somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঝরাপাতার গল্প

০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৫:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঝরাপাতার গল্প

এটা একটা নিছকই হিসেব। এর বাইরে কিছু নয়। হঠাৎই ভাবনায় দোল দেওয়া। ব্যাপারটা এমন হতে পারে। আবার নাও তো পারে।

আমার জন্ম একটা হিন্দু পরিবারে। এবং বড় হিন্দু পরিবার। অর্থাৎ যৌথ পরিবারে। যে পরিবারে আমার পূর্ব প্রজন্মের মায়েরা-মেয়েরা খুবই শুচিবায়ুগ্রস্থ। সম্ভবত এটা তারা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন। এর ব্যতিক্রম হওয়ার সুযোগ নেই। ছোটবেলা থেকেই এই শুচিবায়ুগ্রস্থ আচরণের যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে। এক প্রকার সাংস্কৃতিক আন্দোলন করার খায়েস জাগলেও তেমন কায়দা করে উঠতে পারিনি! কারণ, ঐ যে বললাম বড় তথা যৌথ পরিবার। যে কোন ভাবে একজনের কাছে তথ্য গোপন রাখা বা আন্দোলনের প্রস্তুতি নেওয়া ফাঁস হয়ে যেত!

প্রাইমারি স্কুলে যখন পড়তাম, তখন প্রতিদিন স্কুল থেকে ফেরার পর ঘরের বাইরে থেকে কাপড় বদলে ঘরে ঢুকতে হত। ঘরে ঢুকে কাপড় বদলের কোন সুযোগ আমার মতো সুপুত্রের ছিল না! ওই পোষাকে খেতে বসার তো প্রশ্নই আসে না! এর ব্যত্যয় হলে নিশ্চিতভাবেই 'have the news'!

হাই স্কুলে উঠলাম। সাইকেলে করে যেতাম-আসতাম। ফলে টিফিন পিরিয়ডে পাঁচ-পাঁচ দশ মিনিট প্যাডেল দাগালেই বাড়ি থেকে খেয়ে যেতে পারতাম। নাহ, তখন স্কুল পোষাকে খেতে বসতে কোন সমস্যা হত না। কীভাবে যেন, হাইস্কুলে উঠার পর দেখলাম 'আইন' শিথিল হয়ে গেল। বিকেলে বাড়ি ফিরে নিজের ঘরেই অন্তত কাপড় বদলের 'অধিকার'টুকু পেয়ে গেলাম।

কলেজে যখন উঠলাম তখন এসব নিয়ম কানুন 'মিশরের মমি' হয়ে গিয়েছে। একটা সময় যে এসব কায়দা কানুন ছিল তা বাড়ির মায়েরা-মেয়েরাই ভুলে গিয়েছে। আর আমরা কোন ছাড়!

আসলেই কি তা-ই? নাহ!

আমার ছোট দুই ভাই কনক-প্রতিম যখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ত, তখন ওদের চেয়ে কয়েক বছরের বড় হওয়ার সুবাদে আমি হাই স্কুলে পড়তাম। দেখলাম আমি প্রাইমারিতে পড়তে যে নিয়ম পালন করতে বাধ্য হয়েছি, আমার এই কাজিনদ্বয়ের ক্ষেত্রেও তা বলবৎ। আমি হাইস্কুলে পড়ি বলে সেই রাহু থেকে মুক্ত! শুরুতে ওরা অবশ্য কিন্ডার গার্টেনে পড়ত। ক্লাস ফাইভে বৃত্তি দিবে এই উদ্দেশে প্রাইমারি স্কুলে গমন। যেই না প্রাইমারিতে গেল, অমনি আমার অভিজ্ঞতা ওদের সাক্ষাৎ গিলতে হল!

আমার এ অভিজ্ঞতা কোনদিন হওয়ার কথা ছিল না। কারণ, আমার প্রাইমারি জীবনের শেষের দিকে আমাদের এলাকায় সবে একটা কিন্ডার গার্টেন হল। আগে হলেও বিশেষ লাভ হত বলে মনে হয় না। আমার বাবা অযথা এত টাকার শ্রাদ্ধ করে কিন্ডার গার্টেনে পড়াতেন না! আমিও পড়তাম না। আমার জন্য 'primary was perfect'.

