somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মুক্তগদ্য:ধান ভানতে শীবের গীত হ্যামিলনের বাঁশিঅলা: আর আমার কত অজানারে

১০ ই জুন, ২০০৯ বিকাল ৫:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

হ্যামিলনের বাঁশিঅলা গল্পটা, এক বাঁশিঅলাকে নিয়ে, কিন্তু এই গল্পটার পূর্ণ জন্মও কি কোন একক গল্পকারের মনেই হয়েছিলো? তো বহন করলো কারা এই গল্পটা, শিশুরা, এত বুদ, নাকি শিশুদের মায়েরা, এত নাজুক, নাকি শিশুদের বাবারা, এতো উন্নাসিক, নাকি এলাকার প্রশাসকেরা, এতো ক্ষমতাবান, নাকি সবাই? কেন এরা এমন গল্প বহন করে চলে যুগের পর যুগ, এর পেছনের কারণগুলো কি আমরা কখনও অনুধাবনের চেষ্টা করি? অনেকেই করি নিশ্চয়, কিন্তু...
শহরের ইঁদুর নিধনের ভেতর দিয়ে এত উৎপাতের সমাপ্তি যেমন আমাদের স্বতোদ্বেলিত করে তেমনি শেষাংশে শিশুদের হারিয়ে যাওয়া আমাদের স্তম্ভিত করে। বড় সফলতা আর বিশাল ক্ষতি ছাড়া আমাদের আনন্দ বিহ্বল আর কষ্ট বিমূঢ় হয় না। এখানে দুটোই একইসাথে ঘটেছে, বিপরীত এবং তীব্র। আর আমরা দুলি তীব্র। চরম পরিস্থিতিই চরম একাত্মতা আদায় করে নেয় আমাদের। এই জন্যই কি গল্প এত চুম্বকনময়।
একজন বাঁশিঅলা কি এত দক্ষ হতে পারে, যে আসলে বাঁশি বাজিয়ে স্থলচারী ইঁদুরদের পাগল করে দিতে পারে এবং যারা সমুদ্রের পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময় থমকে দাঁড়ায় না, নিজেদের মৃত্যু পানিতে হতে পারে ভেবে, সাঁতারমুর্খতা সত্ত্বেও। তারা এতদূর পথ পার হয়ে আসার পর ক্লান্ত হয়ে পড়তে পারতো, এবং লাফিয়ে পড়ার ক্ষেত্রে, অবশ্যই জানের ভয়ে থামতে বাধ্য হতে পারতো। এমন সূরের কথা আমরা জেনেছি সমুদ্রগামী জাহাজিদের ক্ষেত্রে যেখানে মোম গলিযে কান বন্ধ করে রাখতে হতো, না হলে সাইরেনদের গান তাদের সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে বাধ্য করতো, কী এমন সুর তৈরি হলো যা ইঁদুরগুলোর মরণভয় বিলুপ্ত করে দিলো? নাকি ইঁদুরগুলো এমন পাগলপাড়া হলো বলেই, যা আসলে অসম্ভব, তার জন্যই কি ঐটি গল্প এবং এমন মুগ্ধতা সঞ্চারি!
আর এমনই যার ক্ষমতা, তার বাঁশিতে কেন এমন সূর নেই যা প্রশাসন যন্ত্রকে বশ করতে পারে, নাকি কোন শিল্পী বা লেখকই প্রশাসন যন্ত্রকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে না বলে লেখে বা গল্প বানায়, এভাবে প্রতিটা গল্পই কি হতাশার সন্তান? না হলে, ইঁদুরকে বশ করতে পারে, শিশুদের পারে, অথচ প্রশাসকদের পারে না কেন, কিংবা শিশুদের অভিবাবকদেরই বা নয় কেন? নাকি বাঁশিওলা সেই সময়কার গ্রামীন পুরোহিতদের কোন আর্কিটাইপ, যাদের গা থেকে সমস্ত আধ্যাত্মিক ও অধিদ্যিক মহিমা খুলে পড়ে নিঃস্ব হয়েছে, শহর পত্তনের ফলে, কেউই তাদেরকে আর মূল্যায়ন করে না। তাই তার পক্ষে বাস্তব সম্মত কোন কাজ করে আর দেখানোও সম্ভব নয় তার ক্ষমতা। ফলে সে এমন