somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শাটল ট্রেনের প্রথম দিন

২০ শে জুলাই, ২০০৯ বিকাল ৩:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দিনটি খুব আগের নয়। আমি সকাল সাড়ে-সাতটায় গিয়ে ষোলশহর রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে হাজির হলাম। গিয়ে দেখি মানুষজন নেই খুব একটা। আমার সন্দেহ হল, এখান থেকেই চট্টগ্রাম ভার্সিটির ট্রেন ছাড়েতো? আমি নিতান্ত গেঁয়ো মার্কা এক তরুণ। কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রীকে দেখা যাচ্ছে বটে। তবুও সংশয় দূর হলনা। ক্ষণিক বাদে আমার বন্ধু মামুন উপস্থিত হল। আগে থেকেই পরিকল্পনা ছিল আমরা একসাথেই ভার্সিটিতে ঘুরতে যাব। কিছুটা স্বস্তি পেলাম সঙ্গীর খোঁজ পেয়ে। ধীরে ধীরে ভীড় বাড়তে লাগল স্টেশনে। আমার দারুণ নার্ভাস লাগছে। মনে হচ্ছে উপস্থিত সবাই এই গোবেচারার দিকে তাকিয়ে আছে। নতুন এই জগতের মধ্যে নগণ্য মানুষ মনে হচ্ছে নিজেকে। সময় গড়াতে গড়াতে একসময় দেখা গেল ডান কিংবা বাঁ যেদিকে তাকাই ছাত্র-ছাত্রী ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আমি উদ্বিগ্ন। কারণ এতগুলো ছাত্র-ছাত্রী যদি একটা ট্রেনের পেছনে হিড়িক দেয় তাহলে হুলুস্থূল কান্ড হবে। নিজের মাংসপেশীর দিকে তাকালাম। অপেক্ষমান ছাত্র-ছাত্রীদের দিকে তাকালাম। নিজের শরীরের সাথে এদের শরীরের তুলনা করে শিউরে উঠলাম। এদের শরীরের চাপে আমার ছোটখাট শরীরখানা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে! তবুও নিজেকে প্রবোধ দিলাম, ছেলেদের সাথে না পারিতো অন্তত মেয়েদের সাথে টেক্কা দেয়া যাবে। এই প্রথম ছেলে হয়ে জন্মালাম বলে গর্ববোধ করলাম। তারপর আবার নিজেই নিজের মাথায় একখানা চাঁটি বসিয়ে নিজেকে শাসন করলাম, “‌কি সব আজেবাজে ভাবছিস!” সোয়া আটটার কিছু পরে ট্রেনের আওয়াজ শোনা গেল। শুরু হল আমার মানষিক প্রস্তুতি। ট্রেন থামছে। এখনি ঝাঁপিয়ে পড়ব। মহাযুদ্ধ হবে। করলামও তাই। প্রথমে মনে হল নাড়িভুঁড়ি সব বেরিয়ে যাবে। কিন্তু নিজেকে অবাক করে দিয়ে একেবারে আগে আগেই উঠে পড়লাম ট্রেনে। ট্রেনে উঠার সিঁড়িতে তখন ভয়ংকর অবস্থা। দারুণ ধস্তাধস্তি চলছে। সবাই ট্রেনে উঠার জন্য দরজার হাতলটা দখল করার চেষ্টা করছে। আমার ক্ষণিক পরে আমার বন্ধুটিও উঠে এল। ট্রেনে কোন সীট খালি নেই। তবুও ধীরে ধীরে বগির শেষ প্রান্ত পর্যন্ত এগিয়ে গেলাম। বগিটির সর্বশেষে নিজের বাঁ দিকের দুটি সীটই খালি। খুশিতে ডগমগ করে উঠল মন। আমাদের জন্যই বুঝি সীট দুটি রাখা ছিল। সীটে কিছু ধুলো ময়লা আছে বটে। সেগুলো পরিস্কার করে পরম শান্তিতে বসে গেলাম। আমাদের সীটগুলোই এ বগির সর্বশেষ সীট। সুতরাং সামনে লোহার পাত ছাড়া কিছুই নেই। সেখানে একটি লেখা চোখে পড়ল “যোগ্যতা বুঝে বাজান।” অবশ্য মহান বাণীটি কার তার কোন উল্লেখ নেই। আমি কথাটির মর্মভেদ করার চেষ্টা করছি। মাথার সব গিলু দিয়ে সর্বান্তঃকরণে বুঝার চেষ্টা করছি। এখানে কি কোন বাদ্য-বাজনা বাজানো হয়? এ নিয়েই চিন্তা করছি। তখন আমার সামনে এক সিগারেটধারী হাজির হল। জ্বলন্ত সিগারেট তার হাতে। আমার দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বলল, “ভাইজান, উপরে উঠে বসেন।” আমি তার কথার আদিঅন্ত কিছুই বুঝতে পারলাম না। ধারণা হল আমার সীটখানা দখল করার পাঁয়তারা করছে সিগারেটধারী। আমি বাজখাঁই গলায় বললাম, “আপনার উপরে বসতে