somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার যুদ্ধ-স্মৃতি :: (ইরান-ইরাক যুদ্ধ - ১)

১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৯ রাত ২:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

৩১ মে , ১৯৮১ । করাচীগামী সন্ধ্যার ফ্লাইটে বাবা দেশ ছাড়ার সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ ।হঠাৎ করেই ভর করে অনিশ্চয়তার কালো মেঘ । ৩০ শে মে রাতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে বিপথগামী কিছু অফিসার কর্তৃক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হলেন । বিদেশগামী যাত্রীদের দেশত্যাগে আরোপ করা হল ভীষণ কড়াকড়ি । বাবা ভীষণ দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন, ঠিক এমন সময় বাবাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন বাবার স্কুলের বন্ধু আর্মির একজন মেজর ।

২ বছর আগে ঢাকা মেডিকেল থেকে পাশ করে আব্বু তখন ঢাকা মেডিকেলের সার্জারি ওয়ার্ডের রেজিস্টারার এবং সিও । বাংলাদেশী
ডাক্তারদের মাঝে তখন মধ্যপ্রাচ্যে যাবার ধুম । ঢাকা মেডিকেলের সার্জারি ওয়ার্ডের ইনচার্জ সিনিয়র প্রফেসর আব্বুকে ভীষণ স্নেহ করতেন । তার হস্তক্ষেপের কারণে সৌদি আরব সরকারের সরাসরি তত্ত্বাবধায়নে
সৌদি যাবার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায় বেশ কয়েকবার । দাদার সংসারের কথা ভেবে বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন স্যারকে না জানিয়েই সৌদি আরবের চেয়ে অনেক কম সুবিধা সম্বলিত ইরান যাবেন । এ যাত্রায় বাবার সঙ্গী , বাবার এক বন্ধু ।


করাচী থেকে বাইরোডে পৌছুলেন পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে । সেখান থেকে বর্ডার পার হয়ে প্রবেশ করলেন ইরানের সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশে । জাহেদান শহর থেকে দীর্ঘ বাসযাত্রা শেষে তেহরান পৌছুতে লেগে গেল পুরো তিনদিন।

ইরান-ইরাক যুদ্ধের অষ্টম কি নবম মাস চলছে তখন । পারস্য উপসাগরে কয়েকটি দ্বীপের মালিকানা এবং শাতিল-আরব মোহনার দখলদারিত্ব নিয়ে ৮ বছর ব্যাপি ইরাক-ইরানের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূচনা ১৯৮০ সালে ।

১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর রেজা শাহ পাহলভীপন্থি আর্মি
অফিসারদের অনেকেই পাশ্চাত্যে পালিয়ে গেছেন , যারা যেতে পারেননি , তাদের অনেককেই বরখাস্ত করা হয়েছে , বা বিভিন্ন মেয়াদে কারাগারে
প্রেরণ করা হয়েছে।শাহের একান্ত অনুগত অনেক জেনারেলকে ফাঁসিকাষ্ঠও ঝুলানো হয়। ১৯৮০ সালে ইরাকের করা আকস্মিক আক্রমণে হতভম্ব ইরান তখনও গুছিয়ে উঠতে পারেনি । সে কারণে , শক্তিশালী ইরাকী
বাহিনীর মোকাবেলায় এলোমেলো ইরানী বাহিনী প্রাথমিকভাবে বিপর্যস্ত
হয়ে পড়ে ।

এরকম পরিস্থিতির মাঝে ৮১ সালের মে মাসের যেদিন আব্বু তেহরান পৌছুলেন , সেদিনও তেহরান দফায় দফায় ইরাকী বোমারু বিমানগুলোর হামলার শিকার হয় ।

দেশে আত্মীয়-স্বজনকে বিপুল উৎকন্ঠার মাঝে রেখে গেছেন আব্বু । কোথায় পোস্টিং হবে সেটা নিয়েও অনেক উৎকন্ঠার মাঝে পড়ে গেলেন ।আব্বুর আশংকাই সত্য হল , পোস্টিং দেয়া হল ইরাক ঘেঁষে থাকা , ইরানের পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ কেরমানশাহের সর্বপশ্চিমের জেলা পাভেহতে ।