এক অলৌকিক ও কল্পিত প্রতিশোধের গল্প ফেঁদেছে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে, প্রশাসকরা শহর পত্তনের সাথে সাথে যার পৌরহিত্য ছিনিয়ে নিয়েছে, তার বহুবছর পরে। সে যে শহরের নয় সেটা স্পষ্ট, শহরে সে এলো, কাজ শেষে চলেও গেলো, বাঁশিটি তার কথিত জাদুদন্ড হয়তো, শিশুগুলোকে নিয়ে যাওয়া হয়তো শহরবাসির প্রতি পুনরায় গ্রামে ফেরারই আহবান এবং নিজের পুরোনো রমরমা অবস্থা পুনরোদ্ধারের কল্পনাও।
তা ছাড়া এটা ভাবার ব্যাপার আছে, শিশুদের নিয়ে চলে গেল এই শহর ছেড়ে, যেকারণ এর পেছনে গল্পে দেখানো হলো, তার পাওনা, তার পাওনা কি অযৌক্তিক নয়? তার বাঁশির সুর কি খাদ্য উৎপাদন করতে পারে না? সেই বা এত উঁচু দাম হাকালো কেন? তার কাজের জন্য যে দাম চাইলো তার ভেতর দিয়ে সে কি আসলে বিত্তশালী হয়ে উঠতে চায়, যা আসলে প্রশাসকদেরই অনুসরণ, কিংবা তার যদি এতো সম্পদের অভাব এবং নিজেকেই চালাতে অপারগ তাহলে সে শিশূদের যে দলবেধে ধরে নিয়ে গেলো, তাদেরকে কিভাবে লালন করবে, তাদেরকে কি সে মেরে ফেলতে নিয়ে গেলো? আর তাই যদি হবে, অভিভাবকরা কি শহরের উপর দিয়ে দল বেধে চলা শিশুদের দেখে একবারও ভাবেনি, তাদের ফেরানো উচিত, সারাদিন অপেক্ষা করে বুঝতে পারলো শিশুরা ফিরছে না? এটাও অদ্ভুত নয়! সাধারণ মানুষের মাঝে শিল্পীদের উপর যে এক মঙ্গলময় বিশ্বাস বজায় রয়েছে, তার উপরই এক আঘাত কি এই গল্প? নাকি এ বাঁশিঅলার কেবলই বুদ্ধির অগ্রাধিকার বলে এতো নিষ্ঠুরতা সাজে? কেবল বুদ্ধির বা দক্ষতার জন্য মানুষের কাছ থেকে কারো এতো দাবীদাওয়া আদায় কি শ্রেয়বোধ সম্মত? এই মেধা, যার প্ররোচনায় অহংকারী সত্তা সবকিছুতে নিজের অগ্রাধিকার দাবী করে বসে এবং অন্যকে নিজের অধস্তনভাবে এবং এটাও কি তাই? নাকি অতি দক্ষ লোক যেমন বড় সংকটের সমাধান করতে পারে তেমনি বিরাট সংকটেরও সৃষ্টি করতে পারে অর্থাৎ মানুষমাত্রেই একাধারে উপকারী ও ভয়ংকর, বিরাট মানুষের ক্ষেত্রে তা মাত্রায়ও বিরাট, শিল্পীও এক্ষেত্রে ব্যাতিক্রম কেউ নয়, এবং তাকেও সমালোচনাহীনভাবে গ্রহণের কোন সুযোগ সমাজমানসের নেই। শিল্পীকে এ সমাজ খুব আন্তরিকভাবেই চায় কিন্তু তাকে ঘিরে বিরাট ক্ষতির ব্যাপারও বিদ্যমানÑএই বার্তাই কি এতে দীপ্যমান। যে সবচেয়ে বড় উপকার করে, সমাজের সবচেয়ে বড় অপকারটিও সেই করে, একাধারে, হায়। বুদ্ধিমান মেধাবি মানুষের প্রতি সমাজের যেমন মুগ্ধতা রয়েছে, তেমনি রয়েছে ভয়; সে একাধারে টোটেম ও টাবু, হায়। কেননা,দক্ষতম লোকগুলোই সমাজকে নতুনভাবে গড়ে এবং ভাঙে, গড়ার আনন্দ আর ভাঙনের ভয় সঞ্চারিত করে দেয় তারা সমাজ মানসে, এর প্রতিক্রিয়াই এই গল্প।
