somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নাটকের কবি

২৯ শে আগস্ট, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কালের ভাস্কর সেলিম আল দীন
সেলিম আল দীন একজন শক্তিমান নাট্যকার। এদেশের নাট্য জগতে তাঁর জনপ্রিয়তা সবার উর্ধেব। নাটক কোনো এক শ্রেণি-গোষ্ঠীর নয়, নাটক সকলের। কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের জীবনের প্রতিচ্ছবিও- নাটকের মূল বিষয় হতে পারে, তা আমরা সেলিম আল দীনের নাটক থেকে পাই। নাটকের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মানবিক অধিকার আদায়ের আন্দোলন সম্ভব –তা আমরা সেলিম আল দীনের কাছে শিখি। তিনি নাটককে গ্রাম-বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে নিয়ে গিয়েছেন। ভূলে যাওয়া--- হাজার বছরের বাঙালী সংস্কৃতিকে মানুষের চেতনার আয়নায় নিয়ে আসার জন্যই তাঁর এই পথচলা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক, সংগঠক, নাট্য নির্দেশক এবং শিল্পতাত্বিক এই মানুষটির জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৮ আগস্ট। ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলার সেনেরখিল গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় তাঁর বয়স বাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। ফলে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট অনুযায়ী তাঁর জন্ম ১৮ নভেম্বর ১৯৪৮ সাল। পিতা মফিজ উদ্দিন আহমেদ এবং মাতা ফিরোজা খাতুন। সাত সন্তানের মধ্যে সেলিম আল দীন তৃতীয়। ছয় ভাই বোন- বুলবুল, জ্যোৎস্না, বোরহান উদ্দিন, জেসমিন, শাহানা এবং আব্দুল গণি। ভাইদের মধ্যে তিনি জ্যেষ্ঠ।
সেলিম আল দীন ১৯৭৪ সালের ২৩ আগস্ট মেহেরুন্নেসাকে সহধর্মিনী করেন। বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল ও কলেজের বাংলা বিভাগে সহকারী অধ্যাপক পদে কর্মরত। তাদের একমাত্র সন্তান মঈনুল। সে অকালে মারা যায়।
১৯৫৪ সালে সেলিম আল দীন কুমিল্লা জেলার আখাউড়ায় গৃহশিক্ষকের নিকট শিক্ষাজীবন শুরু করেন। কিছুদিন পর তিনি নিজ গ্রাম সেনেরখিল প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হন এবং চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। ১৯৫৫ সালে তিনি মৌলভিবাজার বড়লেখার সিংহগ্রাম প্রাইমারি স্কুল, কুড়িগ্রামের উলিপুর মহারাণী স্বর্ণময়ী প্রাইমারি ও হাইস্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। অবশেষে ১৯৬০ সালে তিনি নিজ গ্রাম- সেনেরখিলের মঙ্গলকান্দি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৭ম শ্রেণীতে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকে ১৯৬৪ সালে ২য় বিভাগে এসএসসি পাশ করে ফেনী কলেজে ভর্তি হন। ১৯৬৬ সালে ফেনী কলেজ থেকে ২য় বিভাগে এইচএসসি পাশ করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ১ম বর্ষ স্নাতক সন্মান শ্রেণীতে ভর্তি হন। ২য় বর্ষে পড়াশোনা সময় রাজনৈতিক কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যান। তখন তিনি টাঙ্গাইলের করটিয়া সা’দত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স এবং পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙলা বিভাগ থেকে বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৯৫ সালে সেলিম আল দীন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে ‘মধ্যযুগের বাঙলা নাট্য’ শীর্ষক অভিসন্দর্ভের জন্য পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
এম.এ পরীক্ষা শেষ করার পর তিনি বিজ্ঞাপনসংস্থা বিটপী’তে কপিরাইটার পদে চাকুরী করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে প্রভাষক নিযুক্ত হন। দীর্ঘদিন বাংলা বিভাগে শিক্ষকতা করার পর ১৯৮৬ সালে তিনি নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে যুক্ত হন। এই বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যুক্ত ছিলেন।
সেলিম আল দীন ঢাকা থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ১৯৮১-৮২ সালে সেলিম আল দীন এবং নাট্য-নির্দেশক নাসিরউদ্দিন ইউসুফ দেশব্যাপী গড়ে তোলেন ‘বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার’। তিনি এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক এবং সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ছিলেন এই থিয়েটারের প্রধান উপদেষ্টা।

তিনি ছোটবেলা থেকে লেখালেখি করতেন। ১৯৬৮ সালে কবি আহসান হাবিব সম্পাদিত ‘দৈনিক পাকিস্তান’ পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকীতে ‘আমেরিকার কালো মানুষদের’ নিয়ে সেলিম আল দীনের প্রথম বাংলা প্রবন্ধ ‘নিগ্রো সাহিত্য’ প্রকাশিত হয়। ১৯৬৯ সালে তাঁর প্রথম রেডিও নাটক ‘বিপরীত তমসায়’ এবং ১৯৭০ সালে প্রথম টেলিভিশন নাটক আতিকুল হক চৌধুরীর প্রযোজনায় ‘লিব্রিয়াম’ প্রচারিত হয় । আমিরুল হক চৌধুরী নির্দেশিত এবং ‘বহুবচন’ কর্তৃক প্রযোজিত তাঁর প্রথম মঞ্চনাটক ‘সর্প বিষয়ক গল্প’ মঞ্চস্থ হয় ১৯৭২ সালে। এরপর তিনি ইটালি, ফ্রান্স, আমেরিকা ও স্প্যানিশ সাহিত্য থেকে গল্প, কবিতা ও চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ক বহু প্রবন্ধেরঅনুবাদ করেন। এসব প্রবন্ধ সমসাময়িক বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
তিনি শুধু নাটক রচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, নাট্য বিষয়ক বহু গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখে বাংলা নাটকের হাজার বছরের ইতিহাস এবং তার সুস্পষ্ট সংস্কৃতি নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বাংলা ভাষার একমাত্র নাট্য বিষয়ক কোষগ্রন্থ ‘বাঙলা নাট্যকোষ’ সংগ্রহ, সংকলন, প্রণয়ন ও সম্পাদনা করেন। নাট্য বিষয়ক গবেষণা পত্রিকা ‘থিয়েটার স্টাডিজ’-এর সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
তাঁর রচিত ‘হরগজ’ নাটকটি সুইডিশ ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এ নাটকটি ভারতের রঙ্গকর্মী নাট্যদল কর্তৃক হিন্দি ভাষায় মঞ্চস্থ হয়েছে। সেলিম আল দীনের নাটক ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভূক্ত রয়েছে। এছাড় তিনি দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পতত্ত্ব, ফিউশন তত্ত্ব’র প্রবক্তা এবং নিউ এথনিক থিয়েটারের উদ্ভাবনকারী। বাংলা নাটকে অসামান্য অবদানের জন্য দেশে-বিদেশে তিনি বহুবার সংবর্ধিত হয়েছেন।
রচিত গ্রন্থসমূহ
সর্প বিষয়ক গল্প ও অন্যান্য নাটক (রহমান প্রকাশনী, ১৯৭৩); জণ্ডিস ও বিবিধ বেলুন (বাংলা একাডেমী, ১৯৭৫); বাসন (... ১৯৮৫); তিনটি মঞ্চ নাটক (বাংলা একাডেমী, ১৯৮৬) ; আততায়ী (বিদেশী গল্পের অনুপ্রেরণায়) ; কেরামতমঙ্গল (মুক্তধারা, ১৯৮৮) ; নন্দিকেশ্বরের অভিনয় দর্পণ (অনুবাদ ও সম্পাদনা) ; কবি ও তিমি (কাব্যগ্রন্থ, ধ্রুপদী প্রকাশনী, ১৯৯০)
অমৃত উপাখ্যান (উপন্যাস); প্রাচ্য (নাটক) ; কিত্তনখোলা (নাটক) ; হাত হদাই (নাটক, বাংলা একাডেমী ১৯৯৭)
যৈবতী কন্যার মন (গ্রন্থিক প্রকাশনা, ১৯৯৩) ; চাকা (গ্রন্থিক প্রকাশনা, ১৯৯১) ; হরগজ (গ্রন্থিক প্রকাশনা, ১৯৯২) ; মধ্যযুগের বাঙলা নাট্য (বাংলা একাডেমী, ১৯৯৬) ; একটি মারমা রূপকথা (বাংলা একাডেমী,১৯৯৫) ; বাঙলা নাট্যকোষ ; অমৃত উপাখ্যান; বনপাংশুল (বাংলা একাডেমী, ১৯৯৬) ; নিমজ্জন (ক্রান্তিক প্রকাশনী, ২০০২) ; ধাবমান ; স্বর্ণবোয়াল (সময় প্রকাশনী, ২০০৭) ; ঊষা উৎসব ও স্বপ্নরমণীগণ (নৃত্যনাট্য, আর্থ ফাউন্ডেশন ২০০৭) ;পুত্র ; রচনা সমগ্র-১, ২ (মাওলা ব্রাদার্স)
পুরষ্কার ও সম্মাননা
বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৪; ঋষিজ কর্তৃক প্রদত্ত সংবর্ধনা, ১৯৮৫; কথক সাহিত্য পুরস্কার (আব্দুল বাকী নাট্য পদক)১৩৯০ বঙ্গাব্দ; উত্তরায়ণ কর্তৃক প্রদত্ত সংবর্ধনা, ১৩৯১ বঙ্গাব্দ; জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার, ১৯৯৬; জাতীয় পর্যায়ে ৫০তম জন্মজয়ন্তী ও সংবর্ধনা, ১৯৯৯; অন্য থিয়েটার (কলকাতা) কর্তৃক প্রদত্ত সংবর্ধনা, ২০০০; নান্দীকার পুরস্কার (আকাদেমি মঞ্চ কলকাতা), ১৯৯৪; শ্রেষ্ঠ টেলিভিশন নাট্যকার (টেনাশিনাস পুরস্কার) , ১৯৯৪; খালেকদাদ সাহিত্য পুরস্কার; জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (একাত্তরের যীশু, শ্রেষ্ঠ সংলাপ), ১৯৯৪; একুশে পদক, ২০০৭।



২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পথ হারিয়ে-খুঁজে ফিরি

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ১৩ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৩৩


মনটা ভালো নেই। কার সাথে কথা বলবো বুঝে পাচ্ছি না। বন্ধু সার্কেল কেও বিদেশে আবার কেও বা চাকুরির সুবাদে অনেক দুরে। ছাত্র থাকা কালে মন খারাপ বা সমস্যায় পড়লে... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রজাতির শেষ জীবিত প্রাণ !

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫১



বিবিসির একটা খবর চোখে এল সেদিন । উত্তরাঞ্চলীয় সাদা গন্ডার প্রজাতির শেষ পুরুষ গন্ডারটি মারা গেছে । তার নাম ছিল সুদান । মৃত্যুর সময় তার বয়স ৪৫। বিবিসির সংবাদটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর মধ্যে সে একজন ।।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯



আপনারা কতজন Umma Kulsum Popi চেনেন, আমি ঠিক জানি না। আমার পর্যবেক্ষণ মতে, বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের একজন হলেন উনি। যদি বলি দেশের সেরা পাঁচজন কনটেন্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিস অস্বীকার করে রাসূলের (সা.) আনুগত্য সম্ভব

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৩ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সূরাঃ ৪ নিসা, ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস কর তবে তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আর আনুগত্য কর রাসুলের, আর যারা তোমাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

=কবিতাগুলো যেনো এক একটি মধুমঞ্জুরী ফুল=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:২০



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনের মাধুরী মিশিয়ে যে কবিতা লিখি
কবিতাগুলো যেনো আমার এক একটি মঞ্জুরী লতা ফুল,
মনের ডালে ডালে রঙবাহারী রূপ নিয়ে
ঝুলে থাকে কবিতা দিবানিশি
যে কবিতার সাথে নিত্য বাস,
তাদের আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×