somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অনুগল্প: বাম। বাম হাতি

২৮ শে জুন, ২০০৯ বিকাল ৩:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


দিনের আলোয় অস্পষ্ট আকাশের রঙে রঙে মিছিল থেকে ছলকে উঠা শব্দ-স্বরের মেঘ ভেসে উঠছে যেন, চৌদিকে ছড়িয়ে পড়ছে সেই শব্দ-স্বরের সিম্ফনি, খুরের চকচকে পিঠের উপর রক্তাক্ত মুখ ভাসছে নাকি কারো? ও কি ঠিক ঠিক দেখছে, নাকি গভীর কোন খাদের ভিতর স্বপ্ন দেখছে? মনের টানেলস্থিত ঝাপসা দেয়ালে লাল পরী নীলপরীদের ভিড় ঠেলে কে ওকে উড়িয়ে নিতে আসতেছে, কারা ওকে উড়ায়ে নিতে চায়? অসংখ্য বেলুনের জগতে ও যেন আটকে আছে, খুব জোরে চিল্লাতে চাচ্ছে, গলা ছেড়ে বিকট শব্দ করতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না....গলার ভিতর দলা পাকানো গোঙরানো একটা ভাব আটকে আছে, এটা থেকে সে মুক্তি চাচ্ছে, মিলছে না মুক্তি। এমনি এমনিতেই চোখের আলোর গভীরে ভেসে উঠছে মৃত মাছেদের চোখ, কানকো, ফ্যাকাশে আঁশ...জোনাকীর বিন্দু বিন্দু আলোর কণায় ঢেকে যাচ্ছে ওর সারা দেহ...
ডান দিককার টাটকা ডানাটা কলেজে ঢুকার মুখে, প্রাচীর ঘেষা অর্ধেক মাটি আর অর্ধেক ঘাসের উপর লাফাচ্ছে। ফিনকি দেয়া তাজা রক্তের বিন্দু বিন্দু ফোটা দেয়াল লিখনের ফাঁকে ফাঁকে এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে গেছে। দেয়ালের পুঁজিবাদ নিপাত যাক - তার খুব নিকটস্থ ফাঁকে; শাদা চুনের জিভেতে, গ্রীবায় ডান ডানাটার লাফানো শব্দের ক্ষীণ স্বর কি মিশতে চাচ্ছে? মাটির সঙ্গে রক্তের ছোপ দেয়া ফোটাগুলিও কি দেয়ালের ভিতরকার জগতে কোন সংকেত পাঠাচ্ছে নাকি? ঘাসের উপরকার রক্ত আর ডান ডানাটার লাফানো শব্দের নৃত্যশীলতাও কি দেয়ালে মিশে যাবে নাকি? কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। সব কিছু ঝাপসা আর খণ্ডাংশ। দেহের যেদিকটা এখনো একটু নড়াচড়া করার মতো আছে, সেদিকটাও নড়াতে ইচ্ছা করছে না, মনে হচ্ছে নড়ালে কলেজের দক্ষিণ দিকের বিজ্ঞান ভবনটা ভেঙে পড়বে গায়ের উপর, আর দুটো পা একটু ফাঁক হয়ে আছে, ও উপুড় হয়ে আছে বলে আকাশটা দেখতে পাচ্ছে না, ওর মনে হচ্ছে অনেক অনেক শকুন আর চিল এখন আকাশ দখল করে নিয়েছে। দুটো পা একজায়গায় করারও চেষ্টা করছে, কিন্তু পারতেছে না। নিজেকে গালি দিচ্ছে, ‌শালার চাষার চুদনা দুটো পা একজায় করতে পারছো না, তুমি বালের ক্যাডার? এতোটুকু শক্তি নাই? এতোদিন শুধু খাইচো না বাল ছিড়ছো? ঝাপসা মেঘের ভিতর নিজের কথাগুলা উড়ে উড়ে যাচ্ছে। আর দূরে, জয়বাংলা, নাকি জিন্দাবাদ, নাকি দুনিয়ার মজদুর এক হও, ধ্বনিত হচ্ছে, মিছিল হচ্ছে, ও সেটা বুঝতে পারছে। কিন্তু কোন ধ্বনি ওর কানে আসতেছে...জয়..জিন্দা..মজদুর... ? বুঝতেছে না ও, ওর মনে হচ্ছে পৃথিবীর খোলের ভিতর ও উড়ে উড়ে যাচ্ছে, অসংখ্য মানুষের পদশব্দ মেঘের মত ভাসতেছে, ও সেই শব্দগুলা ধরার চেষ্টা করছে। ডান ডানাটা এখনো লাফাচ্ছে..
একক কারো কথায় তাঁর কানে ঢুকছে না। ও খুব চেষ্টা করছে উপুড় হওয়া থেকে পাশ ফেরার জন্য, পারতেছে না। শুধু মিছিলের অস্পষ্ট ধ্বনি ওর কানে ঢুকছে হুড় হুড় করে। এই ধ্বনি যখনই কানে ঢুকছে তখনি ওর বমি বমি ভাব হচ্ছে, মনে হচ্ছে ও এখনি বমি করে দিবে। এই বমি বমি ভাবটা যখন আসতেছে তখন ওর সারা শরীর কেউ যেন খুর দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে আরো রক্তাক্ত করে ফেলছে। আর মনে পড়ছে ছোট বোনের প্রিয় পোষা বেড়ালটার কথা। ও দেখছে, একদম স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে তিন কোণা মাটির পাত্রে দুধের সর। দূরে কারা যেন ফিস ফিস করে কথা কয়। বেড়ালের লোমের ভিতর ও যেন ঢুকে পড়েছে এইক্ষণে, নাকি ঔ এখন বেড়ালে রূপান্তরিত হয়ে গেলো, কোনটা সত্য? ওর ছোট বোনের মুখটা মনে আসছে না, আনার চেষ্টা করছে, শুধু বেড়ালটার মুখ ভাসতেছে দুধের সরে..
