ঢাকার অফিসগুলোতে দর্শনার্থীদের সাথে সবচেয়ে খারাপ ব্যবহার করে কারা? প্রথমেই দারোয়ানদের কথা মনে আসতে পারে, তবে শিক্ষাগত মাপকাঠি আর পেশাগত দায়িত্বের কথা ভেবে তাদের ছাড় দিতে রাজি আছি, যদিও দারোয়ান শ্রেণীটা আমাকে মোটেই পছন্দ করে না আর আমিও তাদের পছন্দ করি না। সেটা আমার চেহারার জন্য বা পোশাকআশাকের জন্যও হতে পারে, কিন্তু আজকাল অফিসগুলোতে ঢোকার আগে দারোয়ানের অভদ্র জেরা আর ভ্রুকুটির সাথে মানিয়ে নেবার একটা প্রস্তুতি নিয়ে যাই, বলা যায় গায়ে সয়ে গেছে। যেটা সয় নি এখনো সেটা হলো রিসিপশনিস্ট নামের আজব প্রাণীগুলোর কথাবার্তা আর আচার আচরণ। এদের রাখার উদ্দেশ্য হবার কথা আগত মানুষজনকে অভ্যর্থনা জানানো, কিন্তু ঢাকার অফিস বা অ্যাপার্টমেন্ট হাউসগুলোর রিসিপশনিস্টদের আচারব্যবহার দেখলে মনে হয় তাদের দায়িত্ব দারোয়ানদের হাতেকলমে প্রশিক্ষণ দেয়া আর কথা শুনলে মনে হয় জন্মের সময় এদের মুখে মধুর বদলে কীটনাশক না হলেও অন্তত চিরতার রস ঢেলে দেয়া হয়েছিল। এমনই তেতো আর রুক্ষ এদের কথা বলার ভাব, মনে হয় তাদের বাবার অফিসে সিটি কর্পোরেশনের আবর্জনা ফেলার আস্ত ট্রাকটা নিয়ে ঢুকে পড়েছেন আপনি আর তার দুর্গন্ধে তাদের ক্লিওপেট্রা নাকটা উঁচু হয়ে বেঁকে আকাশ ছুঁয়েছে।
হঠাৎ এভাবে খেপে গেলাম কেন? ব্যাখ্যায় যাই একটু। খেপাটা হঠাৎ নয়, সত্যি বলতে কি খেপে যাই-ও নি, একটু করুণ অভিজ্ঞতার বয়ান দেবার জন্য শখ হলো আরকি। একটা সাধারণ চিত্র তুলে ধরা যাক। ধরা যাক, আপনি অফিসে ঢুকলেন, মতলব হলো বসের সাথে দেখা করবেন, এসেছেন অন্য আরেকটা অফিস থেকে, অথবা আপনি আমারই মত হতভাগা কোন চাকরিপ্রার্থী। প্রথমেই আপনার দিকে (এখানে ধরে নিচ্ছি আপনি দারোয়ানের বাধা পার করে গেছেন) ভদ্রমহিলা বা ভদ্রতরুণীটি তাকাবেন না, তিনি তখন গভীর মনোযোগে মোবাইলে বা অফিসপ্রদত্ত ফোনটিতে গভীর মনোযোগে জনগুরুত্বপূর্ণ কোন আলাপে ব্যস্ত, না শুনলে নিশ্চিতভাবেই ধরে নেবেন এর উপর অফিসের ভবিষ্যৎ নির্ভরশীল। তবে, একটু খেয়াল করলেই শুনতে পাবেন, আলাপের বিষয় হলো অফিসের কোন আপা বসের রুমে ঢুকলে আর বেরোয় না অথবা নতুন ফ্যাশনের দুলটা তার কানে মানাচ্ছে কিনা সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা কিংবা ঈদে এবার নকশাতে দেখানো বুটিকের জামাটার ডিজাইনের ব্যবচ্ছেদ। ৫ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে একটু উসখুস শুরু করলে একবার চোখ তুলে তাকিয়ে "দেখো না কাজ করি" ধরণের একটা চাহনি দিয়ে আবার ফোনে মনোযোগ, সাথে সোফা বা চেয়ারে বসার ইশারা। বসলেন, ঝিমোচ্ছেন, ১০ মিনিট পরে হয়তো জনাবার