somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমাদের সাহেবী দাদু

২৮ শে জুলাই, ২০০৯ বিকাল ৩:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমাদের এক সাহেবী দাদু আছেন। ইংরেজদের মতো মাথায় টুপী পরেন। কখনো গাউন আবার কখনো জামা-প্যান্ট। হাতে থাকে একটা লাঠি। এই সংস্কৃতি তিনি ইংরেজদের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। ইংরেজরা তার সাহস আর চেহারা, ছবি আর শিক্ষা দেখে দাদুকে 'সাহেবী' টাইটেল দিয়েছিলেন। আমরা দাদুর মুখ থেকে এসব কথা শুনেছি। আমাদের সাহেবী দাদুর অনেক গুণ আছে। তিনি আমাদের জন্যে গল্প লেখেন। খুব সুন্দর সুন্দর গল্প। কিন্তু তাঁর লেখা আর বলার মধ্যে অনেক তফাৎ আছে। দাদু খুব সুন্দর করে গল্প বলতে পারেন। যা শুনতে বসলে ছোটরা কেন বড়রাও উঠতে পারেন না। খাবার-দাবারের কথা একদম ভুলে যান। এ অঞ্চলে তাই দাদুর এতো নাম ডাক। সাহেবী দাদুর পাশাপাশি দাদুর আরেক নাম হলো গল্প দাদু।
দাদুর বয়স এখন একশোর উপরে। বয়স যে তাকে কাবু করতে পারেনি তা তাকে দেখলে বোঝা যায়। এখনো একজন যুবকের মতো চলাফেরা করেন। খাবার-দাবারে তাঁর কোন আপত্তি বা বাদ-বিচার নেই। যা পায় তাই খায়। পাহাড়ের মতো দেখতে। গায়ের রঙ একেবারে দুধে আলতা। আমাদের দিদিমা বেঁচে নেই। দাদুর দুই ছেলে এখন কানাডা থাকেন। মাসে মাসে বাবার জন্য তারা অনেক টাকা পাঠান। সে টাকাতে দাদুর ভালোভাবে চলে যায়। অনেকবার ছেলেরা তাঁকে কানাডাতে চলে যাবার কথা বলেছেন। তিনি যাবেন না। দেশের মাটিতে জন্ম নিয়েছেন, দেশের মাটি-মানুষের জন্য তিনি যুদ্ধ করেছেন। দেশের মাটিতেই তাঁর কবর হবে। এটাই তিনি চান।
সময় কাটাতে দাদু পাড়ার ছোট ছোট ছেলেদের নিয়ে নানা গল্প করেন। মজার মজার সে গল্প। বিশাল বাড়িতে দাদু একা থাকেন। আকবর আর রহিমা নামে দুজন কাজের লোক আছে দাদুর। বিশাল বাগানঅলা বাড়ি। সব তারাই দেখাশুনা করে। দাদু নিজের ইচ্ছেমতো শুধু আমাদের সাথে সময় কাটান। গল্প বলতে বসলে তাঁর রাতদিন হিসেব থাকে না। খাবারবেলা কখন পার হয়ে যায় সেদিকে খেয়াল থাকে না। রহিমা আর আকবর ডেকে ডেকে খুন হয়ে গেলেও গল্প বলা থেকে দাদু বিরত থাকেন না। বিশেষ করে আমাদের গল্প বলার আড্ডাটা হয় শুক্রবারে। স্কুল বন্ধ থাকে। সকাল থেকে বসে গল্প বলার আসর। দুপুরের খাবারের জোগাড়ও হয় দাদুর বাড়িতে। সকাল-দুপুর-বিকাল কাটে গল্পে আর গল্পে। পূর্ণিমাতেও বসে আসর। সারারাত ধরে চলে সে আসর। ছেলেমেয়েরা ঘুমোনোর কথাও ভুলে যায়। মা-বাবারা দাদুর কোন কাজে বাঁধা দেন না। তাঁরা জানেন দাদু যা করেন তা ছেলেমেয়েদের ভালোর জন্যই করেন।
গ্রামের অধিকাংশ মানুষদের তিনি নানাভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেন। কোন পরিবার খেতে না পারলে তাদের খাবার দেন দাদু। কোন ছেলে বেতনের জন্য স্কুলে যেতে না পারলে তাদের বেতন তিনি দিয়ে দেন। কেউ জমিতে ফসল ফলাতে পারছে না বীজ, সারের অভাবে দাদু তার বীজ, সার কেনার টাকা দিয়ে দেন। নানাভাবে গ্রামবাসীদের সাহায্য করে থাকেন। গ্রামবাসী ভাবেন, তাদের মাথার উপর ছায়া দেবার জন্য একটা বটগাছ আছেন।
মাঝে মাঝে দাদু হারিয়ে যান। রহিমা আর আকবর খুঁজতে খুঁজতে তাকে পান বাগানের ঝোঁপঝাড়ে। বসে লেখালেখি করছেন আপনমনে। রহিমা আর আকবর ডাকে। তাদের দেখে বিরক্তি ফুটে ওঠে দাদুর মুখে। তারপর হাসতে হাসতে বলেন,
