somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মোহনগঞ্জের লোককথা (ছড়া) ::: আইলাম্বর আইলাম্বর

২৮ শে জুলাই, ২০০৯ দুপুর ১:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রত্যেক মানুষের কাছেই নিজের জন্মস্থানকে অনুপম মনে হয়; আমার এই বোধ কিছুটা কম। তবে জন্মস্থানকে অনুপম মনে না হলেও এর কিছু কিছু দিক আমাকে বিহ্বল করে তোলে প্রায়ই। এর একটি লোককথা। হাওর-বাওর-নদী-খাল-বিলবেষ্টিত এবং অসংখ্য পুকুরশোভিত একটি উপজেলার নাম মোহনগঞ্জ, নেত্রকোনা জেলার একটি অংশ। এখানেই আমার বেড়ে উঠা। কৈশোরের বয়ঃসন্ধি যখন আমাকে প্রায়ই বিভিন্ন বিষয়ে প্রবলভাবে দ্বিধায় ফেলে দিতো, ঠিক সে সময়টাতেই মোহনগঞ্জকে ছেড়ে চলে আসি এই নগররাজ ঢাকায়। ফলে সে সময় থেকে আমার অস্তিত্বে মিশে যাওয়া লোককথাগুলো আস্তে আস্তে নিস্পৃহ হতে থাকে।

অনেককাল আগে মোহনগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে একটি বই বেরিয়েছিলো- সেটি এখন বিলুপ্ত। একদল উদ্যোগী তরুণ আবার নতুন করে সেই কাজ শুরু করলেও আর্থিক সীমাবদ্ধতা এবং স্বার্থকেন্দ্রিক ব্যস্ততা সবাইকে আবার নিজ নিজ ঘরে ফেরত নিয়েছে। আমার দায়িত্ব ছিলো লেখাগুলোকে সাজানো, প্রুফ দেখা এবং পেজ মেকাপ করা। সেই কাজ করতে গিয়েই চেপে রাখা বাতাসের মতো লোককথাগুলো সজোরে হানা দেয় আমার সমগ্র অস্তিত্বকে। আমি এই ভেবে স্বস্তিবোধ করি যে- নগরজীবন আমার শিকড় ধরে টান দিয়েছে, কিন্তু আমার অগোচরে কিছু কিছু খণ্ডিত শিকড় নগরজীবনকে ফাঁকি দিয়ে লম্বা এক শীতঘুম দিয়েছিলো আমারই ভেতর।

এই সিরিজের জন্য আমি ঋণী মোহনগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে যারা কাজ করেছেন তাদের প্রতি। এখানে আমি নিজের মতো করে লোককথাগুলো সংগ্রহ ও ব্যাখ্যা করেছি, বিশেষ করে নির্ভর করেছি আমার স্মৃতির ওপর। ছোটবেলায় যে ছড়াগুলো পড়তাম, বলতাম, খেলতাম- সেগুলো তো এসেছেই; তাছাড়া যে লোককথাগুলো সম্পর্কে আমি একেবারেই অবগত ছিলাম না সেগুলোর কিছু ধার নিয়েছি আমাদের মোহনগঞ্জ বইটি থেকে। কিছু কিছু ছড়া-ধাঁধা-হেঁয়ালি বইতে একরকমভাবে রয়েছে, স্থানীয় মানুষজন ও আমি জানি আরেকরকমভাবে। সেগুলোর ক্ষেত্রে বইয়ের বদলে আমার স্মৃতি ও মানুষের মুখে শোনার ধরনটিকেই আমি গুরুত্ব দিয়েছি বেশি। তবে ব্যাখ্যা-টীকা পুরোপুরি আমার ব্যক্তিগত জানাশোনা, দৃষ্টিকোণ ও উপলব্ধি থেকে দেওয়া। এখানে আরেকটি কথা বলা দরকার। এই সিরিজে হয়তো এমনসব ছড়া-ধাঁধা বা হেঁয়ালির সন্ধান মিলবে যেগুলো হয়তো অন্য এলাকাতেও প্রচলিত। থাকুক প্রচলিত, কোনো বাছবিছার ছাড়াই আমি মোহনগঞ্জে প্রচলিত সবগুলোকে তুলে আনতে চাই এই সিরিজে


