somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মুহিব -ফটোগ্রাফিকে ভালবাসতে গিয়ে হারিয়ে গেল চিরদিনের জন্য ।।

২৬ শে জুলাই, ২০০৯ সকাল ১১:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কি রে পানি ধরতে ভ্য় পাচ্ছিস নাকি ? হ্যাঁ -সাঁতার পারিনাত । ধূর বেটা কূয়াকাটা সুন্দরবন ঘুরে এসে এখন হাওড় দেখে ভয় পাচ্ছিস , এটা হল।

সত্যিই তো - হঠাৎ করে যেন সাহস পেল। অভয় দিলাম -ভয় পাসনা, আমি আছিনা, আমি সাঁতার পারি, পড়লে সবার আগে তোকে তুলব চিন্তা করিসনা। এরপর সে আর রনি হাত ধরাধরি করে অনেকক্ষন লঞ্চের কিনারা ছুয়ে যাওয়া উচছল পানিতে পা ডুবিয়ে বসে থাকল। আমরা ছবি তুলতে ব্যস্ত। নতুন অনেকে জানতে চাচ্ছে ভাইয়া এই ছবিটা কিভাবে তুলব , ওটা কিভাবে তুলব। সাজ্জাদ ভাই , সোহাগ ভাই বাবু পার্থ দেখিয়ে দিচ্ছে সবাইকে। মাসুম ভাই আমি ব্যস্ত পৌঁছে র‌্যাফেল ড্র , বিশ্রাম কোথায় , কোন সময় নেয়া হবে সব ঠিক করতে। জনি দেলোয়াড় পুরো আয়োজন তদারকিতে ব্যস্ত।

২৬ শে জুলাই,২০০২ । শাহজালাল ইউনিভার্সিটি ফটোগ্রাফার্স এসোসিয়েশন (সুপা ) এর ফটোগ্রাফী বেসিক কোর্স শেষে আউটিং এর আয়োজন সুনামগঞ্জের ডলুয়া হাওড়ের শেষ সীমানায় সীমান্ত বর্তী এলাকায়।

বেলা সোয়া বার টায় লঞ্চ থেকে আমাদের গন্তব্যস্হল দেখা যাচ্ছিল। এসে গেছি। সবাই নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমন সময় আমাদের লঞ্চ আঁটকে গেল বালুচরে। হাওড়ের একদম মধ্যিখানে।

বামে তাকালে অপর পাড় পর্যন্ত চোখে পড়ে পরিষ্কার হাঁটু পানির নীচে জমাট বালু। মাঝির সহকারী নেমে গেল ধাক্কা দেয়ার জন্য। হাঁটু পানি তাই শর্টস পরে আমিও নামলাম। পানি নিয়ে আমার খুব একটা ভয়ডর নেই। ঘুটঘুটে আঁধারে নৌকা করে সেন্টমার্টিন থেকে টেকনাফের পথেও আমার ভয় লাগেনি শুধু দিক হারানোর চিন্তা ছাড়া। সাথে সাথে আরও দশ বার জন নেমে এল। ধাক্কা দিয়ে সবাই মিলে লঞ্চ ভাসিয়ে দিলাম, গন্তব্য অপর পাড়ে।

বাম পাশে যেহেতু হাঁটু পানির বালুচর সেহেতু ডান দিকে ও এমন হবে আমাদের বোকা মস্তিস্ক এই ধারনা তৈরী করে নিল। মাঝিও নিষেধ না করায় কেউ আর লঞ্চ এ উঠলামনা। লঞ্চ চলে গেল।

ধরনী কখনও মানুষের কথায় দ্বিধা হয় কিনা জানিনা তবে সেদিন সে নিজে নিজেই হয়ে ছিল। হয়েছিল মৃত্যুকূপ।

আরও পনের বিশ মিটার আমরা সবাই মিলে দাপাদপি করে বেড়ালাম। হঠাৎ করে যেন পায়ের নীচে কিছু নেই।

সবাই ভাসতে লাগলাম। সামনের কূল প্রায় পঞ্চাশ মিটার দূরে। চূড়ান্ত বিপদের মুখোমুখি হয়ে কারো মাথায় কাজ করছিলনা। পিছনে সামান্য ফিরে আসলেই বালুতে দাঁড়ানো যায় , কিন্তু সেই দিকে না ফিরে সবাই অনিশ্চয়তাকে সঙ্গী করে কেন জানি সামনের দিকে ঠাঁয়বিহীন পানিতে ঠাঁয় খুজতে লাগলাম।

মাথা তুলে আশেপাশে দেখি একজন অন্যজন থেকে অনেকদূরে। আমার খুব কাছে মুহিব আর অপু। তিনজন হাত ধরাধরি করে কিভাবে যেন ডুবন্ত একটা বালির ঢিবিতে দাঁড়াতে পারলাম। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সে ঢিবিও মিলিয়ে গেল। অপু হালকা সাঁতার জানে , অন্তত ভেসে থাকতে জানে। মুহিব কিছুই না।

হালকা স্রোত বহমান , পাহাড়ি খরস্রোতা নদীতে। মুহিব এর সাথে শেষ স্মৃতিটুকু এই , আমি সে আর অপু তিনজন হাত ধরে আছি। দুজনের পরনেই ছিল জিন্সের প্যান্ট।

হঠাৎ মনে হল আমি তলিয়ে যাচ্ছি , দম বন্ধ হয়ে আসছে। এরপর কিছু সময় কোন স্মৃতি নেই। ওদের চাপে আমি তলিয়ে গিয়েছিলাম। খানিকপর পানিতে ভেসে উঠলাম। আশেপাশে কেউ নেই। হাত পা অচল হয়ে গিয়েছিল। সাঁতার জানা আমিও সাঁতার ভুলে গেছি।

শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। কোন মতে চিত হলাম পানিতে। স্রোতের হাতে নিজেকে সপে দিয়ে একসময় কূলে আসলাম।

পাড়ে উপুড় হয়ে পড়ে আছি এমন সময় অপুকে ভাসতে দেখলাম। সেও ভেসে ভেসে কূলে আসল। আমাদের লঞ্চটি ততক্ষনে কূল থেকে এসে উদ্ধার শুরু করেছে। ছয় জনকে তোলা হয়েছিল। রিয়াজকে শেষ মুহুর্তে তোলা হল , ডুবন্ত মাথাটা দেখা যাচ্ছিল। বেঁচে গিয়ে ও ছবি তোলায় ছেড়ে দিয়েছিল।

ধাতস্ত হয়ে উঠে বসতেই রূমমেট বাবু পার্থ এসে জড়িয়ে ধরল। কেউ একজন চিৎকার করছিল দুজনকে পাওয়া যাচ্ছেনা -মুহিব আর রবিন।

রবিন , ঐদিন সকালেই ওর সাথে পরিচয় হয়েছিল। প্রথমে ভাইয়া ডাকছিল। পরে জানা গেল আমাদের ব্যাচের অর্থনীতিতে পড়ে। সাঁতার জানলেও ভারী জিন্সের বদৌলতে ভাগ্যের নির্মমতায় সে হারিয়ে গেল। পাড় থেকে দেখে অনেকে চিৎকার করলেও উদ্ধারকারী লঞ্চ তার কাছে পৌছতে পারেনি।

মুহিব আমার এক বছরের জুনিয়র। সুপাতে পরিচয়। সুপার সপ্তম আলোকচিত্র প্রদর্শনীর প্রধান সমন্বয়কারী আমি , সে আমার সহকারী। কখনও না বলতনা , কাজ করতে করতে একসময় ঘনিষ্ঠতার চূড়ান্ত হয়ে গেল।

প্রায়ই বাসায় আসত। সারাদিন বসে বসে পিসিতে গেম আমার কাছে অসহ্য লাগে এটা জেনে সে দ্বিগুন উৎসাহ নিয়ে আমার রূমে তাই করত।