-খাবারের সময় হয়েছে বুঝি? তোরা যা, আমি আসছি।
তবুও দাঁড়িয়ে থাকে আকবর আর রহিমা। তারা জানে, তারা চলে গেলে দাদু আবার খাবার কথা ভুলে যাবেন। তাই তারা দাদুকে সাথে করেই ঘরে নিয়ে আসে।
দাদু আমাদের জন্য অনেককিছু কিনে রাখেন ঘরে। এই বয়সে নাকি আমরাই তার বন্ধু। কখনো চকলেট, কখনো বিসকিট, কখনো চানাচুর। বিভিন্ন ধরণের খাবার দিয়ে আমাদের খুশি করেন। পাশাপাশি ক্লাসে কে কেমন পড়াশোনা করছে, কার রেজাল্ট কেমন হচ্ছে, কার পরিবার খেয়ে আছে না খেয়ে আছে সব খোঁজ-খবর রাখেন তিনি।
দাদু আমাদের জন্য গ্রামে প্রাথমিক স্কুল, হাই স্কুল ও কলেজ করেছেন। গান শেখার জন্য আলাদা স্কুল করেছেন। খেলাধূলা করার জন্য নিজের জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন মাঠ করতে। বিকেল বেলা আজও দাদু হাফপ্যান্ট পরে মাথায় টুপি দিয়ে ফুটবল খেলতে নামেন। ক্রিকেট খেলেন। দৌড়-ঝাঁপে তাঁর কোন তুলনা হয় না। দাদুর কথা, খেলাধূলা করলে শরীর ও মন দুটোই ভালো থাকে। আমাদের জন্য তিনি বেশ বড় বড় কয়েকটি পুকুর কেটেছেন। সাঁতার সেখান সাবইকে। পাশে মধুমতি নদী আছে। সেখানেও তিনি ছেলেমেয়েদের দলবেঁধে নিয়ে যান কোন কোন ছুটির দিনে।
এই গ্রামের মাথা হলো আমাদের দাদু। যে কোন সমস্যা সমাধান করতে দাদুকে ডাকা হয়। দাদু যা বলেন তাই-ই শোনেন গ্রামের মানুষ। কঠিন কঠিন সমস্যার সমাধান দিয়ে দেন এক মুহূর্তে। কারো মেয়ে বিয়ে দেবে, দাদু হ্যাঁ বললেই হবে। কারো ছেলের বিয়ে হবে দাদু মত দিলে হবে। দাদু হয়ে উঠেছে এই গ্রামের ভাগ্য বিধাতা।
এই গ্রামের ছেলেমেয়েরা মিথ্যে কথা বলে না। বিপদে-আপদে সবার উপকার করে। দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়ায়। এ সবকিছু শিখেছে ছেলেমেয়েরা দাদুর কাছ থেকে।
দাদুর ছেলেরা যখন তাদের ছেলে বউ নিয়ে গ্রামে আসেন, তখন দাদুদের বড় উঠোনে বসে গানের আসর। জারি, সারি, পুঁথিপাঠ, গাজীর গান, রামায়ণ ইত্যাদি। তখন এই গ্রামে মেলা শুরু হয়। দাদুর জন্মদিনে এই গ্রামের মানুষ বটতলাতে নানা ধরণের আয়োজন করেন। লাঠিখেলা, ষাড়ের লড়াই, গান বাজনা, গল্প বলার আসর ইত্যাদি। দাদু না করতে চাইলেও গ্রামের লোকজন এসব করে দাদুকে সম্মান দেখাতে। দাদুকে একটা মঞ্চ করে সেখানে হাজির করা হয়। তিনি তার ফেলে আসা দিনের কথা শোনান সবাইকে। তার কথা শুনে আজকের মানুষ অনুপ্রেরণা পান সামনের দিকে এগিয়ে যাবার।
আমাদের সেই আদরের দাদু একদিন হারিয়ে গেলেন। খোঁজ.. খোঁজ.. খোঁজ পরে গেলো সব জায়গায়। বাগানে, ঝোঁপে, গ্রামে, শহরে সবখানে। দিন গেলো। রাত গেলো। দাদু তাও ফিরে এলো না। নদী, পুকুর কিছুই খুঁজতে বাদ দেয়া হলো না। শেষে অন্য আর কোন উপায় না দেখে থানাতে ডায়েরি করা হলো দাদুর নামে। কিন্তু তারাও কোন খোঁজ দিতে পারলো না দাদুর। গ্রামের লোকজন অস্থির হয়ে উঠলো। কাঁদতে লাগলো সবাই। আমাদের সবার মন খারাপ হয়ে গেলো। মনে হতে লাগলো গল্প দাদু হারিয়ে যাওয়া মানে আমাদের জীবন থেকে হাসি-আনন্দ হারিয়ে যাওয়া। কিছুতেই দাদুর এই চলে যাওয়া আমরা মেনে নিতে পারছি না। গ্রামের ভেতরে যেন একটা শোক পরে গেলো। কারো মনে শান্তি নেই। কেউ ভালো করে খায় না। কেউ প্রাণ খুলে হাসে না। সবকিছু যেন থেমে গেছে দাদুর অনুপস্থিতিতে।
দিনে দিনে বছর পেরিয়ে গেল। তারপরও আমাদের গ্রামের সবাই আজও দাদুর অপেক্ষায় থাকে। সবার বিশ্বাস- দাদু একদিন না একদিন ফিরে আসবে।

সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুলাই, ২০০৯ বিকাল ৩:৫২
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডেল্টা ফ্লাইট - নিউ ইয়র্ক টু ডেট্রয়ট

লিখেছেন ঢাকার লোক, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:২৬

আজই শ্রদ্ধেয় খাইরুল আহসান ভাইয়ের "নিউ ইয়র্কের পথে" পড়তে পড়তে তেমনি এক বিমান যাত্রার কথা মনে পড়লো। সে প্রায় বছর দশ বার আগের ঘটনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রিয়ট যাবো,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

চরফ্যাশন

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫৯



নয়নে তোমারি কিছু দেখিবার চায়,
চলে আসো ভাই এই ঠিকানায়।
ফুলে ফুলে মাঠ সবুজ শ্যামলে বন
চারদিকে নদী আর চরের জীবন।

প্রকৃতির খেলা ফসলের মেলা ভারে
মুগ্ধ হয়েই তুমি ভুলিবে না তারে,
নীল আকাশের প্রজাতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কর কাজ নাহি লাজ

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪


রাফসান দা ছোট ভাই
ছোট সে আর নাই
গাড়ি বাড়ি কিনে সে হয়ে গেছে ধন্য
অনন্য, সে এখন অনন্য।

হিংসেয় পুড়ে কার?
পুড়েপুড়ে ছারখার
কেন পুড়ে গা জুড়ে
পুড়ে কী জন্য?

নেমে পড় সাধনায়
মিছে মর... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×