somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কে বুদ্ধজীবী ? --------শহিদুল ইসলাম-২

২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ বিকাল ৩:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১ম পর্বঃ

২য় পর্বঃ
কিন্তু আধুনিক যুগ ও আধুনিক বিজ্ঞানের শুরু থেকেই বুদ্ধিজীবীদের কর্মতৎপরতার ধারা একটু একটু করে বদলে যেতে থাকে। অর্থনীতি যেমন আর সামন্তবাদের জালে আটকে থাকতে চায় না, তেমনি সেই সময়ের বুদ্ধিজীবীরাও রাজা-বাদশাহর দরবারে শোভাবর্ধনে সন্তুষ্ট থাকতে পারেন না। সামন-বাদী সম্পদের মতো তারা আর ঘড়াভর্তি হয়ে মাটির নীচে চাপা পড়ে থাকতে রাজি নন। পুঁজির মতো সচল হয়ে উঠতে চান। ইউরোপীয় রেনেসাঁ, রিফর্মেশন ও শিল্প-বিপ্লবের দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে আধুনিক যুগের বুদ্ধিজীবীরা হয়ে ওঠেন বিদ্যাবুদ্ধিধারী শ্রমিক। সমাজ ও জনমানুষের থেকে দূরে সরে থাকা তাদের পক্ষে আর সম্ভব হয়নি। সভ্যতার নুতন মোড়-পরিবর্তনে বুদ্ধিজীবীদের কাজের ধারাও পালটে যায়। মানুষের স্বাধীনতা ও জ্ঞানের বৃদ্ধির সাথে সাথে বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব আরো বেড়ে যায়। কারণ মানুষের স্বাধীনতার যেমন সীমা নেই, তেমনি সীমা নেই তার জ্ঞানের। তাই রাজ-দরবারের আয়েশী ও নিশ্চিত জীবন তাদের ধরে রাখতে পারে না। এডওয়ার্ড সাঈদ আধুনিক বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্বের কথা বলতে গিয়ে বলেন, আমি নিঃসন্দেহ যে বুদ্ধিজীবীরা দূবর্ল এবং তারা নামগোত্রহীন মানুষেরই কাতারভূক্ত। দূবর্ল ও নামগোত্রহীন মানুষের সঙ্গে থাকাই আজকের পৃথিবীতে বুদ্ধিজীবীর প্রধান দায়িত্ব। এ-সম্পর্কে সাঈদের মনে কোন দ্বিধা-দ্বন্দ্বের স্থান নেই। তাই আজকের সভ্যতায় কেউ যদি বিদ্যার জাহাজ হয়েও সেই বিদ্যার ভারে নুইয়ে থাকেন এবং সমাজ ও মানুষের কোন কাজে না আসেন, তাকে বুদ্ধিজীবী বলা যাবে না। বিণয় ঘোষ ১৯৭৩ সালে এ ধরণের পণ্ডিত সম্পর্কে এই বলে মন্তব্য করেছিলেন, মহাবিদ্বান কেউ যদি অগাধ জ্ঞানসমুদ্রে ডুব দিয়ে তলিয়ে থাকেন এবং কেবল ভুড়ভুড়ি কাটেন, যদি তাকে দেখা না যায়, তার চিন্তাভাবনার কথা জানা না যায়, তাহলে জ্ঞানতপস্বী স্কলার হলেও সামাজিক অর্থে ইন্টেলেকচুয়্যাল নন। অর্থাৎ একজন বুদ্ধিজীবীকে আজ অবশ্যই সামাজিক হতে হবে। সমাজ-পরিবর্তনে তাঁর ভূমিকা থাকতে হবে। প্রাইভেট বুদ্ধিজীবী বলে যে কিছু নেই সে-কথা আমরা আগেই সাঈদের মুখে শুনেছি। এবারে বিণয় ঘোষের কলম দিয়ে মিচেল্‌সের কথা শুনি, যারা কেবল জ্ঞানই সঞ্চয় করে চলেন তাদেরকে সত্যিকার অর্থে বুদ্ধিজীবী বলা চলে না। বুদ্ধিজীবীকে অবশ্যই ধর্মবেত্তার গুণাবলী সম্পন্ন হতে হয় এবং রাজনৈতিক কর্মকান্ডসহ একজন ধর্মবেত্তার দায়িত্ব পালন করতে হয়। ফিচ্‌ট- এর কথা উদ্ধৃত করে মিচেলস্‌ বলেন, তার (বুদ্ধিজীবীর) জ্ঞানকে অবশ্যই সত্যিকার