somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জীবনের কথা বলুন কবি, মানুষের কথা বলুন

২৪ শে জুন, ২০০৯ বিকাল ৫:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাল্মিকী নামে একজন হিন্দু সাধু রামায়ন রচনা করেছিলেন। রামায়নের রাম হিন্দুদের অবতার। হিন্দুরা তাঁকে ভগবান বিষ্ণুর মানবরূপ হিসেবে মানে। বাল্মিকীর রামায়ন সংস্কৃত ভাষায় রচিত। সংস্কৃত কুলীন ও পন্ডিতদের ভাষা। সাধারণ মানুষ এ ভাষার ব্যবহার করতনা, জানতনা। যা সাধারণের নয় তা টিকে থাকেনা- পৃথিবীর অবধারিত এই নিয়ম অনুসারে একদিন সংস্কৃত বিলুপ্ত হয়। সংস্কৃতের সাথে বিলুপ্ত হওয়ার কথা ছিল মহাকবি বাল্মিকী, তাঁর রামায়ন এবং একই সাথে ভগবানেরও। কিন্তু তা হয়নি। কারণ ভারতবর্ষের বিভিন্ন ভাষার কবিরা এটিকে নিজের ভাষায় রূপান্তর করে নিয়েছিলেন। বাংলায় এর অনুবাদ করেছিলেন মহাকবি কৃত্তিবাস। কৃত্তিবাসের রামায়ন এতোটাই জনপ্রিয় ছিল যে তাঁর জীবিতাবস্থায়ই এর চরণগুলো লোকের মুখে মুখে ফিরত। তাই একদৃষ্টিতে বলা চলে মহাকবি কৃত্তিবাস রামায়নকে কুলীনদের ভাষার খোলস থেকে মুক্ত করে সাধারণের করেছিলেন বলে এই বাংলায় রামায়ন টিকে আছে, একই সাথে টিকে আছেন স্বয়ং ভগবান।

আজকাল বাংলা কবিতাগুলোকে বাল্মিকীর সংস্কৃত রামায়নের মতোই মনে হয়। অতিমাত্রায় দুর্বোধ্য, নিশ্চিত দুর্ভেদ্য। সত্যিকার অর্থেই কবিতাগুলোকে দেখলে মনে হয় কোন সুরক্ষিত দুর্গ বা ক্যান্টনম্যান্টের মতো। সাধারণের প্রবেশ নিষেধ এখানে। ক্যান্টনমেন্টের নীল রক্তের প্রাণীগুলো যেমন নিজেদের অন্যের চেয়ে আলাদা ভাবেন, নিজের সিদ্ধান্ত, নীতি, বিচার-আচার নিজেরাই করে থাকেন তেমনি কবিতাগুলোকে দেখলে মনে হয় এগুলো শুধুই কবির নিজের বা নিজের গন্ডির জন্য। কবিতার পাঠক কবি। কবিতার সমালোচকও কবি।

কলেজে পড়ার সময়ে আমার এক শিক্ষক বর্তমানের বাংলা কবিতাগুলোর একটি নমুনা দেখিয়েছিলেন। বাংলা ডিকশনারীর কিছু কঠিন ও দাতভাংগা শব্দ ব্লাকবোর্ডে লিখে লেখার উভয় পাশ থেকে দু' ইঞ্চি পরিমাণ ডাস্টার দিয়ে মুছে তিনি বলেছিলেন এটাই আধুনীক বাংলা কবিতা। আধুনীক বাংলা কবিতার যে নমুনা তিনি উপস্থাপন করেছেন তাঁর সাথে হয়তো অনেকেই একমত হবেন। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি কবিতা অতোটা সহজে লেখা যায় বলে বিশ্বাস করিনা। কবিতা অবশ্যই সাধনার বিষয়। কবি নিঃসন্দেহে একজন সাধক। তবে বর্তমানে এই সাধকের সাধনার বিষয়ের প্রকাশ ও বিকাশ এতোটাই দুর্ভেদ্য যে সাধারণের পক্ষে সে দেয়াল ভেদ করা সম্ভব নয়।

