somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

ফকির ইলিয়াস
আলোর আয়না এই ব্লগের সকল মৌলিক লেখার স্বত্ত্ব লেখকের।এখান থেকে কোনো লেখা লেখকের অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা, অনুলিপি করা গ্রহনযোগ্য নয়।লেখা অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা করতে চাইলে লেখকের সম্মতি নিতে হবে। লেখকের ইমেল - [email protected]

বিষ্ণু দে'র কবিসত্তা : দ্বন্দ্ব ও উত্তরণের সমগ্রতায় / রফিকউল্লাহ খান

১৯ শে জুলাই, ২০০৯ সকাল ১০:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বিষ্ণু দে'র কবিসত্তা : দ্বন্দ্ব ও উত্তরণের সমগ্রতায়
রফিকউল্লাহ খান
======================================
বিশ শতকের বাংলা কবিতার ধারায় বিষ্ণু দে সম্ভবত সর্বাপেক্ষা দ্বান্দ্বিক চেতনার শিল্পী। এই দ্বন্দ্ব তার কবিচৈতন্য ও কবিজীবনে সমানভাবে ক্রিয়াশীল। বাঙালির সহজিয়া কাব্যধারায় এ কারণেই তিনি ব্যতিক্রম। পুরাণ ও ঐতিহ্যের পুনর্মূল্যায়ন প্রবণতা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর ইউরোপীয় সাহিত্যকে যে দিকচিহ্নহীন গতি ও চাঞ্চল্য দান করে, বিগত শতাব্দির তিরিশের দশকের কাব্যধারায় বিষ্ণু দের মধ্যেই তার সার্থক অঙ্গীকার লক্ষ্য করা যায়। যাত্রালগ্ন থেকেই তিনি বিচিত্র শিল্প ও দর্শনের তত্ত্বজ্ঞান শিল্পে যুগান্তর সৃষ্টির অভিপ্রায় থেকে আত্মস্থ করেছিলেন। যে কারণে এলিয়টীয় পোড়ো জমির সাদৃশ্যসূচক 'চোরাবালি'র আগেই তিনি রচনা করেন 'উর্বশী' ও 'আর্টেমিসে'র কবিতাগুলো। ক্ষয়চেতনার আগেই চলেছিল সমন্বয়ের সাধনা- প্রাচ্যের সঙ্গে প্রতীচ্যের, উর্বশীর সঙ্গে আর্টেমিসের এবং আরও অনেক নাম ও অনুষঙ্গ, যেগুলো গ্রিক, রোমান ও ভারতীয় পুরাণের দীর্ঘ সময়-কালের লুপ্ত ইতিহাসের সত্য দৃষ্টান্ত।
সভ্যতা ও ইতিহাসের বিবর্তন পরম্পরার অনুভবে উজ্জীবিত ব্যক্তিচৈতন্যে বর্তমানের ক্ষয়, নৈরাজ্য এবং শূন্যতার সর্বময় বিস্তারের মধ্যেও বিষ্ণু দে তার মানসদৃষ্টি প্রসারিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন অতীত ও ভবিষ্যতের বিপুলা পটভূমিতে। এজন্যই কবির চৈতন্যের যুক্তি অন্বেষণা কেবল ব্যক্তিক আত্মবিস্তারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বাংলা কবিতার মুক্তি সম্ভাবনাদীপ্ত অরুণোদয়কেও নির্দেশ করে। তার সভ্যতার আদি উৎসলালিত স্মৃতিসত্তা স্বপি্নল হয়ে ওঠে এ স্বপ্নরঙিন ভবিষ্যতের