অর্থে সমাজের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে হবে। এখানে ধর্মবেত্তার গুণাবলী এবং ধর্মবেত্তার দায়িত্ব বাক্যবন্ধ দুটি নিয়ে একটু বিভ্রানি-র অবকাশ আছে। তাই বিষয়টির একটু ব্যাখ্যা দরকার। আমি একটু আগেই বলেছি, প্রাচীন ও মধ্যযুগে ধর্মবেত্তারাই ছিলেন বুদ্ধিজীবী। কারণ সে সময়ে তারাই সাধারণ মানুষের চিন্তাধারাকে পরিচালিত করতেন, সেই সমাজের জীবনদর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ন্ত্রণ করতেন। এমনকি সেই সময়ের রাজ্য বা সাম্রাজ্য এবং রাজা-বাদশাহরাও অনেক সময়ে তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকতেন। সেই সময়ের আচার-অনুষ্ঠান, নৈতিক মূল্যবোধ, শিক্ষা সবই নিয়ন্ত্রিত হতো ধর্ম ও আধ্যাত্মিক চিন্তার বাঁধা সড়কে। আধুনিক পূঁজিবাদ সেই প্রাচীন সামন্তবাদী অচলায়তনকে ধ্বংস করে এবং ব্যক্তির স্বাধীনতাকে অনেকটা বৃদ্ধি করে। ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে বুদ্ধিজীবীদের কাজ যুগে যুগে এক হলেও, তাঁদের কাজ করার পথ ও পদ্ধতির পরিবর্তন হয়েছে।
তাই এডওয়ার্ড সাঈদ তাঁর আলোচ্য গ্রন্থে মূল প্রশ্নটি উত্থাপন করেন এই বলে যে, মানুষ কিভাবে সত্য বলে? কোন সত্য? কার কাছ থেকে আসে সে সত্য এবং কার উদ্দেশে তা প্রযুক্ত? সাঈদ মনে করেন যে আজকের ঐতিহাসিক ও সামাজিক পৃথিবীর স্রষ্টা মানুষ। আমাদের এই পৃথিবী ইহজাগতিক, সুতরাং এই ইহজাগতিক কাঠামোর মধ্যেই একজন বুদ্ধিজীবীর কাজ সীমাবদ্ধ থাকা উচিত বলে মনে করেন সাঈদ। ব্যক্তি (প্রাইভেট) জীবনে কোন প্রত্যাদেশ বা বাইরের কোনো প্রেরণার অপরিহার্যতার কথা অস্বীকার করেন না এডওয়ার্ড সাঈদ। কিন্তু সেগুলো যখন তত্ত্বগতভাবে ইহজাগতিক জগতে প্রয়োগ করা হয়, সেগুলো তখন সবর্নাশা পরিণতি ডেকে আনে। এমনকি তা কখনো কখানো বর্ববরতার পযার্য়ে চলে যেতে পারে। সাঈদ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, একজন বুদ্ধিজীবীকে সারা জীবন প্রত্যাদেশ বা গ্রন্থসমূহের অভিভাবকবৃন্দের সঙ্গে বাদানুবাদে লিপ্ত থাকতেই হবে কারণ অসংখ্যবার তারা মানুষের স্বাধীনতা ও জ্ঞানান্বেষণের স্পৃহাকে লুন্ঠন করেছে। তাদের শক্ত হাত কোনো দ্বিমত সহ্য করে না। কোন রকম বৈচিত্র্যকে তো সহ্যই করেই না। মতপ্রকাশের আপসহীন স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলিত রাখা একজন ইহজাগতিক বুদ্ধিজীবীর প্রধান কাজ। কোনো অজুহাতে সে স্বাধীনতাকে জলাঞ্জলি দিলে কিংবা যে-কোন যুক্তিতে সে-স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করার প্রচেষ্টাকে মেনে নিলে তা হবে বুদ্ধিজীবী নামের সঙ্গে প্রতারণা করার শামিল। সেজন্য সাঈদ সালমান রুশদির স্যাটানিক ভার্সেসের পক্ষাবলম্বন করা মূল কর্তব্য বলে মনে করেন। কেবল সালমান রুশদির স্বার্থে নয়, যে-কোন সাংবাদিক, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, কবি ও ইতিহাসবিদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আর যেন কখনো বিঘ্নিত না হয়, তার স্বার্থেই সালমান রুশদির পাশে দাঁড়ানো কর্তব্য বলে মনে করেন এডওয়ার্ড সাঈদ।