ইচ্ছে হলে আপনি বসেন।” নিজের গলার আওয়াজ শুনে নিজের কানেই ঝাঁঝাঁ লাগল। এবার দ্ধিতীয় আরেক ব্যক্তি সীটের হেলান দেয়ার স্থানে হাত রেখে বলল, “ভাইজান, এখানে উঠে বসেন। এখানে সবাই এভাবেই বসেন।” আমি আমার চারপাশে নজর বুলিয়ে দেখলাম। কই! কেউতো উপরে উঠে বসেনি। আমি কেন বসব? দেখি, আমার পাশে শালা মামুনটা দাঁড়িয়ে পড়েছে। রীতিমত ভয় পেয়ে গেছে। ভয় আমিও অবশ্য কম পাইনি। প্রথম শাটল ট্রেনে উঠেছি, হাবভাব কিছু বুঝিনা। তাই কোন ঝামেলা না করে দাঁড়িয়ে সবার মাথার উপর অর্থাৎ সীটের যে জায়গায় সবাই পিঠখানা লাগিয়ে হেলান দিচ্ছে আমি তার উপর বসার চিন্তা-ভাবনা করছি। তখন তৃতীয় এক ব্যক্তি আমরা যে নতুন বুঝতে পেরেই বোধহয় নরম সুরে বলল, ভাইয়া, “আমার এখানে একটু গান-বাজনা করি। আপনারা একটু উপরে উঠে বসে আমাদের জায়গা করে দিলে সুবিধে হয়।” এবার মুটামুটি ব্যাপারটি আমার মাথায় ঢুকল। আমিও উপরে উঠে বসলাম। তখনি দেখি ট্রেনের বগির ধাতুতে হাতের আঘাতে দারুণ বাজনা বাজানো হচ্ছে। এতক্ষণে আমি “যোগ্যতা বুঝে বাজানথাটির মর্মভেদ করলাম।” যে ছেলেটি বাজাচ্ছে সুন্দরই বাজাচ্ছে অর্থাৎ তার যোগ্যতা আছে। ভালোই লাগছে। তার সাথে কয়েকজন গলা ছেড়ে গান গাইছে। পরিবেশটা জমে উঠেছে। আমি কোনমতে সীটের উপর দাঁড়িয়ে আছি। যাকে বসাও বলেনা। আবার দাঁড়ানোও বলা যায় না। খুব অসুবিধা হচ্ছে। একেবারে ঝুলন্ত অবস্থা। ট্রেন দুললে আমিও দুলছি। ট্রেন হঠাৎ হঠাৎ থামছে কিংবা গতি কমছে ট্রেনের। সম্ভবত কোন ক্রসিং নতুবা স্টেশনে। আবার মাঝে মাঝে গতি বাড়ছে। ঝুলন্ত অবস্থায় ভয়ও লাগছে। এতগুলো লোকের সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলে ভয়ংকর কাণ্ড হবে। তাছাড়া এর আগে অনেকদিন ট্রেনে চড়া হয়নি। আমার সীট থেকে বাইরের কিছু দেখা যাচ্ছিলনা। তবুও মাঝে মাঝে মুখ বাড়িয়ে দেখছি বাইরে। সেখানে শুধু সবুজ আর সবুজ। দৃশ্যগুলো খাঁটি গ্রামের মত। ট্রেনের উদ্যমী ছেলেরা একের পর এক গান গেয়ে চলেছে। সাথে বাদ্যও বাজছে সমান তালে। বিনে পয়সায় গান শুনছি। এরকম ভাগ্য কি সবসময় হয়! কিছুক্ষণ পর গাইয়ে আর বাদকদের ছত্রভঙ্গ হল। নতুন বাদক শুরু করল বাজনা। এই বাদক একেবারেই আনকোরা। দমাদম হাত দুটো পিটিয়ে চলেছে ট্রেনে। নিজের হাতের আয়ু কমিয়ে ফেলছে। এমন বেসুরো বাদ্য কেউ বাজায়! ব্যাটা বৃথা এনার্জি আর ক্যালরি খরচ করছে। কানে যন্ত্রণার মত লাগছে। আগের জনকে যদি আমি একশতে নব্বুই দিই একে ডাবল জিরোর চেয়ে বেশী দেয়া যায় না। আমার ইচ্ছে হল, তাকে হাতের আঙ্গুল দিয়ে ভাল করে দেখিয়ে দিই মহান বাণীটা “যোগ্যতা বুঝে বাজান।” এবাণী তার উপর প্রযোজ্য। কিন্তু সাহসের অভাবে পারলাম না। তবে গান তখনো সমান তালে চলছে। বেসুরো বাধ্য আমাদের বেশীক্ষণ শুনতে হলনা। ট্রেন হঠাৎ ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল। প্রথমে বুঝতে পারিনি ভার্সিটিতে চলে এসেছি। সবাই যখন দরজার দিকে পা বাড়াচ্ছে তখনি বুঝলাম পৌঁছে গেছি ভার্সিটিতে। আমি আর মামুন দরজার দিকে ধীরে ধীরে পা বাড়ালাম। ট্রেন থেকে নেমেই অনুভব করলাম। আজ শুধু আমার শাটল ট্রেনেই প্রথম দিন নয়। চট্টগ্রাম ভার্সিটিরও প্রথম দিন বটে!
৫টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সীমানা পিলার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ৩১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৮