মাটির দেয়ালের সবুজ ছ্যাদলায় জেগে ওঠা ভোরের ফকফকা আলোর মত ও তাঁর মুখখানি ভেসে ওঠা দ্যাখে। গোসলের পর সে যা করে তা দেখলে তৃষ্ণার তেজ বাড়ে, পুকুর পাড়ের যেইখানটা ভাঙা ঠিক তার পাশে চোখ এঁটে যায়। দুর্বাঘাসের গা বেয়ে বেয়ে যেন সেই তৃষ্ণার ঝোপে কিছু একটা নড়ে ওঠে, চিকন শব্দের স্বর কানের লতি বেয়ে বেয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ে। ও চিৎ হওয়ার কসরত করে পারে না।
মিছিলের শব্দ আরো বাড়ে। দালানগুলা কি চমকে উঠছে। কারা মিছিল করছে? লিয়াকত, ঠাণ্ডু, জুয়েল ওরা কই গেলো..এত শব্দের তোড়ে কারো পায়ের শব্দই ও ধরতে পারতেছে না। কিন্তু এখন ও টের পাচ্ছে মেজো ভাবির পায়ের শব্দ। কি আশ্চর্য! ওর হাসি পাচ্ছে। মেজো ভাবি পা টিপে টিপে ওর ঘরের উত্তর দিকের জানালায় মুখ করে, ডাকছে যেনো, গভীর রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে ও মেজো ভাবির পায়ের শব্দকে আলাদা করতে পারতো। এইক্ষণে ও এসব কি ভাবছে! আবালের মত কিসব ভাবছে। মিছিলটা তো অনেকবার চক্কর দিচ্ছে মনে হচ্ছে। কারা মিছিল করছে। ও আবার ট্রাই করতেছে চিৎ হওয়ার, পারতেছে না। ডান ডানাটা কি কেউ খুলে নিয়েছে? কেমন শূন্য শূন্য লাগছে। ও কি ঘুমিয়ে গেছে নাকি জেগে আছে? ফুল ভরতি ট্রাকের ভিতর ও একবার ঘুমিয়ে পড়েছিল, মামাদের ফুলের চাষ ছিল, বড়মামা ট্রাক ভরে ফুল ঢাকায় নিয়ে আসতো, তো একবার ও মামার কাছে আবদার করেছিল, মামা, আমি ঢাকা যাবো? মামাও রাজি হয়েছিল। ও বুঝে উঠতে পারছে না, জেগে আছে নাকি ঘুমিয়ে গেছে..ও এখন কই আছে? ওর কাঁহার পাড়ার কথা মনে হচ্ছে কেনো?
কুচকুচে কালো রাতের গভীরে কাঁহার পাড়ার মানুষেরা ঘুমিয়ে আছে নাকি জেগে আছে, ঠিক বুঝতে পারছে না সে। তাঁর চোখের ভিতর শুকনো গাঙের পিঠ খোলা ব্লাউজের মত কি যেন দুলছে, তার মানে বাতাস বইছে ধীরে ধীরে, সেটা সে ঠাহর করতে পারছে, নাকি কাঁহার পাড়ার মানুষেরা দুলছে - খোলা ব্লাউজের হুকে? ও স্বপ্ন দেখছে না তো? নাকি কাঁহার পাড়ার মানুষেরা স্বপ্ন দেখছে? ও কি ঘুমিয়ে আছে কাঁহার পাড়ার বুধু সদ্দারের বাড়ির পিছন দিকে বেড়ার এক কোণে? নিজের শরীরটা নাড়ানোর চেষ্টা করে, পারে না। আচ্ছা ওর ডান ডানাটা কই গেলো, ও বাম হাতটা নড়ানোর চেষ্টা করছে, নাড়াতে পারতেছে না। অসংখ্য শকুন আর চিলে ভরতি আকাশ ওর মাথার একদম কাছে এসে গেছে। ও বাম হাত দিয়ে মেঘ সরাচ্ছে। মেঘের ভিতর, ওর চোখের ভিতর শুকনো গাঙের পিঠ খোলা ব্লাউজ কই থেকে আসলো? এই ছবি চোখের সামনে থেকে সরছে না কেনো? মেজভাবির মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, ছোট বোনের মুখটা দেখা যাচ্ছে না..বেড়ালটা দেখা যাচ্ছে..আর বুধু সদ্দারের পুকুর পাড়ের সাপের সঙ্গমদৃশ্য দেখতে দেখতে পাড়ার তাবৎ নারী-পুরুষের মুখের অবাক চাহনিই বা মনে পড়ছে কেনো ওর! ওর ডান দিকটা শূন্য হয়ে মাটি থেকে আকাশভরতি চিল-শকুনের ডানার ছায়ায় মিশে যাচ্ছে, ও বাম দিকটা ঝাঁকি দেয়ার চেষ্টা করছে, বুঝতে পারছে ওর বাম দিকটা। ও এখন বাম। বাম হাতি। বুঝতে পারার কারণে হুহু করে বুক ঠেলে কান্না উথলে উঠছে...
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুন, ২০০৯ বিকাল ৩:০৬
১২টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×