somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বন্ধুদিবসে খুব মনে পড়ে এক ভিনদেশী বন্ধুকে

০৩ রা আগস্ট, ২০০৯ রাত ২:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ছেলেটির নাম জিয়াং মাও, বয়স ২৪ কি ২৫ হবে। চায়নার শেনজেন শহরে বাস করে। ছোটখাট একটা ট্রেডিং কোম্পানী খুলেছে। স্ত্রী চাকুরী করে একটা লজিস্টিক কোম্পানীতে। স্ত্রী আর এক বাচ্চা নিয়ে খুব সুখের সংসার।

জিয়াং মাওয়ের সাথে আমার পরিচয় ২০০৫ সালে। ব্যবসার খাতিরে আমি বিভিন্ন বিজনেস ওয়েবসাইটে আমার অফিসের বিজনেস প্রোফাইল এবং এমএসএন মেসেঞ্জার এড্রেস দিয়ে রেখেছিলাম। হঠাৎ একদিন আমার এমএসএন মেসেঞ্জারে একটা এ্যাড রিকোয়েস্ট মেসেজ, জিয়াং মাও নামের একজন পাঠিয়েছে। আমি তাকে এ্যাড করলাম এবং চ্যাটও করলাম। জানতে পারলাম সে চায়নার শেনজেন শহরে থাকে এবং ছোটখাট একটা ট্রেডিং কোম্পানী আছে।

আমি তখন চায়না থেকে কম্পিউটার হার্ডওয়্যার, নেটওয়ার্কিং প্রডাক্ট, কিছু গার্মেন্টস একসেসরিজ ইমপোর্ট করতাম থার্ড পার্টি ভায়া মিডিয়া ধরে। কখনো ডাইরেক্ট ইমপোর্ট করতে সাহস করিনি কারণ কখনও চায়না যাইনি। তাছাড়া শুনেছি ওরা ভাল ইংলিশ বুঝে না খাবার দাবার সমস্যা, ওরা খুবই ঠগ টাকা মেরে দিবে ইত্যাদি ইত্যাদি। যাহোক আস্তে আস্তে জিয়াং মাওয়ের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা বাড়তে লাগল। একদিন আমি তাকে কিছু প্রডাক্টের প্রাইস লিস্ট পাঠাতে বলি, উদ্দেশ্য আমার আমদানীকৃত পণ্যের দাম যাচাই করা। সে যা করল তা অবাক করার মত, সে আমাকে ঐ প্রোডাক্টগুলোর ফ্যাক্টরী প্রাইস দিল যা কিনা শিপিং কস্ট, ট্যাক্স, ভ্যাট, সিএন্ডএফ চার্জ, এলসি খরচ সব বাদ দিয়ে আমার মিনিমাম ৪০% বেশী লাভ হবে। আমি ঐ প্রাইসে মালামাল কিনতে আগ্রহী হলাম, সে আমাকে চায়না ভ্রমনের অফার করল কিন্তু আমি তাকে ভাষা সমস্যা, খাদ্য সমস্যা ইত্যাদির কথা বললাম। সে বলল যে সে এসব দেখবে ভয়ের কোন কারণ নেই। যাহোক এর কিছুদিন পর আমি চায়না গেলাম। যাবার সময় মানি এক্সচেন্জ থেকে ডলার নেয়ার পাশাপাশি কিছু চাইনিজ ইউয়ান (চায়নিজ মুদ্রা যার আরেক নাম আরএমবি) নিলাম।