বৃটিশ কর্তৃক এদেশে ম্যাগনেটিক পিলার স্থাপনের রহস্য।
ম্যাগনেটিক পিলার নিয়ে অনেক গুজব ও জনশ্রুতি আছে, এই প্রাচীন ‘ম্যাগনেটিক পিলার' স্থাপন নিয়ে। কেউ কেউ এটিকে প্রাচীন মূল্যবান ‘ম্যাগনেটিক’ পিলার... ...বাকিটুকু পড়ুন

মাথায় চাপা ভূত ভূত ভূতং এর দিনগুলি

লিখেছেন শায়মা, ৩১ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৫


এই যে চারিদিকে এত শত কাজ কর্ম, ঝামেলা ঝক্কি, ক্লান্তি শ্রান্তি সব টপকে আমার মাথায় আজও চাপে নানান রকম ভূত। এক ভূত না নামতেই আরেক ভূত। ভূতেদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায় (দ্বিতীয় অংশ)

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ৩১ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:০৫


আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায় (প্রথমাংশ)
আমাদের সদ্য খনন করা পুকুরটা বৃষ্টির পানিতে ভেসে গেল। যা মাছ সেখানে ছিল, আটকানোর সুযোগ রইল না। আমি আর দুইবোন শিউলি ও হ্যাপি জালি... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিজের পাসওয়ার্ড অন্যকে দিবেন না ;)

লিখেছেন অপু তানভীর, ৩১ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:৫৭



কথায় আছে যে পাসওয়ার্ড এবং জাঙ্গিয়া অন্যকে দিতে নেই । মানুষ হিসাবে, বন্ধু হিসাবে প্রেমিক/প্রেমিকা হিসাবে অথবা আজ্ঞাবহ হওয়ার সুবাদে আমরা অন্যকে ব্যবহার করতে দিই বা দিতে বাধ্য হই।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শৈল্পিক চুরি

লিখেছেন শেরজা তপন, ০১ লা জুন, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭


হুদিন ধরে ভেবেও বিষয়টা নিয়ে লিখব লিখব করে লিখা হচ্ছে না ভয়ে কিংবা সঙ্কোচে!
কিসের ভয়? নারীবাদী ব্লগারদের ভয়।
আর কিসের সঙ্কোচ? পাছে আমার এই রচনাটা গৃহিনী রমনীদের খাটো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×