অনুধ্যানে। পরাক্রান্ত অন্ধকারের সাম্রাজ্যকে খুঁড়ে খুঁড়ে তিনি নির্মাণ করে চলেন আলোকিত সম্ভাবনার সিংহতোরণ_ জ্ঞান, বৈদগ্ধ্য ও যুক্তিসিদ্ধ সংহতির অন্তরালে লালন করেন রোমান্টিকতার অন্তর্গত স্রোতস্বিনী। উর্বশী ও আর্টেমিস, বা চোরাবালি কাব্যে তার যে শিল্প নিরীক্ষা টিএস এলিয়টের ছত্রচ্ছায়ায় উপমা, প্রতীক, রূপক ও চিত্রকল্পের সাধর্ম্য সন্ধান করে, সেখানেও কবির অন্যতর অভিনিবেশ প্রযুক্ত হয় এলিয়টের যুগান্তকারী ঐতিহ্যভাবনার মধ্যে। তাই নেতিতে যাত্রা শুরু হলেও তার বিস্তার ঘটে মানস প্রগতিতে, আবিশ্ব চৈতন্যের নিগূঢ় অন্বিষ্ট কামনায়। কিন্তু এলিয়টের খণ্ড চৈতন্যের একাগ্র উপলব্ধিকে সর্বাংশে গ্রহণ করতে পারেননি তিনি। তার কাম্য ছিল অখণ্ড চৈতন্যের সার্বিক মুক্তি। বিষ্ণু দের এই জাগরণকামী কবি স্বভাবের স্বীকৃতি মেলে তার গদ্যভাষ্যে_ যেখানে দ্বন্দ্ব জটিল যুগচৈতন্যের অনিবার্য অভিক্ষেপ সত্ত্বেও শিল্প অস্তিত্বের দ্বন্দ্ব-উত্তরণ ও মীমাংসার প্রশ্নে তিনি আস্থাশীল : 'নেতিতে আরম্ভ হতে পারে এই মানস প্রগতি। তারপর মিনারবাসীর ভূতলে অবতরণ। মুখ্য ব্যাপার হচ্ছে, ওই চৈতন্য ওই বোধ।... জীবনের প্রত্যক্ষে আর সর্বসংস্কৃতিগত পরোক্ষের দ্বন্দ্ব থেকে মাটিতে এসে মেশে প্রচণ্ড পলায়নীতে। তাই প্রয়োজন শিল্পীর অপক্ষপাত, পিকাসোর মতো নৈর্ব্যক্তিকতার সিদ্ধান্তে যাতে করে দ্বন্দ্বটা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে।... আর নেতি নেতি ধ্বনিতে প্রত্যক্ষের অস্তিত্বই প্রমাণিত হয়।' ('বাংলা সাহিত্যে প্রগতি', সাহিত্যের ভবিষ্যৎ )
একদিকে এলিয়টের কাব্যবিষয় ও প্রকাশরীতির প্রতি অনতিক্রমণীয় আকর্ষণ, অন্যদিকে বস্তুবাদী বিশ্বদৃষ্টিলব্ধ মানস প্রক্রিয়া_ এই দ্বৈতের মধ্যবিন্দুতে অবস্থিত তার চৈতন্যের স্বভাবগত আত্মমুক্তির অভিপ্রায়; এভাবেই বিষ্ণু দের কবি-চৈতন্য এতো গভীরভাবে আন্দোলিত ও তরঙ্গিত যে, তার মৌল কাব্যস্বভাব একটা সার্বক্ষণিক অস্থিরতা এবং অনিবার্য দ্বন্দ্বময়তায় আভাসিত। যার ফলে তার প্রাচ্য-প্রতীচ্যের পৌরাণিক মিলন মোহনায় জাগ্রত, রবীন্দ্র প্রভাব অতিক্রমী শিল্পচৈতন্য এক স্বপ্নবিলাসী রোমান্টিক মানসাভিসারে পর্যবসিত হয়েছে। কিন্তু চেতনার যে বিশ্বগ্রাসী একাগ্রতায় তিনি এলিয়টীয় শিল্পদৃষ্টির মধ্যে সমকালীন নাগরিক মধ্যবিত্ত মন ও কবিতার মুক্তির সম্ভাবনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন, তার ফলাফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। রবীন্দ্রনাথ নির্মিত আধুনিক বাংলা কবিতার প্রচলিত সংস্কার ও সংজ্ঞার্থকে ভেঙে সেখানে কেবল নৈরাশ্য এবং অবক্ষয় চেতনাকেই সংযোজিত করলেন না, একটা অনুসন্ধানী মানস-প্রসারণে ক্রমাগত অন্বেষণ করে চললেন উত্তরণের নিহিত শক্তিমত্তা ও সম্ভাবনাকে। এ মানদণ্ডে গোড়া থেকেই বিষ্ণু দে বিপ্লবী কবি। উপনিবেশিত কলকাতার মধ্যবিত্তের সার্ধ শতাব্দী তার প্রায় শৈশবেই অতিক্রান্ত হয়েছে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে। আর কৈশোর যুদ্ধ-উত্তর ক্ষতজর্জর জটিল সমাজ, রাজনীতি আর ভাব ও তত্ত্বের আন্দোলন-আলোড়নে অস্থির হয়ে উঠেছে।
যে বৈচিত্র্যপাগল মানস-প্রবণতা, বৈদগ্ধ্য ও প্রবল ব্যক্তিত্ববোধ কোনো শিল্পীর চৈতন্যকে সমগ্রতা সন্ধানী ও অনুপুঙ্খচারী করে তোলে, বিষ্ণু দের মানসকাঠামোর মৌল চারিত্র সেখানেই নিহিত। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিচিত্র উৎসধারায় গোড়া থেকেই লালিত হয়েছে তার মানস ও বিশ্বদৃষ্টি। মননশীলতার অনিবার্য পদবিক্ষেপে তার অন্তর্গত রোমান্টিক দৃষ্টিভঙ্গি ক্ল্যাসিক বীজমন্ত্রে সংহত ভিত্তিরূপ অর্জন করে। কিন্তু বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐকান্তিক সম্পর্ক স্থাপনে কবির যে বুদ্ধিদীপ্ত প্রয়াস, প্রতীক, রূপক ও চিত্রকল্প নির্মাণের প্রথারহিত ঐশ্বর্য_ সেখানে চেতনার তরঙ্গিত উৎসারণ পাঠকের গভীরতর অভিনিবেশ দাবি করে। সেজন্য দেখা যায়, ধ্রুপদ ঐতিহ্যের রহস্যলোক থেকে তিনি যে যুগান্তকারী কাব্যিক উপাদান আহরণ করেন, সেখানেও তার স্বপ্নবিলাসী রোমান্টিক চিত্তবৃত্তিই মুখ্য হয়ে ওঠে এবং এই ব্যতিক্রমী ও স্ব-স্বভাবী অনুধ্যানের ফলে এলিটীয় যুদ্ধক্ষত, অবক্ষয়তাড়িত আবেগের অঙ্গীকার সত্ত্বেও আত্মগত ও শৈল্পিক উত্তরণের নতুন উৎস সন্ধানে গোড়াতেই কৌতূহলী হয়ে ওঠেন তিনি। চোরাবালি-উত্তর পর্যায়ে মার্কসীয় তত্ত্বচিন্তায় উদ্বুদ্ধ, বাংলার আবহমান লোকজীবন ও লোক-ঐতিহ্যস্নাত এবং রাবীন্দ্রিক উত্তরাধিকারবোধে উজ্জীবিত বিষ্ণু দে চৈতন্যকে বিস্তৃত করে দেন কবিতার বিষয় ও প্রকরণের বিচিত্র ধারায়।
