ভাষাসৈনিক গাজীউল হককে নিয়ে আমার একটি নিবন্ধ আজ ছাপা হয়েছে দৈনিক সমকাল'এর উপসম্পাদকীয় পৃষ্ঠঅয় (পৃষ্ঠঅ ৫)। ব্লগারদের জন্য এটি এখানে উপস্থাপন করা হলো।
অন্তিম শ্রদ্ধাঞ্জলি : ভাষাসৈনিক গাজীউল হক
তপন বাগচী
ভাষাসৈনিক গাজীউল হক চলে গেলেন। এই নাম কারো কাছে আর অপরিচিত নয়। গাজীউল হককে কেবল ভাষাসৈনিক বললে তাঁর পরিচয়কে খণ্ডিত করা হয়। ভাষাসৈনিক হিসেবে গৌরবের পরিচয়বাহী এই মানুষটি ভাষা-আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েই তাঁর দায়িত্ব পালন সম্পন্ন করেননি, পরবর্তী প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি সক্রিয় ছিলেন। এইখানেই তাঁর মহত্ত্ব, এইখানেই তাঁর সামাজিক প্রতিশ্র“তি পালনে নিষ্ঠার প্রমাণ। এই কারণেই তিনি আমার নমস্য হয়ে উঠেছেন।
গাজীউল হকের সৌভাগ্য যে, ভাষা-আন্দোলনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। তাই তিনি পাকিস্তানের অপশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পেরেছিলেন। উর্দু চাপিয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার প্রেরণা পেয়েছিলেন অন্তরের তাগিদ থেকে। ওই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র তো ছিল হাজার হাজার। সকলেই তো আর ১৪৪ ধারা ভাঙার সাহস করেনি। যে-ক’জন সেই সাহস প্রকাশ করেছেন তাঁদের একজনের নাম গাজীউল হক। উর্দুর বিরুদ্ধে ‘না’ বলার নেতৃত্ব তো আর সবাই দেননি। তিনি তা দিয়েছিলেন বলেই আজ সকলের শ্রদ্ধার পাত্র।
কেবল ৫২ নয়, ৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৪-র সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী আন্দোলন, ৬৯-র গণঅভ্যুত্থান, ৭১-র মুক্তিযুদ্ধ, আশির দশক জুড়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন- সবল ক্ষেত্রেই গাজীউল হকের ছিল প্রভাববিস্তারী ভূমিকা। মুক্তিযুুুুুুদ্ধে তাঁর অবদানের কথা কে না জানে? সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। লড়াকু সৈনিক হিসেবে দেশ-স্বাধীনের ত্যাগী কর্মযজ্ঞে তাঁর অংশগ্রহণ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেও তিনি সম্মানিত। সর্বজনশ্রদ্ধেয় এই মানুষটিকে আমাদের সময়ের দেখতে পেয়েছি, এটি পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার বলে মনে করি।
অনেকেরে মতোই জীবিকার জন্য পেশা হিসেবে আইন-ব্যবসায়কে বেছে নিয়েছিলেন তিনি। দেশের শীর্ষস্থানীয় আইনজীবী হিসেবে তাঁর অবস্থান। রাজনৈতিক অনেক মমালা তিনি লড়েছেন প্রথমত আদর্শের স্বার্থে, দ্বিতীয়ত দেশের স্বার্থে। নিজের গাঁটের টাকায় রাজনৈতিক মামালা লড়ার কথাও আমরা জানি। সাধারণ অনেক মানুষও তাঁর কাছ থেকে আইনি সহায়তা পেয়েছেন। টাকার জন্য কেউ আইনি সহায়তা থেকে বঞ্চিত হলে তিনি এগিয়ে যেতেন। পেশার ক্ষেত্রে তিনি সিরিয়াস থাকলেও, পেশাদারিত্বের দোহাই দিয়ে তিনি মানবিকতা বিসর্জন দেয়ার পথে পা বাড়াননি।
