বাসায় আমার এক ভাগ্নে এসেছে। খালাতো বোনের ছেলে। খুবই সামান্য বয়স। তার জন্য অনেকগুলো খেলনা কিনে আনলাম। তালিকায় ছিলো একটা টেনিস বলও। বাসায় এনে ভাগ্নেকে দিতেই সব কিছু নিয়ে তার হুড়োহুড়ি শুরু হলেও টেনিস বলটায় তেমন আগ্রহ দেখালো না। সে ডুবে রইলো বাকী গুলোতেই ।
অবহেলায় পড়ে থাকতে দেখে টেনিস বলটা হাতে নিলাম। টেনিস বল হাতে নিলেই যে সমস্যা হয়, সেটা বেশিক্ষণ হাতে রাখা যায়না। উপরে ছুড়ে বারবার ক্যাচ নিতে ইচ্ছে হয়, না হলে ইচ্ছে হয় মাটিতে ড্রপ দিতে।
আজ সেসব করলাম না।
বলটা নিতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো।
এই সেই টেনিস বল। কত বছর হবে?
প্রায় ১৫-১৬ বছর বা তারও আগের কথা।
এই টেনিস বলের জন্য প্রতিদিনই আমাদের বিকেলগুলোর সৌন্দর্য একজনের হাতে বন্দি ছিল। সে চাইলে বিকেলটা বর্ণাঢ্য, রঙচঙে হতো। না চাইলে বিবর্ণ। তার এই রঙদায়ক ক্ষমতার উৎস, তার একটা টেনিস বল ছিল। আমাদের ছিল না। সে প্রতিদিন বল নিয়ে এসে বসে থাকতো। ইচ্ছে হলে খেলতো না হলে না-ই।
আমরা তাকে অনুরোধের উপরে রাখতাম। আয় খেলি। আয়। তার ভালো লাগলে সে খেলতো। না লাগলে, অন্যদিকে তাকিয়ে থাকতো। মাটি থেকে তুলে ঘাস চিবাতো।
আমাদেও মেজাজ গরম হলেও কিছু বলতাম না। রাগ চেপে তার দিকে তাকিয়ে হাসতাম। আর দুরে গিয়ে গালাগালি দিতাম।
সে খেলতে নামলেও মহাবিপদ। আউট হলেও আমাদের চুপ করে থাকতে হতো। সে ব্যাট ছাড়ে কিনা?
না হলে আরেকবার ব্যাটিং দিতে হতো। তার বল সে যদি নিয়ে যায়? খেলা একেবারে বাদ হওয়ার চেয়ে একটু কষ্ট খারাপ রাগতো না। তাকে দিতাম। ভাব দেখাতাম, না ইউট হয়নি। পাটকাঠির উইকেট বাতাসে পড়ে গেছে বোধ হয়।
এইভাবেই চলতো আমাদের বিকেল। তার উপরে নির্ভর। তখন টেনিস বল ৩০-৩৫ টাকা। আমাদের পক্ষে কেনা টাফ ছিল।
অনেকদিন পর একবার বাবাকে বুঝিয়ে কিনে ফেললাম। অবাক ব্যাপার সেই সাথে আমিও রাবন হয়ে গেলাম। আমার চরিত্রেও একই প্রতিফলন। খেলতে যেতেই ভালো লাগেনা। যদি বল হারিয়ে যায়!খুব একটা দাম দেইনা তাদের। দুইবার ব্যাটিং করি।
একটা সময় টাকার সমস্যা আর রইলো না। ইচ্ছে হলেই টেনিস বল কিনে ফেলতে পারি। শুরু হলো টেনিস বলে লেখা আমাদের কৈশর সময়। প্রতিদিন বিকেলে টেনিস বল নিয়ে স্কুল মাঠে যাই। সন্ধ্যা বাড়ী ফিরি। কখনো টেনিস বল নিয়ে ফিরি। কখনো বা পারিনা। হারাই। স্কুলের ছাদে আটকে থাকে টেনিস বল। আমাদের কত বেদনা যে ধারণ করে আছে আমাদের হাইস্কুলের ছাদ, সেটা সেই জড়বস্তু ছাদ-ই বলতে পারে।
আমাদের বেড়ে ওঠাও লিখিত হয়ে রইলো টেনিস বলে। টেনিস বলের গায়ে প্যাচানো স্কচটেপ জানান দিত আমরা এখন একটু বড় হয়েছি। আমাদের যারা তখনো স্কচটেপ ছাড়া খেলে তাদের জন্য সে কি তাচ্ছিল্য আমাদের?
একদিন সময়গুলো পাল্টে যায়। প্রতিদিনের টেনিস বল সপ্তাহে একবার হাতে নেই, এরপর মাসে।
আর আজ, কতদিন পর!
কতদিন হয়ে গেলো ক্যাচ ধরার ফিলিংস পাইনা।
কতদিন হয়ে গেলো পাইনা ক্যাচ মিস করে অনুশোচনার স্বাদ, ইস! একটুর জন্য ধরতে পারলাম না।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুলাই, ২০০৯ রাত ১:৪৩