শহরের মেয়রও কি বাধা দিলো না তাকে, যাকে দাবীকৃত পরিমাণ স্বর্ণমুদ্রা পরিশোধে অস্বীকার করলো, তাকে তো সন্দেহের এবং পর্যবেক্ষণে রাখার কথা, যে এতো বড়ো একটা ঘটনা ঘটালো, এতো দক্ষ যে, ইঁদুরের উৎপাত থেকে শহরটাকে বাঁচালো, সে যেদিকেই যাক সেদিকেই তো প্রশাসকদের সংশয়কীর্ণ মনোযোগ থাকার কথা! তাদের মনোযোগ তো দেখি না! তাহলে? নাকি গল্প এমন অনেক ফাঁক ফোঁকর রেখেই নির্মিত হয় এবং সমাধানহীন এক ধাঁধার মধ্যে পাঠককে ঘুরিয়ে মারার ব্যবস্থাই কি গল্প?
কিংবা ধরা যাক, যে ছোট শিশু ঘরের ভেতর থাকে, তার বেরিয়ে যাওয়ার সাথেও তো মা বা বাবা কেউ পিছু নেওয়ার কথা, তাহলে কি তারা একটা নিদির্ষ্ট বয়েসের শিশু, যারা স্কুলে যাবার, মাঠে যাবার, ঘরের বাইরে খেলা ধুলা করার অনুমোদন পেয়েছে, তাদেরই নিয়ে গেলো বাঁশিঅলা, যাদের নিয়ে মা বা বাবা সাধারণত সারাক্ষণ ভাবনাব্যস্ত থাকে না?
নাকি এ আসলে একটি শিশুর সামনে অজানা জগতের টান, যেটান কোন শিশুই অস্বীকার করতে পারে না, নতুনের টানে, অজানার আকর্ষণে শিশুদের বাড়ি থেকে দূরে পালানোর যে বয়সটা, সেই বয়সটা এটা এবং তাদের মনোজগতের দিকে চেয়েই কি এ গল্প মায়েরা বানিয়েছে, যা আসলে মায়ের ট্র্যাজিক অনুভূতির এক রূপকল্প, সবকিছু যার যার পাওনা ঠিকঠাক বুঝিয়ে দাও, না হলে আমাদের অবুঝ সবুজ শিশূরা হারিয়ে বা পালিয়ে গেলে কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে না। এবং শিশু যত বড় হয় ততই মায়ের জগতের প্রতি তার মনোযোগ কমে আসে এবং বাহির বিশ্বের হাজারো কাজ তার সমস্তটা সময় দখল করে নেয়, অন্যকথায়, মায়ের কাছ থেকে জগৎ শিশুকে ধীরে ছিনিয়ে নেয়, যা কোন মা-ই চায় না, বা চাইলেও তার নিজের শূন্যতাকে মেনে নিতে পারে না। একি তার সেই অবচেতনের ভয়ংকর গল্প বহির্বিশ্বের প্রতি ছুঁড়ে দেয়া, দেখো আমার মন, এমন মনোযোগকাড়ার প্রচেষ্টা, একটা শহর শিশু শূন্য হলে যে বেদনা, যে স্তব্ধতা, যে শূন্যতা নেমে আসতে পারে, তারই উপমা এক মায়ের মন। জগতের কোথাও অবিচার হলে তার শিশুর প্রতি তা বিপদ বয়ে আনবে- গল্পটি কি মায়ের এমন উদ্বেগের এক জগৎ?
গল্পটা কি প্রশাসনই জন্ম দিয়েছে? নাকি বাবারা, রাজনৈতিকভাবে এর ভেতর দিয়ে তাদের কোন অভিপ্সা পূরণ এবং নিজেদের একাত্ম করার ইচ্ছার প্রতিফলন, এমন একটা গল্পতো অভিবাবকদের জোটবদ্ধ না করে পারে না এবং প্রসাশকদের প্রতি একধরনের অবিশ্বাসকেও গল্পাকারে ছুঁড়ে দেয়া, যাদের ভয়ে সত্যও বলা যায় না, সেখানে একটা গল্পের আশ্রয়ে প্রশাসকদের অবিচারকে সামনে আনা যে, শহরের সবচেয়ে বড় উপকার করা লোকটিও তার নায্য পাওনা পায় না, অন্যরাতো তথৈবচ, শহরের প্রশাসকরা বহুদিন থেকেই দুনীর্তিবাজ, এমনসব সম্ভবনা কি আমরা বাতিল করে দিতে পারি?