আধুনীক কবিতা অতিমাত্রায় রূপক। অনেকের মতো আমিও বিশ্বাস করি অতিমাত্রার এই রূপকতা কবিতাকে অতি কঠিন এবং সাধারণের ধরাছোয়ার বাইরে নিয়ে গেছে। আর আধুনীক কবিতায় রূপকতার একটি প্রভাবশালী উপাদান হচ্ছে নারী। রূপক হিসেবে ব্যবহারের জন্য পৃথিবীতে অনেক উপাদান বিদ্যমান থাকলেও বর্তমানের কবিরা কেন বেশিরভাগক্ষেত্রেই নারী অঙ্গের স্পর্শকাতর অংশগুলোকে বেছে নিচ্ছেন তা আমার বোধগম্য নয়। অনেকে বলেন এটা শিল্প, অশ্লীলতা বা বিকৃতি নয়। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে মনে হয় আমাদের সামাজিক বিকৃতির ক্রমবর্ধমান ধারাটি বোধ হয় ইতোমধ্যেই কবির মননের সীমা পর্যন্ত পৌছে গেছে। কবিতায় রূপকতা বা শিল্পের নামে নারী অঙ্গের এই প্রকাশ আসলে আমাদের সামাজিক বিকৃতিরই কাব্যিক বহিঃপ্রকাশ।

কবিতা বাংলাসাহিত্যের অন্যতম প্রাচীন এবং অন্তত উনিশ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত সবচেয়ে জনপ্রিয় শাখা। চর্যাপদের কবি কাহ্নপা থেকে শুরু করে চন্ডীদাস, শাহ মুহম্মদ সগীর, আলাওল, ঈশ্বরচন্দ্র চন্দ্র গুপ্ত, মাইকেল মধুসূধন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাস কিংবা হালের শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ, আল মাহমুদ সহ হাজারো কবি তাদের অবিনাশী সৃষ্টি দিয়ে সাহিত্যের এই শাখাটিকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাদের কবিতাগুলোতে জীবনের উচ্ছাস ছিল, গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনের যন্ত্রণা ছিল, না পাওয়ার বেদনা ছিল, আশার কথা ছিল, ছিল ছোট ছোট সুখ-দুঃখের বর্ণনা। দেশপ্রেম ছিল, সংগ্রামী চেতনা ছিল, ছিল শোষকের বিরুদ্ধে লড়ার অবিনাশী মন্ত্র। সেই কবে ‍'অন্ধবধু' নামে একটা কবিতা পড়েছিলাম। গ্রামের একজন অন্ধনারীর আকুলতা এবং মনোযন্ত্রণার যে ছোয়া আমি তাতে পেয়েছিলাম তার উপস্থিতি এখনো টের পাই। কবিতাটির প্রতিটি লাইন এখনও আমার মনে পড়ে, হৃদয় ছুয়ে যায়। নজরুলের বিদ্রোহী কবিতাগুলো এখনও আমার নেতিয়ে পড়া ধমনীকে নতুন রক্তের স্রোতে ভাসিয়ে দেয়। রবীন্দ্রনাথের ছোটনদী কবিতাটি এখনও যখন নিজের অজান্তে আবৃত্তি করি তখন মনে হয় এ যেন আমার গ্রামেরই চিরন্তন বর্ণন, যা আমি ফেলে এসেছি এবং যেখানে আমি আর কোনদিন ফিরে যাব না। জন্মস্থানের সাথে আমার বিচ্ছেদ আমাকে রক্তাক্ত করে। কেউ হয়তো হেসে বলবেন এটাতো শিশুদের জন্য লেখা। এটা কেন আপনাকে এতো আবেগতাড়িত করে। হ্যা, এটা শিশুদের কবিতা। আমার কাছে তাই সর্বোচ্চ যা আপনার শিশুস্বত্তা-কে জাগ্রত করে। কারণ কেবলমাত্রই সে সময়টাতেই আপনি নিষ্পাপ ছিলেন। জাগতিক কোন দ্বন্দ্ব বা পাপ আপনাকে স্পর্শ করেনি। ঠিক ঐ সময়টাতে যে লেখা আপনাকে ফিরিয়ে নিতে পারে অর্থাৎ আপনার নিষ্পাপ স্বত্ত্বাকে যে জাগিয়ে তুলতে পারে তাইতো সত্যিকারের শ্রেষ্ঠ লেখা।

