
হাসু তখন অভিমান করে না খেয়ে উঠে যাবে। কঠিন অভিমান। সহজে ভাংতে নেই। হাসুর চোখের জল দেখে স্বামী বেচারা অস্থির হয়ে যাবে। স্বামী বলবে, তরকারী অতি সুস্বাদু হইছে, লবণ কুনো সমস্যাই না বউ। এমন তরকারীই আমার পছন্দ।

হাসুর সে স্বপ্ন এখন সত্যি। স্বামীর নাম আবুল কালাম। সে গার্মেন্টসে চাকরি করে। সুপারভাইজার। মাইনে কত তা এখনো বলেনি হাসুকে। জিজ্ঞেস করলে মুখ টিপে হাসে। বলে, মেয়েদের বয়স আর ছেলেদের বেতন জিজ্ঞেস করতে হয়না। হাসুর তখন রাগ হয়। ভাবে আমাকে বললে কি এমন ক্ষতি? আবুল কালাম বলে চল আজকে সিনেমা দেখে আসি, শাকিব খানের নতুন ফিল্ম, বাবা কেন রিক্সাওয়ালা। হাসু অভিমান ভুলে সাজতে বসে যায়। বাংলা সিনেমা তার তেমন পছন্দ।

হাসু ইন্টার পাস। ভালো ছাত্রী ছিল সে। এক চান্সে পাস করেছে। ইচ্ছা ছিল অনার্স পড়া। কিন্তু বড় মামার পিড়াপীড়িতেই বিয়ে হয়ে গেল হঠাৎ। হাসুর বাবাকে বলল, এমন ছেলে পাওয়া বেজায় কঠিন হাসুর বাপ। ঢাকায় বড় চাকরি। সহজ বিষয় না। আর এ ছেলের কোন দাবীদাওয়া নেই। এমন ছেলে লাখে একটা পাওয়া যায়।
বাবা বলল, পড়াশুনায় ভালো ছিল মাইয়া।
মামা সে কথা আমলে না নিয়ে বললেন, কপালে থাকলে বিয়ের পরেও পড়তে পারবে হাসুর বাপ। তুমি চিন্তা নিওনা। ভালো পোলা। মেয়ের ইচ্ছা থাকলে পড়াশুনায় জামাইয়ের না থাকবে না।
বিয়ের আগেই বড় মামা ছেলেকে হাসুর জামাই বলে ঘোষণা দিল। দরজার আড়াল থেকে সে সব শুনেছিল। লজ্জায় তার মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছা করছিল তখন। হাসু বুঝল বড় মামার ইচ্ছেই সব। না করা যাবেনা। লাখে একটা পাওয়া এই ছেলেকেই বিয়ে করতে হবে। হাসুর লেখাপড়ার খরচ মামা চালান। হাসুর বাবা কিছু করেনা। সরকারী প্রাইমেরী স্কুলের শিক্ষকতা করতেন তিনি। রিটায়ার্ড করার পরে একদম বসা। পেনসনের টাকায় সংসার চলে। তারপরও হাসুর বাবা ক্ষীণ কন্ঠে বললেন, মেয়ের বয়স কম।

কিন্তু হাসুর মা বিয়েতে রাজী হয়ে গেলেন। বাবাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ভাইজান আফনে বিবাহের দিন তারিখ ঠিক করেন। ছেলে আমাগো পছন্দ হইছে।
এর এক সপ্তাহের মাথায় বিয়ে হয়ে গেল। হাসুরও ছেলে পছন্দ হয়েছিল তা বলাই বাহুল্য। সে সুখি। আবুল কালাম বিয়ের প্রথম দিনই বলছিল যে সে হাসুকে পড়াশুনা করাবে। ঢাকায় নিয়ে ডিগ্রীতে ভর্তি করে দিবে। আনন্দে হাসুর চোখে পানি এসে গিয়েছিল সেদিন।

