somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রাচীন ফিনিসিয় জাতি।

২৫ শে জুলাই, ২০০৯ সকাল ১০:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



জীবনানন্দ দাশের ‘নগ্ন নির্জন হাত’ কবিতার চারটে লাইন এরকম-

ভারতসমুদ্রের তীরে
কিংবা ভূমধ্যসাগরের কিনারে
অথবা টায়ার সিন্ধুর পারে
আজ নেই, কোনো এক নগরী ছিল একদিন ...

টায়ার সিন্ধুর পারে ...এই টায়ার নগরেই এককালে বাস করত প্রাচীন ফিনিসিয় জাতি। এখন যে দেশটা লেবানন-খ্রিস্টপূর্ব যুগে সেখানেই ছিল বালবেক, ক্যাসেরিয়া, কার্থেজ, জারেপথা, টায়ার সিদন আর বিবলস নামে বেশ কটি নগর। সেসব নগরে বাস করত ফিনিসিয়রা। বড় বিস্ময়কর এক জাতি। ভীষণ উন্নত। সেকালেই হাতির খামার ছিল ওদের। এমন কী দন্তচিকিৎসাও জানত ওরা। মধ্যপ্রাচ্যে প্রথম সংসদ অধিবেশনের আয়োজন করেছিল তারাই। ফিনিশিয়রা সভ্যতায় যা তা জাতি ছিল না। প্রমাণ? ওদের বর্ণমালা থেকেই ইউরোপ পেয়েছে বর্ণমালা । শুধু তাই নয়। মুসা নবীর বাইবেলের প্রথম পাঁচটি অধ্যায় (পেন্টাটিউক বা তোরা নামে যা পরিচিত ছিল) ফিনিসিয় অক্ষরে লিখিত।




পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর; পুবে ফিনিসিয়া।


সেই খ্রিস্টপূর্ব যুগেই ফিনিসিয় নির্মান শিল্পীরা ছিল অতুলনীয় শিল্পপ্রতিভার অধিকারী। উল্লেখিত টায়ার নগরীটিতে ছিল মেলকারট নামে একটি ফিনিসিয় উপাসনালয়। কেন এই প্রসঙ্গটি তুললাম? তার কারণ আছে।
আমরা জেরুজালেমে সলোমনের প্রার্থনাগৃহ কথা জানি- যেটি পরবর্তীকালে রোমানরা পুড়িয়ে দিয়েছিল; তার আগে যেটি নির্মানে ঐ টায়ার নগরীর মেলকারট উপাসনাগৃহের শৈলীর অনুকরন করা হয়েছিল । কথা আরও আছে। ফিনিসিয়ার ভূপ্রকৃতি ঈষৎ রুক্ষ হলেও ঐ অঞ্চলের সিডার গাছগুলি ছিল দুর্দান্ত । যে কারণে জেরুজালেমের সলোমনের প্রার্থনাগৃহটি নির্মানকালে ফিনিসিয় সিডার গাছ ব্যবহার করা হয়েছিল। এমন কী ...মিশরের ফারাওরাও ঘরবাড়ি ও আসবাবপত্র নির্মানের জন্য ব্যবহার করতেন ফিনিসিয় সিডার গাছ ।



এই সেই বিখ্যাত ফিনিসিয় সিডার গাছ

খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ ফিনিসিয় সভ্যতার রাজধানী ছিল বিবলস। বিবলস শব্দটির মানে যেখানে প্যাপিরাস (মিশরের সেই লেখার জিনিস...) বিক্রি হয়। বাইবেলের নামটি এসেছে ওই বিবলস থেকেই। এবার বুঝুন। রাজধানী দীর্ঘকাল একই জায়গায় থাকে না। ফিনিসিয় সভ্যতার রাজধানী এরপর স্থানান্তরিত হয় টায়ারে। খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ অবধি টায়ারই ছিল ফিনিসিয়দের রাজধানী।



এককালের সেই টায়ার নগরী



বালবেক নগর

হোমারের ইলিয়াদ ও ওদেসিতেও ফিনিসিয়দের কথা রয়েছে। আসলে ওরা ভূমধ্যসাগরের পূর্বতীরের আদি বাসিন্দা। একালের ডি এন এ পরীক্ষাও তাইই বলে। ফিনিসিয় নামটা দিয়েছিল গ্রিকরা। গ্রিক ভাষায় ফিনিসিয় অর্থ- টকটকে লাল। তা এরকম নাম দেওয়ার কি কারণ? ফিনিসিয়রা এক ধরনের সামুদ্রিক মাছের খোলা দিয়ে বেগনী রং তৈরি করত কাপড় রং করার জন্য। সেই কাপড় বেচেই প্রভূত ধনরতেœর অধিকারী হয়েছিল তারা। ফিনিশিয়দের রাজটিই ছিল বাইবেলবর্ণিত প্রাচীন সেই কেনান দেশ। ইহুদিরা কেনানিদের বলত ব্যবসায়ী। ফিনিশিয়দের প্রধান পেশাই ছিল ব্যবসা।



