দাদুর বয়স এখন একশোর উপরে। বয়স যে তাকে কাবু করতে পারেনি তা তাকে দেখলে বোঝা যায়। এখনো একজন যুবকের মতো চলাফেরা করেন। খাবার-দাবারে তাঁর কোন আপত্তি বা বাদ-বিচার নেই। যা পায় তাই খায়। পাহাড়ের মতো দেখতে। গায়ের রঙ একেবারে দুধে আলতা। আমাদের দিদিমা বেঁচে নেই। দাদুর দুই ছেলে এখন কানাডা থাকেন। মাসে মাসে বাবার জন্য তারা অনেক টাকা পাঠান। সে টাকাতে দাদুর ভালোভাবে চলে যায়। অনেকবার ছেলেরা তাঁকে কানাডাতে চলে যাবার কথা বলেছেন। তিনি যাবেন না। দেশের মাটিতে জন্ম নিয়েছেন, দেশের মাটি-মানুষের জন্য তিনি যুদ্ধ করেছেন। দেশের মাটিতেই তাঁর কবর হবে। এটাই তিনি চান।
সময় কাটাতে দাদু পাড়ার ছোট ছোট ছেলেদের নিয়ে নানা গল্প করেন। মজার মজার সে গল্প। বিশাল বাড়িতে দাদু একা থাকেন। আকবর আর রহিমা নামে দুজন কাজের লোক আছে দাদুর। বিশাল বাগানঅলা বাড়ি। সব তারাই দেখাশুনা করে। দাদু নিজের ইচ্ছেমতো শুধু আমাদের সাথে সময় কাটান। গল্প বলতে বসলে তাঁর রাতদিন হিসেব থাকে না। খাবারবেলা কখন পার হয়ে যায় সেদিকে খেয়াল থাকে না। রহিমা আর আকবর ডেকে ডেকে খুন হয়ে গেলেও গল্প বলা থেকে দাদু বিরত থাকেন না। বিশেষ করে আমাদের গল্প বলার আড্ডাটা হয় শুক্রবারে। স্কুল বন্ধ থাকে। সকাল থেকে বসে গল্প বলার আসর। দুপুরের খাবারের জোগাড়ও হয় দাদুর বাড়িতে। সকাল-দুপুর-বিকাল কাটে গল্পে আর গল্পে। পূর্ণিমাতেও বসে আসর। সারারাত ধরে চলে সে আসর। ছেলেমেয়েরা ঘুমোনোর কথাও ভুলে যায়। মা-বাবারা দাদুর কোন কাজে বাঁধা দেন না। তাঁরা জানেন দাদু যা করেন তা ছেলেমেয়েদের ভালোর জন্যই করেন।
গ্রামের অধিকাংশ মানুষদের তিনি নানাভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেন। কোন পরিবার খেতে না পারলে তাদের খাবার দেন দাদু। কোন ছেলে বেতনের জন্য স্কুলে যেতে না পারলে তাদের বেতন তিনি দিয়ে দেন। কেউ জমিতে ফসল ফলাতে পারছে না বীজ, সারের অভাবে দাদু তার বীজ, সার কেনার টাকা দিয়ে দেন। নানাভাবে গ্রামবাসীদের সাহায্য করে থাকেন। গ্রামবাসী ভাবেন, তাদের মাথার উপর ছায়া দেবার জন্য একটা বটগাছ আছেন।
মাঝে মাঝে দাদু হারিয়ে যান। রহিমা আর আকবর খুঁজতে খুঁজতে তাকে পান বাগানের ঝোঁপঝাড়ে। বসে লেখালেখি করছেন আপনমনে। রহিমা আর আকবর ডাকে। তাদের দেখে বিরক্তি ফুটে ওঠে দাদুর মুখে। তারপর হাসতে হাসতে বলেন,
-খাবারের সময় হয়েছে বুঝি? তোরা যা, আমি আসছি।
তবুও দাঁড়িয়ে থাকে আকবর আর রহিমা। তারা জানে, তারা চলে গেলে দাদু আবার খাবার কথা ভুলে যাবেন। তাই তারা দাদুকে সাথে করেই ঘরে নিয়ে আসে।
দাদু আমাদের জন্য অনেককিছু কিনে রাখেন ঘরে। এই বয়সে নাকি আমরাই তার বন্ধু। কখনো চকলেট, কখনো বিসকিট, কখনো চানাচুর। বিভিন্ন ধরণের খাবার দিয়ে আমাদের খুশি করেন। পাশাপাশি ক্লাসে কে কেমন পড়াশোনা করছে, কার রেজাল্ট কেমন হচ্ছে, কার পরিবার খেয়ে আছে না খেয়ে আছে সব খোঁজ-খবর রাখেন তিনি।