আইলাম্বর আইলাম্বর

আইলাম্বর আইলাম্বর
আইলাম রে মোড়লের বাড়ি
পথ পাইলাম কলার ছড়ি
কলার ছড়ি লড়বড়
ও মোড়ল চোর ধর
চোর ধরতে টেহা পড়ে
ঝনঝনাইয়্যা টেহা পড়ে
উগলা টেহা পাইলাম গো
বাইন্যা বাড়িত গেলাম গো
বাইন্যা তর রূপার মালা
তর ঘরডা দেখতে বালা
ঘর বালা ঘর বালা
ঘর বালা গাড়ুনি
গিত্যাইন বালা রাঁধুনি
ও গিত্যাইন লড়চড়
আমায় দিবা কত ধন
আমি তো মাইগ্যা খাই
বাঘের নামে শিরনি চাই
বাঘ গেল নাগাইরপুর
কিইন্যা আনল চাম্পাফুল
চাম্পা গায়া পোলাইন রে
কী কী ধান নিছ রে
আপন ধান মাইগ্যা খাই
বাঘের নামে শিরনি চাই।

এছাড়া অনেকে বাইন্যা বাড়িত গেলাম গো-এর পরে বাকি লাইনগুলো না বলে নিচের লাইনগুলো বলে থাকে:

বাইন্যা বাড়িত টকইর বাসা
টকই টকই নলভাসা।

শব্দের অর্থ
১. আইলাম্বর = শব্দের অর্থ জানা নেই; সম্ভবত আসার ঘোষণা
২. আইলাম = এলাম
৩. লড়বড় = নড়বড়ে অবস্থা
৪. টেহা = টাকা
৫. উগলা = একটা
৬. বাইন্যা = ব্যবসায়ী
৭. বালা = ভালো
৮. গাড়ুনি = শব্দের অর্থ জানা নেই
৯. গিত্যাইন = একজনের নাম; গীতাকে এভাবে ডাকা হয় (নজমুল আলবাবের মতে গৃহিণী)
১০. মাইগ্যা= চেয়ে, ভিক্ষা করে
১১. নাগাইরপুর = নাগরপুর (টাঙ্গাইলের নাগরপুর কি?)
১২. কিইন্যা = কিনে
১৩. চাম্পাফুল = চম্পাফুল
১৪. গায়া = গ্রাম
১৫. টকইর = টুনটুনি পাখি
১৬. নলভাসা = যা জলে ভাসে

ব্যাখ্যা
লোককথা অনুসারে, মোহনগঞ্জ একসময় একদিকে সমুদ্র, একদিকে হাওর ও অন্যদিকে বনঘেরা একটি অঞ্চল ছিলো। বনে বিভিন্ন হিংস্র জীবজন্তু বাস করলেও সেগুলোর মধ্যে বাঘের আতঙ্ক ছিলো সবচাইতে বেশি। বর্তমানে সমুদ্র ও বন না থাকলেও হাওর আছে। শুকনো মওসুমে এসব হাওরে রাখালরা গরু-ছাগল চড়াত, কিন্তু প্রায়ই বাঘের অত্যাচারে অনেক গরু-ছাগল মারা পড়তো। বাঘের উপদ্রব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রতি বছর ধান উঠার পর রাখালরা ‘বাঘাই শিরনি’র আয়োজন করে বাঘকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করতো যাতে বাঘের হাত থেকে গরু-ছাগল রক্ষা করা যায়। এই বাঘাই শিরনির উপকরণ সংগ্রহ করার সময় রাখালরা সুর করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে এই ছড়াটি পাঠ করতো।

