somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হাসন রাজা যাদুঘরে একদিন

১৫ ই আগস্ট, ২০০৯ রাত ১২:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সুনামগঞ্জ শহরে ঢুকতেই চোখে পড়বে হাসন রাজা তোরণ। সুনামগঞ্জ বলতেই সর্ব প্রথমে আসে হাসন রাজার নাম। সুনামগজ্ঞে হাসন রাজার বাড়িতেই তার নামে মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা করেছেন প্রপৌত্র সামারীন দেওয়ান। দর্শনার্থী এবং পর্যটকদের কৌতুহল নিবৃত্তকল্পে হাসন রাজার ব্যবহৃত দ্রব্যাদি, বংশলতিকা ও অনান্য তথ্যাদি সম্বলিত দলিলাদি মিউজিয়ামে প্রদর্শিত হচ্ছে।

হাসন রাজার পুরো নাম দেওয়ান হাসন রাজা চৌধুরী। জন্ম ২১ ডিসেম্বও ১৮৫৪ সালে। মৃত্যু ৬ ডিসেম্বর ১৯২২ সালে। তার পিতার নাম দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী। মাতা হুরমত জান বিবি। পিতার মৃত্যুর পর মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি বিশাল জামদারির উত্তরাধিকারী হন। বংশের নিয়ম অনুযায়ী প্রথমে আরবী এবং পরে বাংলা শিক্ষা লাভ করেন। সে সময় মুসলমান সমাজে ইংরেজী শিক্ষার প্রচলন না থাকায় আনুষ্ঠানিক শিক্ষা তার বেশী দূর এগোয়নি। স্বশিক্ষিত এই রাজা ছিলেন একজন শিক্ষা অনুরাগী। সুনামগঞ্জের প্রধান প্রধান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরীতে তার অবদান ছিল। সুনামগঞ্জ জুবিলি হাই স্কুল ও কলেজে জায়গা প্রদান তার অন্যতম।

তৎকালীন রাজা, জমিদারদের ইতিহাস ঘাটলে পাওয়া যায় শাষণ, শোষণ আর প্রজা নিপিড়নের কাহিনী। রাজা-প্রজার মধ্যে সম্পর্ক ছিল শোষক আর শোষিতের। যে কজন রাজা প্রজাদের মঙ্গলের জন্য কাজ করেছেন হাসন রাজা তাদের একজন। আমাদের ইতিহাসে তিনিই বোধহয় একমাত্র রাজা যিনি সবসময় প্রজা পরিষ্টেত হয়ে থাকতেন। কারণ তলোয়ার দিয়ে তিনি রাজা হননি, হয়েছেন সুর আর গান দিয়ে। যদিও বংশানুক্রমে তিনি ছিলেন রাজ বংশের উত্তরাধিকার। কিন্তু গানের জন্য তিনি আজও বেঁচে আছেন মানুষের মনে ’লোকের রাজা’ হয়ে। ’লোক’ বলতে এখানে দ্বিমাত্রিক ব্যজ্ঞনা দেয়া হয়েছে। ’লোক’ মানে জনগনের রাজা ছিলেন। অন্যদিকে লোকের রাজা মানে তিনি লোকসাহিত্যের রাজা।

হাসন রাজা নৃত্য গীতে সর্বদা বিভোর হয়ে থাকতেন। কখনো বাড়ির বাইরে গানের আসরের ঘরে, কখনো পানশী নৌকায় করে সুরমা নদীতে, কখনোবা অচিন্তপুরের সাহেরের ভিটে টিলায়, আবার কখনো সদরগড়ের সবুজ গাছ-গাছালি পরিবেষ্টিত জলাশয়ে নৌকার মাঝখানে। মাঝে মাঝে তিনি আবেগআপ্লুত হয়ে নিজের কোলে টেনে নিতেন প্রিয় ঢোলটি এবং স্বতঃস্ফুর্ত হয়ে বাজাতে খাকতেন। এই ঢোলটি হাসন রাজা মিউজিয়ামে আজও শোভা পাচ্ছে।

অত্যন্ত সহজ সরল জীবন যাপনে অভ্যস্ত এই বিশাল জমিদার বাস করতেন মাটির ঘরে। নিজের ঘরবাড়ী সম্পর্কে একটি গানে তিনি বলেছেন- লোকে বলে, বলেরে ঘরবাড়ী বালা না আমার, কি ঘর বানাইমু আমি শুন্যের মাঝার। প্রভাত কুমার শর্মার লেখা থেকে পাওয়া যায় তার ঘরবাড়ী সম্পর্কে একটি সুন্দর ঘটনা। একবার কয়েকজন বিদেশী ভদ্রলোক হাসন রাজার বাড়ী দেখতে এসেছিলেন। বাড়ীর সামনে তারা দেখা পাই হাসন রাজার । রাজা জানতে চাইলেন কি জান? ভদ্রলোকগন তাকে না চিনে বললেন- আমরা হাসন রাজার বাড়ী দেখতে এসেছি। হাসন রাজা অত্যন্ত আগ্রহের সাথে বললেন 'আসুন আসুন আমি আপনাদের হাসন রাজার বাড়ী দেখাই'। এই বলে তিনি তাদের মাঠের মধ্যে নিয়ে গেলেন। সেখানে এই সাধকের কবর তৈরী হচ্ছিল। সেই চিরদিনকার বাড়ীর দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করে দেখালেন - ঐ দেখুন আমার বাড়ী।