দয়া হলো, ফোন রেখে ইশারায় ডাকলেন-- "কি চান?" আওয়াজ শুনে মনে হবে দজ্জাল গিন্নী ফেরিওয়ালা বিদায়ের চেষ্টায় আছে। ঢোঁক গিলে জবাব দিলেন, জ্বি অমুক সাহেবের সাথে একটু দেখা করতাম। এবার মনোযোগ সামনে রাখা প্যাড বা কম্পিউটারে, নিশ্চিতভাবেই সেখানে কাটাকুটি বা কার্ডের গেম চলছে। "কি দরকার??" এইবারে আপনি যদি অন্য অফিসের প্রতিনিধি হন, তিনি আস্তেধীরে ফোনটা তুলে "মিটিংয়ে ব্যস্ত" স্যারকে খবরটা দেবেন, তারপরে আবারো বসতে ইশারা করে (এদের কথা বলা শেখায় না?) ফের আঁকিবুকিতে নজর দেবেন। আর যদি চাকরিপ্রার্থী হয়ে থাকেন তো হয়ে গেল, তেলাপোকা দেখলে যেভাবে তাকায় সেরকম একটা চাউনি দিয়ে পাশের কোন একটা কক্ষে চালান করে অনির্দিষ্টকালের এক প্রতীক্ষায় ফেলে আবারো দুনিয়া উদ্ধারে মন দেবেন শাহাজাদী। এখানে আপনার একটু সাবধান থাকতেই হবে, তিনি যদিও ফোনালাপে ব্যস্ত বা আশপাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া লোকের সাথে মধুর আলাপে, আপনার ফোনটা যদি ভুলেও বেজে ওঠে এবং আপনি হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফিসফিস করেও কথা বলে ফেলেন তো একগাদা উপদেশ শোনা অনিবার্য ঘটনা।
এবারে আপনি চালান হয়ে গেলেন বসের হাতে। সে ব্যাটা অতি অবশ্যই "জরুরী" কাজে আছে, যার মাঝে আছে কফি খাওয়া, পাতি বসের সাথে দেশ নিয়ে আলোচনা এবং লুইচ্চা ধরণের হলে সেক্রেটারী এবং সুন্দরী সহকর্মীর সাথে একান্ত আলাপ। একটা রিয়েল এস্টেটের অফিস জানি, সেখানে এমডি'র ফ্লোরে সব মহিলা কর্মচারী, প্রায়ই তাদের সাথে তার "একান্ত" আলাপ করার দরকার হয়, সেসময় অন্যদের প্রবেশ নিষেধ। এর মাঝে মাঝে দয়া হলে ইন্টারভিউতে ডাকছে, সত্যি সত্যি যাদের নেয়ার ইচ্ছে তাদের সাথে হয়তো গুরুত্বপূর্ণ আলাপ করতেও পারে, এই অধমের সাথে সবসময়ই নাম কি (সেটা সিভিতেই আছে), বাপ কি করে (চাকরি তো করবো আমি, বাপ দিয়ে কি করবি?), জেলা কোথায় (সেটা জেনেই বা কি লাভ, আমি গাইবান্ধা নাকি কক্সবাজার তা দিয়ে কি বিল্ডিংয়ের ২টা হাত গজাবে?), আগে কোথাও কাজ তো মনে হয় করেননি, এবারই প্রথম (সিভিতে নামের নিচেই বড় বড় করে লেখা কোথায় কি কাজ করেছি, ইংরেজি পড়তে না জানলে বল পড়ে দিই), এধরণের খাজুরে আলাপ। পরবর্তী প্রশ্নটা থাকে, আপনি তো থাকবেন না (তাহলে ব্যাটা ডাকলি কেন?), আচ্ছা থাকলে বেতন কত নেবেন? এরপর মাছের বাজারের মত খানিক দরাদরি, সবশেষে আচ্ছা আমরা জানাবো, যদিও কোনদিনই জানা হয় না। মাল্টিন্যাশনাল অফিসগুলোতে সম্ভবত পরীক্ষা এবং নানা ধরণের ধাপের ব্যাপার আছে, একটা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে চলে সবকিছু, অবস্থা এর চেয়ে অনেক ভাল হবারই কথা, তবে অধমের ভাগ্যে এই ধরণের অফিসগুলোই জুটেছে বলে একটু সাধারণীকরণ করতে হলো।