গাজীউল হককে আমরা কবি ও গীতিকার হিসেবেও জানি। তাঁর সঙ্গে পরিচয়ের অনেক আগেই ফুটপাত থেকে কিনেছিলাম তাঁর জেলখানায় লেখা গান ও কবিতার একটি সংকলন। তিনি যদি গান লেখাটা অব্যাহত রাখতেন, তাহালে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ গীতিকারদের তালিকায় স্থান পাওয়া ছিল একেবারে স্বাভাবিক ঘটনা। তাঁর ভাইও গণসংগীত লিখেতেন। পরিবারের মধ্যে শিল্পচর্চার ধারা বহমান। তাঁর কন্যা সুজাতা হক সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে যথেষ্ট পারঙ্গমতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর আরো এক কন্যা চিত্রশিল্পী হিসেবে কর্মরত। গাজীউল হক নিজেও সাহিত্যচর্চা করেন। আইন বিষয়ক লেখালেখি ছাড়াও সাহিত্য-সংস্কৃতির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ রচনা করেছেন। ইতিহাসের বিষয়াদিও নিয়েও তাঁর গভীর পর্যবেক্ষণ রয়েছে। তাঁর অনেক লেখা গ্রন্থিত হয়ে সচেতন পাঠকের প্রশংসাধন্য হয়েছে। বিশেষত আদালতে বাংলাভাষার ব্যবহার নিয়ে তাঁর নিজস্ব চিন্তাধারা পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে প্রবাহিত হয়েছে। এ-বিষেয়ে তাঁর সুচিন্তিত মতামত গ্রন্থকারে প্রকাশিত হয়েছে। আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহারের পক্ষে তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হয়েছে। ভাষা-আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন বলেই যে তিনি এই মহান কর্মে প্রবৃত্ত হয়েছেন, তা নয়। এর প্রেরণা হিসেবে রয়েছে স্বাদেশিকতা ও স্বজাত্যবোধ। মাতৃভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি গভীর অনুরাগেই তিনি আদালতে বাংলা ভাষার প্রচলনে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বাংলঅভাষায় রায় প্রদানের যৌক্তিকতা নিয়েও তিনি কথা বলেছেন। তাঁর এই সকল উদ্যোগ প্রকারান্তরে দেশপ্রেমেরই ফসল।
ব্যক্তি গাজীউল হকের সঙ্গে আমার তেমন ঘনিষ্ঠতা নেই। ভাষা-আন্দোলনের এই সৈনিকের প্রতি সাধারণ একজন নাগরিক হিসেবেই আমি শ্রদ্ধা পোষণ করি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে-আন্দোলনে, সভা-সমিতিতে তাঁর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। কথা বলেছি, শ্রদ্ধা নিবেদন করেছি এই মাত্র। কিন্তু তাঁর কাছের মানুষ হয়ে ওঠার সৌভাগ্য হয়নি। এতবড় একজন মনীষীতুল্য মানুষের কাছে যাওয়ার যোগ্যতাই বা আমার কোথায়? কর্মসূত্রে তাঁর এক কন্যার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। সেই সুবাধে তাঁর বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। অল্পবিস্তর মেশার সুযোগ হয়েছে। তাঁর স্ত্রীকে খালাম্মা বলে ডাকার সুযোগ হয়েছে। আমি যখন বাংলাদেশ প্রেস ইনিস্টিটিউটে চাকরি করি, তখন তিনি পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। সভায় যোগ দিতে তিনি অফিসে আসতেন। কিন্তু তাঁকে সমীহ করতাম বলেই, সালাম দেয়ার বাইরে তেমন কোনো কথা বলার সাহস করিনি। একবার তুমুল অসুস্থ হলে, তাঁর বাসায় দেখতে যাই। বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁর শারীরিক অসুস্থতার কথা লেখা হয়। সেই সময় তাঁর জন্মদিনকে সামনে রেখে দৈনিক জনকণ্ঠে একটা নিবন্ধ পাঠাই। তারা সুবিধামতো সেটি যথাগুরুত্বে প্রকাশ করে।
আমার ওই লেখার অবলম্বন ছিল তাঁর একটি কবিতার বই এবং কয়েকটি প্রবন্ধের বই। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, তাঁর মতো মানুষের জন্মদিনের অনুষ্ঠান জাতীয়ভাবে উদযাপন করা উচিত। আমার সেই সামর্থ্য নেই। তাই লিখে শ্রদ্ধা জানানোর চেষ্টা করেছি। দুতিন দিন পরে বাংলা একাডেমীতে এক অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়। তখন অসুস্থতাকে তুচ্ছ করে তিনি উঠে দাঁড়িয়েছেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন। আমি এগিয়ে দিয়ে সালাম দিতেই তিনি চিনলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে জড়িয়ে ধরে আমার লেখাটার কথা উল্লেখ করে, আমাকে আশীর্বাদ করলেন। লেখাটা তাঁর খুব পছন্দ হয়েছে বলেও জানালেন। অনুরুদ্ধ হয়েও অনেকের ওপর লিখেছি। কিন্তু যাঁদের নিয়ে লিখেছি, তাঁদের কাছ থেকে আনন্দ পাওয়ার মতো ধন্যবাদ খুব কমই পেয়েছি। কিন্তু গাজীউল হকের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তিনি বললেন, তোমার লেখাটা আমি পড়েছি। তুমি খুব ভালো লিখেছ। আমি খুব খুশি হয়েছি। আমার খুব ভালো লেগেছে। এটি আমার জন্য বড় উপহার।’ এই রকম অনেক কথা বললেন তিনি। গর্বে ভরে উঠেছিল আমার হৃদয়। তাঁর জন্মদিনে আমার দেয়া এই লেখা-উপহার তিনি এত আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করেছেন জেনে নিজেকে ধন্য মনে হলো।
আমরা তো কিছুই দিতে পারিনি গাজীউল হককে। ভাষা-আন্দোলনের অন্যতম এই প্রাণপুরুষকে একুশে পদক দিয়ে সরকার তার ঋণ শোধের কিছুটা চেষ্টা করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দিয়ে তাঁর প্রতি যথার্থ সম্মান দেখিয়েছে। বাংলাদেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে এবং ভাষা-আন্দোলনের সকল সৈনিককে এইরকম সম্মান জানালে আমরা খুশি হবো।
বৈষয়িক কিছুু প্রাপ্তির প্রত্যাশা না করেই তিনি জাতিতে সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছেন। কিন্তু আমার যোগ্য মূল্য দিতে পেরেছি বলে মনে হয় না। বিপরীতচিন্তায় এই কথাও বলা যায়, এই লোকটির কাছ থেকে জাতির আরো কিছু গ্রহণ করা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এই লোকটির দেয়ার আরো কিছু ছিল। বিচারব্যবস্থার সর্বোচ্চ পর্যায়ে বসার যোগ্যতা তাঁর রয়েছে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ অবস্থানে তাঁকে অধিষ্ঠিত করতে পারলে এই জাতিই গর্বের অধিকারী হতো। কিন্তু তা কি আমরা করতে পেরেছি? কিংবা করার কথা ভেবেছি?
গাজীউল হকের কর্মের ও অবদানের মূল্যায়নের উদ্যোগ আমি গ্রহণ করেছিলাম। কিন্তু ব্যক্তিগত নানান সীমাবদ্ধতায় সেই কাজটি যথাসময়ে যথাপরিকল্পনায় করে উঠতে পারিনি। সেই দায় আমি বহন করছি। তবু আমার গর্ব যে গাজীউল হকের সম্মানা জানানোর এই আক্ষরিক উদ্যোগের সঙ্গে আমারও সংযোগ রয়েছে। জয়তু গাজীউল হক।
... .. .. .. ..
তপন বাগচী। কবি, গবেষক ও সাংবাদিক।
অন্তিম শ্রদ্ধাঞ্জলি : ভাষাসৈনিক গাজীউল হক
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
৯টি মন্তব্য ৮টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
কাঁচা আম পাড়ার অভিযান
গাজীপুর জেলার জয়দেবপুরের বাড়ীয়া ইউনিয়নের দেউলিয়া গ্রামে আমার প্রায় ৫২ শতাংশ জমি কেনা আছে। সেখানে ছোট একটি ডোবা পুকুর, অল্প কিছু ধানের জমি আর বাকিটা উঁচু ভিটা জমি। বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমরা কেন এমন হলাম না!
জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন
অভিমানের দেয়াল
অভিমানের পাহাড় জমেছে তোমার বুকে, বলোনিতো আগে
হাসিমুখ দিয়ে যতনে লুকিয়ে রেখেছো সব বিষাদ, বুঝিনি তা
একবার যদি জানতাম তোমার অন্তরটাকে ভুল দূর হতো চোখের পলকে
দিলেনা সুযোগ, জ্বলে পুড়ে বুক, জড়িয়ে ধরেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি
২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন
বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১
তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন