somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমি তো যাদুকর নই!

১৫ ই জুন, ২০০৯ সকাল ৯:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বছর দুই পর দেশে ফিরে দেখছি তেমন কিছুই বদলায়নি। ঢাকার গরম আগের মতোই অসহনীয়, বিদ্যুৎ আগের মতোই ক্ষণদৃষ্ট, ধুলা আগের মতোই নির্বিবাদে উড়ছে, অগ্নুৎপাতের পরে পাহাড়ের মাথায় হ্রদ জমার মতোই গলির ভেতরে সরকারের লোকেরা আগের মতোই খানা-খন্দ-কাদার জন্ম দিয়ে রেখেছে। কেবল রাস্তাঘাটের জ্যাম আরও বেড়েছে। আর এখানে ওখানে প্রাইভেট ব্যাংকগুলোর সুন্দরদর্শন এটিএম বুথের ছড়াছড়ি।

এসবের মধ্যেই চেনামুখ, বন্ধু-পরিজনের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগে মনটা আনন্দময় হয়ে ওঠে। চল্লিশ-ছুঁই জীবনে অর্জিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কীর্তির ব্যক্তিগত প্রসন্নতা বা মানবিক সংসর্গের বন্ধন দু'বছরের বিদেশজীবনে সামান্য এদিক-ওদিক হয়নি, বরং পুনর্মিলনের উচ্ছ্বাসে সেসব নবরূপে হাজির।

তবে দেশছাড়ায় কিছু জিনিস তো লণ্ডভণ্ড তো হয়ই। যেমন মাথা গোঁজার ঠাঁই, অফিসিয়াল নানা স্ট্যাটাস ইত্যাদি। সেসব ঠিকঠাক করতে দু'সপ্তাহ ধরে কেবল দৌড়াচ্ছি মেগাসিটির এপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। আর হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি ট্রাফিক জ্যামের প্রকৃত পরিস্থিতি। বিগত এক দশক ধরেই শহরে চলাচল সীমিত হয়ে পড়েছিল। ঢাকার মানুষেরা নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া শহরের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে চায় বলে মনে হয়না। মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেট-ইমেইলের আবির্ভাব সময়মতো না হলে এশহর স্থবির হয়ে কেবলই ধুঁকতো। আমিও তাই করতাম, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাইরে সচারচর বের হতাম না। কিন্তু এখন বাধ্য হয়ে শহরের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত দৌড়াতে চাচ্ছি, কিন্ত পারছি না।

বাস, প্রাইভেট কার, রিকশা, সিএনজি স্কুটারের অসহনীয় সহাবস্থান শহরটাকে কেমন স্লথ বানিয়ে রেখেছে। আর রিকশা-সিএনজি ভাড়ার সেকি হাঁক! সামর্থ্য নেই, তবুও মাঝে মাঝে মনে হয়, একটা নিজস্ব কার থাকলে সামান্য সুবিধা পাওয়া যেত, চলাফেরায়। কিন্তু দেশের প্রেক্ষাপটে আমার আর্থিক স্ট্যাটাস তাকে 'অসম্ভব' বলে সম্ভাবনার দ্বারে সশব্দে কপাট লাগিয়ে দিচ্ছে। অথচ বিদেশে আমার গাড়ি ছিল।

বিদেশে আমি 'নোবডি'। দেশে কিন্তু 'সামবডি'। ফেলে আসা বিদেশজীবনের কথা তাই মনেই পড়েনা প্রায়। শুধু মনে পড়ছে আমার অতি-পুরনো টয়োটা করোলাটির কথা।

আমি যেশহরে থাকতাম, সেখানে গাড়ি ছাড়া পরিবার নিয়ে টেকা দায়। বাচ্চাদের স্কুলে পৌঁছানো, দৈনন্দিন শপিং, নিজ স্কুলে গমন ইত্যাদি রেগুলার কর্মসূচিতে গাড়ি অপরিহার্য। তাই গাড়ি কিনতেই হলো। কিন্তু আমাদের দেশে গাড়ি কেনা বলতে যা বোঝায়, সেটা তেমন কিছু ছিলনা। সেটা ছিল একটা টেলিভিশন কেনার মতোই সহজ বিষয়। কারণ গাড়িটি ছিল মহাপুরনো, দাম ছিল অতি সস্তা। ১৯৭৯ মডেলের টয়োটাটি আমি কিনেছিলাম মাত্র ২৮ হাজার বাংলাদেশী টাকা দিয়ে।

সস্তার কয় অবস্থা সবাই জানেন। ফলে গাড়িটি প্রায়ই সকালবেলা স্টার্ট নিতো না। ব্যাটারি পরিবর্তন করলাম। উন্নতি নাই। সকালবেলা বাচ্চাদের স্কুলে নেবার জন্য যেটা কেনা, সেই সার্ভিসটাই সে দিতে পারছে না। যেদিন গাড়ি স্টার্ট নিতো না, প্রতিবেশীদের জন্য অপেক্ষা করতাম, একই স্কুলে কেউ বাচ্চাদের নিচ্ছে কিনা। একজন প্রতিবেশী পরামর্শ দিলেন ঐ উঁচু জায়গায় গাড়ি রাখেন। যদি স্টার্ট না নেয়, তবে গড়িয়ে দেবেন। এক বা দুই গিয়ারে রেখে ক্লাসটা ছেড়ে দিবেন, স্টার্ট হয়ে যাবে। এই পরামর্শে কাজ দিল। সারাদিনের কাজ সেরে গাড়িটাকে দিনশেষ উঁচু জায়গায় পার্ক করতাম, সকালে গড়িয়ে দিতাম, একবার স্টার্ট নিলে তাকে আর পায় কে। পঙ্খিরাজ যাকে বলে!