বেসরকারি অফিসগুলোর যদি দারোয়ান আর রিসিপশনিস্টের পিণ্ডি চটকাই, সরকারি অফিসগুলোতে মশামাছি গুলোকেও গালিগালাজ করা উচিত, অন্তত ওখানকার মাছিমারা কেরানিগুলোকে তো অবশ্যই প্রতি বেলায় বেত দিয়ে পিটিয়ে ৪ মাইল ডাবল মার্চ করানো দরকার। সম্ভবত বিদেশীদের আমাদের দেশের সরকারী অফিসগুলোতে কোন কাজে যেতে হয় না, গেলে সন্দেহাতীতভাবে বাংলাদেশ ব্যর্থ রাষ্ট্রের তালিকায় এক নম্বর জায়গা দখল করে রাখতো। ঘুষ ছাড়া ওখানে ফাইল কেন, ফিতাটাও নড়ে না সেটা তো পুরানো কথা, কিন্তু এত জঘণ্য আচরণ দুনিয়ার আর কোথাও পাওয়া যাবেনা এটা লিখে দেয়া যায়। রিসিপশনিস্ট থাকতে দেখেছি শুধু হাসপাতালগুলোতে, তারাও অত্যন্ত তিরিক্ষি মেজাজে থাকে, বারডেমে রিসিপশনিস্টের ঝাড়ি শুনেছি ক'দিন আগেও। অন্য অফিসগুলোতে এমন কোন কিছু নেই, থাকলেও সেখানে ডেস্কে কাউকেই পাওয়া যায় না, এই টেবিল ঐ টেবিলে ঘুরলে দেখা যাবে কেরানিরা সব দল বেঁধে দেশ উদ্ধারে ব্যস্ত। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতে গেলে প্রথমে কিছু শুনবেই না, এরপরে উদাস চোখে ২-১বার তাকাবে, এরপরে মাছি তাড়ানোর মত হাত ঝাড়া দিয়ে বিদায় হতে বলবে। যদি একটু কিছু বলেছেন তো আপনার হয়ে গেল, হুমকিধামকি গালিগালাজ অনেক কিছুই শোনা যাবে। ইউনিয়ন জিনিসটা কর্মচারীদের অধিকারের জন্য রাখা হলেও, আমাদের দেশের সরকারী কর্মচারীদের ঘুষ দুর্নীতি কাজে অবহেলা সবকিছুর কেন্দ্রে এখন এই ইউনিয়নগুলো, কেউ কিছু করতে চাইলেও ৩য় বা ৪র্থ শ্রেণীর কর্মাচারীদের নেতার কাছে সবাই অসহায়। রোডস এন্ড হাইওয়েজের অফিসে একটা বইয়ের খোঁজে একদিন বেলা ১১টায় গিয়ে দেখি, সব টেবিল ফাঁকা। হল্লা শুনে এক রুমে গিয়ে দেখি, রাজ্যের কর্মচারী সব জড়ো হয়ে ভোটের উপর গরম আলোচনায় ব্যস্ত। বক্তৃতা দিতে দিতে একজনের জোশ এসে গেল, তিনি বঙ্গবন্ধু স্টাইলে আঙ্গুল উঁচিয়ে "এই দেশের মুক্তির জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে" বলতে বলতে সোজা চেয়ারে উঠে পড়লেন। কিন্তু অফিসাররা কোথায়? সম্ভবত, তারা অফিসে নেই।
আমাদের সম্ভবত ধারণা, আমাদের সরকার পয়সা দেবে আরাম করার জন্য, আর কাজ করার জন্য বাড়তি পয়সা দেবে জনগণ। সরকারী অফিসগুলোতে হানা দিয়ে এদের বেতিয়ে আচার ব্যবহার আর কাজ করা শেখানোর সময় আসলেই হয়ে এসেছে। কথা হলো, যারা শেখাবেন সেই কর্তাদের মাঝেই ভূত, সরষে দিয়ে না হয় ভূত তাড়ানো যায় কিন্তু সরষে তাড়াবে কে?