নাকি শহরের দক্ষ বুদ্ধিজীবি পেশাধারী লোকদের তৈরি এ গল্প, যেটা প্রশাসনের কাছ থেকে বেশি দাবী দাওয়া আদায়ের চেষ্টা থেকেই কি জন্ম নিয়েছে? এ গল্প দক্ষ পেশারুদের পক্ষে সাধারণ মানুষকে বুঝিয়ে দেয়, আমরা ঠিকঠাক পরিশোধিত না হলে তোমাদের সন্তানরা বাঁচবে না এবং প্রসাশনকে জানিয়ে দেয়, একটা অদক্ষ অশিক্ষিত নতুন প্রজন্ম মানে মৃত প্রজন্মই এবং তারা না হলে এই শহরই টিকবে না। এরা কি সেই ক্ষমতাশালী পেশাজীবি শ্রেণী যেমন আজকের দিনের ডাক্তার, উকিল, ব্যবসায়ি কি প্রকৌশলি, যারা দেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক সুবিধা ও ক্ষমতার সিংহভাগই ভোগ করে, এবং একে তাদের বুদ্ধির নায্য অধিকার মনে করে, এ গল্প কি তাদেরই কারসাজি?
আমরা সাধারণত যাদের মাধ্যমে উপকৃত হই, তাদের প্রতি আমাদের এক ধরনের মোহ ও মুগ্ধতা জন্মে। এর সুযোগ নিয়ে উপকারকারী নায্য পাওনা বা মর্যাদার চেয়ে বেশি বা অবৈধ দাবীদাওয়া আদায় করতে পারে এবং আমরা এর ভেতর দিয়ে বিপদে পড়তে পারি। শিশুদের বেলা এ বিষয়টি আরো সত্য, কারো প্রতি একবার মুগ্ধ হলে তার প্রতি বিবেচনাহীন দুর্বলতা দেখানোই তাদের পক্ষে স্বাভাবিক, এই দুশ্চিন্তাই কি গল্পটিতে ছড়িয়ে আছে? তাদের এ গল্পে কি কর্মব্যস্ত মাবাবার সন্তানকে সুরক্ষা দেয়ার অভিপ্সাই প্রকাশিত হয়েছে? যারা সারাক্ষণ দূর থেকে সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন, তাদের গল্পই কি এটা?
শহরটা পাহাড়ের কাছাকাছি, এবং শিশুরাও পাহাড়ের কোন গুহায় কেন হারিয়েছে? এটা কি সেই গহন আঁকাবাঁকা এবং উঁচুনিচু দুর্গম পথের প্রতি শিশুদের ভয় দেখানো, যেনো তারা সে পথে না ছুটতে যায় এবং না হারায়?
আচ্ছা, গল্পটার সমাপ্তি এমন নিষ্ঠুর এবং ট্র্যাজিক কেনো? এটা কি সেই শহরবাসীর কোন গভীর হতাশা থেকে জন্ম নিয়েছে, যার ফলে কারো মনে গল্পটার জন্ম নেয়ার পর তা থেকে পুরো জনমানস তৃপ্ত হয়েছে, নিজেদের ভাবনার প্রতিধ্বনি শ্র“ত হয়েছে এবং এই গল্পকে আজও তাই বাঁচিয়ে রেখেছে?
নাকি প্রশাসন যন্ত্রের সাথে একটা চিরন্তন সংঘর্ষ লেগেই আছে, কর্মসম্পাদন কারী লোকদের, এবং প্রশাসন কখনই একজন ইন্ডিভিজুয়্যালকে তার সঠিক প্রাপ্য দেয় না এবং এর ভেতর দিয়ে সে হতাশ হয়ে পড়ে এবং অদ্ভুত কল্পনার জন্ম দেয়, প্রতিশোধের সরাসরি কোন উপায় দেখে না, ফ্যান্টাসির জন্ম দেয়Ñ এই গল্প তারই এক সাধারণ নমুনা কিনা কে জানে!
কিংবা প্রশাসনই অপরাধ করে আর এর দক্ষ এবং কর্মী বা প্রশাশক শ্রেনী এর শাস্তির শিকার হয় না, শিকার হয় তারাই, যাদের এই অপরাধের সাথে কোন সর্ম্পকই নেই, এখানে তারা হলো দক্ষ শ্রেনীটিকে যারা অনুসরণ করে বেড়ে উঠে সেই দামাল, নিরীহ, আত্মমগ্ন, অদক্ষ, অপক্ক বিচারবোধ সম্পন্ন শিশুকোশোর শ্রেণী। এ ক্ষেত্রে যে শাস্তি দাতা সেই বা কেমন বিচারক, যে নিজের প্রতি অন্যরা অবিচার করেছে বলে বুঝতে পেরেছে, অথচ শাস্তি দেয় অন্যদের, এতে কি প্রশাসকরা আদৌ শাস্তি পেলো? যে এতো দক্ষ এবং ন্যায জ্ঞান সম্পন্ন সেও এমন স্ববিরোধী? নাকি গল্পকার যা ঘটে গিয়েছিলো এবং একে ঘিরে আমার মতো তাল তাল প্রশ্নের অতলে পড়ে গিয়েছিলো এবং তা মেনে নিতে