বিশ্বকাপ ফুটবল ২০০২ শুরুর সাথেসাথে কাপড়চোপড় নিয়ে হাজির। কিরে তুই ! আপনাদের সাথে খেলা দেখব। বেটা জুনিয়র নিজের বাসায় যা। না যাচ্ছিনা , এখানেই থাকব খেলা দেখব। আচ্ছা যা থাকতে পারবি তবে শর্ত হল খেলা দেখার সময় চা বানাইয়া খাওয়াবি। রাজি হয়ে শুধু চা না পুডিং ও বানিয়ে খাওয়াল।

আর্জেন্টিনা হারল -আমার প্রিয়দল হারাতে তার খুশীর সীমা নেই। মগ ভর্তি চা দিয়ে বলল খান মাথা ঠান্ডা হবে। পরের ম্যাচে ব্রাজিল জিতায় তাকে ঘর থেকে বের করে দিলাম। তুই তোর বাসায় যা-অনেক হইছে। প্রতি রাতে ডাইরী লিখত মুহিব, ব্যাগ ডাইরী গুছিয়ে চলে গেল।

পরদিন আবার এসে হাজির। তুই আবার। খেলা দেখে মজা পাচ্ছিনা -তাই চলে আসছি। কার্ড খেলতে পারতনা -আমরা খেলতাম ও দেখত , শিখতে চেয়েছিল -শিখা হলোনা।

সামার ভ্যাকেশনে আমি , আরজু , বাবু , রনি কূলাউড়া যাব শবনম আপুদের বাড়ীতে। আমরা তাকে নিবনা , সে যাবে কারন শবনম আপুও তাকে যেতে বলেছে। ঐ বেটা জুনিয়র আমাদের সাথে তোর কিরে । মন খারাপ করে রয়ে গেল। খুব পছন্দ করলে তাকে বুঝতে দেয়া উচিত নয় আগে তাই ভাবতাম। মন খারাপ করলেও কিছু প্রকাশ করেনি।ফিরে এসে দুদিনের সব গল্প বলে কথা দিলাম পরেরবার তোকেও নিব। নিয়তি আর সে সুযোগ দিলনা।

নিয়মিত নামায পড়ত , কখনও মন খারাপ অবস্হায় তাকে দেখিনি। শামসীর ভাই - ঢাকায় গেলে আমাদের বাসায় অবশ্যই আসবেন। মুহিব তোর বাসায় গিয়েছিলাম - শুধু তুই ছিলিনা।

মুহিব-দুদিন পর তোকে খুঁজে পেয়েছিলাম , লঞ্চে বসা তোর হাসিমুখটা মনে রাখতে চেয়েছিলাম। বন্ধু জয় তা হতে দেয়নি। কিরে তোর ছোট ভাইটিকে শেষ বারের মত দেখবিনা - সেই আকুতি ভরা অসহায় মুখ দেখে বিশ্বাস কর আজও আমি আমাকে ক্ষমা করতে পারিনি।

এক সপ্তাহ পর মোটামুটি ধাত্স্হ হয়ে ঢাকায় তোর বাসায় গেলাম। গাজীপুরের কাপাসিয়ায় তোর কবরের কাছে গিয়ে বিশ্বাস করতে পারছিলামনা আমার প্রিয় ছোট ভাইটি এখানে শুয়ে আছে। বৃষ্টি তোর শেষ ঠিকানটুকু ভিজিয়ে দিচ্ছিল। পানিই যেন তোর অন্তিম নিয়তি। রাসেল সাজ্জাদ শিশির ভাই , বাবু পার্থ আমি অনেকক্ষন বসেছিলাম। তুই কি আমাকে ক্ষমা করেছিস ?