এর আরও পরে, আমার আট-দশ বছরের ছোট দুই বোন তুষ্টি-দৈবীকে দেখলাম প্রাইমারি লেভেলে পড়ছে খুবই নির্বিঘ্নে। প্রাইমারি লেভেল মানে কিন্ডার গার্টেনে পড়ত। ফলে, দাদাদের মত ঝামেলা নেই বললেই চলে। আমি যখন উচ্চ শিক্ষার্থে বাড়ি ছাড়ি তখন আমার এই কাজিনদ্বয় কেবল বুঝি স্কুল যাওয়া শুরু করেছে। প্রতিম-কনক সম্ভবত তখন হাইস্কুলে পড়ার সুবাদে শুচিবায়ুগ্রস্থতার প্রতিকূল পরিস্থিতি কাটিয়ে ফেলেছে।

শুচিবায়ুগ্রস্থতা! নমোঃ নমোঃ!

আসল কথাটা সেদিন মাথায় এলো। কথাটা বেশ বেদনার। যদি আসলে এমনটাই ঘটে থাকে।

আমাদের দেশে প্রাথমিক শিক্ষার প্রতিষ্ঠান হিসেবে এখনও সবচেয়ে বেশি পরিবার প্রাইমারি স্কুলের ওপর নির্ভর করে। যে পরিবার গরীব সেই পরিবার তো প্রাইমারি স্কুল ছাড়া নিরুপায়। সেজন্যই ব্যয়ভার মেটাতে না পেরে, প্রাইমারি লেভেল থেকে সেকেন্ডারি লেভেলে যেতেই যেতেই অনেক শিক্ষার্থী ঝরে যায়। যাদের আমি বলছি 'ঝরাপাতা'।

আমার বহু বন্ধু-বান্ধবী এভাবে ঝরে গেছে। ওদের অনেকের কথাই মনে পড়ে। অনেকের কথা মনে পড়ে না। কে কোথায় আছে জানি না। কেউ হয়ত নিষ্ঠাবান কৃষক হয়েছে। কেউ শ্রমিক। কেউ রিক্সাচালক। বা দোকানদার। কেউ বা কয়েক সন্তানের পিতা বা মাতা। মাতারা সুযোগ্য গৃহিনী হতে হতে হয়ত শ্বাশুরিও হয়ে যাবার বয়সে চলে গিয়েছে! এর নাম নিয়তি। ঝরাপাতাদের নিয়তি!

আজকে হয়ত ঝরাপাতাদের ঝরে যাওয়ার হারটা কম। কিন্তু আজ থেকে ১৫ বছর আগে এই নিয়তি জলের দামে বিক্রি হত। বিক্রি হত কারণ বাংলাদেশের অধিকাংশ পরিবার গরীব। এই গরীব পরিবারের সন্তানেরা আমার মত শুচিবায়ুগ্রস্থ মধ্যবিত্ত হিন্দু পরিবারের সন্তানদের ক্লাসমেট হয়েছিল ঠিক। কিন্তু পরিবার ওদের সম্পর্কে আগে থেকেই সাবধানি। কারণ ওদের পরিবারে শাসন নেই। মা-বাবা অশিক্ষিত। পারিবারিক পরিবেশও তথৈবচ! ওরা নানা জায়গায় ঘুরে। পয়-পরিষ্কার থাকে না। নোংরা থাকে। ঘটনা মিথ্যে না। ওদের অনেকেই হয়ত মাঠে ধানের বীজ বুনে স্কুলে আসত। কেউ আসত দোকানে কাজ করে। কেউ গরু-ছাগল চড়িয়ে। অর্থের অনটনটাকে ওরা এভাবেই পুষিয়ে দিয়ে পরিবার ও পেট চালাত। অর্থনৈতিক অভাব-অনটনের কারণেই ওদের সঙ্গে গাত্রবর্ণেরও একটা তারতম্য থেকে যেত! তাই ওদের সঙ্গে স্কুলে পড়ালেখা করে আসার পর শুচি হতে হবেই হবে।

পড়ালেখার ক্ষেত্রে ওদের সংখ্যাটা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। প্রাইমারি থেকে সেকেন্ডারিতে গিয়ে একটা অংশ ঝরে যায়। সেকেন্ডারি থেকে হায়ার সেকেন্ডারিতে গিয়ে আরও ঝরে। হায়ার সেকেন্ডারি থেকে হায়ার এডুকেশনে গিয়ে আরও। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাটা হয়ে গিয়েছে শেষ পর্যন্ত ঝরাপাতাদের গল্প!