ইরাক সীমান্ত থেকে মাত্র ১৭ কিলোমিটার দূরে দামাভান্দ পর্বতমালার একটি পাহাড়ে গা বেয়ে নেমে আসা শহর পাভেহ । ইরাক সীমান্ত থেকে মাত্র ১৭ কিমি দূরে হওয়া সত্ত্বেও যুদ্ধের এক বছরে পাভেহর একবারও আক্রান্ত না হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ ছিল । ইরাক-ইরান যুদ্ধ তখন পরিচিত হয়ে উঠছে "ব্যাটল অব সিটিজ" হিসেবে । সম্ভাব্য সর্বোচ্চ ক্ষয়ক্ষতি সাধনের জন্য দু' দেশই পরস্পরের বৃহত্তম শহরগুলোকে টার্গেট করতে শুরু করে , ফলে পাভেহ এর মত ছোট শহরগুলো প্রাথমিক আক্রমণের লক্ষবস্তু হয়নি । ইরাক সীমান্ত থেকে দূরত্ব মাত্র ১৭ কিমি হলেও এর পুরোটাই দুর্গম পার্বত্য অঞ্চল , ফলে স্থল আক্রমণ থেকেও পাভেহ তখনও অক্ষত রয়ে যায় ।

১৯৮২ সালের শুরুর দিকে যুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি পায় । ইরাকী স্থলবাহিনী ইরানী ভূ-খন্ড দখলের লক্ষ্য নিয়ে ইরানের পশ্চিম সীমান্তে তীব্র আক্রমণ চালায়। আক্রান্ত হয় ইরাক সীমান্তবর্তী পাভেহ জেলার সীমান্ত সংলগ্ন শহর নওসুদ এবং নোদশেহ এবং ক্বাসর-এ-শিরিন।

প্রথমেই ইরাকী বাহিনীর হাতে পদানত হয় মরুদ্যান ক্বাসর-এ-শিরিন । ক্বাসর-এ-শিরিনের পতনের পর ইরাকী বাহিনী তখন নউসুদ এবং নদশা অভিমুখে উদ্যত ।


বাংলাদেশ সরকারের সাথে চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশী কোন ডাক্তারকে ফ্রন্টে পাঠানোর কথা নয় ।নউসুদ এবং নোদশেহ এর আকস্মিক ভাবে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা সে চুক্তিতে কয়েকদিনের জন্য ছেদ টানল ইরাকী মর্টারশেল নিক্ষেপে ইরানি ডাক্তারদের অধিকাংশ তখন নিহত হন , ধ্বংস হয়ে যায় নৌসুদ হাসপাতাল। শয়ে শয়ে আহত সৈন্যে ভরে যায় নোদশেহ হাসপাতাল । প্রাদেশিক রাজধানী কেরমানশাহ থেকে ইরানী ডাক্তার এসে পৌছুতে সময় লেগে যাবে দু'তিনদিন । জরুরী ডাকে নদশেহ পাঠানো হল আব্বুকে । ইরাক সীমান্তের মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে নোদশেহ শহর দখল করতে এগিয়ে আসছে
ইরাকী ট্যাংকবাহিনী । জীবন-মরণের দোলাচলে , নদশা হাসপাতালে
বাবা অতিবাহিত করেন জীবনের দুঃসহতম তিনটি দিন ।

১৯৮২ এর শেষদিকে মাস দুয়েকের জন্য দেশে ফেরেন বাবা ।সদ্য বিয়ে করে ইরান ফেরার পর বাবার নতুন কর্মস্থল পাভেহ এর দক্ষিণের শহর জাভানরুদে । চারটা বড় পাহাড়ের মধ্যবর্তী উপত্যকায় অবস্থিত জাভানরুদ তুলনামূলক ভাবে অনেক ছোট শহর , পাভেহ এর মত পুরো শহরটা পাহাড়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নেই । শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট পাহাড়ি নদীটির নামও জাভানরূদ । পাভেহ এর তুলনায় জাভানরুদ অনেক বেশি সুরক্ষিত । ইরাকি বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হবার সুযোগটা অনেক কম , এ কথা ভেবে বাবা অনেকটাই আস্বস্ত । ১৯৮৩ এর মাঝামাঝি আম্মু জাভানরুদ যান ।

