somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হুমায়ূন আহমদ : আহমদ ছফার চোখে

২৪ শে আগস্ট, ২০০৯ রাত ১১:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আজ সন্ধ্যায় মাশা বলে একজন ব্লগারের একটি লেখা "হুমায়ূন আহমেদের (হুমায়ূন আহম্মক নহে) বই। বলপয়েন্ট।।" (২৪ শে আগস্ট, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬:৫৪) দেখে এবং সেখানে কিছু মন্তব্য দেখে এ লেখাটি।
সবই আহমদ ছফার সাক্ষাৎকার থেকে। রচনাবলী তৃতীয় খণ্ড (খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানি) এখানে প্রসঙ্গত ইমদাদুল হক মিলনের বিষয়ও এসেছে, যাকে হুমায়ূন আহমেদ সেরা লেখকের সার্টিফিকেট দিয়েছেন। আরো দু'চারজন লেখকের বিষয়ও এসেছে।

এ সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন সাজ্জাদ শরীফ ও ব্রাত্য রাইসু মিলে। জানুয়ারি ১৯৯৬।

ছফা : ... হুমায়ূনের বড় প্রবলেমটা হচ্ছে সে এখন যে সোশ্যাল ডায়ালেক্টিকসের মধ্যে পড়ে গেছে ... অর্থাৎ সোশ্যাল ডায়ালেক্টিকসটা ... হুমায়ূন কিংবা মিলন এই লোকগুলো, মার্শাল ল'র মধ্যে এঁদের গ্রোথ ...
রাইসু : মার্শাল ল'র মধ্যে?
ছফা : মার্শাল ল'র ভেতরেই একদম। লেখক হিসেবে সেভেন্টি ফোরে তার উপন্যাস বেরিয়েছে, সেভেন্টি ফাইভ থেকে এদের গ্রোথ। মার্শাল ল'র মধ্যে আমাদের গ্রেটেস্ট সোশ্যাল ডিসকোর্স যেগুলো ... একজন লেখককে সোশ্যাল ডিসকোর্সে অংশগ্রহণ করতে হয়।
রাইসু : ওনারা করেন নাই?
ছফা : হুমায়ূন করে নাই একদম।
রাইসু : মিলন?
ছফা : মিলন যেটা করে, 'আনন্দবাজার' যে ডিসকোর্সটা আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে ...
রাইসু : সেইটা করছেন?
ছফা : সেইটাতে অংশগ্রহণ করেছে।
রাইসু : মিলন তাইলে ঐ ইন্ডিয়ানদের বলি?
ছফা : বলি, আমি সেইটা বলব না। এগুলো সাধারণ লোক বলবে। কিন্তু মিলন যে ডায়ালেক্টিকসটায় এখন কাজ করছে, সোশ্যাল ডায়ালেক্টিকসে, সেটা আমাদের নিজেদের ডায়ালেক্টিস নয়।
সাজ্জাদ : কিন্তু নূরজাহানের ঘটনা সত্যি ছফা ভাই।
ছফা : না, ঘটনাটা সত্য হলেও ... আমার প্রশ্নটা হচ্ছে, কোন রকমের ভাবাবেগমুক্ত একটি একাডেমিক আলোচনা, যেখানে মানুষ কোন পার্সোনাল মন্তব্য করবে না; আমার নিজের ধারণা আমাদের প্রবলেম যেটা সাহিত্যের, সকলে এই ডিসকোর্সটা এড়িয়ে যায় ... তসলিমা কিন্তু আমাদের সোশ্যাল ডিসকোর্স থেকে জন্মেছে, ইন্ডিয়ানরা ব্যবহার করেছে তাকে। কিন্তু মিলন আমাদের ডিসকোর্স থেকে জন্মায়নি। আর হুমায়ূন ডিসকোর্সটা এভয়েড করেছে। তসলিমা একটা ইন্টারভিউতে বলেছিল, আমি হুমায়ূন আহমেদের মত লিখতে পারতাম, লিখি নাই। এখন যেটা হুমায়ূনের প্রবলেম, সে এই ডিসকোর্সের মধ্যে আসতে চেষ্টা করছে, কিন্তু আসা হচ্ছে না ...।
সাজ্জাদ : 'জোছনা ও জননীর গল্প'?
ছফা : 'জোছনা ও জননীর গল্প'টা তো জমতেছে না।
সাজ্জাদ : শীত বেশি পড়ে নাই।
ছফা : না প্রশ্নটা হচ্ছে, শীত আর হবে না, এক সময় বর্ষা এসে যাবে। না, না, সে চেষ্টা করছে। কিন্তু মানসিক শুদ্ধতার একটা প্রশ্ন আছে না, অর্থাৎ বাইরের রাস্তার লোক কী চায় সেই জন্যে আমি লিখব, নাকি আমার প্রাণ কী চায় সেই জন্য লিখব? এখন এই জিনিসগুলো একটা বড় ফ্যাকটর, এবং এগুলো আমার মনে হয় ক্রমাগত আলোচনা হওয়া প্রয়োজন।

... ...

ছফা : ... তারপরে এই হুমায়ূন আহমেদের প্রথম লেখাটা, 'নন্দিত নরকে' ... সেই সময়ের জন্য রেয়ার লেখা।
সাজ্জাদ : এটা কি আপনি ঐ সময়কার পড়া থেকে বলছেন, নাকি রিসেন্টলি পড়ে বলছেন?
ছফা : ঐ সময়ের পড়া থেকে। এখন আমি রিসেন্টলি পড়তে পারি নাই আর। আমি তার 'এপিটাফ' বলে একটা লেখা পড়েছি। ভেরি গুড রাইটিং, ভালভাবে লিখেছে। জামাকাপড় তো বানায়, কিন্তু প্রাণ দিতে পারে না, কী একটা মুশকিল! এই যে ম্যানারিজম, এইগুলো তো ... সৈয়দ শামসুল হকের ব্যাপারে সবচে ক্ষিপ্ত হয়েছি। 'বাজার সুন্দরী' বলে একটা উপন্যাস আমি পড়েছি তাঁর। মুক্তিযুদ্ধের উপর লেখা। কী এগুলো! কী করে এগুলো মানুষ লেখে! সেক্স দিলে লোকে বই কিনবে, সেটার জন্যই করছে। বাজারের জন্য করছে। এবং যেটা হুমায়ূন আহমেদ একবিন্দুও সেক্স না লিখে শ্রেষ্ঠ বাজারসফল বই লিখছে, অন্যেরা সেক্স দিয়ে এইটার সাথে কমপিট করতে চাইছে।
রাইসু : ধনতান্ত্রিক?
ছফা : হুমায়ূন আহমেদ যত কিছুই করুক না কেন, তার নষ্টামিটা অন্য জায়গায়। তার নষ্টামিটা ব্রেনে। এদের নষ্টামিটা শিশ্নে।

... ... ...
এ সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন মীজানুর রহমান মীজান, ১৯৯৪ সালের জানুয়ারি মাসে। পরে ১৯৯৫ সালে এটা সামান্য সম্পাদনা করে প্রকাশিত হয়।

ছফা : সফলতা একটা আপেক্ষিক ব্যাপার। জাতির মর্মমূল স্পর্শ করে যদি ব্যর্থও হই, তার একটা আলাদা মূল্য আছে। মামুলি সার্থকতার চাইতে মহৎ ব্যর্থতার মূল্য অনেক বেশি। হুমায়ূন আহমেদ এঁরা ওই অর্থে সফল লেখক যে লিখে তাঁরা টাকা কামিয়েছেন। টাকা কামানোটাই কি একমাত্র সাফল্যের মাপকাঠি?
মীজান : হুমায়ূন আহমেদের এই জনপ্রিয়তার কারণ কী?
ছফা : হুমায়ূনের সঙ্গে আমার সম্পর্কের ইতিহাস যাঁরা জানেন, তাঁদের অনেকেই তাঁর এই উন্নতি বা অবনতির জন্য অংশত আমাকেই দায়ী করতে চান। তাঁর প্রথম বই যখন বেরিয়েছিল, আমি সবচাইতে বেশি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছি। তখন আমার মনে হয়েছিল হয়ত হুমায়ূনের মধ্যে কালে কালে আমরা চেখভের মত একজন প্রতিভার সন্ধান পাব। তিনি তো সে পথে গেলেন না। উপর্যুপরি সামরিক শাসন, গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার পরাজয় সব মিলিয়ে এখানে যে চিন্তাহীন অরাজক পরিস্থিতি _ হুমায়ূন সেই সময়ের প্রোডাক্ট। অবশ্য হুমায়ূনের ব্যক্তিগত কামালিয়াত এটুকু যে তিনি পাঠকদের মধ্যে স্থান করে নিয়েছেন। আমার প্রশ্ন এটা কি স্থান? হুমায়ূনের পরবর্তী রচনা চানাচুরের মত। খেতে মজা লাগে কিন্তু পেট ভরে না এবং সার পদার্থও বিশেষ নেই।