শেনজেন শহরে যেতে হলে ঢাকা থেকে প্রথমে কুনমিং যেতে হয়, সেখানে একদিন থাকতে হয় তারপরদিন সকালে কুনমিং টু শেনজেন ফ্লাইট। চায়না যাত্রার পূর্বে সে আমাকে চাইনিজ কিছু টুকটাক শব্দ চ্যাটের সময় শিখিয়ে দিয়েছিল, চাইনিজ ভাষার কিছু লেখা আমাকে জেপিইজি ফরম্যাটে ই-মেইল করেছিল প্রিন্ট করে সাথে নিয়ে যাবার জন্য। এগুলোর একটি ছিল কুনমিং এয়ারপোর্ট থেকে নেমে ট্যাক্সি ড্রাইভারকে দেখানোর জন্য আর আরেকটি ছিল কুনমিং হোটেল লিভ করার সময় ট্যাক্সি ড্রাইভারকে দেখানোর জন্য। সে ওভার ফোনে আগে থেকেই কুনমিংয়ে হোটেল বুকিং দিয়ে রেখেছিল। আমি কুনমিং এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে ট্যাক্সি ড্রাইভারকে প্রিন্টআউট করা চাইনিজ লেখাটা দেখালাম, ড্রাইভার সোজা আমাকে হোটেলে নিয়ে গেল। হোটেলে গিয়ে দেখি হুলস্থুল কান্ড, আমার জন্য জিয়াং মাওয়ের কুনমিং বাসিন্দা দুই বন্ধু সু ওয়েন এবং লিউ চেন ঘন্টা দুই যাবত অপেক্ষা করছিল। আমাকে পেয়ে যেন তারা আকাশের চাঁদ হাতে পেল। সৌভাগ্যক্রমে তারা ভাঙাভাঙা ইংলিশ বলতে পারত। তারা আমাকে হোটেলের রুমে ইন করিয়ে দিল। আমি ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। তারপর তারা আমাকে সাপার করানোর জন্য এক মুসলিম রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেল। চায়নাতে মুসলিম রেস্টুরেন্ট পেয়ে আমি অবাক হয়ে গেলাম। খাওয়া শেষে বিল দিতে গিয়ে দেখি বিল দেয়া হয়ে গেছে। ওরা কিছুতেই আমার কাছ থেকে টাকা নিল না, এমনকি আমাকে ট্যাক্সি ভাড়াও দিতে দিল না। :(

পরদিন সকালে আমার কুনমিং টু শেনজেন ফ্লাইট ছিল লোকাল টাইম সকাল ৯টায় কিন্তু আমাকে এয়ারপোর্টে চেকইন করতে হবে সকাল সাড়ে ৭টায়। যথা সময়ে হোটেল ম্যানেজার আমাকে ওয়েক আপ কল দিল। আমি ঘুম থেকে উঠে দেখি সেই দুজন হাজির। :) এত সকালে মুসলিম রেস্টুরেন্ট খুলবেনা, তাই ওরা আমার জন্য আপেল, কমলা, স্ট্রবেরী, আম নিয়ে এল। আমিও মনে মনে খুশী হলাম। ওরা আমাকে কুনমিং এয়ারপোর্ট পর্যন্ত পৌছে দিল। এবারও ট্যাক্সি ভাড়া দিতে পারলাম না। যাহোক ঘন্টা দুই পরে আমি শেনজেন এয়ারপোর্ট পৌছে গেলাম। জিয়াং মাও আমাকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করল। রিসিভ করার পর সে আমাকে চায়না মোবাইল (জিএসএম অপারেটর) কোম্পানীর একটা সিম হাতে দিয়ে বলল দেশে ফোন কর, তোমার স্ত্রী আর পরিজনেরা হয়তো তোমার জন্য খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে আছে। তাইতো! গত ১৫ ঘন্টা সবার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। সাথে সাথে আমার মোবাইল সেটে সিমটি ভরে আমার স্ত্রী ও পরিজনদের ফোন করলাম, আমার ফোন পেয়ে সবাই চিন্তামুক্ত হল। প্রথম দর্শনেই ছেলেটা আমার মনে স্থান করে নিল।

আমরা এয়ারপোর্ট বাসে করে শহরের লৌ হু ডিস্ট্রিক্টে রওনা হলাম। লৌ হু বাস টার্মিনালের কাছেই জিয়াং মাওয়ের ভাড়া বাসা। সে আমাকে নিয়ে তার বাসায় উঠল। বাসাটা ছিল এক রুমের। সে আমাকে তার বাসায় থাকতে বলল, তারা ফ্লোরিং করবে আর আমি ফুলবাবু হয়ে তাদের বিছানায় ঘুমাব। ব্যাপারটা আমার কাছে অমানবিক মনে হল। আমি তাকে অনুরোধ করলাম একটা হোটেল ঠিক করে দেয়ার জন্য। সে আমাকে একটা ভাল অথচ কম খরচের একটা হোটেল ঠিক করে দিল পাশেই ছিল একটা শিনজিয়াং মুসলিমদের খাবার দোকান। যাক মনে মনে খুশী হলাম, থাকা খাওয়ার চিন্তা এখন আর নেই।