সাঈদের মতে, এ-যুগের বুদ্ধিজীবীকে অবশ্যই প্রথাবিরোধী ও প্রতিষ্ঠানবিরোধী হতে হবে। নিরবচ্ছিন্নভাবে সে কর্তৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। তাকে কখনো দুর্বল ভাববে না। এ-সম্পর্কে তিনি এ-যুগের একজন অত্যন- প্রভাবশালী দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানী মাইকেল ফুকোর উদ্ধৃতির উল্লেখ করেন। ফুকো বলেন, একজন মতাদর্শহীন ব্যক্তিকে লেখক বলা উদ্দেশ্যপূর্ণ ও অতিরঞ্জিত করা। প্রত্যেক বুদ্ধিজীবীই কোনো-না-কোনো মত ও পথের সমর্থক। তাঁর একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকে। উদাহরণ হিসেবে সাঈদ তার কালচার এন্ড ইম্পেরিয়ালিজম গ্রন্থ থেকে একটি দৃষ্টান্তের উল্লেখ করেন। ঊণবিংশ শতাব্দীর ফরাসি বুদ্ধিজীবী এলেক্সিস ডি টকোভেলি আমেরিকার গণতন্ত্রের চুলচেরা বিচার করেন এবং ইন্ডিয়ান ও কালো ক্রীতদাসদের সঙ্গে তারা যে-ব্যবহার করত তার তীব্র সমালোচনা করেন। কিন্তু সেই তিনিই ১৮৩০-৪০ এর শেষে ফ্রান্সের উপনিবেশবাদনীতি এবং আলজেরিয়া দখলের কোন সমালোচনা করেন না। সেদিন ফ্রান্স আলজেরিয়ায় যে-গণহত্যা চালিয়েছিল, তা তাকে বিচলিত করে না কারণ তিনি মনে করতেন যে মুসলমানরা একটি নিম্নস্তরের ধর্মে বিশ্বাস করে। কাজেই তাদের সংশোধন করতেই হবে।

চলবে................
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ বিকাল ৩:৪৩
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জলদস্যুরা কি ফেরেশতা যে ফিরে এসে তাদের এত গুণগান গাওয়া হচ্ছে?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭


জলদস্যুরা নামাজি, তাই তারা মুক্তিপণের টাকা ফেরত দিয়েছে? শিরোনাম দেখে এমনটা মনে হতেই পারে। কিন্তু আসল খবর যে সেটা না, তা ভেতরেই লেখা আছে; যার লিংক নিচে দেওয়া হলো।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায়; অদৃষ্টের ইশারায়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৩৯

১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বাগদাদের একটা গল্প লিখেছিলেন৷ গল্পের নাম দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা বা সামারায় সাক্ষাৎ৷

চলুন গল্পটা শুনে আসি৷

বাগদাদে এক ব্যবসায়ী ছিলেন৷ তিনি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ঋণ মুক্তির দোয়া

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪৯



একদিন রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববিতে প্রবেশ করে আনসারি একজন লোককে দেখতে পেলেন, যার নাম আবু উমামা। রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘আবু উমামা! ব্যাপার... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×