এই পর্বে কয়েকটি খনার বচন আর অল্প কিছু ব্যাখ্যা তুলে দিলাম। পাঠকের আগ্রহ এবং সময় থাকলে মন্তব্য আকারে আরো কিছু বচন এবং ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে।
#ষোল চাষে মুলা। তার অর্ধেক তুলা।
তার অর্ধেক ধান। বিনা চাষে পান।।
অর্থাৎ খনার বচন অনুসারে ধান বুনতে চার চাষের প্রয়োজন। কৃষি-বিজ্ঞানীদের মতেও তাই। জরিপে দেখা যায় ৭২% কৃষকই পাঁচ চাষের পক্ষে অভিমত দিয়েছেন। চার চাষের পক্ষে গড়ে ১৩% কৃষক রায় দিয়েছেন। এর কারণ আছে, সাধারণত আমাদের দেশের যে সমস্ত কৃষকরা হাল বলদের অভাবে ভোগে তারা পাঁচ চাষেই আস্থা পান। যাদের শক্ত সামর্থ্য গরু এবং হাল আছে তাদের পক্ষে চার চাষই যথেষ্ঠ। ফলে খনার এই বচন অবস্থাসম্পন্ন কৃষকদের জন্যেই যা আমাদের অতীত সমৃদ্ধির নজির। খনার আমলে মানুষের চাইতে কৃষি জমির সংখ্যা ছিল বেশি। শুধু রাজস্ব মিটিয়ে ইচ্ছামত জমিতে চাষ করা যেত। প্রাচীন কালের কৃষকরাও ছিলেন সবল। ফলে চার চাষই যথেষ্ট ছিল। এই সম্পর্কিত খনার আরেকটি চন আছে- সবল গরু গভরি চাষ। তাতে পুরে মনের আশ।। এই সংক্রান্ত আরো কিছু বচন আছে যা আমাদের কৃষিজ সংস্কৃতি, প্রাণী এবং মানুষের সম্পর্ক প্রভৃতি বিষয়কে তুলে আনে।
#গাই দিয়ে বায় হাল। দুঃখ তার চিরকাল।।
#গরুর মুখে ঘাস পানি। হাল গৃহস্থি পরে জানি।
#বাপ বেটায় চাষ চাই। তদ অভাবে সোদর ভাই।।
#কার্তিকের ঊনজলে। খনা বলে দুনো ফলে।।
-কার্তিক মাসে ধান ক্ষেতে কম পানি থাকলে ও কম বৃষ্টি লে দ্বিগুন ফসল ফলে। কুমিল্লা, ময়মনসিংহ ও দিনাজপুরের কৃষকেরা ৯৯%, ৯৭% ও ৯৮% রায় দিয়েছেন এই বচনের পক্ষে।
#চাঁদের সভার মধ্যে তারা। বর্ষে পানি মুষল ধারা।
-চাঁদের সভা বিষয়টি আমি বুঝিনি কেউ বুঝে থাকলে জানাবেন। তবে আমাদের কৃষকদের প্রকৃতি সম্পর্কিত জ্ঞানের বিষয়টিই এখানে উঠে আসে। এখনকার ৪৫% কৃষক মনে করেন এই অবস্থায় বৃষ্টি হয়। সম্ভবত চন্দ্র সভা কদাচিৎ দেখা যায় যে কারণে এই সম্পর্কে কেউ জানেন না। প্রসঙ্গত, ১৩৮৫ সালে জৈষ্ঠ্য মাসের এক সন্ধ্যায় ক্ষুদ্রাকৃতির এক চন্দ্রসভা দেখা যায় এবং পরদিন অনেক বৃষ্টি হয়।
#মাঠে গিয়ে আগে দিক নিরূপণ। পূর্ব দিক হতে কর হাল চালন।।
-এই বিষয়ে রায় দিয়েছেন ৭৯% কৃষক যারা দক্ষিণ হতে পূর্বে হাল শুরুর পক্ষে। যে কোন দিকের পক্ষেও মত আছে। তবে বিষয় হচ্ছে এই জরিপের লোকেরা কৃষি ঘনিষ্ট নন। আরো একটি বিষয় তাৎপর্যপূর্ণ, ইসলাম ধর্মের আগমনের পরে খনার বচনের নানা দিকের মধ্যে এই বচনটিও পাল্টে গেছে। ময়মনসিংহের একজন মাওলানা পশ্চিম দিক থেকে হাল চালনা শুরুর কথা বলেছেন তিনি মনে করেন কাবার দিক হতেই হাল চলনা করা উচিত। যাইহোক, খনার পূর্ব দিক দক্ষিণ-পূর্ব দিকও হতে পারে। পূর্ব দিক হতে হাল শুরু করে ক্রমশ পশ্চিমে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। বংশানুক্রমিক বিবর্তনে তা হয়তো পাল্টে গেছে।
#পূর্ণিমা আমায় যে ধরে হাল। তার দুঃখ সর্বকাল।।
তার বলদের হয় বাত। ঘরে তার থাকে না ভাত।।
খনা বলে আমার বাণী। যে চষে তার হবে হানি।।