হাসন রাজার যেমন বিলাসী তেমনি বৈরাগীও ছিলেন। মুক্ত হস্তে দান করতেন তিনি। তার এক মজার শখ ছিল ছোট ছোট বাচ্চাদের জড়ো করে রুপোর টাকা ছড়িয়ে দেয়া। বাচ্চরা হুটোপুটি করে কুড়িয়ে নিত, তা দেখে খুব মজা পেতেন তিনি। হাসন রাজা ছিলেন অত্যন্ত সুপুরুষ । পশু পাখী ভালবাসতেন । ঘোড়া ও কুড়া পাখির প্রতি তার আসক্তি ছিল বেশী। তার হাতি শালায় ছিল হাতি এবং ঘোড়া শালায় ঘোড়া । তার সংরক্ষিত ১৭৮ টি কুড়া পাখির নাম, ৮০ টি ঘোড়া এবং ৯টি হাতির নাম এখন হাসন রাজা মিউজিয়ামে শোভা পাচ্ছে। অশ্বারহনে সুপটু এই রাজা জীবনে অনেকবার সিলেট, হবিগজ্ঞ, ঢাকা এমনকি কলকাতায় ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহন করেছেন।

হাসন রাজা রচনা করেছেন দেহতত্ব, মুর্শিদি, সারি, প্রেম ও দেশাত্বোবোধক গান । হাসন রাজার সাথে কাব্য আর দর্শণ এক হয়ে মিশে আছে। মাত্র ১৫ বছর বয়সে বাবা এবং বড় ভাইকে হারিয়ে তার নিজের মধ্যেও মৃত্যু চিন্তা ভর করে। তাই তার রচিত মরমী গানের অনেক অংশ জুড়েই রয়েছে আধ্রাতিক সাধনা ও পারলৌকিক চিন্তার প্রতিফলন। তাইতো তার কন্ঠে বেজেছে ’আমি যাইমু রে যাইমু আল্লারও সঙ্গে বা একদিন তোর হইবোরে মরণ রে হাসন রাজা- এই রকম অসংখ্য গান। অত্যন্ত তীক্ষ দূরদৃষ্টি সম্পন্ন এই সাধক তার গানে নিজেকে উল্লেখ করেছেন বাঙালি হিসাবে।
হাসন রাজা বাঙালি হয়ে কাঙ্গালী
প্রেমানলে জ্বালিয়ে যায় প্রান
আমি তোমার কাঙ্গালী গো সুন্দরী রাধা

হাসন রাজা যখন গান লিখতেন অথবা গানের কলি, সুর এবং তাল মেলাতে ব্যস্ত থাকতেন, তখন তার চারপাশে পরিবেষ্টিত থাকত একদল সাদামাটা নারী-পুরুষ। এরাই তার গানের শব্দ, কলি এবং সুরে যথেষ্ট অবদান রাখতেন। তার কাব্যে অপূর্ব কবিত্ব শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। ভাষা সহজ সরল হলেও তা অত্যন্ত মর্মস্পর্শী। মরমী কবি হাসন রাজা ছিলেন অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্ব। তার আধুনিক দর্শণ আজও শেষ হয়ে যায়নি। তিনি মানুষের কবি মানবতার কবি। মানব প্রেম যুগে যুগে মহামনবে উন্মোচিত করেছে তাকে।

তারেক মাহমুদ
[email protected]

(লেখাটি ১৪আগষ্ট, 2009 "প্রথম আলো" তে প্রকাশিত, পাতা ১৩)

সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই আগস্ট, ২০০৯ দুপুর ১:০২
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শিয়াল ফিলিস্তিনীরা লেজ গুটিয়ে রাফা থেকে পালাচ্ছে কেন?

লিখেছেন সোনাগাজী, ১১ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১০



যখন সারা বিশ্বের মানুষ ফিলিস্তিনীদের পক্ষে ফেটে পড়েছে, যখন জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে সাধারণ সদস্য করার জন্য ভোট নিয়েছে, যখন আমেরিকা বলছে যে, ইসরায়েল সাধারণ ফিলিস্তিনীদের হত্যা করার জন্য আমেরিকান-যুদ্ধাস্ত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাফসানের মা হিজাব করেন নি। এই বেপর্দা নারীকে গাড়ি গিফট করার চেয়ে হিজাব গিফট করা উত্তম।

লিখেছেন লেখার খাতা, ১১ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩


ছবি - সংগৃহীত।


ইফতেখার রাফসান। যিনি রাফসান দ্যা ছোট ভাই নামে পরিচিত। বয়স ২৬ বছর মাত্র। এই ২৬ বছর বয়সী যুবক মা-বাবাকে বিলাসবহুল গাড়ি কিনে দিয়েছে। আমরা যারা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ এঁটেল মাটি

লিখেছেন রানার ব্লগ, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৫৬




শাহাবাগের মোড়ে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম, মাত্র একটা টিউশানি শেষ করে যেন হাপ ছেড়ে বাঁচলাম । ছাত্র পড়ানো বিশাল এক খাটুনির কাজ । এখন বুঝতে পারি প্রোফেসরদের এতো তাড়াতাড়ি বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

আসুন সমবায়ের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচন করি : প্রধানমন্ত্রী

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১২ ই মে, ২০২৪ ভোর ৪:১০



বিগত শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী নিজ সংসদীয় এলাকায় সর্বসাধারনের মাঝে বক্তব্য প্রদান কালে উক্ত আহব্বান করেন ।
আমি নিজেও বিশ্বাস করি এই ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খুবই আন্তরিক ।
তিনি প্রত্যন্ত অন্চলের দাড়িয়ারকুল গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

পাইলট ফিস না কী পয়জনাস শ্রিম্প?

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১২ ই মে, ২০২৪ সকাল ৭:৪০

ছবি সূত্র: গুগল

বড় এবং শক্তিশালী প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পাশে ছোট ও দূর্বল প্রতিবেশী রাষ্ট্র কী আচরণ করবে ? এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধিক্ষেত্রে দুইটা তত্ত্ব আছে৷৷ ছোট প্রতিবেশি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×