ঐ দিন ছিল পহেলা আগস্ট সারাদিন আমি আর জিয়াং শপিং মলে ঘুরাঘুরি করলাম। বিকেলে হোটেলে ফিরে এসে ঘুম দিলাম। জিয়াং বাসায় চলে গেল। ঘুম থেকে উঠে দেখি রাত ১১টা বাজে। বাইরে বেরিয়ে দেখি খাবার দোকানটা বন্ধ। খুব ক্ষিদে পেয়েছিল বলে খাবার দোকান খুজে বের করতে বেরিয়ে পড়লাম। কিছুদুর গিয়ে টুপি মাথায় দেয়া এক ভ্রাম্যমান শিক কাবাব বিক্রেতার সন্ধান পেলাম। সে ছিল উইঘুর মুসলিম। তার আইটেমের মধ্যে ছিল বিভিন্ন ধরনের কাবাব। ক্ষুধার চোটে অনেকগুলো খেয়ে ফেললাম। রাত সাড়ে ১২টায় হোটেলে ফিরে টিভি দেখছি হঠাৎ তলপেটে তীব্র ব্যাথা অনুভব করলাম, তার কিছুক্ষণ পড়ে বমি করলাম, বমির পর পরই ডায়রিয়া শুরু হয়ে গেল বুঝলাম ফুড পয়জনিং হয়েছে। অবস্থা ক্রমেই খারাপ হতে লাগল, কাপড় নষ্ট করে ফেললাম সাথে সাথে হোটেল রুমও নোংরা করে ফেলেছি। সারা ঘরে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পরল। উপায় না দেখে জিয়াংকে ফোন করলাম। ১০ মিনিটের মধ্যে জিয়াং আর ওর বউ এসে হাজির। আমাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে গেল। সারারাত তারা হাসপাতালে ছিল। পরের দিন সকালে ওর বউ অফিসে চলে গেল আমি জোর করে জিয়াংকে তার বাসায় পাঠালাম রেস্ট নেয়ার জন্য আর আসার সময় হোটেল রুম থেকে আমার কিছু কাপড় নিয়ে আসতে বললাম। দোসরা আগস্ট সন্ধ্যায় আমি অনেকটা সুস্থ হয়ে হোটেলে ফিরে গেলাম।

হোটেলে ফিরেতো আমি অবাক, জিয়াং যখন আমার জন্য কাপড় নিতে হোটেলে এসেছিল তখন সে আমার নষ্ট হয়ে যাওয়া সবগুলো কাপড় নিজের হাতে ধুয়ে দিয়েছে। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম কেন সে এইকাজ করতে গেল। সে জবাব দিল যে সে আমাকে তার বন্ধু মনে করে। জিয়াংয়ের জায়গায় আমার কোন বাংলাদেশী বন্ধু হলে সেও নিশ্চয়ই আমার নোংরা কাপড় গুলো ধুয়ে দিত। সাথে সাথে আমার চোখদিয়ে পানি চলে আসল। আমি তাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম "ফ্রম টুডে ইউ আর মাই বেস্ট ফ্রেন্ড"।

সেই ঘটনার পর থেকে আগস্টের দুই তারিখ আমার জন্য এক স্মরনীয় দিন। প্রতিবছর আগস্টের দুই তারিখ আমার ভিনদেশী বন্ধু জিয়াং মাওকে খুব খুব মনে পড়ে। জিয়াংয়ের সাথে আজো আমার বন্ধুত্ব টিকে আছে। আমাদের বন্ধুত্ব সারাজীবন টিকে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস, কারণ আমাদের এই বন্ধুত্বে নেই কোন স্বার্থের দন্দ্ব আছে শুধু এক নিখাদ ভালবাসা। কাকতালীয়ভাবে এ বছরের আগস্টের দুই তারিখ ফ্রেন্ডশীপ ডে ও বটে। তাই এই বন্ধু দিবসে তাকে আমি বলেছি -

"As precious as you are to me,
As precious no one can ever be,
I know friends are hard to choose,
But you are a friend I never want to lose"

সবাইকে বন্ধুদিবসের শুভেচ্ছা। সবাই ভাল থাকুন, দীর্ঘজিবী হোন। সবাইকে শুভকামনা।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা আগস্ট, ২০০৯ রাত ৩:৩২
২১টি মন্তব্য ২১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমানের দেয়াল

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৪




অভিমানের পাহাড় জমেছে তোমার বুকে, বলোনিতো আগে
হাসিমুখ দিয়ে যতনে লুকিয়ে রেখেছো সব বিষাদ, বুঝিনি তা
একবার যদি জানতাম তোমার অন্তরটাকে ভুল দূর হতো চোখের পলকে
দিলেনা সুযোগ, জ্বলে পুড়ে বুক, জড়িয়ে ধরেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×