দেবতা বাল



দেবী অ্যাশতারতে

ফিনিসিয়রা বাস করত নগররাষ্ট্রে। ছিল বহুদেবতায় বিশ্বাসী। উপাসনা করত নানা উর্বরা শক্তির দেব দেবীর । প্রধান দেবীর নাম অ্যাশতারতে। সেই দেবীর এমনই মোহনী শক্তি যে- বৃদ্ধ বয়েসে এমন কী ইহুদিদের রাজা সলোমনও দেবীর অ্যাশতারতে এর উপাসক হয়ে উঠেছিলেন! ফিনিসিয়দের প্রধান দেবতার নাম ছিল বাল। দেবতা বাল-এর উপসনালয়ে শিশু বলির কথা শোনা যায়! যাক। তবে গ্রিক ও রোমান প্যাগান ধর্মবিশ্বাসও নাকি ফিনিসিয়ায় প্রভাব বিস্তার করেছিল। এমনটা হতেই পারে। তবে খ্রিস্টানধর্মের প্রচারের শুরুতেই ফিনিসিয় জনগন ধর্মটি সাদরে গ্রহন করে। স্বয়ং যিশু নাকি ফিনিসিয়ায় গিয়েছিলেন লোককে ধর্মপথে ফেরাতে। যিশুর কথায় বিশ্বাস
করেছিলেন একজন ফিনিশিয় নারী ।



প্রাচীন ফিনিসিয় উপাসনালয়ের ধ্বংসাবশেষ; এখানে শিশুবলিও নাকিও হত!

ফিনিসিয়রা মূলত ছিল ব্যবসায়ী । ভূমধ্যসাগরজুড়ে ছিল তাদের অবাধ যাতায়ানত। তারা উপনিবেশ গড়ে ছিল সাইপ্রাস, স্পেন ও জিবরালটারে। ব্রিটেন নামটির স্মৃতিও সঙ্গেও ফিনিসিয়রা জড়িত । ফিনিসিয়রা টিন নিত প্রাচীন ব্রিটেন থেকে। ফিনিসিয় ভাষায় বার মানে (জমি) আর টাননিক মানে। (টিন)। এভাবেই ব্রিটেন নামের সৃষ্টি। অনেকে বলে নামটি রোমানরা। কথাটি সত্য নয়।




ফিনিসিয় জাহাজ

ফিনিসিয়রা ছিল দক্ষ নাবিক। তারাই প্রথম ভূমধ্যসাগরের পূর্বতীর থেকে আফ্রিার উপকূলে পৌঁছে গিয়েছিল। নৌচলাকালীন সময়ে তারা দিকনির্দেশনা পেত মেরুনক্ষত্রের অবস্থান থেকে। এমনও বলা হয় যে ... সেই খ্রিস্টপূর্ব যুগেই নাকি ফিনিসিয় জাহাজ পৌঁছে গিয়েছিল উত্তর আমেরিকায়! এমন দাবীর সপক্ষে অবশ্য কোনও প্রমাণ নেই। যাই হোক। ফিনিসিয়রা ছিল দক্ষ জাহাজনির্মাতা। সেকালের সাম্রাজ্যলোভী নৃপতিরা ফিনিসিয় জাহাজনির্মানশিল্পীদের দিয়েই তৈনি করিয়ে নিত রণজাহাজ ।




এই ছবিটা দেখে ধারনা করা যেতে পারে সেকালে ফিনিসিয়দের মেক আপ গেটআপ কেমন ছিল ...

যুগ যুগ ধরে যুদ্ধবাজরা ফিনিসিয়া আক্রমন করেছে। যেমন, মিশর, আরিরিয়া, ব্যাবিলন, মেসিডন, পারস্য ও রোমান। ফিনিসিয়া ব্যবসায়ী ছিল যোদ্ধা না। কাজেই বৈদেশিক আগ্রাসন ঠেকাতে পারেনি। তবে সব বৈদেশিক আক্রমনই যে অশুভ ফল বয়ে এনেছিল-তা নয়। একটা উদাহরণ দিই। এখনকার লেবাননের রাজধানী বৈরুত শহরের প্রাচীন নাম ছিল বেরিটাস। রোমান যুগে বৈরুতে আইন নিয়ে পড়ার বিদ্যাপীঠ গড়ে উঠেছিল।



ফিনিসিয় শিল্পের নমুনা



মুদ্রা



ফিনিসিয় নারী (একালের শিল্পীর চোখে)