বিষ্ণু দের কবিতার আদি-অন্তব্যাপী পুরাণের জঙ্গম ব্যবহার বাংলা কবিতার ধারায় তার বিশিষ্টতাকে চিহ্নিত করে। তবে তার পুরাণ ব্যবহারের ধরন সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। সময় ও সমাজের ক্ষয়, ধ্বংস ও দ্বন্দ্বময় বিকাশের সমান্তরালে তার অন্তর্গত রক্তক্ষরণও এই পুরাণ ব্যবহারের মধ্যদিয়ে অভিব্যক্ত হয়েছে। এবং পুরাণ ও ইতিহাসের মধ্যে পরিক্রমণ বিষ্ণু দের আত্মপরিক্রমণকে অনেকটা নিয়ন্ত্রিত ও বিচারশীল পর্যায়ে উন্নীত করেছে। অরুণ সেনের বিবেচনাকে এ সূত্রেই অনিবার্য মনে হয় আমার কাছে। উর্বশী ও আর্টেমিস 'যেমন অপরিণত তারুণ্যের ও সঙ্কটসঙ্কুল ব্যক্তিত্বের কাব্য, তেমনি আবার এখানেই ইশারা পাওয়া যায় কীভাবে যৌবনারম্ভের এই স্তরকে তিনি পার হয়ে যাচ্ছেন, পরিণতি অর্জন করে চলেছেন, বলা যায় এমন সব চাবি খুঁজে নিচ্ছেন, যা নিয়ে যেতে পারে কাব্য আকাঙ্ক্ষার অন্য প্রকোষ্ঠে।' আর এই বিচারেও উর্বশী ও আর্টেমিস বিষ্ণু দের 'ভেতরকার সংগ্রাম ও বিকাশের ইতিহাস' হয়ে ওঠে। আর ইংরেজি সাহিত্যের এমএ শ্রেণীর ছাত্র থাকা অবস্থায়ই চোরাবালির অধিকাংশ কবিতা রচনা করেন বিষ্ণু দে। কিন্তু এ পর্যায়েই যেন বয়সের চেয়ে বেশি আত্মসচেতন, পরিণত ও প্রাজ্ঞ হয়ে উঠেছে তার মনের জগৎ। পুরাণ বিহারের কারণে গোড়া থেকেই এসে গেছে নৈর্ব্যক্তিকতা, যা কবির দীর্ঘ সমাজ, ইতিহাস ও আত্মপরিক্রমার দ্বান্দ্বিক সমীকরণের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে। যে 'জঙ্গম সমীকরণে'র কথা অনেক পরে বলেছেন কবি, তাও শুরু হয়ে গেছে চোরাবালিপূর্বলেখ-এর পর্যায়েই। এরই পরিণত প্রকাশ শুরু হলো সাত ভাই চম্পা থেকে, যেখানে লোকপুরাণ ও ঐতিহ্যের জগতেও ধ্বনিত হতে থাকে মহাসংগ্রামের অপরাজেয় কণ্ঠস্বর :
নীলকণ্ঠ ইতিহাসে বহুদীর্ঘ উতরাই-চড়াই
কৈলাশে হয়েছি পার। চোখে জাগে নবীন সভ্যতা,
অজেয় প্রাণের অগি্ন রক্তাক্ত সে জনতার হাতে
মৃত্তিকা সন্তান যারা, মৃত্যুহীন যুগান্তসাক্ষাতে
নির্র্ভীক, কর্মিষ্ঠ যারা। তাই আজ উচ্ছ্বসিত কথা
আমাদেরও, মৃত্যুহীন সমাজের করি জয়গান
উজবেক, তাজিক, তুর্কি, কাজাক_ ও দূর হিন্দুস্তান
( ২২শে জুন, ১৯৪২, সাত ভাই চম্পা)
পুরাণ, লোকপুরাণ ও ইতিহাসচেতনার সঙ্গে সমীকৃত হলো সমকালীন বিশ্বজনীন সংগ্রামের চেতনা, ব্যক্তির সঙ্গে সমষ্টি এবং উভয়ের সঙ্গে বিশ্বের গতিময় আন্তরক্রিয়া। বিষ্ণু দের ব্যক্তিসত্তা ও শিল্পীমনের পরিকল্পিত পন্থায়ই সৃজিত হয়েছে এই গতির ব্যাকরণ। ইতিহাস অন্বেষণের সূত্রে ব্যক্তির প্রকৃত অবস্থান শনাক্তিকরণও এই বহুবিভঙ্গ সমাজ বাস্তবতায় তাৎপর্যপূর্ণ। তাই বিষ্ণু দের প্রগতিচেতন মন তটসন্ধানী ব্যাকুলতায় উচ্চারণ করে :
বর খুঁজে ফেরে সত্তা আত্মপরিচয়
মাঠে গঞ্জে শহরে বন্দরে খোঁজে সে আপন সত্তা, সনাক্তিকরণ
দশের দর্শনে,...