হাসুর গাঁয়ের রং যদিও একটু ময়লা, কিন্তু চেহারা মায়া মায়া। রূপ চর্চার ব্যাপারে তার একটু ঝোঁক বেশি। ছোটবেলা থেকেই। মাঝে মাঝে বিউটিপার্লার থেকে ভ্রু প্লাগ করে। আর সপ্তাহে একদিন মেহেদি বাটা দিয়ে চুল ধোয়া পুরনো অভ্যাস। মায়ের কাছে শিখেছে এই বিদ্যা। চাঁদপুরের বাড়িতে তো মেহেদি গাছ আছে। তাই মেহেদি পেতে কখনই সমস্যা হয়নি। ঢাকায় মেহেদি গাছ কই পাবে? স্বামী আবুল কালামের কাছে মেহেদি গাছের কথা বলতে আবুল কালাম হেসেই খুন। বলল, এখানে তুমি কত মেহেদি পাতা চাও? গাছ দরকার নেই। বাজারে গেলেই মেহেদি পাতা। ইচ্ছে হলে বাটা মেহেদিও পাওয়া যায়।
হাসু বলল, না না, আমি বেটে নিতে পারব। পাতা হলেই হবে।
সেদিনই বউকে খুশী করার জন্য বাজার থেকে এক ঝুরি মেহেদি পাতা কিনে নিয়ে এলো আবুল কালাম। হাসু চোখ বড় বড় করে বলল, এতো পাতা দিয়া আমি কি করব?
আবুল কালাম হাসতে হাসতে বলল, হাতে দাও, মাথায় দাও। আমার হাতেও দিয়া দিও। আমারও অনেক মেহেদি মাখার সখ।

হাসু মহা খুশি। সে স্বামীর হাতে মেহেদি মেখে দিল। হাতের ঠিক মাঝে লিখল তার নাম, “হাসু। নামের চারপাশ ঘিরে লাভ চিহ্ন আঁকা। আবুল কালাম সে নামের উপর চুমু খেলো। স্বামীর ভালোবাসায় হাসু মুগ্ধ। সে ভাবল কপাল গুনে এমন ভালো স্বামী পেয়েছে যে হাসুকে অনেক ভালোবাসে। বড় মামা ছেলে চিনতে ভুল করেননাই। বড় মামার জন্য খারাপ লাগল ওর। কতদিন দ্যাখেনা!

বিয়ের পরে হাসু বাবার বাড়ি ছিল সাত মাস। মাসে মাসে হাসুকে হাত খরচের জন্য দু’ হাজার টাকা করে পাঠাতো আবুল কালাম। তখন বাসা নেয়া হয়নি, আবুল কালাম মেসে থাকতো। সংসার শুরু করার জন্য টাকা জমিয়ে একটা একটা করে সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনেছে সে। আর যখন যা কেনা হতো, হাসুকে মোবাইলে জানাত। আলমীরা অর্ডার দিয়ে ফোন দিল আবুল কালাম, আজ তোমার আলমীরা অর্ডার দিয়ে এসেছি। স্টিল আলমীরা। সবুজ কালার। সবুজ কালার কি তোমার পছন্দ?
আমারতো নীল পছন্দ।
বল কি? আজই রং চেঞ্জ করতে বলে দিচ্ছি। আবুল কালাম ব্যস্ত হয়ে পরল আলমীরার কালার চেঞ্জ করার জন্য। আরেকদিন ফোন দিয়ে বলল, আজকে খাটের অর্ডার দিয়ে এসেছি। সেগুনের দাম বেশি। তাই মেহগনি। বেশ মজবুত। মজবুত তো হতেই হবে। এই খাটেইতো তুমি আর আমি... বলে হেসে ফেলে আবুল কালাম। হাসির অর্থ বুঝতে পেরে হাসু বলল, এই অসভ্য কথা চলবে না।

