হাওরের ‘আফাল’ (হাওরের উত্তাল ঢেউ)। এর সঙ্গে পরিচয় আছে ভারতের আসাম রাজ্যের কাছাড় জেলার বৈরাগীবন্দ গ্রামের কৃষকদের। চিরায়ত ভাটি বাংলার বিশেষ করে সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জসহ বর্ষায় হাওর লোকালয়ের কৃষকদের এই রুদ্রমূর্তির সঙ্গে তারাও পরিচিত। বর্ষাকালীন সময়ে হাওরপাড়ের লোকজন যে দুর্দশায় ভোগেন ভারতের বরাক উপত্যকার আসাম রাজ্যের বাংলাদেশ পার্শবর্তী ভাটির লোকজননকেও ভোগায় এই আফাল।
কাছাড় জেলার গুমড়া বাজার এলাকায় কালাই ব্লকে রয়েছে ছোট ছোট ৮টি হাওর। কেলমা-১ থেকে কেলমা-৮ পর্যন্ত এসব হাওরের উপর নির্ভরশীল ছাদিরগাও, কাটিগড়া, বৈরাগী বন্দ, বুড়ারাইয়ারপাড় কেলমাসহ আশপারেশর প্রায় ২০টি গ্রাম। এসব গ্রামের অধিকাংশ লোকের কাজ হলো হাওরে মাছধরা, কৃষিকাজ ও দিনমজুরি। এমনকি বাংলাদেশের হাওরাঞ্চলের বন্ধকী কামলার প্রচলনও রয়েছে এখানে।
এই অঞ্চলের প্রায় নব্বই ভাগ লোকের পূর্বপুরষরা ছিলেন বাংলাদেশের হাওর এলাকা সিলেটের। দেশবিভাগ, রেফারেন্ডামের মাধ্যমে সিলেট থেকে আসাম পৃথক ও পরবর্তী সময়ে জীবনজীবিকা ও নিরাপত্তার প্রশ্নে তারা ভারতে পাড়ি দিয়ে এখন ভারতের গর্বিত নাগরিক। তবে তাদের সবাইরই নাড়িপোতা বাংলাদেশে। নিু আয়ের এসব লোকদের অভিজ্ঞতাও বাংলাদেশের হাওরবাসীর ন্যায়। অভিন্ন সমস্যায় ভোগছেন এপাড়-ওপাড়ের হাওরবাসীরা। ভারতের মেঘালয়ের উজানের ঢলে বাংলাদেশের নিুাঞ্চল প্লাবিত হলেও তাদের এই বিষয়ে ধারণা নেই। তবে বর্ষায় শহরে পৌছতে তাদেরও ছোট ডিঙ্গি নৌকায় পাড়ি দিতে হয় আফালময় হাওর। বন্যা হলে তাদের আশ্রয় নিতে হয় উচু সড়কে।
খেলমা-২ হাওরপাড়ের বুড়ারাইয়া গ্রামের শ্যামল দাস (৩৫) বলেন ‘‘ আমরা জলেমারা’’ জায়গায় থাকি। তাই প্রতি বর্ষায় আমাদের বাড়িঘর ৪/৫ হাত জলের নিচে ডুবে যায়। তিনি জানান, ছোট বেলায় দেখেছেন বর্ষায় আগে পানি আসলেও দ্রুত চলে যেতো। এখন পানি বেশিদিন থেকে হাওরবাসীদের দুর্ভোগে ফেলে দেয়। হাওর এলাকায় অপরিকল্পিত রাস্থাঘাট তৈরীর কারণেই এসব হচ্ছে।
একই গ্রামের অমল দাস (৩৩) বলেন, ‘‘আগে জল আইলে ফট খরি যাইতগি। এখন হাওর ঘিরে আতারেপাতারে সড়ক হওয়ায় আর যায়না।’’ তাছাড়া এখন ঘনঘন বন্যা হয় বলেও তিনি জানান। বন্যা হওয়ার কারণ হিসেবে তারা নিজ অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, কয়লা, চুনাপাথর ও কাগজকলের জন্য তাদের আসাম রাজ্যের পাহাড় কাটা হচ্ছে নির্বিচারে। এসব কারণে ঘনঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিচ্ছে বলে তারা জানিয়েছেন।
স¤প্রতি বাংলাদেশের বেসরকারি সংস্থা বারসিকের নেতৃত্বে বরাক-সুরমা উপত্যকার বিভিন্ন সংগঠনের লোকজন ‘‘উজানভাটি নাগরিক সংহতির’’ ব্যনারে বরাক উপত্যকার বুদ্ধিজীবি, সাংবাদিক সাহিত্যিক, পরিবেশকর্মীদের সঙ্গে একাধিক মতবিনিময় করেছে। বরাক উপত্যকার বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত এসব মতবিনিময় সভায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল উজানের (ভারতের) ঢলে ভাটিবাংলার প্রকৃতি, পরিবেশ ও প্রতিবেশে পাল্টে যাওয়ায় সচিত্র তথ্য উপস্থাপন করেছে। এসব তথ্যচিত্র দেখে বরাক উপত্যকার সুশীল সমাজ এখনই ভারত সরকারকে বাংলাদেশের ভাটি এলাকার পরিবেশ বিপর্যয় সম্পর্কে বিশেষভাবে ভাবার কথা ব্যক্ত করেছেন। বরাক উপত্যকার প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবি আইনজীবি ইমাদ উদ্দিন বুলবুল বলেন, ভারতের মেঘালয়, খাসিয়া ও জৈন্তহিল এলাকা ও বাংলাদেশের ভাটি এলাকার প্রাকৃতিক সমস্যা অভিন্ন। আমাদের প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে আরো গভীর সম্পর্ক তৈরী করে এই অভিন্ন সমস্যার সমাধান জরুরি হয়ে পড়েছে।