ওয়ান-ইলেভেনের পর দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটসহ নানা বিষয়ে সামরিক নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (ডিজিএফআই)-র সঙ্গে বহুবার বৈঠকের কথা স্বীকার করেছেন ওয়ান ইলেভেনের গর্ভে জন্ম নেয়া দল পিডিপি’র চেয়ারম্যান ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী। তিনি দাবি করেছেন, দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সংস্কার প্রভৃতি বিষয়ে তিনি তাদের পরামর্শ দিয়েছেন, সহযোগিতা করেছেন। তবে নিজ দল গঠন ও পরিচালনায় তাদের কাছ থেকে কোন প্রকার আর্থিক সুবিধা নেয়ার কথা অস্বীকার করেছেন। চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেছেন, এটা কেউ প্রমাণ করতে পারলে রাজনীতি ছেড়ে দেবো।
ড. কোরেশী বলেন, ওয়ান ইলেভেনের পর এক সময় সারাদেশে সমাবেশ ও র্যালির মাধ্যমে জেনারেল মইনকে ক্ষমতা গ্রহণের ব্যাপারে এক শ্রেণীর লোক উৎসাহী করে। আওয়াজ ওঠে আধা নয়, পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতা যেন তিনি হাতে নেন। আমি এতে সায় না দেয়ায় তারা আমার ওপর ক্ষুব্ধ হয়। আমাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এতে আমার দলের অনেক নেতাও রুষ্ট হয়েছে। ধাপে ধাপে তারা দলত্যাগ করেছে। কারণ, তারা যখন বুঝতে পেরেছে পিডিপি কারও ক্ষমতা আরোহণের সিঁড়ি নয় তখন তারা হতাশ হয়। সরে পড়ে।
কোরেশী বলেন, জেনারেল মইন আশির দশকের মতো বিভিন্ন দল ভেঙে একটি রাজনৈতিক বলয় তৈরি করে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করতে চেয়েছিলেন। তৎকালীন ক্ষমতাসীনরা একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করার কথাও বলেছিলেন। আমরা এসব কিছুতেই আশাব্যঞ্জক সাড়া দেইনি। আমি চেয়েছি, রাজনীতি দিয়ে রাজনীতিকে মোকাবিলা করবো। কিন্তু তারা বিএনপি-আওয়ামী লীগ ভেঙে পাল্টা দল করতে চেয়েছেন। চেয়েছেন দুই নেত্রীকে নির্বাসনে পাঠাতে। আমি এসব কিছুই সমর্থন করিনি।
তিনি বলেন, আমি প্রস্তাব করেছিলাম, আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করে পরে জাতীয় নির্বাচন দেয়া হোক। তারা আমার এই পরামর্শ শোনেন নি। জেনারেল মইন ২০০৭ সালের নভেম্বর মাসে বিদেশ সফর শেষে দেশে ফেরার পর তাদের সঙ্গে আমাদের দূরত্ব বাড়তে থাকে। তখন থেকেই তার বক্তব্য ও কর্মে ভিন্নতা দেখা যায়। এ সময় আমরাও তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে থাকি। আমি তাদের বলেছি, সাপের লেজে পা দিয়েছেন। এবার মাথা চেপে ধরুন। না হয় রাজনৈতিক সংস্কারের যে প্রতিশ্রুতি জাতিকে দিয়েছেন তা পূরণ হবে না। তবে তারা সেটা না করে দলছুট ও ভাঙা দলের অংশবিশেষ নিয়ে একটা কিছু করতে চেয়েছিলেন। আমি তাতে দ্বিমত পোষণ করি। মূলত এ কারণেই তারা আমাকে আস্থায় নিতে পারেননি।
এজন্য জেনারেল মইনের সঙ্গে আমার আনুষ্ঠানিক কোন বৈঠকও হয়নি। তবে অনানুষ্ঠানিক দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। কোরেশী বলেন, ওয়ান ইলেভেনের সবচেয়ে সুবিধাভোগী আওয়ামী লীগ এবং এর প্রধান শেখ হাসিনা স্বীকারও করেছেন, ওয়ান ইলেভেন তাদের আন্দোলনের ফসল। ওয়ান ইলেভেনের মাধ্যমে মইন উ আহমেদ বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় আরোহণের পথ সুগম করেছেন। তাই অনেকের ধারণা ছিল, তার চাকরির মেয়াদ বাড়ানো হবে। তবে, নানা কারণে তিনি সেনাবাহিনীর আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। এ জন্য ইচ্ছা থাকলেও সরকার তার চাকরির মেয়াদ বাড়ায়নি। তবে এটা সরকারের একান্ত নিজস্ব এখতিয়ার। জেনারেল মইন যে বৈপ্লবিক যাত্রা শুরু করেছিলেন সেটার ফিনিশিংটা ভাল করতে পারেননি। তাই তাকে নীরবে বিদায় নিতে হয়েছে।