বাসায় নতুন টিভি কেনা হয়েছে। টিভিটা হাসুকে সাথে নিয়ে হাসুর পছন্দে কিনল আবুল কালাম। একুশ ইঞ্চি কালার টিভি। ডিসের লাইন লাগিয়ে দিল। আবুল কালাম সারাদিন অফিসে থাকলেও হাসুর সময় কেটে যায় টিভি দেখে। ঢাকায় আসার পর কতদিন হলো হিন্দি সিরিয়াল দ্যাখেনি সে। স্টার প্লাস আর জি বাংলার সিরিয়াল গুলো হাসুর বড়ই পছন্দ। আবুল কালাম কখনোই এসব ইন্ডিয়ান সিরিয়াল পছন্দ করতো না। বন্ধুরা বলতো এসব মেয়েদের চ্যানেল। কিন্তু বিয়ের পরে অবাক হয়ে দেখল হাসুর সাথে সেও দেখা শুরু করেছে। অফিস থেকে ফিরে হাসুর সাথে বসে যেতো টিভির সামনে। কখনো কোন ঘটনা মিস করলে হাসুর কাছে শুনে নিত। হাসুও মহা আনন্দে বলতো রাবারের মতো টেনে লম্বা করা ইন্ডিয়ান সিরিয়ালের ঘটনা। চোখ বড় বড় করে বলতো, তারপরে আকসারা ওর জামাই নেত্তিক এর মধ্যে সেইরকম ঝগড়া। কাটাকাটি ঝগড়া।
আবুল কালাম উদ্বিগ্ন হয়ে বলতো, বল কি?
হাসু আরো উৎসাহিত হয়ে বলে, দুজন ঝগড়া করে দু দিকে বসে আছে। কেমন খারাপ লাগার ব্যাপার বলতো? আমার চোখে পানি এসে গিয়েছিল। আমরা কোনদিন এমন ঝগড়া করি নাই।
হাসুর চোখে আবার পানি এসে গেল। ওর মন খারাপ হয়েছে হিন্দি সিরিয়ালের ঘটনা মনে করে। মেয়েরা বিচ্ছেদ ব্যাপারটা যেন সহযে মেনে নিতে পারেনা। আবুল কালাম তখন সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করতো। বলতো, মন খারাপ ক’রনা বউ। ওদের মধ্যে আবার মিল হয়ে যাবে...

ঢাকা আসার মাস দুয়েক বাদেই হাসু টের পেল তার কেমন হঠাৎ মাথা ঘুরায়। বমি বমি লাগে। কিছু খেতে ইচ্ছে করেনা। আবুল কালাম সবশুনে বলল, বউ তুমি মা হতে চলেছ। আমি বাবা। সে হাসু কে কোলে তুলে নিয়ে খুশিতে ঘুরতে লাগলো। হাসু বলে, এই কর কি, কর কি, আমাকে নামাও, আমি পরে যাব। আবুল কালাম হাসুকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। ডাক্তার নিশ্চিত করলে যে ঘটনা সত্য। আবুল কালাম সেদিন বাসায় ফেরার পথে মরণচাঁদ থেকে মিষ্টি নিয়ে এলো। সে মিষ্টি আশেপাশের সবাইকে দেয়া হল। পাশের বাসার রীনা ভাবী মিটি মিটি হেসে বলল, ভালো করেছো বাচ্চা নিয়েছো। হাসু সারাদিন একা একা থাকে।

রীনা ভাবী আর তার জামাই সোহেল দুজনেই গারমেন্টসে চাকরি করে আবুল কালামের সাথে। জামাই-বউ দুজন প্রতিদিন সকাল বেলা একসাথে বের হয়। আবার বিকালে একসাথে ঘরে ফিরে। ঠিক যেন পাখির মতো। সারাদিন শেষে ঘুরেফিরে রাতে নীড়ে ফিরে আসে। সারাদিন একসাথে থাকে। সে যেন এক আলাদা শান্তি। হাসুরও ইচ্ছে হয় গারমেন্টসে চাকরি করতে। আবুল কালাম আর সে একসাথে যাবে, একসাথে ঘরে ফিরবে। কিন্তু আবুল কালাম রাজী হয়না। বলে, আমাদের এতো টাকা দরকার নেই। গারমেন্টসের চাকরি ভালো না। অনেক কষ্ট। আমি বেঁচে থাকতে তুমি এমন কষ্ট করবা ক্যান?