সাঁতার জানা আমি বলেছিলাম পড়ে গেলে তোকে সবার আগে তুলব। পারিনি , স্বার্থপরের মত শুধু নিজে বেঁচেছি।

তোকে দেখে ফিরে আসার পথে টঙ্গী হাসটাতালের সামনে আমাদের মাইক্রোবাস ট্রাকের সাথে লেগে দুমড়ে মুচড়ে গেল। সবাই আবারও কিভাবে যেন বেঁচে গেলাম। ড্রাইভারকে বের করতে গাড়ির সামনের অংশ কাটতে হয়েছিল , সামনে বসা আমার আর শিশির ভাইয়ের কিছুই হলনা। ভাই তুই হয়ত ক্ষমা করেছিস , রাগ করেত বেশীক্ষন থাকতে পারতিনা , এইজন্য আল্লাহও মনে হয় আমাদের আবার বাঁচিয়ে দিলেন।

তুই তোর বাবা মার একমাত্র ছেলে। তোর মার মুখোমুখি বসে কেউ কোন কথা বলতে পারিনি। কি বলব - সবাই আছি শুধু তুই ঘরে নেই। কিছু বলা হয়নি - অনেকক্ষন বসে সবাই একসাথে বিদায় নিয়েছি।

ঢাকায় থাকি, কিন্তু কেন জানি তোর বাসায় যাবার শক্তি, সাহস খুঁজে পাইনা। 7TH PHOTOGRAPH EXHIBITION তোর লাগানো এই পোষ্টারটি যতদিন ছিলাম লাইব্রেরীর উপরে লাগানো ছিল।আমরা মুছতে পারিনি।

তোকে কিভাবে হারিয়েছি , তুই সুপা পরিবারের কত আপন ছিলি সেটা আমরা জানি । জানি তোকে রবিনকে আর কখনও ফিরে পাবনা, পরমকরুনাময়ের কাছে তোরা শান্তিতে থাক ,যতদিন বাঁচি এই কামনায় করে যাব।
৪০টি মন্তব্য ৩০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অতিরিক্ত বা অতি কম দুটোই সন্দেহের কারণ

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ৩১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৩০

অনেক দিন গল্প করা হয়না। চলুন আজকে হালকা মেজাজের গল্প করি। সিরিয়াসলি নেয়ার কিছু নেই৷ জোসেফ স্টালিনের গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। তিনি দীর্ঘ ২৯ বছর সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান নেতা ছিলেন। বলা... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সীমানা পিলার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ৩১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৮



বৃটিশ কর্তৃক এদেশে ম্যাগনেটিক পিলার স্থাপনের রহস্য।
ম্যাগনেটিক পিলার নিয়ে অনেক গুজব ও জনশ্রুতি আছে, এই প্রাচীন ‘ম্যাগনেটিক পিলার' স্থাপন নিয়ে। কেউ কেউ এটিকে প্রাচীন মূল্যবান ‘ম্যাগনেটিক’ পিলার... ...বাকিটুকু পড়ুন

মাথায় চাপা ভূত ভূত ভূতং এর দিনগুলি

লিখেছেন শায়মা, ৩১ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৫


এই যে চারিদিকে এত শত কাজ কর্ম, ঝামেলা ঝক্কি, ক্লান্তি শ্রান্তি সব টপকে আমার মাথায় আজও চাপে নানান রকম ভূত। এক ভূত না নামতেই আরেক ভূত। ভূতেদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায় (দ্বিতীয় অংশ)

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ৩১ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:০৫


আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায় (প্রথমাংশ)
আমাদের সদ্য খনন করা পুকুরটা বৃষ্টির পানিতে ভেসে গেল। যা মাছ সেখানে ছিল, আটকানোর সুযোগ রইল না। আমি আর দুইবোন শিউলি ও হ্যাপি জালি... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিজের পাসওয়ার্ড অন্যকে দিবেন না ;)

লিখেছেন অপু তানভীর, ৩১ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:৫৭



কথায় আছে যে পাসওয়ার্ড এবং জাঙ্গিয়া অন্যকে দিতে নেই । মানুষ হিসাবে, বন্ধু হিসাবে প্রেমিক/প্রেমিকা হিসাবে অথবা আজ্ঞাবহ হওয়ার সুবাদে আমরা অন্যকে ব্যবহার করতে দিই বা দিতে বাধ্য হই।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×