এই পদ্ধতিতে স্কুল, শপিং এমনকি উইক এন্ডে বেড়ানো, সব সার্ভিসই দিয়েছে আমার সেই জগদ্দল। জগদ্দল হলো সুবোধ ঘোষের বিখ্যাত 'অযান্ত্রিক' গল্পের গাড়িটির নাম, যে গল্প অনুসারে নির্মিত ঋত্বিক ঘটকের 'অযান্ত্রিক' চলচ্চিত্রটি অধিক বিখ্যাত হয়। সেখানে গল্পের নায়ক ট্যাক্সি ড্রাইভারের সঙ্গে তার ভাঙ্গা গাড়িটির এক অদ্ভূত সম্পর্ক স্থাপিত হয়, যা প্রায় মানবিক আবেগীয় সম্পর্কে উন্নীত হয়। গাড়িটি চলবে কি চলবে না, কখন কী আচরণ করবে তা কেবল ঐ ট্যাক্সি ড্রাইভারই বোঝে, অন্য কেউ বোঝে না। আমার জগদ্দলটি আমার হাতেই ভালো থাকতো। খোলা মহাসড়কে সাঁই সাঁই বেগে গাড়ি ড্রাইভ করার যে মজা, তা আমার ভাঙ্গা করোলা ঠিকই দিতে পেরেছে। দেশে ফেরার আগ দিয়ে গাড়িটিকে বিক্রি করার জন্য নোটিশ লাগালাম তার গায়ে। কেউ কিনতে আসেনি। অগত্যা এক মেকানিকের কাছে জলের দরে তাকে দিয়ে আসলাম। সে সম্ভবত জগদ্দলকে জবাই করবে, তার চামড়া-হাড্ডি-গোশত আলাদা আলাদা করে জ্বাল দেবে, গলাবে এবং এভাবে অন্য কোনো কাজে লাগাবে। তাকে যখন চীনা মেকানিকের হাতে তুলে দিলাম, খুব মনখারাপ হলো। সেদিনই দেশে ফিরবো, মনটা চঞ্চল ও আনন্দিত। বিদেশের আরাম-নিরাপত্তা আমাকে মোটেই পিছু টানতে পারছে না। কেবল গাড়িটার জন্য মনটা ভীষণ খারাপ হলো।

এখন ঢাকায় এসেও সেই গাড়িটার কথাই মনে পড়ে, যখন মনে হয় নিরাপদ সড়কে কী নিরাপদে গাড়ি চালাতাম! আর ঢাকার সিএনজিচালক, বাস-কার ড্রাইভার বা রিকশাচালক কী ঝুঁকি নিয়েই না গাড়ি চালান। অপ্রশস্ত বেশিরভাগ রাস্তায় লেনের চিহ্ন নেই, থাকলেও সেটা ধরে গাড়ি চালানোই অনিয়ম। লক্ষ্য কেবল এগোনো, নয়তো যখন যেখানে ফাঁক পাওয়া, এঁকেবেঁকে কাত হয়ে সেখানেই নিজের বাহনকে গুঁজে দেয়া এবং পাশেরটির সঙ্গে ধাক্কা লাগার আগেই ব্রেক কষে ফেলা। ঢাকার চালকেরা কী যাদুকর? এইসব পর্যবেক্ষণ দু'বছর আগেও করতে হয়নি, কারণ দেশে আমি কখনোই রাস্তায় গাড়ি চালাইনি। এযাবত ঢাকায় আমি কেবল যাত্রীই ছিলাম কেবল। এখন খুব ভাবি, এখানেও একটা জগদ্দল দরকার। ধরা যাক, ১০ বছর পর আরেক জগদ্দলের চাবি হাতে উঠলো, কিন্তু তাকে চালাবো কী প্রকারে? আমি তো যাদুকর নই!

চিত্র: ফেলা আসা জগদ্দল।
১৯টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সিকান্দার রাজার চেয়ে একজন পতিতাও ভালো।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৭

সিকান্দার রাজা কোকের বোতল সামনে থেকে সরিয়ে রাতারাতি হিরো বনে গেছেন! কিন্তু তাকে যারা হিরো বানিয়েছেন, তারা কেউ দেখছেন না তিনি কত বড় নেমকহারামি করেছেন। তারা নিজেদেরকে ধার্মিক বলে দাবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৫৬

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ অন্তর্জাল।

ছোটবেলায় মুরব্বিদের মুখে শোনা গুরুত্বপূর্ণ অনেক ছড়া কবিতার মত নিচের এই লাইন দুইটাকে আজও অনেক প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×