আবুল কালাম বেশ খুশী স্ত্রীর সন্তান আসার সংবাদে। সে ইতিমধ্যে নাম ঠিক করে ফেলেছে। বলে, আমার কন্যা সন্তান পছন্দ। তাই আমি কন্যার নাম ঠিক করেছি। আমার কন্যার নাম রাসু। তোমাকে এখন থেকে রাসুর মা বলে ডাকব।
হাসু হাসে। বলে, এখুনি নাম ঠিক করে ফেলেছ? আগে দুনিয়ায় আসুক।
আবুল কালাম নাছোড়বান্দা। সে বলে, শোন রাসুর মা, নাম ফাইনাল। হাসুর মেয়ে রাসু। ভালো না নামটা?

হাসু কিছু বলেনা। যদিও সে আবুল কালামের আনন্দ দেখে পুলকিত। কিন্তু বাবা-মা’র এতো আনন্দ ভালো না। তাতে বাচ্চার অমঙ্গল। হাসু সুরা পরে নিজের পেটে ফুঁ দিল তিনবার। আল্লাহ্ রহমতের মালিক। আরেকদিন আবুল কালাম বাচ্চাদের জুতো কিনে আনল দোকান থেকে। জিরো সাইজের লাল টকটকে একজোড়া জুতো। বলে, দেখ রাসুর মা, আমার বাবু প্রথম এই জুতা পরবে। হাসু আবার সুরা পরে। বাচ্চার অমঙ্গল সে হতে দিবেনা।

কিন্তু আবুল কালাম এসবের ধার ধারেনা। সে অনাগত বাচ্চা নিয়ে নানান স্বপ্ন দেখতে থেকে। বাচ্চার জন্য তার মন তখন সিক্ত হতে থাকে অনাগত নতুন জীবন শুরুর আশায়। পিতৃত্তের নতুন পরিচয়ে তার জীবন যেন এক নতুন দিকে মোড় নিয়েছে। সে অনাগত স্বপ্ন বুনতে থাকে। আর হাসু সুরা পরে। কোন মাতৃকূল সন্তানের অমঙ্গল মানতে পারেনা।

সেদিন ছিল মঙ্গলবার। হাসু দুপুরের রান্না মাত্র শেষ করেছে। ঘর দোর ঝাড়ু দিচ্ছিল। এমন সময় আবুল কালাম এসে উপস্থিত। হাসু অবাক হল, কি ব্যাপার। এতো আগে আসার তো কথা না। আবুল কালাম জানাল যে তাদের ফ্যাক্টরি ভবনের তৃতীয় তলায় ফাটল ধরাতে অফিস আজ ছুটি। কাল জানাবে আবার কবে অফিস চালু হবে। আগে আসতে পেরে আবুল কালাম বেশ খুশী। হাসুকে বলল, চলো মার্কেটে যাই। বাবুর জন্য দোলনা কিনে নিয়ে আসি।
হাসু বাঁধা দেয়। অতি আনন্দ ভালনা। বাচ্চার অমঙ্গল। কিন্তু কে শুনে কার কথা? হাসুকে নিয়ে বের হয় আবুল কালাম। বেশ মজা করে ওরা দুজন। অপ্রত্যাশিত ছুটিই এই আনন্দের কারণ। সিনেমা দেখে দুজন। রিয়াজের নতুন ফিল্ম। তারপর অনাগত রাসুর জন্য দোলনা কিনে বাসায় আসে। দোলনাটা খাটের পাসে রাখে। আবুল কালাম বলে, শোন রাসুর মা। বাচ্চারে এই দোলনায় দোল খাওয়াবা আর ঘুম পরানি গান গাইবা। কি গান গাইবা জান? গাইবা,

