somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নিঃসঙ্গ যোদ্ধা : তাজউদ্দীন

১৮ ই আগস্ট, ২০০৯ সন্ধ্যা ৭:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই দিনটা কেমন ছিল, জানি না। পৃথিবী নামক গ্রহের ভাগ্যাকাশে কোন নক্ষত্র কোন স্থানে ছিল তাও আমাদের অজ্ঞাত। বাংলাদেশ হয়নি, হয়নি পাকিস্তান, সময়টা তখন তেমনই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধাক্বায় তখন বিশ্ব দুলছে। তেমনই এক সময়ে পূর্ব বাংলার কাপাসিয়ার দারদরিয়া গ্রামে একজনের জন্ম। তিনি বাংলাদেশের রূপকার তাজউদ্দীন।

কেউ কি একদিনে নেতা হয়ে উঠে? নেতৃত্ব এমন এক জিনিস যা মানুষকে শত মানুষের মাঝে এককভাবে চিনতে সহায়তা করে। শৈশব কৈশোর প্রতিটি পদক্ষেপেই জনাব তাজউদ্দীন তাঁর অনন্যতার সাক্ষর রেখেছেন সফলতার সাথে। জনাব তাজউদ্দীনের জন্ম এক মৌলভী পরিবারে। মৌলভী মোহাম্মদ ইয়াসিন খান ছিলেন তাজউদ্দীন সাহেবের পিতা। দশ ছেলেমেয়ের এক সুবৃহত পরিবার ছিল মৌলভী সাহেবের। পারিবারিক নিয়মানুযায়ী তাজউদ্দীনকে প্রথমে গ্রামের মক্তবে দেয়া হয় যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তাজউদ্দীন সাহেবের পিতা। তারপর গ্রামের ২কিলোমিটার দূরে ভুলেশ্বর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিনি ভর্তি হন। চতুর্থ শ্রেণীতে উঠতেই তাঁকে কাপাসিয়া মাইনর ইংলিশ স্কুলে দেয়া হয় তাঁর মায়ের একান্ত ইচ্ছায়। এ স্কুলে থাকতেই তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের তিনজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার সংস্পর্শে আসেন এবং তারা তাঁর মাঝে দেশপ্রেমের শিখা জ্বালিয়ে দেন। এই নেতারা তাঁর স্কুলে শিক্ষকদের বলে যান এই ছেলেকে আরো ভালো কোন স্কুলে ভর্তি করানোর কথা। তারপর তাঁর স্থান হয় কালিগঞ্জের সেন্ট নিকোলাস স্কুলে। এখানেও তিনি তাঁর কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন এবং তাঁর প্রধান শিক্ষকের পরামর্শে তাঁকে ভর্তি করা হয় সেন্ট গ্রেগরী হাইস্কুলে। ১৯৪৪ সালে তাজউদ্দীন কলকাতা বোর্ডে ১২তম স্থান অর্জন করে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। তাজউদ্দীন সাহেব কোরআনে হাফেজ ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি সিভিল ডিফেন্সের উপর প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হন। ১৯৪৮ সালে চতুর্থ স্থান অর্জন করে পাশ করেন ইন্টারমিডিয়েট। স্কুলজীবন থেকেই তিনি বয়েজ স্কাউটের সাথে যুক্ত ছিলেন।

স্কুলের সময় থেকেই তিনি নানা ধরনের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং প্রগতিশীল কর্মকান্ডের সাথে জড়িত ছিলেন। এসব কারণে তিনি বহুবার কারাবরণ করেন। এতদ্সত্তেও মেধাবী তাজউদ্দীন কৃতিত্বের সাথে অর্থনীতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স পাশ করেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তাজউদ্দীন তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সাফল্যের আরেক অনন্য নজির স্থাপন করেন। এ নির্বাচনে তিনি মুসলিম লীগের জেনারেল সেক্রেটারীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে এমএলএ নির্বাচিত হন। আইনের ছাত্র হিসেবে তিনি নিয়মিত ক্লাস করেন ঠিকই কিন্তু এলএলবি পরীক্ষা দেন জেল থেকে এবং পাশ ও করেন।