দাদু আমাদের জন্য গ্রামে প্রাথমিক স্কুল, হাই স্কুল ও কলেজ করেছেন। গান শেখার জন্য আলাদা স্কুল করেছেন। খেলাধূলা করার জন্য নিজের জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন মাঠ করতে। বিকেল বেলা আজও দাদু হাফপ্যান্ট পরে মাথায় টুপি দিয়ে ফুটবল খেলতে নামেন। ক্রিকেট খেলেন। দৌড়-ঝাঁপে তাঁর কোন তুলনা হয় না। দাদুর কথা, খেলাধূলা করলে শরীর ও মন দুটোই ভালো থাকে। আমাদের জন্য তিনি বেশ বড় বড় কয়েকটি পুকুর কেটেছেন। সাঁতার সেখান সাবইকে। পাশে মধুমতি নদী আছে। সেখানেও তিনি ছেলেমেয়েদের দলবেঁধে নিয়ে যান কোন কোন ছুটির দিনে।
এই গ্রামের মাথা হলো আমাদের দাদু। যে কোন সমস্যা সমাধান করতে দাদুকে ডাকা হয়। দাদু যা বলেন তাই-ই শোনেন গ্রামের মানুষ। কঠিন কঠিন সমস্যার সমাধান দিয়ে দেন এক মুহূর্তে। কারো মেয়ে বিয়ে দেবে, দাদু হ্যাঁ বললেই হবে। কারো ছেলের বিয়ে হবে দাদু মত দিলে হবে। দাদু হয়ে উঠেছে এই গ্রামের ভাগ্য বিধাতা।
এই গ্রামের ছেলেমেয়েরা মিথ্যে কথা বলে না। বিপদে-আপদে সবার উপকার করে। দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়ায়। এ সবকিছু শিখেছে ছেলেমেয়েরা দাদুর কাছ থেকে।
দাদুর ছেলেরা যখন তাদের ছেলে বউ নিয়ে গ্রামে আসেন, তখন দাদুদের বড় উঠোনে বসে গানের আসর। জারি, সারি, পুঁথিপাঠ, গাজীর গান, রামায়ণ ইত্যাদি। তখন এই গ্রামে মেলা শুরু হয়। দাদুর জন্মদিনে এই গ্রামের মানুষ বটতলাতে নানা ধরণের আয়োজন করেন। লাঠিখেলা, ষাড়ের লড়াই, গান বাজনা, গল্প বলার আসর ইত্যাদি। দাদু না করতে চাইলেও গ্রামের লোকজন এসব করে দাদুকে সম্মান দেখাতে। দাদুকে একটা মঞ্চ করে সেখানে হাজির করা হয়। তিনি তার ফেলে আসা দিনের কথা শোনান সবাইকে। তার কথা শুনে আজকের মানুষ অনুপ্রেরণা পান সামনের দিকে এগিয়ে যাবার।
আমাদের সেই আদরের দাদু একদিন হারিয়ে গেলেন। খোঁজ.. খোঁজ.. খোঁজ পরে গেলো সব জায়গায়। বাগানে, ঝোঁপে, গ্রামে, শহরে সবখানে। দিন গেলো। রাত গেলো। দাদু তাও ফিরে এলো না। নদী, পুকুর কিছুই খুঁজতে বাদ দেয়া হলো না। শেষে অন্য আর কোন উপায় না দেখে থানাতে ডায়েরি করা হলো দাদুর নামে। কিন্তু তারাও কোন খোঁজ দিতে পারলো না দাদুর। গ্রামের লোকজন অস্থির হয়ে উঠলো। কাঁদতে লাগলো সবাই। আমাদের সবার মন খারাপ হয়ে গেলো। মনে হতে লাগলো গল্প দাদু হারিয়ে যাওয়া মানে আমাদের জীবন থেকে হাসি-আনন্দ হারিয়ে যাওয়া। কিছুতেই দাদুর এই চলে যাওয়া আমরা মেনে নিতে পারছি না। গ্রামের ভেতরে যেন একটা শোক পরে গেলো। কারো মনে শান্তি নেই। কেউ ভালো করে খায় না। কেউ প্রাণ খুলে হাসে না। সবকিছু যেন থেমে গেছে দাদুর অনুপস্থিতিতে।
দিনে দিনে বছর পেরিয়ে গেল। তারপরও আমাদের গ্রামের সবাই আজও দাদুর অপেক্ষায় থাকে। সবার বিশ্বাস- দাদু একদিন না একদিন ফিরে আসবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুলাই, ২০০৯ বিকাল ৩:৫২