আমার রাসু দোল খায়
চোখে এবার ঘুম আয়।

হাসু আবার সুরা পরে তিনবার ফুঁ দেয়। বাচ্চার অমঙ্গল সে চায়না। পরদিন অফিস হবে না বলে ওরা বেশ রাত করে গল্প করল। গভির রাতে ঘুমাতে গেল। কিন্তু সেদিন বেশ ভোরেই পাশের বাসার সোহেল আবুল কালামকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল। ফ্যাক্টরিতে যেতে হবে। ফ্যাক্টরি মালিকের নির্দেশ। ফাটল কোন বিষয় না। রানা প্লাজার আট তলায় আবুল কালামের ফ্যাক্টরি। যদিও যেতে ইচ্ছা করছিলনা, কিন্তু সোহেল বলল, আরে ভাই চলো। না গেলে মাইনে কেটে রাখবে ব্যাটারা।

দো মনা আবুল কালাম হাসুর কাছ থেকে বিদায় নিল। হাসুর সেদিন মন কেমন করল হঠাৎ। এমন কখনো করে না। সে আবুল কালাম কে যেতে নিষেধ করল। একদিন অফিস কামাই দিলে আর এমন কি ক্ষতি হবে? একদিনের মাইনে কাটলে কাটুক। আবুল কালাম বলল, সমস্যা হলে চলে আসব বউ। চিন্তা করোনা।

আবুল কালাম ফ্যাক্টরিতে গিয়ে ফোন দিল। বলল সব ঠিক আছে বৌ। তুমি টেনসন নিও না। হাসুর দুঃশ্চিন্তা কমেনা। সে তজবি নিয়ে বসল। দোয়া করতে লাগলো আবুল কালামের জন্য।
এর ঘণ্টা খানিক বাদেই সে বাইরে হৈ চৈ শুনতে পেল। বের হয়ে দেখল ওপাশের বাসার এক মহিলা চিৎকার দিয়ে কাঁদছে আর বলছে, আমার মাইয়া শেষ। বিল্ডিং ভাইঙ্গা পরছেরে আল্লাহ্।

হাসুর হাত থেকে তজবি পরে গেল। সে কানে আর কিছু শুনতে পেলনা। মাথা ঘুরতে লাগলো। কাঁপা হাতে আবুল কালামের মোবাইলে কল করল। রিং হল কিন্তু মোবাইল কেউ ধরলনা। মাথা কাজ করছেনা তখন হাসুর। সে রাস্তায় নামল। রাস্তায় তখন অনেক মানুষ। সবাই শঙ্কিত দৃষ্টিতে রানা প্লাজার দিকে ছুটছে। রানা প্লাজা হাসুদের বাসা থেকে দশ মিনিটের পথ। হাসুও ছুটসে সবার সাথে। কেউ আহাজারি করছে, কেউ চিৎকার দিয়ে কাঁদছে। এর মধ্যে সে যে কতবার আবুল কালামের মোবাইলে কল করেছে তা বলতে পারবেনা। কিন্তু ফোন ধরলনা কেউ। হাসুর দু চোখ দিয়ে তখন অঝোরে জল গরিয়ে পরছে।