মালটার লোকেরা আজও নাকি ফিনিসিয় ভাষায় কথা বলে । অবিকৃত অবশ্য নয়। কেননা, ভাষা বদল যায়। অক্ষরও। আজ রোমান হরফ দেখে কে বলবে যে এককালে ওগুলো সৃষ্টি করেছিল ফিনিসিয়রা।





ফিনিসিয় বর্ণমালা




এতক্ষন আমি প্রাচীন ফিনিসিয় সভ্যতা সম্পর্কে যা লিখেছি তাতে ফিনিসিয়দের সম্বন্ধে কতদূর বোঝা গেল বলতে পারি না। অনুভূতিই যেহেতু আসল। আমি যা লিখলাম সেসব পড়ে অনুভূতি তৈরি নাও হতে পারে। আমার কেন জানি মনে হয় প্রাচীন ফিনিসিয় সভ্যতাকে একটু অন্যভাবে দেখলে অনুভূতি তৈরি হলেও হতে পারে, যদি আমরা তথ্য ও তত্ত্বের ভার এড়িয়ে ফিনিসিয়াকে কবির চোখে দেখি-জীবননান্দের চোখে দেখি।
সে উদ্দেশ্যেই কবির ‘নগ্ন নির্জন হাত’ কবিতাটি পাঠ করা যাক-

আবার আকাশে অন্ধকার ঘন হয়ে উঠেছে:
আলোর রহস্যময়ী সহোদরার মতো এই অন্ধকার।
যে আমাকে চিরদিন ভালোবেসেছে
অথচ যার মুখ আমি কোনাদিন দেখিনি,
সেই নারীর মতো
ফাল্গুন আকাশে অন্ধকার নিবিড় হয়ে উঠেছে।

মনে হয় কোনো বিলুপ্ত নগরীর কথা
সেই নগরীর এক ধুসর প্রাসাদের রূপ জাগে হৃদয়ে।

ভারত সমুদ্রের তীরে
কিংবা বূমধ্যসাগরের কিনারে
অথবা টায়ার সিন্ধুর পারে
আজ নেই কোনা এক নগরী ছিল একদিন,
কোনো এক প্রাসাদ ছিল;
মূল্যবান আসবাবে ভরা এক প্রাসাদ;
পারস্য গালিচা, কাশ্মিরী শাল, বেরিন তরঙ্গের নিটোল মুক্তা প্রবাল,
আমার বিলুপ্ত হৃদয়, আমার মৃত চোখ, আমার বিলীন স্বপ্ন আকাঙ্খা;
আর তুমি নারী-
এই সব ছিল সেই জগতে একদিন।

অনেক কমলা রঙের রোদ ছিল,
অনেক কাকাতুয়া পায়রা ছিল,
মেহগনির ছায়াঘর পল্লব ছিল অনেক;

অনেক কমলা রঙের রোদ ছিল;
অনেক কমলা রঙের রোদ;
আর তুমি ছিলে;
তোমার মুখের রূপ কত শত শতাব্দী আমি দেখি না,
খুঁজি না।

ফাল্গুনের অন্ধকার নিয়ে আসে সেই সমুদ্রপারের কাহিনী,
অপরূপ খিলারও গম্বুজের বেদনাময় রেখা,
লুপ্ত নাশপারিত গন্ধ,
অজস্র হরিণ ও সিংহের ছালের ধুসর পান্ডুলিপি,
রামধনু রঙের কাচের জানালা
ময়ুরের পেখমের মতো রঙিন পর্দায় পর্দায়
কক্ষ ও কক্ষান্তর থেকে আরো দূর কক্ষ ও কক্ষান্তরের
ক্ষণিক আভাস-
আয়ুহীন স্তব্ধতা ও বিস্ময়।

পর্দায়, গালিচায় রক্তাভ রৌদ্রের বিচ্ছুরিত স্বেদ,
রক্তিম গেলাসে তরমুজ মদ!
তোমর নগ্ন নির্জন হাত;
তোমার নগ্ন নির্জন হাত।

সর্বশেষ এডিট : ০১ লা অক্টোবর, ২০০৯ রাত ৯:২৭
২৬টি মন্তব্য ২৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা

লিখেছেন জানা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৬



২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেভাবে শরণার্থীরা একটি দেশের মালিক হয়ে গেলো!

লিখেছেন মাঈনউদ্দিন মইনুল, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২৬



এবার একটি সেমিনারে প্রথমবারের মতো একজন জর্ডানির সাথে পরিচয় হয়। রাসেম আল-গুল। ঘনকালো মাথার চুল, বলিষ্ট দেহ, উজ্জ্বল বর্ণ, দাড়ি-গোঁফ সবই আছে। না খাটো, না লম্বা। বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। প্রতিটি সেশন... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিউ ইয়র্কের পথে.... ২

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২


Almost at half distance, on flight CX830.

পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×