১৯৮৪ এর শুরুর দিকে যুদ্ধের গতিপথে বড় ধরণের পরিবর্তন আসল । প্রাথমিক বিপর্যয় অবস্থা কাটিয়ে উঠে ইরানিরা পাল্টা প্রতিরোধ গড়তে শুরু করে । বড় শহর গুলোর সীমা ডিঙিয়ে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে ছোট শহরগুলোতে ।

১৯৮৪ এর শেষদিকে এক রাতে জাভানরুদের আকাশ ভেঙ্গে প্রথম উড়ে যায় কয়েকটি ইরাকী জঙ্গী বিমান । শহরের উত্তর প্রান্তের পাহাড়ের উপর অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট কামানগুলো গর্জে ওঠে । পরের দিন আতঙ্কে শহরের অনেকটাই খালি হয়ে যায় ।শহরের উপকন্ঠের শান্ত পাহাড়ী গ্রামগুলো জাভানরুদবাসীর প্রাথমিক আশ্রয়স্থল । আম্মাকে
নিয়ে অন্য অনেক জাভানরুদবাসীর মত আব্বু আশ্রয় নেন জাভানরুদের উপকন্ঠে শান্ত , ছায়াঘেরা গ্রাম সাফিদবার্গে । আমার বয়েস তখন কয়েকমাস ....

ঘোরতর দুঃশ্চিন্তা আর অনিশ্চয়তার মাঝে আব্বু সিদ্ধান্ত নেন আরও দুর্গম এলাকায় পোস্টিং নেয়ার । হেড-অফিসে দরখাস্ত করার পর নতুন অফার আসে ... গন্তব্যের নাম শারভিনাহ। ১৯৮৬ এর একদম প্রারম্ভে আমরা জাভানরুদ ছেড়ে যাই , নতুন ঠিকানা শারভিনাহ । মোটামুটি প্রত্যন্ত অঞ্চল বলতে যা বোঝায় শারভিনাহের সাথে তা মোটামুটি মানিয়ে যায় ।শারভিনাহ যাবার রাস্তা তখনও পুরো পাকা হয়নি , পাহাড় কেটে বানানো কাঁচা রাস্তা ধরে শারভিনাহ যাবার পথটাও ভীষণ বিপদসঙ্কুল , বেশ কিছু জায়গায় রাস্তার পাশে হাজার ফুটের বেশি গভীর খাদ । জাভানরুদের পূর্ব দিকে অবস্থিত শারভিনাহ ইরাকী ভু-খন্ড থেকে মাত্র ৩৫ কি।মি দূরে । তবে এ ৩৫ কি.মি এর প্রায় পুরোটাই বিপদশঙ্কুল পর্বতাকীর্ণ , সে কারণে স্থলবাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সুযোগ শারভিনাহতে নেই ।আর কৌশলগত কারণে শারভিনাহতে বিমান হামলা হওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় ইরাকের অনেক কাছাকাছি থেকেও শারভিনাহ ছিল তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি নিরাপদ ...


(এ পর্বের পুরোটাই আমার বাবা মায়ের কাছ থেকে শোনা , অল্প বয়েসের কারণে তখনকার কোন স্মৃতিই আমার মনে নেই । শারভিনাহ থেকে আমার স্মতিগুলো জমাট বাঁধতে শুরু করে , সেসব কথা থাকছে পরের পর্বে)
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সকাল ১০:২১
৪২টি মন্তব্য ৪০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সিকান্দার রাজার চেয়ে একজন পতিতাও ভালো।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৭

সিকান্দার রাজা কোকের বোতল সামনে থেকে সরিয়ে রাতারাতি হিরো বনে গেছেন! কিন্তু তাকে যারা হিরো বানিয়েছেন, তারা কেউ দেখছেন না তিনি কত বড় নেমকহারামি করেছেন। তারা নিজেদেরকে ধার্মিক বলে দাবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৫৬

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ অন্তর্জাল।

ছোটবেলায় মুরব্বিদের মুখে শোনা গুরুত্বপূর্ণ অনেক ছড়া কবিতার মত নিচের এই লাইন দুইটাকে আজও অনেক প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×