হাসু যখন রানা প্লাজার সামনে এলো তখন দেখল এক ভয়াবহ দৃশ্য। আবুল কালাম তাকে যে নয় তলা বিল্ডিংটা দেখিয়ে বলেছিল, এই হচ্ছে আমার অফিস। হাসুর সেদিন ভালো লেগেছিল ভেবে যে তার জামাই কতো সুন্দর একটা অফিসে কাজ করে। সেখানে সে বিল্ডিংটা এখন নেই। সেখানে এখন ধ্বংসস্তূপের একটা পাহাড়। খেটে খাওয়া গরীব মানুষগুলোর মাথার উপর ভবনটি ধ্বসে পরেছে। নয় তলার প্রতিটি তলা যেন পাউরুটির টুকরোর মতো একটার উপর আরেকটা চেপে বসেছে। আর পিষে ফেলল অগণিত মানুষ। ভিতর থেকে আর্তনাদ ভেসে আসছে। হাসু বিল্ডিঙের কাছে যেতে চাইল। কিন্তু সেখানে তখন অনেক লোকের ভীর। সবাই দিশেহারা হয়ে এদিক ওদিক ছুটছে। কারো মেয়ে, কারো ছেলে, কারো মা, কারো বাবা, কারো ভাই, কারো বোন, কারো মামা, কারো চাচা, কারো খালা কেউ না কেউ বিল্ডিঙের ভেতরে আটকা পরেছে। তারা জীবিত আছে না মরে গেছে কেউ বলতে পারেনা। পুলিশের লোকজন এলাকাটা ঘিরে রেখেছে। কাছে যেতে পারছেনা হাসু।

হাসু ফোন করেই যাচ্ছে। হঠাৎ ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ করল আবুল কালাম। হাসু আবুল কালামের গলা চিনতে পারলনা প্রথমে। কেমন খীণ কণ্ঠস্বর, আমি ব্যাথায় মরে যাচ্ছি হাসু। আমাকে বাঁচাও।
হাসু কান্না জরিত কন্ঠে চিৎকার করে বলল, তুমি কই আছো?
আমি জানিনা। আমাকে একটু পানি দাও।

আবুল কালাম আর কথা বলতে পারলনা। জ্ঞান হারিয়েছে সে। হাসু অনেকবার হ্যালো হ্যালো করল। আবুল কালাম কোন উত্তর দিল না। শুধু গোঙানির শব্দ ভেসে আসছে অনেকের। হাসু লাইন কেটে দিয়ে আবার ফোন করল। আবুল কালাম আর ফোন ধরলনা। আবারো ফোন করল। কিন্তু কোন উত্তর পেলনা। হাসু কান্না করতে করতে বসে পরল ওখানে। কিন্তু হাসুর এ কান্না দেখার মতো কেউ ছিলনা। সবাই তখন দিক শূন্য অস্থির।

এর ঘন্টা খানিক বাদে আবারো ফোন ধরল আবুল কালাম। সম্ভবত তার জ্ঞান ফিরেছে আবার। হাসু কাঁদতে কাঁদতে বলল, চিন্তা করোনা। উদ্ধার কর্মীরা উদ্ধার শুরু করছে।
আবুল কালাম বলল, আমাকে বাঁচাও হাসু। আমি বাঁচতে চাই। তোমার রাসুর জন্য আমি বাঁচতে চাই। আমি নড়তে পারছিনা। এখানে ভীষণ অন্ধকার।
হাসু কাঁদতে থাকে চিৎকার করে বলল, তুমি বাঁচবে রাসুর বাপ। আর একটু সময়।
তোমার মুখে রাসুর বাপ শুনে ভালো লাগছে। কিন্তু আমার মাথাটা ভীষণ ব্যাথা করছে, কথা বলতে পারছিনা। রাসুকে দেখে রেখ...
আবুল কালাম আবার জ্ঞান হারাল। হাসু পাগলের মতো ফোন করতে লাগল আর কাঁদতে লাগল। ওর দিকে তখন কারো তাকানোর সময় নেই। সবাই নিস্প্রান ভাবে অপেক্ষা করছে কখন বের হবে তার পরিচিত জন। হয় জীবিত অথবা মৃত।