পারে নি এবং গল্পটি বলে বলে তার প্রতিবাদ করেছিলো? নাকি গল্পটা কেউ লেখে নি এবং কোথাও না কোথাও ঘটনাটি ঘটে থাকবে এবং তারই স্মৃতির অবশেষ এই গল্প, যা বিবেক তাড়িত মানুষ, যারা আজও ঘটনাটিতে ব্যাথা পায় তাদেরই দায়, একে বাঁচিয়ে রাখে এবং পরবর্তি প্রজন্মের বিবেকের প্রতি ছুঁড়ে দেয়া এক ট্র্যাজিক ও স্ববিরোধময় প্রশ্নমালা, যা আজও মানুষ তার মর্মে (?) বয়ে বেড়াচ্ছে?
আমরা আরো অনেক কিছু ভাবতে পারবো গল্পটিকে ঘিরে কিন্তু নিশ্চিত হতে পারবো না। গল্পটাতে যে এত সব প্রশ্নের উত্তর বলা নাই, তার কারণ কি সবাই তখনকার সময়ে শহরের যাবতীয় বিষয়ে মোটমুটি সর্বজ্ঞাত ছিলো যে, গল্প ইঙ্গিতে এগোলেও সবাই এর সঠিক অর্থটি বুঝে নিয়েছিলো? আচ্ছা, তখনকার সময়ে গল্প বলতে কি বুঝতো লোকজন, আমরা যেমন বুঝি তেমন নয়, নিশ্চয়? কিংবা, তারা গল্প বলে কিছুই বুঝতো না। এবং এ গল্প আসলে গল্প নয়, তখনকার মানুষ সত্য মনে করতো এবং ভীষণ ভয় পেয়েছিলো, এ গল্পটির জন্ম যখন, তখনকার আর্থসামাজিক পরিবেশ এবং তাদের সম্ভাব্য সংকট এবং সম্ভাবনাগুলো কেমন ছিলো সামাজিক ক্ষেত্রে? তাদের রীতিনীতি কেমন ছিলো? এ সব না জেনে কি গল্প পড়া যায়? কিংবা পড়া গেলে, গল্পের অর্থের এই যে বিবর্তন ধারা এ কেন গল্পের সাথে বিযুক্ত থাকবে, কিংবা গল্পকে কি আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করি, এবং গল্পের পেছনে পাঠকের চেতনার অংশগ্রহন কি মানি না? গল্পটি যেসময়ের যে পাঠক পড়ছে তার সংস্কৃতি এবং তার মনোভাব, নৈতিকতা, দর্শন, সাধারণজ্ঞান, বিশ্বাস কি গল্পটিকে তার মতো করে নিচ্ছে না, তা হলে গল্প আর স্বয়ংসম্পূর্ণ রইলো কই, সে তো এই দিক দিয়েও সময়ের এবং স্থানের এবং ব্যাক্তি পাঠকের উপর নির্ভরশীল এবং তাহলে কি বলছি গল্প বিভিন্ন পরিস্থিতিতে ভিন্ন অর্থ নিয়ে আসে, আসে যদি, আসল অর্থ কোনটা, যেটা আমি করছি, নাকি বেশির ভাগ মানুষ যে অর্থকে মোটামোটি মেনে নিয়েছে সেটাই, সেই প্রজন্মের জন্য সেটাই কি আসল অর্থ, তাহলে কি গল্পে বিভিন্ন অর্থ থাকে, যারা বিভিন্ন সীমাবদ্ধতায়ও ভোগে? এবং গল্প সময়ের, বাস্তবতার দর্পন হয়ে ওঠতে গিয়েও তা আর হতে পারে না পূর্নভাবে, এবং তাহলে গল্পকারের বাস্তবতার প্রতি বিশ্বস্ত থাকার অর্থ কি? গল্পকার যে সময়ে বসবাস করে সে সময়ের মানুষজন বাস্তবতা বলতে যা বোঝে তার অনুসরণে নিজের অবলোকনকে সিদ্ধ করে তোলা? তা হলে কি সে নিজের কাছে বিশ্বস্ত? নাকি সময়ের কাছে, নাকি সংস্কৃতির কাছে, নাকি বাস্তবতার কাছে, নাকি এর মধ্যে অংশত সবগুলো, এবং পূর্ণত কোনটাই নয়? তা হলে আমি যদি বলি, আমি জীবনের গল্প লিখি, তাহলে আমি কী বোঝাতে চাই? জীবন এবং গল্প, এদের মাঝখানে যে ব্যবধান তাকে হ্রাস করতে চাই, কিন্তু যে পড়বে সে তা নিজের বোঝমতো পড়বে, বুঝবে এবং নিজের রঙে রাঙাবেই অংশত, আর পাঠক ছাড়াতো কোন