[ লেখাটা শেষ করে মনে হলো, আজকের অভিজ্ঞতাটাও এই বেলা লিখে ফেলি, মূল লেখার সাথে সম্পর্কহীন যদিও। যে অফিসটা থেকে একটু আগে বের হয়ে বাসায় ফিরলাম আরকি সেটার কথা। একদিন ইন্টারভিউ দিয়ে এসেছি এখানে, আবার ডেকেছে, বেশ আশাবাদী হয়ে গেছি। রিসেপশনের আপুও সেদিনের মত "তেলাপোকা" চাউনি দিলেন না, যদিও দু'ঘণ্টা বসিয়ে রাখলেন ঠিকই। এরপরে দয়া করে একটা রুমে নিয়ে বসানো হলো, বসের আগমন, সাথে সহকারী, এই আপা আবার আগেরদিন ঐসব খাজুরে প্রশ্নেই ডায়েরিতে বিশদ নোট নিয়েছিলেন, কে জানে কি গবেষণা হলো। তারা জানালেন, আমাকে তাদের পছন্দ হয়েছে (বাহ বাহ, এতদিনে আমাকে চিনলো তবে!)। তবে বেতন যা চেয়েছি শুরুতে ৩ মাস তার চেয়ে কম দেবে (মন্দের ভাল)। তবে তাদের কিছু "টার্মস এন্ড কন্ডিশন" আছে। বেশ তো, শুনি। চাকরি ছাড়ার দু'মাস আগে জানাতে হবে। কোন সমস্যা নেই, জানাবো। আর কিছু? হ্যাঁ, মূল সার্টিফিকেট সব কয়টা তাদের কাছে জমা দিতে হবে। ব্যাটা বলে কি? হুম, তাদের ওখানে যারা জয়েন করছে সবাই নাকি এই শর্তেই এসেছে। এর আগে "বন্ড" চাইতে শুনেছি, গতকাল একজায়গায় চেয়েছেও, কিন্তু মূল সার্টিফিকেট জমা? যাব্বাবা! ১৬ বছর খেটেখুটে জমানো সার্টিফিকেটগুলো শুধুমাত্র বুয়েট আর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ছাড়া আর কারো হাতেই জমা দিতে আমি রাজি নই। ঝিম মেরে আছি দেখে আপা মিষ্টি হেসে জানালেন, আমি রাজি থাকলে তারা এখনই তাদের বাকি অফারগুলো বলতে পারেন। নিশ্চিতভাবেই আমার হাসিটা বেকুবের মত হয়েছিল, ওভাবেই বললাম, জ্বি আমি একটু বাসায় গিয়ে ভেবে জানাই? তিনি বললেন, অবশ্যই, কালকের মাঝে জানান। বললাম, আজকে রাতেই জানাবো। দু'জনের দিকে মাথা নেড়ে বের হয়ে এলাম, আস্তেধীরে লিফটে উঠে ফোন বের করে এক বন্ধুকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, দোস্ত একটা সিভি পাঠাইসি তোর বলা ঠিকানায়, একটু দেখিস তো! আচ্ছা আমি বলে দেব। থ্যাংকস দোস্ত, আরে না না ব্যাপার না, দেখ কি হয়!
লিফট থেকে বের হয়ে মনে পড়লো, মিষ্টহাসি ডায়েরিওয়ালি আপুর ফোন নম্বরটাই আনি নি।
ধ্যুৎ! ]