স্থানিয় উদ্ধার কর্মীরা উদ্ধার কাজ শুরু করেছে ততক্ষনে। তাদের সাথে হাত মিলিয়েছে ফায়ারব্রিগেডর লোকজন, পুলিশ, আর্মি, র্যা ব, বিজিবি। জীবিতদের বের করে পাশের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে চিকিৎসার জন্য। লাশ বের করে একপাশে জড় করে রাখা হচ্ছে। হাসু একবার ছুটে যাচ্ছে যখন জীবিত কাউকে বের করা হচ্ছে। আবার এ পাশটায় ছুটে আসছে যখন কোন লাশ বয়ে নিয়ে আসছে উদ্ধার কর্মীর দল। সাড়া দুপুর এভাবে কেটে গেল ওর। বিকালের দিকে একটা লাশ চিনতে পেরে হাসু ছুটে গেল। আবুল কালামের লাশ। আবুল কালামকে যখন অন্ধকার থেকে আলোয় বের করা হলো তখন সে চির আঁধারে হারিয়ে গেছে। হাসু চিৎকার করে জরিয়ে ধরল। সারা দেহ রক্তাক্ত। মাথার একদিক থেতলে গেছে। হাসু বুকে মাথা রাখল। প্রান আছে কিনা বুঝার চেষ্টা করল। মন মানছে না আবুল কালাম মরে গেছে।

হাসু আবুল কালামের ডান হাতটা গালে নিয়ে বসে রইল সারা রাত। আরো কতো লাশ আসছে। সেখানে সোহেল-রীনার লাশও আছে। হাসু সেদিকে এগিয়ে গেলনা। ওর হাতে আবুল কালামের হাত। আবুল কালামের হাতে তখনো মেহেদি দিয়ে লিখা ছিল “হাসু”।



০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অতিরিক্ত বা অতি কম দুটোই সন্দেহের কারণ

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ৩১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৩০

অনেক দিন গল্প করা হয়না। চলুন আজকে হালকা মেজাজের গল্প করি। সিরিয়াসলি নেয়ার কিছু নেই৷ জোসেফ স্টালিনের গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। তিনি দীর্ঘ ২৯ বছর সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান নেতা ছিলেন। বলা... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সীমানা পিলার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ৩১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৮



বৃটিশ কর্তৃক এদেশে ম্যাগনেটিক পিলার স্থাপনের রহস্য।
ম্যাগনেটিক পিলার নিয়ে অনেক গুজব ও জনশ্রুতি আছে, এই প্রাচীন ‘ম্যাগনেটিক পিলার' স্থাপন নিয়ে। কেউ কেউ এটিকে প্রাচীন মূল্যবান ‘ম্যাগনেটিক’ পিলার... ...বাকিটুকু পড়ুন

মাথায় চাপা ভূত ভূত ভূতং এর দিনগুলি

লিখেছেন শায়মা, ৩১ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৫


এই যে চারিদিকে এত শত কাজ কর্ম, ঝামেলা ঝক্কি, ক্লান্তি শ্রান্তি সব টপকে আমার মাথায় আজও চাপে নানান রকম ভূত। এক ভূত না নামতেই আরেক ভূত। ভূতেদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায় (দ্বিতীয় অংশ)

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ৩১ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:০৫


আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায় (প্রথমাংশ)
আমাদের সদ্য খনন করা পুকুরটা বৃষ্টির পানিতে ভেসে গেল। যা মাছ সেখানে ছিল, আটকানোর সুযোগ রইল না। আমি আর দুইবোন শিউলি ও হ্যাপি জালি... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিজের পাসওয়ার্ড অন্যকে দিবেন না ;)

লিখেছেন অপু তানভীর, ৩১ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:৫৭



কথায় আছে যে পাসওয়ার্ড এবং জাঙ্গিয়া অন্যকে দিতে নেই । মানুষ হিসাবে, বন্ধু হিসাবে প্রেমিক/প্রেমিকা হিসাবে অথবা আজ্ঞাবহ হওয়ার সুবাদে আমরা অন্যকে ব্যবহার করতে দিই বা দিতে বাধ্য হই।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×