রাজনৈতিক দল গঠন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিশেষ করে ডিজিএফআই-এর সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে কোরেশী বলেন, পিডিপি’র নাম পছন্দের বিষয়ে আমাদের বন্ধু অনেক সামরিক কর্মকর্তার সায় ছিল। তবে ডিজিএফআই এই দলের নাম ঠিক করে দিয়েছে একথা ঠিক নয়। তিনি বলেন, সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা আমাদের কাছে এসে বিভিন্ন পরামর্শ নিতো। আমরা তাদের সৎ পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেছি। তারা আমাদের শুভাকাক্সক্ষী মনে করতেন। তবে তাদের সঙ্গে আমাদের বৈষয়িক কোন লেনদেন হয়নি। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে চাই, পিডিপি গঠন ও পরিচালনায় কোন অবস্থায় কোন সংস্থার লোকেরা আমাদের আর্থিক সহযোগিতা করেনি। এটা কেউ প্রমাণ করতে পারলে আমি সকল রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ড ছেড়ে দেবো, চুড়ি পরে ঘরে ফিরে যাবো। তারা বহুবার আমাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। যেমন করেছে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ অন্য দলের সংস্কারপন্থি নেতাদের সঙ্গে। তবে সরকারি তহবিলে পিডিপি গঠিত হয়েছে, পরিচালিত হয়েছে এমন দলিল কেউ দেখাতে পারবে না। প্রমাণ করতে পারবে না।
তিনি বলেন, দেশের যে কোন গোয়েন্দা সংস্থাকে সহযোগিতা করাকে আমি দায়িত্ব ও কর্তব্য মনে করি। ভারত, পাকিস্তান বা অন্য কোন দেশের গোয়েন্দা সংস্থা হলে নিশ্চয় সহযোগিতা করতাম না। তাছাড়া ওয়ান ইলেভেনের পর তাদের কর্মকাণ্ডগুলোকে আমরা সমর্থন করেছি। তাই তারাও আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। তবে গোয়েন্দাদের সঙ্গে বৈঠকগুলো কোথায় হয়েছিল তা প্রকাশ করতে নারাজ ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী। ডিজিএফআই-এর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তিনি বলেন, পরে আরও কয়েকটি উপদল তৈরি করেছে তারা। উদ্দেশ্য ছিল দলছুট ও ভাঙা দলের অংশবিশেষ নিয়ে মধ্যবর্তী কোন জোট গঠন করে রাজনৈতিক সুবিধা নেয়া। কিন্তু তাতে তারা সফল হয়নি। কারণ, তাদের সত্যিকারের সুনির্দিষ্ট মিশন ছিল না। ২০০৭ সালের নভেম্বর পর্যন্ত আমরা আশাবাদী ছিলাম। তারপর থেকে আমরা আশাহত হতে থাকি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষ বছরের নানা কর্মকাণ্ডের উদাহরণ টেনে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ইতিহাসের কাছে তাদের জবাবদিহি করতে হবে। যারা তাদেরকে উৎসাহী করেছে তাদেরও বিচারের দাবি উঠতে পারে। কারণ, যে আশায় জনগণের দু’টি বছর হরণ করা হয়েছে, তাদের সেই দু’বছর ফিরিয়ে দিতে হবে। আশা করেছিলাম তারা বৈপ্লবিক পরিবর্তন করবে। পরে দেখা গেল তাদের সুনির্দিষ্ট কোন কর্মসূচি নেই। তাই আমি ২০০৮ সালের মার্চের মধ্যে নির্বাচন দাবি করেছি। সেটাই ছিল উপযুক্ত সময়। তবে তারা সময়ক্ষেপণ করে সেই সম্ভাবনাকে নষ্ট করেছে।
কিংস পার্টি বলে কতিপয় সংবাদপত্রে তাদের দলকে কটাক্ষ করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। বলেন, যারা এই শব্দটি ব্যবহার করেছে তারা এর প্রকৃত অর্থ বোঝে না। তিনি বলেন, আমি মাইনাস টু ফর্মুলা এবং রাজনৈতিক নেতা ও তাদের স্ত্রীপুত্র কন্যাদের ঢালাওভাবে গ্রেপ্তার করার বিরোধিতা করেছি। কারণ, আমার বিশ্বাস, জোর করে কারও রাজনৈতিক অধিকার হরণ করা যায় না। রাজনীতি থেকে কাউকে সরিয়ে দেয়া যায় না। দেশে জরুরি অবস্থায় যেখানে রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল সেখানে নতুন দল গঠনে আগ্রহী হলেন কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে কোরেশী বলেন, তাদের প্রাথমিক কর্মকাণ্ডে রাজনৈতিক দল গঠনে উদ্বুদ্ধ হই। ভেবেছি একটি তৃতীয় ধারার রাজনীতি গড়ে তুলবো। কারণ, দু’টি দল আওয়ামী লীগ-বিএনপি’র বাইরে মানুষের জন্য বিকল্প রাজনৈতিক পথ খোলা নেই। বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি উন্মেষ এখনও সময়ের দাবি।