... ... ...

এ সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন বিপ্লব রহমান। ডিসেম্বর ১৯৯৩।

বিপ্লব : বাংলাদেশের জনপ্রিয় লেখক কাদের বলে আপনি মনে করেন?
ছফা : জনপ্রিয় লেখক হচ্ছেন হুমায়ূন আহমেদ।
বিপ্লব : বাংলাদেশে জনপ্রিয়তার দিক থেকে হুমায়ূন আহমেদ হচ্ছেন এ যুগের শরৎচন্দ্র। আপনি কি এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত?
ছফা : জনপ্রিয়তার দিক থেকে দেখতে গেলে হুমায়ূন শরৎচন্দ্রের চাইতে বড়। মেরিটের দিক থেকে দেখতে গেলে হুমায়ূন নিমাই ভট্টাচার্য্যের সমান। আর হুমায়ূনের প্রশ্নটা হচ্ছে -- হি ইজ রাইটিং ফর বাজার।
বিপ্লব : অর্থই এখানে মূল?
ছফা : আমার তো মনে হয় না এখানে অন্যকোন উদ্দেশ্য আছে। হুমায়ূন সম্পর্ক বলতে আমার কষ্ট হয়। হি ইজ পার্টলি মাই ক্রিয়েশন। তারপরেও এগুলোকে পুত্রজ্ঞানে দেখাই ভার।

... ... ... ...

ছফার এ সব মন্তব্যের বাইরেও আরো কয়েক জায়গায় হুমায়ূন প্রসঙ্গ এসেছে। কিন্তু চুম্কক অংশটুকুই তুলে ধরলাম। হুমায়ূন আহমেদের বিচার সম্পর্কে এটুকুই যথেষ্ট। এখন কেউ যদি চানাচুরের দরকার আছে, বাজারের জন্য লিখলে ক্ষতি কি, এসব প্রশ্ন তোলোন তা আলাদা আলোচনার দাবি রাখে।

সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে আগস্ট, ২০০৯ রাত ১১:০৯
৩৯টি মন্তব্য ১৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাফসান দ্য ছোট ভাই এর এক আউডি গাড়ি আপনাদের হৃদয় অশান্ত কইরা ফেলল!

লিখেছেন ব্রাত্য রাইসু, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫২

রাফসান দ্য ছোট ভাইয়ের প্রতি আপনাদের ঈর্ষার কোনো কারণ দেখি না।

আউডি গাড়ি কিনছে ইনফ্লুয়েন্সার হইয়া, তো তার বাবা ঋণখেলাপী কিনা এই লইয়া এখন আপনারা নিজেদের অক্ষমতারে জাস্টিফাই করতে নামছেন!

এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঁচতে হয় নিজের কাছে!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৮

চলুন নৈতিকতা বিষয়ক দুইটি সমস্যা তুলে ধরি। দুটিই গল্প। প্রথম গল্পটি দি প্যারবল অব দ্যা সাধু।  লিখেছেন বোয়েন ম্যাককয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জার্নালের ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। গল্পটা সংক্ষেপে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা

লিখেছেন জানা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৬



২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×