যে সত্তার স্বপ্ন দেখে মানবসভ্যতা চিরকাল
আদিম গোষ্ঠীর যুগ থেকে সাম্রাজ্য অবধি।
('স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ', স্মৃতিসত্তা ভবিষ্যৎ)
কিন্তু এই অনুসন্ধান ও চূড়ান্ত সমীকরণে উপনীত হতে ব্যর্থ হয় বারবার। কারণ সমাজ ও রাষ্ট্রের দ্বৈরথ, ব্যক্তি ও সমষ্টির দ্বৈরথ এবং ব্যক্তি ও তত্ত্বের দ্বৈরথ। মানবসভ্যতার স্বপ্ন একজন ব্যক্তির অনুভবের সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। আর অন্ধকার কামনার পুনরাবৃত্তিতে (সেই অন্ধকার চাই) ইতিহাসের বেদনাদীর্ণস্বরূপ উন্মোচন প্রত্যাশায় (ইতিহাসের ট্র্যাজিক উল্লাসে) তার চৈতন্য বারবার আলোড়িত ও স্পন্দিত হতে থাকে। অতঃপর ক্ষত-বিক্ষত মধ্যবিত্ত মানসের উজ্জীবন প্রয়াসী চেতনাস্রোতে অনুরণিত হয় কাঙ্ক্ষিত উত্তরণের বরাভয় বাণী :
দ্বান্দ্বিক বটে তাই সর্বদা উত্তরণ
মননে অস্থিমজ্জায় শ্বাসবায়ুতে।
. . . . . . . . . . . .
জানি যে শরীর মনে ইতি-নেতি স্মরণ
আজন্ম চায় জঙ্গম সমীকরণ
('জঙ্গম সমীকরণ', ঈশাবাস্য দিবানিশা)
কিন্তু মনন ও তত্ত্বাবেগচালিত আদর্শ সন্ধানের এই কাব্যভূগোলে এক পরিপূর্ণ শিল্পজগতের আলোকরশ্মি ক্রমাগত প্রকাশমান হতে থাকে। বিষ্ণু দের আত্মপরিক্রমার পথে একদা অতিক্রান্ত রবীন্দ্রবিশ্ব ১৯৪১ থেকেই অনুপ্রবিষ্ট হতে থাকে। এ প্রসঙ্গে অবশ্য স্মরণীয় যে, শিল্পযাত্রায় আত্মসন্ধান, সত্তাসন্ধান ও বিশ্বসন্ধানের যে আকুলতা লক্ষ্য করি, সেখানে দ্বান্দ্বিক বস্তুতত্ত্বের বিবর্তনশীলতা অপেক্ষা রূপান্তরের চারিত্র্যধর্মই বেশি ক্রিয়াশীল। অবশ্য বস্তুধর্ম ও মানবস্বভাব কোনো ক্রমেই অভিন্ন ব্যাকরণ নিয়ন্ত্রিত হতে পারে না। রবীন্দ্রনাথের কৃতী ও কীর্তি রূপান্তরের শৃঙ্খলায়ই ক্রমবিকাশ লাভ করেছে। বিষ্ণু দের মধ্যেও এর সাধর্ম্য সুস্পষ্ট। মননাবেগের সঙ্গে হৃদয়াবেগের সংযুক্তির মধ্যেই তিনি সন্ধান করেন আত্মমুক্তি ও শিল্পমীমাংসার অপার উৎস। এবং পরিণামে রাবীন্দ্রিক জীবনবোধের আনন্দময় পরিপূর্ণতার মধ্যেই তিনি খুঁজে পান চৈতন্যমুক্তির পরম আশ্রয়। মরুচারী 'ঘোড়সওয়ার' রবীন্দ্রনাথের পারমার্থিক চেতনার অন্তরঙ্গ উপলব্ধি থেকেই যেন উচ্চারণ করেন, '_মরু বিজয়ের কেতন উড়াও হে শূন্যে, উড়াও, হে প্রবল প্রাণ!' (আমার চেনা গাছ ক'টি', আমার হৃদয়ে বাঁচ, ১৯৮১) এভাবেই মননশীল তত্ত্বনিষ্ঠ ও বুদ্ধিবাদী বিষ্ণু দে প্রত্যাবর্তন করেন হৃদয়বৃত্তির সংবেদনঘন পটভূমিতে_ যেখানে 'চিরসুন্দরের দূতী' আনন্দের নিত্যনৈমিত্তিক উপহার সামগ্রী নিয়ে কবির আপন প্রাঙ্গণে আবির্ভূত_
চিরসুন্দরের দূতী,
আপন প্রাঙ্গণে এলে অসতর্ক আবির্ভাবে,
আমার চোখের হীরা
হৃদয়ের মর্মস্থলে জ্বলে তাই যেন সাক্ষাৎ প্রস্তাবে
মূর্তি ধরে, মৃদঙ্গ মন্দিরা
বাজাও অজ্ঞাতে নিজে আমারই আকুতি।
তুমি তো জানো না তুমি আজীবন সুদীর্ঘ আয়ুতে
আমার হৃদয়ে বাঁচ মননে স্নায়ুতে
আনন্দের নিত্যনৈমিত্তিক আমারও প্রস্তুতি
('আমার হৃদয়ে বাঁচ মননে স্নায়ুতে, ঐ)
বিষ্ণু দের সুদীর্ঘ কাব্যসাধনা একটা শূন্যতা থেকে পূর্ণতার দিকে ক্রমবিকশিত। চৈতন্যময় বিশ্বভ্রমণের উন্মোচন, বিবর্তন ও বিস্তারে পথে পথে তাঁর যে শত ক্ষতচিহ্নজর্জর ও দ্বন্দ্বময় মানসিক রক্তপাত ও উত্তরণের সূত্র আবিষ্কার প্রচেষ্টা_ তিরিশের কোনো কবির মধ্যেই তার প্রমাণ মেলে না। #
-------------------------------------------------------------------------
দৈনিক সমকাল সাহিত্য সাময়িকী '' কালের খেয়া'' / ১৭ জুলাই ২০০৯
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুলাই, ২০০৯ সকাল ১০:৩৯
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তাঁর বোতলে আটকে আছে বিরোধী দল

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



সেই ২০০৯ সালে তিনি যে ক্ষমতার মসনদে বসলেন তারপর থেকে কেউ তাঁকে মসনদ থেকে ঠেলে ফেলতে পারেনি। যারা তাঁকে ঠেলে ফেলবে তাদের বড়টাকে তিনি বোতল বন্দ্বি করেছেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ১৬ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৪



কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?
আমার খুবই জরুরি তার ঠিকানাটা জানা,
আমি অনেক চেষ্টা করেও ওর ঠিকানা জোগাড় করতে পারছিনা।

আমি অনেক দিন যাবত ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছি,
এই ধরুণ, বিশ-একুশ বছর।
আশ্চর্য্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজকের ব্লগার ভাবনা:কথায় কথায় বয়কট এর ডাক দেয়া পিনাকীদের আইডি/পেইজ/চ্যানেল বাংলাদেশে হাইড করা উচিত কি? ব্লগাররা কি ভাবছেন?

লিখেছেন লেখার খাতা, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:১৩



অপূর্ব একজন চমৎকার অভিনেতা। ছোট পর্দার এই জনপ্রিয় মুখকে চেনেনা এমন কেউ নেই। সাধারণত অভিনেতা অভিনেত্রীদের রুজিরোজগার এর একটি মাধ্যম হইল বিজ্ঞাপনে মডেল হওয়া। বাংলাদেশের কোন তারকা যদি বিদেশী... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায়; অদৃষ্টের ইশারায়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৩৯

১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বাগদাদের একটা গল্প লিখেছিলেন৷ গল্পের নাম দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা বা সামারায় সাক্ষাৎ৷

চলুন গল্পটা শুনে আসি৷

বাগদাদে এক ব্যবসায়ী ছিলেন৷ তিনি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×