১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ এবং মৃত্যু তাজউদ্দীনের মনে গভীর ছাপ ফেলে। দুর্ভিক্ষের পরে তিনি তাঁর গ্রামের মানুষদের সংগঠিত করেন এবং খাদ্যশস্য মজুদের জন্য একটা উপায় বের করেন এবং এর নাম দেন ”ধর্মগোলা”। এ পদ্ধতিতে ধান পাকার সময় ধনীদের কাছ থেকে খাদ্যশস্য সংগ্রহ করা হতো যাতে করে দুর্বিপাক দেখা দিলে ক্ষুধার্তদের মাঝে তা বিতরণ করা যায়।

ভাষা আন্দোলন, আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে এমন কোন সময় বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে খুঁজে পাওয়া যাবে না যখন তাজউদ্দীন সাহেব ছিলেন না। বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছেন, সেসব স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করেছেন আমাদের তাজউদ্দীন। ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানী জান্তার আক্রমণের পর এবং বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হবার পর নেতৃত্বশূন্য জাতিকে যিনি একীভূত করে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলের সামনে অতি অল্প সময়ে নিয়ে আসেন তিনি আর কেউ নন, আমাদের তাজউদ্দীন। ১৯৫৯ সালের ২৬শে এপ্রিল যে যোগ্য সহধর্মিণীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন সেই জোহরা খানমকে বাচ্চাদের সহ যুদ্ধাক্রান্ত ঢাকা শহরে শুধু স্রষ্টার কৃপায় সঁপে দিয়ে তিনি দেশমাতৃকার সেবায় আবার ঝাঁপিয়ে পড়েন। গঠন করেন ১০ এপ্রিল ১৯৭১ কুষ্টিয়ার মেহেরেপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা আম্রবাগানে বাংলাদেশ নামক উদীয়মান রাষ্ট্রের প্রবাসী সরকার। তাজউদ্দীন হন প্রধানমন্ত্রী। তাজউদ্দীনের প্রজ্ঞা ও ধী শক্তির বলে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সফলতার মুখ দেখান, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। ১৯৭২ সালের ১২ই ফেব্র“য়ারী তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে দেন এবং অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ভার নেন। সদ্য ভূমিষ্ঠ যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি রাষ্ট্রের জন্য কালজয়ী যে সংবিধান রচিত হয় তার অন্যতম কারিগর জনাব তাজউদ্দীন।

১৯৭৪ সালের ২৬ অক্টোবর জনাব তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীসভা থেকে ইস্তফা দেন এবং তখনই প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের রাজনীতিতে শকুনের কালো থাবার আনাগোনা শুরু হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হবার পর বাংলাদেশের জাতশত্র“রা সেই আলবদর আলশামস রাজাকার বাহিনীদের মতোই যাঁরা দেশ গড়তে পারেন তাঁদের নিধনে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে । আর তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর পৃথিবীর সবচাইতে নিরাপদ স্থান কারাগারে আরো তিন সাথীসহ জনাব তাজউদ্দীন নিহত হন। যে দেশ স্বাধীন করার জন্য কোনদিন সংসার কি জিনিস তার স্বাদ গ্রহণ করেননি. যে দেশের মানুষের জন্য আয়ুর সিংহভাগ সময় কাজ করেছেন সে দেশের মানুষ তাঁকে জেলের মধ্যে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, গুলি করে মেরে ফেলেছে রাতের অন্ধকারে। অকৃতজ্ঞ জাতি, তার চাইতে অকৃতজ্ঞ সামরিক বাহিনীর সদস্য এবং রাজনৈতিকরা টুঁ শব্দটি উচ্চারণ করেনি এসব হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে। বিলের পর বিল পাশ হয়েছে এসব হত্যাকারীকে বাঁচানোর জন্য। কেউ কেউ হয়েছে পুরস্কৃত। পেয়েছে কূটনৈতিকের মতো লোভনীয় পদমর্যাদার চাকুরী।

এ জুলাইয়ে আমার সেই মহান মানবকে স্মরণ করি। স্রষ্টা যুগে যুগে অবতার পাঠিয়েছেন এক এক জাতিকে হেদায়েতের জন্য। আমরা আমাদের জন্য পাঠানো একজন মানবকেও ধরে রাখতে পারিনি। কথায় কথায় আমরা বলি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি এখন ক্ষমতায়। সপক্ষ বিপক্ষ সব একাকার হয়ে যায় আপন আপন স্বার্থের প্রশ্নে। যে জাতি তার সূর্যসন্তানদের এভাবে হারায় এবং এর পেছনে দায়ীদের বিচার করতে পারে না, সে জাতি যতই দিন বদলের গান গা’ক কোন বদলই আসলে হবে না। বলতে পারি - ”উদয়ের পথে শুনি কার বাণী ভয় নাই ওরে ভয় নাই, নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই তাঁর ক্ষয় নাই”।