গল্পের অস্তিত্বই নেই! তা হলে কেউ গল্পের ভেতর জীবনকে যতোভাবেই প্রবেশ করাক, যে পড়ে সে কি সেভাবেই গল্প থেকে জীবনকে নিংড়ে নিবে? না কি এমন বিশ্বাস, এমন আস্থার প্রতি সন্দেহ পোষণ করে গল্পে জীবন চর্চা করা যায় না? কিংবা সংশয়, পাঠক ভেদে গল্পের মর্ম যদি পাল্টায় আর পাল্টায়, মাত্রাভেদে বা গুনগতভাবে এবং এক সংস্কৃতির গল্প যদি অপর সংস্কৃতির কাছে পুরো বোধগম্য না হয়, বা ভুলার্থের জন্ম দেয়, তাহলে? কিংবা গল্পকারের দেশের সংকটের বিষ্টিতা তাকে দিয়ে যেগল্প লিখিয়ে নিলো, এ সংকটের তীব্রতা অনুপাতে এর প্রতি গল্পকারের দেশের পাঠক যেভাবে সারা দেয়, অন্যদেশে সে সংকট একবারেই তীব্র নয় বলে, অন্যদেশের পাঠক হয়তো সাড়া দেবে না, ভাববে, “দূর এসব কোন গল্প হলো! এসব আমাদের পড়ার ব্যাপার নয়।” তা হলে? তখন মনে হয়, গল্পের ভেতর জীবনের চর্চা কি, কেবল দেশ সাপেক্ষ, সংস্কৃতি সাপেক্ষ ব্যাপার?
আর জীবনের গল্প যদি এত ফাঁকফোঁকর রেখেও তা জীবনেরই গল্প থেকে যায়, স্পষ্টতার অর্থ কি? এর অর্থ তো একটা মুহুর্ত নিয়ে অসীম বাগবিস্তার করা এবং এর অর্থ, স্পষ্ট করতে গিয়ে মুহুর্তটিকে আরও অস্পষ্ট করা, এবং এক মুহুর্ত থেকে আরেক মহুর্তে ছুটে যাওয়ার বিষয়টিকে একেবারই থামিয়ে দেয়া, অবস্থানটি স্পষ্ট হলো কিন্তু গতিটি নষ্ট হলো, জীবনের গতিটি কি উপেক্ষা করা চলে? জীবনের গল্প বলে যারা কেবল ডিটেইলে যায় তারা সম্ভবত এই সত্যটি ভুলে যায় এবং একটি মুহুর্তের স্থানিক সৌন্দর্যে মগ্ন থাকে এবং গল্প বিস্তার পায়। আমরা মুহুর্তের জটিলতা, ঐশ্বর্য এবং বিস্তার দেখি, আমাদের গতির বোধ লুপ্ত হয়। যেসব গল্পকার জীবনের গতিকে ধরতে গিয়ে মুহুর্তের ঐশ্বর্য আর জটিলতাকে উপেক্ষা করে, তারা? তারা কি জীবনের গল্প বলে না? কিংবা মুহুর্ত ও গতি, একে অপরের পিঠে লেগে আছে শত্র“র মতো, এবং শত্র“তা জান্তব রূপ পায় লেখকের কলম যখন চলতে থাকে। এদের মাঝে কোন বিন্দুটি ভারসাম্য বিন্দু? সেটা কি একজন গল্পকারের কাম্য কখনও? এটাই তো সেই বাস্তবতা, যেটা লেখককে লেখার হাত থামিয়ে বসে থাকতে প্ররোচিত করে। এটাই তো যেকোন সময়ের পৃথিবীর চলতিরুপ এবং এটাকেই সম্ভ^বত অস্বীকার করে লেখক। কারণ সে তাই দেখাতে চায়, সম্ভবত, আমরা যা দেখি না, বা দেখলেও উপেক্ষা করি এবং এর ফলে লেখকের কাছে তা মানুষের জন্য অবমাননাকর ঠেকে, লেখকের কলম সম্ভবত চলে এই বিন্দুটিকে উপেক্ষা করার জন্যই। ফলে ভারসাম্য বিন্দুটি লেখকের জন্য একটা চির-হারা-বিন্দু, যেটা সে সন্ধান করে কিন্তু খুঁজে পায় না, আবার লেখে, এবং এর সন্ধান কোন এক দিকে ঠেলে দেয়, হয় মুহুর্তের মধ্যে, নয় এক মুহুর্ত থেকে ভিন্ন মুহুর্তের মধ্যে ছুটে চলায়, অর্থাৎ, এদের কোন একটার দিকে অতিরিক্ত ঝোঁকে পড়তে তাকে বাধ্য করে, কিংবা একেক সময় একেকটার দিকে। তো জীবনের গল্প? এমনই।
০২.০৪.২০০৯