ওরা যত ঝরে, আমাদের মত পরিবারগুলোর শিথিলতা তত কমে! ওরা যত ঝরে, সম্ভবত আমাদের পরিবারগুলোর শুচিবায়ুগ্রস্থতা তত কমতে থাকে। কিন্ডার গার্টেনে সন্তান পড়লে সেই বায়ুগ্রস্থতা থাকে না। কারণ, এই ভদ্রপল্লীতে ওদের মতো পরিবারের সন্তানেরা আসতে পারে না। শুধু বায়ুগ্রস্থতাই বা বলি কেন। নানা দিক থেকেই তো পরিবার শিথিল হতে থাকে!

আমার এই ধারণা কি আসলে ঠিক? আমি নিশ্চিত নই। কারণ, আমার অভিজ্ঞতা তো সবারই হয়নি। কিন্তু কারও না কারও তো হয়েছেই। নৃবিজ্ঞানের বন্ধুরা এটা নিয়ে ভাবতে পারেন।

এটা আমি সেদিন উপলব্ধি করলাম। আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর এমন আচরণের মধ্যেই সম্ভবত সমাজের এই অর্থনৈতিক বৈষম্যের দগদগে দাগ লেগে আছে! আসল বৈষম্য তো শুরু হয় পরিবার থেকেই! তা ঠিক এবং এটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু এই বৈষম্য কী মাত্রায় সাংস্কৃতিক সেটা আমার পারিবারিক অভিজ্ঞতা থেকে চিন্তা করে বারবার অবাক হচ্ছিলাম। মানুষ শিক্ষা গ্রহণের অধিকার থেকে ঝরে যায়, সরে যায় আর আমাদের মধ্যবিত্ত-উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে এক ধরনের পরোক্ষ শিথিলতা কেমন যেন অজান্তেই চলে আসে!

[এটা একটি ফেসবুক-স্ট্যাটাস। প্রয়োজনে : Click This Link
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কোরআন কী পোড়ানো যায়!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৮

আমি বেশ কয়েকজন আরবীভাষী সহপাঠি পেয়েছি । তাদের মধ্যে দু'এক জন আবার নাস্তিক। একজনের সাথে কোরআন নিয়ে কথা হয়েছিল। সে আমাকে জানালো, কোরআনে অনেক ভুল আছে। তাকে বললাম, দেখাও কোথায় কোথায় ভুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেঞ্চুরী’তম

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


লাকী দার ৫০তম জন্মদিনের লাল গোপালের শুভেচ্ছা

দক্ষিণা জানালাটা খুলে গেছে আজ
৫০তম বছর উকি ঝুকি, যাকে বলে
হাফ সেঞ্চুরি-হাফ সেঞ্চুরি;
রোজ বট ছায়া তলে বসে থাকতাম
আর ভিন্ন বাতাসের গন্ধ
নাকের এক স্বাদে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরানের প্রেসিডেন্ট কি ইসরায়েলি হামলার শিকার? নাকি এর পিছে অতৃপ্ত আত্মা?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯


ইরানের প্রেসিডেন্ট হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে নিহত!?

বাঙালি মুমিনরা যেমন সারাদিন ইহুদিদের গালি দেয়, তাও আবার ইহুদির ফেসবুকে এসেই! ইসরায়েল আর।আমেরিকাকে হুমকি দেয়া ইরানের প্রেসিডেন্টও তেমন ৪৫+ বছরের পুরাতন আমেরিকান হেলিকপ্টারে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভণ্ড মুসলমান

লিখেছেন এম ডি মুসা, ২০ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:২৬

ওরে মুসলিম ধর্ম তোমার টুপি পাঞ্জাবী মাথার মুকুট,
মনের ভেতর শয়তানি এক নিজের স্বার্থে চলে খুটখাট।
সবই যখন খোদার হুকুম শয়তানি করে কে?
খোদার উপর চাপিয়ে দিতেই খোদা কি-বলছে?

মানুষ ঠকিয়ে খোদার হুকুম শয়তানি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আসবে তুমি কবে ?

লিখেছেন সেলিম আনোয়ার, ২০ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪২



আজি আমার আঙিনায়
তোমার দেখা নাই,
কোথায় তোমায় পাই?
বিশ্ব বিবেকের কাছে
প্রশ্ন রেখে যাই।
তুমি থাকো যে দূরে
আমার স্পর্শের বাহিরে,
আমি থাকিগো অপেক্ষায়।
আসবে যে তুমি কবে ?
কবে হবেগো ঠাঁই আমার ?
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×