কিন্তু কবিতায় মানুষের ভাবাবেগের উপস্থাপনের বিষয়টি এখন গৌণ। কবি এখন কবিতা সাজান ডিকশনারী খুঁজে বের করা কঠিন শব্দমালা দিয়ে। কাউকে বুঝানো বা প্রণোদিত করার কোন প্রচেষ্টা তাঁর নেই। তিনি অভিজাত, তিনি কুলীন। জনসাধারণের স্পর্শ তার আরাধ্য নয়। স্বৈরাচারী এরশাদ ক্ষমতা থাকাকালীন সময়ে শামসুর রাহমানের লেখা, '‍অদ্ভুত উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ' কবিতাটির পর অন্তত এই বাংলার কবিদের কাছ থেকে আমি এমন কোন কবিতা পাইনি যাতে মানুষেরে আবেগের বিষয়টি স্থান পেয়েছে, মানুষকে প্রণোদিত করেছে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলেছে। হ্যা, এটা হয়তো সত্যি যে, কবি এখনও তাঁর কবিতায় নাগরিক যন্ত্রণার প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলেন। তবে এর উপস্থাপন এতোটাই কঠিন এবং কুলীন যে, একমাত্র কবি ব্যতিত অন্য কারো তাকে নিয়ন্ত্রণে আনার সামর্থ্য নেই। কবিতার ভাব, উদ্দেশ্য তাই এখন সাধারণের ভাব নয়। কবি বা কবিতা কেউই এখন সাধারণের নন।

আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, যা অতিমাত্রায় কুলীন, যা বাস্তবতা এবং সাধারণের মতকে অবজ্ঞা করে তা নিশ্চিহ্ন বা বিলুপ্ত হতে বাধ্য। সংস্কৃতের মতো কুলীন ভাষা পৃথিবী থেকে মুছে গেছে। কারণ তা সাধারণের উপযোগী ছিলনা। ভয় হয় ঠিক একই কারণে হয়তো একদিন কবিতা বা কবি সম্প্রদায়েরও বিলুপ্তি হবে। আমার ধারণা এ বিষয়ে অনেকেই আমার সাথে একমত হবেন। কবিতার একজন একনিষ্ট ভক্ত এবং পাঠক হিসেবে এই চিন্তাটা আমাকে সব সময়ই ব্যথিত ও উদ্বিগ্ন করে। অত্রএব কবি একজন সাধারণ ভক্ত হিসেবে, একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আপনার/আপনাদের কাছে অনুরোধ থাকবে দয়া করে অস্তিত্বের স্বার্থে এই কুলীনতা, এই আভিজাত্য, এই দুর্বোধ্যতা পরিহার করুন। সাধারণের কথা বলুন, সাধারণের মতো ভাবুন। জীবনের কথা বলুন কবি, মানুষের কথা বলুন।
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্যবহারে বংশের পরিচয় নয় ব্যক্তিক পরিচয়।

লিখেছেন এম ডি মুসা, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৫

১ম ধাপঃ

দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে কত মানুষের সাথে দেখা হয়। মানুষের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য আসলেই লুকিয়ে রাখে। এভাবেই চলাফেরা করে। মানুষের আভিজাত্য বৈশিষ্ট্য তার বৈশিষ্ট্য। সময়ের সাথে সাথে কেউ কেউ সম্পূর্ণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ধুর বউ কে শাড়ি উপহার দিলেন ব্যারিস্টার সুমন। বাটার প্লাই এফেক্ট এর সুন্দর উদাহারন।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



এক দেশে ছিলো এক ছেলে। তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার। তার নাম ব্যারিস্টার সুমন। তিনি একজন সম্মানিত আইনসভার সদস্য। তিনি সরকার কতৃক কিছু শাড়ি পায়, তার জনগণের মাঝে বিলি করার জন্য।... ...বাকিটুকু পড়ুন

অধুনা পাল্টে যাওয়া গ্রাম বা মফঃস্বল আর ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া শহুরে মানুষ!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০০


দেশের দ্রব্যমুল্যের বাজারে আগুন। মধ্যবিত্তরা তো বটেই উচ্চবিত্তরা পর্যন্ত বাজারে গিয়ে আয়ের সাথে ব্যায়ের তাল মেলাতে হিমসিম খাচ্ছে- - একদিকে বাইরে সুর্য আগুনে উত্তাপ ছড়াচ্ছে অন্যদিকে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমুল্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

×