-এই বচন বুঝিয়ে বলার প্রযোজন নেই মনে করছি। তবে এর তাৎপর্যটুকু গুরুত্বপূর্ণ। গ্রহ নক্ষত্রের বিশেষ অবস্থান প্রাণী জগতের ওপর পড়ে, একথা আধুনিক জ্যোর্তিবিদ্যাও অস্বীকার করে না। এই সম্পর্কিত আলোচনায় পরে যাওয়া যাবে। তবে এই বচনের পক্ষে মত দিয়েছেন ৭৬% কৃষক। এবং এখানে একটি বিষয় আলোচনা হওয়া জরুরি আমাদের গ্রামের সংস্কৃতিতে অতীত কোন ঘটনার রেশ পরম্পরায় থেকে যায়। ফলে হয়তো এমন কোন ঘটনা ঘটেছিল -যা খনার এই বচনের পক্ষে রায় দেয়। এখানে আরো একটি বিষয় উল্লেখ্য খনার বচনের বিপক্ষে যে সমস্ত কৃষক রায় দিয়েছেন তাদের কৃষিজ ঐতিহ্য নেই। অর্থাৎ তারা পূর্বে অন্য কোন পেশায় ছিলন কিন্তু এখন কৃষিকাজে সম্পৃক্ত। এখানে আরো কিছু বচন উল্লেখ করা যায়।
#ন'খানা ছ'খানা ভাগ্যে পাই। সাতের কাছেতেও না যাই।।
-গরুর দাঁত সাত হলে ভালো না। কুমিল্লায় ৯৮% কৃষক সাত দাঁতওয়ালা গরুকে খারাপ বলেছেন।
এরকম আরেকটি আছে-
#জাতের গরু জিহ্বা কালা।
আরো কিছু বচন-
#লাউ গাছে মাছের জল। ধেনো মাটিতে ঝাল প্রবল।।
#ব্যাং ডাকে ঘনঘন। শীঘ্র বৃষ্টি হবে জেনো।
#ডাহিনে ফণী বামে শিয়াল। দহিলে দহিলে বলে গোয়ালী।। তবে জানিবে যাত্রা শুভালী।।
-বচনটার মানে হচ্ছে ঘর হতে বের হওয়ার সময় ডানে সাপ বামে শেয়াল দেখলে যাত্রা শুভ হবে। এটাকে হোরা শাস্ত্র বলা হয়। প্রাচীন ভারতের রাজা থেকে শুরু করে পন্ডিতরাও এই হোরা শাস্ত্র চর্চা করতো এবং মানতো। বরাহ মিহিরও এই শাস্ত্র চর্চা করতেন। শহুরে মেজাজেও এই রকম বিভিন্ন সংস্কার আছে। তবে এগুলোকে কুসংস্কার বলার বাজারি রেওয়াজ চালু আছে। সেই আলাপে না গিয়ে বলা যায় আমাদের গ্রামের লোকেরা এই সমস্ত বেশ ভালো ভাবেই মেনে চলেন, এবং গড়ে ৮০% পল্লিবাসী এই বচন মেনে চলেন।
একই রকম আরেকটি বচন-
#হাঁচি টিকটিকির বাধা। যে না মানে সে গাধা।
#দক্ষিণ ছেড়ে উত্তর বেড়ে। ঘর করগে পোতা জুড়ে।।
বাড়ির দক্ষিণ দিক খোলা রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন ৫৩%। কুমিল্লায় এই মতের ক্ষে ১০০%।
স্বাস্থ্য বিষয়ক কিছু বচন আছে-
#আলো হাওয়া বেঁধো না। রোগে ভোগে মরোনা।।
#পুবে হাঁস পশ্চিমে বাঁশ। উত্তরে বেড়ে, দক্ষিণে ছেড়ে, ঘর করগে পুতা জুড়ে।।
খাবার বিষয়ক-
#অধিক খেতে করে আশ। এর নাম বুদ্ধি নাশ।।
#মুড়ি আর ভুড়ি । সকল রোগের গুড়ি।।
#বারো মাসে বারো ফল। না খলে যায় রসাতল।।
#ফল খেয়ে জল খায়। জম বলে আয় আয়।।
#বেল খেয়ে খায় পানি। জির বলে মইলাম আমি।- জির মানে কৃমি।
#আম খেয়ে খায় পানি। পোঁদ বলে আমি ন জানি।।
#শুধু পেটে কুল। ভরা পেটে মূল।
#খানা খায় করে শব্দ। অলক্ষী খুশী লক্ষী জব্দ।।
#দিনে বালিশ। রাতে চালিশ।।
#দুগ্ধ শ্রম গঙ্গাবারি, এ তিন উপকারী।।
#ততো তিতা চুকা ঝাল। এই চার পুরুষের কাল।
#ভোরের হাওয়া, লাখ টাকার দাওয়া।।
এমন অসংখ্য বচন আছে। এই লিখার সমস্ত বচন ও পরিসংখ্যান কৃষি ও কৃষ্টি নামক ড. আলি নওয়াজ লিখিত বই থেকে নেয়া। এই উপপর্ব শেষ করছি একটি মজার বচন দিয়ে।
#অক্ষর দ্বিগুণ চৌগুণ মাত্রা। নামে নামে করি সমতা।।
তিন দিয়ে হরে আন। তাহে মরা বাঁচা জান।।
এক শুণ্যে মরে পতি। দুই থাকলে মরে যুবতী।।
অর্থঃ দম্পতির নামের অক্ষরে দ্বিগুণ ও মাতাকে অর্থাৎ অ ই ইত্যাদি দ্বিগুণ সংখ্যাকে চতুর্গুন করিয়া ৩ দিয়া হরণ করিলে যদি ভাগশেষ ১ বা শূণ্য থাকে, তবে পতি অগ্রে মরিবে এবং দুই থাকিলে স্ত্রীর মৃত্যু অগ্রে হইবে।''
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে আগস্ট, ২০০৯ দুপুর ১২:০৯