১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আজকের ব্লগার ভাবনা: ব্লগাররা বিষয়টি কোন দৃষ্টিকোন থেকে দেখছেন?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৯ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪১


ছবি- আমার তুলা।
বেলা ১২ টার দিকে ঘর থেক বের হলাম। রাস্তায় খুব বেশি যে জ্যাম তা নয়। যে রোডে ড্রাইভ করছিলাম সেটি অনেকটা ফাঁকা। কিন্তু গাড়ির সংখ্যা খুব কম।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাপ, ইদুর ও প্রণোদনার গল্প

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৯ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪৪

বৃটিশ আমলের ঘটনা। দিল্লীতে একবার ব্যাপকভাবে গোখরা সাপের উৎপাত বেড়ে যায়। বৃটিশরা বিষধর এই সাপকে খুব ভয় পেতো। তখনকার দিনে চিকিৎসা ছিলনা। কামড়ালেই নির্ঘাৎ মৃত্যূ। বৃটিশ সরকার এই বিষধর সাপ... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের সংগ্রামী জনতার স্লুইস গেট আক্রমণ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৯ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২১


(ছবির লাল দাগ দেয়া জায়গাটিতে গর্ত করা হয়েছিল)

শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

২৩শে এপ্রিল পাক সেনারা ফুলছড়ি থানা দখল করে। পাক সেনা এলাকায় প্রবেশ করায় মানুষের মধ্যে ভীতিভাব চলে আসে। কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাড়ির কাছে আরশিনগর

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ০৯ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৫০


বাড়ির কাছে আরশিনগর
শিল্পকলা একাডেমির আশেপাশেই হবে চ্যানেলটার অফিস। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করল মৃণাল। কিন্তু খুঁজে পাচ্ছে না সে। এক-দু'জনকে জিগ্যেসও করল বটে, কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারছে না।

কিছুদূর এগোনোর পর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি ভালো আছি

লিখেছেন জানা, ০৯ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯



প্রিয় ব্লগার,

আপনাদের সবাইকে জানাই অশেষ কৃতঞ্গতা, শুভেচ্ছা এবং আন্তরিক ভালোবাসা। আপনাদের সবার দোয়া, সহমর্মিতা এবং ভালোবাসা সবসময়ই আমাকে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে শক্তি এবং সাহস যুগিয়েছে। আমি সবসময়ই অনুভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

×