জাতি হিসেবে নিজেদের ক্ষয়িষ্ণু পরিচিতি পুনরুদ্ধারকল্পে এখনই তাজউদ্দীনসহ সব হত্যার বিচার হওয়া অতীব জরুরী। শাসনকার্যের ভার পাওয়ার ছয় মাস অতিক্রান্ত - জাতি জানতে চায় রাজাকারদের বিচার কবে হবে?বঙ্গবন্ধু হত্যার সাথে জড়িত সামরিক বেসামরিক ব্যক্তিদের কবে ফাঁসীতে ঝুলানো হবে? চার নেতার হত্যাকারীদের একইভাবে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে কবে মারা হবে? ১৯৭৫-৮১ সালে শত শত সামরিক অফিসারের বিনা কারণে মৃত্যুর কোন সুরাহা কি হবে না? ধারাবাহিক এসব হত্যাই আজকের বাংলাদেশে এত অরাজকতার মূল। এ সত্য যতদিন আমরা সম্যকভাবে উপলব্ধি করে বিচারকার্যে ব্রতী না হব, ততোদিন নিঃসঙ্গ যোদ্ধা তাজউদ্দীন এভাবেই আমাদের দিক থেকে অভিমানে মুখ ফিরিয়ে রাখবেন আর আমরা ভুগতে থাকব নেতৃত্ব সংকটে।

সূত্র : দৃষ্টিপাত ব্লগ ও ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইট
*** জনাব তাজউদ্দীনের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে লিখেছিলাম গতমাসে। দেব দেব করে আর দেয়া হয়নি পোস্টটা।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই আগস্ট, ২০০৯ রাত ১১:৫৮
২৬টি মন্তব্য ২৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

রাফসানের মা হিজাব করেন নি। এই বেপর্দা নারীকে গাড়ি গিফট করার চেয়ে হিজাব গিফট করা উত্তম।

লিখেছেন লেখার খাতা, ১১ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩


ছবি - সংগৃহীত।


ইফতেখার রাফসান। যিনি রাফসান দ্যা ছোট ভাই নামে পরিচিত। বয়স ২৬ বছর মাত্র। এই ২৬ বছর বয়সী যুবক মা-বাবাকে বিলাসবহুল গাড়ি কিনে দিয়েছে। আমরা যারা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ এঁটেল মাটি

লিখেছেন রানার ব্লগ, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৫৬




শাহাবাগের মোড়ে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম, মাত্র একটা টিউশানি শেষ করে যেন হাপ ছেড়ে বাঁচলাম । ছাত্র পড়ানো বিশাল এক খাটুনির কাজ । এখন বুঝতে পারি প্রোফেসরদের এতো তাড়াতাড়ি বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

আসুন সমবায়ের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচন করি : প্রধানমন্ত্রী

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১২ ই মে, ২০২৪ ভোর ৪:১০



বিগত শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী নিজ সংসদীয় এলাকায় সর্বসাধারনের মাঝে বক্তব্য প্রদান কালে উক্ত আহব্বান করেন ।
আমি নিজেও বিশ্বাস করি এই ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খুবই আন্তরিক ।
তিনি প্রত্যন্ত অন্চলের দাড়িয়ারকুল গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

পাইলট ফিস না কী পয়জনাস শ্রিম্প?

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১২ ই মে, ২০২৪ সকাল ৭:৪০

ছবি সূত্র: গুগল

বড় এবং শক্তিশালী প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পাশে ছোট ও দূর্বল প্রতিবেশী রাষ্ট্র কী আচরণ করবে ? এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধিক্ষেত্রে দুইটা তত্ত্ব আছে৷৷ ছোট প্রতিবেশি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছেলেবেলার অকৃত্রিম বন্ধু

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ১২ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৯

খুব ছোটবেলার এক বন্ধুর গল্প বলি আজ। শৈশবে তার সাথে আছে দুর্দান্ত সব স্মৃতি। বন্ধু খুবই ডানপিটে ধরনের ছিল। মফস্বল শহরে থাকতো। বাবার চাকুরির সুবাদে সেই শহরে ছিলাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

×