সত্যিকার অর্থে এই ছড়াটির উৎপত্তি কীভাবে এবং এই ছড়ার পেছনের কাহিনীর মূলসূত্র বর্ষীয়ান অনেকের সাথে কথা বলেও জানা যায় নি। এই ছড়ার সাথে বাঘ তাড়ানোর সম্পর্ক কী- তাও বের করা সম্ভব হয় নি। তবে মনে করা যায়- শিরনির উপাদান সংগ্রহ শুরু হতো মোড়লের বাড়ি থেকে এবং তারপর ব্যবসায়ীর বাড়ি হয়ে অন্যান্যদের কাছে যাওয়া হতো। ছড়ায় মোড়ল, ব্যবসায়ী ও অন্যান্য মানুষ- যার যার কাজের প্রকৃতি অনুসারে তাদের বাড়ি বা কাজের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া শিরনির জন্য মূলত ধান সংগ্রহ করতে গেলেও অনেকেই ধানের বদলে অন্য কিছু বা টাকাপয়সা দিতো। সেগুলো আবার বিনিময় করে রাখালরা শিরনির জন্য কেবল ধান, মশলা, পান ইত্যাদি সংগ্রহ করতো।

(প্রতি পর্বে এরকম কোনো ছড়া বা ধাঁধা বা হেঁয়ালি থাকবে। তবে আগামী পর্ব থেকে ভূমিকাটুকু থাকছে না।)
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুলাই, ২০০৯ দুপুর ১:৫৬
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অতিরিক্ত বা অতি কম দুটোই সন্দেহের কারণ

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ৩১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৩০

অনেক দিন গল্প করা হয়না। চলুন আজকে হালকা মেজাজের গল্প করি। সিরিয়াসলি নেয়ার কিছু নেই৷ জোসেফ স্টালিনের গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। তিনি দীর্ঘ ২৯ বছর সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান নেতা ছিলেন। বলা... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সীমানা পিলার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ৩১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৮



বৃটিশ কর্তৃক এদেশে ম্যাগনেটিক পিলার স্থাপনের রহস্য।
ম্যাগনেটিক পিলার নিয়ে অনেক গুজব ও জনশ্রুতি আছে, এই প্রাচীন ‘ম্যাগনেটিক পিলার' স্থাপন নিয়ে। কেউ কেউ এটিকে প্রাচীন মূল্যবান ‘ম্যাগনেটিক’ পিলার... ...বাকিটুকু পড়ুন

মাথায় চাপা ভূত ভূত ভূতং এর দিনগুলি

লিখেছেন শায়মা, ৩১ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৫


এই যে চারিদিকে এত শত কাজ কর্ম, ঝামেলা ঝক্কি, ক্লান্তি শ্রান্তি সব টপকে আমার মাথায় আজও চাপে নানান রকম ভূত। এক ভূত না নামতেই আরেক ভূত। ভূতেদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায় (দ্বিতীয় অংশ)

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ৩১ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:০৫


আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায় (প্রথমাংশ)
আমাদের সদ্য খনন করা পুকুরটা বৃষ্টির পানিতে ভেসে গেল। যা মাছ সেখানে ছিল, আটকানোর সুযোগ রইল না। আমি আর দুইবোন শিউলি ও হ্যাপি জালি... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিজের পাসওয়ার্ড অন্যকে দিবেন না ;)

লিখেছেন অপু তানভীর, ৩১ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:৫৭



কথায় আছে যে পাসওয়ার্ড এবং জাঙ্গিয়া অন্যকে দিতে নেই । মানুষ হিসাবে, বন্ধু হিসাবে প্রেমিক/প্রেমিকা হিসাবে অথবা আজ্ঞাবহ হওয়ার সুবাদে আমরা অন্যকে ব্যবহার করতে দিই বা দিতে বাধ্য হই।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×