somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রবীন্দ্রনাথকে লেখা অপ্রকাশিত পাঁচপত্র

২০ শে মে, ২০০৯ রাত ২:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রবীন্দ্রনাথকে লেখা অপ্রকাশিত পাঁচ পত্রঃ
১৯২৪ থেকে ১৯৩৮ পর্যন্ত কালপর্বে রবীন্দ্রনাথকে লেখা খ্যাত-অখ্যাত পাঁচজন কবি যশস্কামের অপ্রকাশিত পাঁচটি চিঠি এখানে গ্রথিত। সাহিত্যিক বিবেচনায় নয়, সামাজিক ঐতিহাসিক গুরুত্বের পরিপ্রেক্ষিতে আপাততুচ্ছ এসব পত্র বিবেচ্য।
রাজশাহীর হোমিওপ্যাথ ডাক্তার কবি এমএ (মীর আজিজুর) রহমানের চিঠিতে কবির কাছে প্রার্থনা করা হয়েছিল রহমান সাহেবের প্রকাশিতব্য মাস্তানা কাব্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের পূর্বে প্রদত্ত হারিয়ে যাওয়া অভিমতটি আবার লিখে দিতে। কলকাতা মাদ্রাসার শিক্ষক কাজী কাদের নওয়াজ তাঁর উপহার দেওয়া মরাল কাব্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের প্রতিশ্রুত অভিমত চেয়ে লিখেছেন। মালদহ জেলা স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র এ কে এস (পরে আ কা শ) নূর মোহাম্মদ একটি কবিতা পাঠিয়ে অনুরোধ করেছেন কবি যেন কোনও পত্রিকায় সুপারিশ করে কবিতাটি প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। বগুড়ার স্কুল ছাত্রী সাড়ে এগারো বছর বয়েসী জেব-উন-নেছা (পরে জেব-উন-নেসা জামাল) রবীন্দ্রনাথকে ‘দাদু’ সম্বোধন করে তার কাঁচা হাতের লেখায় চিঠিতে কবির স্নেহলিপি প্রার্থনা করেছিল।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মুসলমান সমাজের নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত, সাড়ে পাঁচ বছরের শিশু মামুন মাহমুদ থেকে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, হিজ হাইনেস আগা খান-খাজা নাজিমউদ্দিন, স্যার আজিজুল হক ও আবদুল গাফফার খান পর্যন্ত অসংখ্য খ্যাত-অখ্যাত মুসলমানের যোগাযোগ ঘটেছিল। পত্রবিনিময়, সাক্ষাৎ-পরিচয়, মুসলমান লেখকদের বইয়ে কবির ভূমিকা ও সমালোচনা, মুসলমান সম্পাদিত সাময়িকপত্রে শুভেচ্ছাবাণী ও কবির রচনা প্রকাশ, শান্তিনিকেতনে কবির উপস্থিতিতে মুসলমান সাহিত্যিকদের রচনা-পাঠ, বিশ্বভারতীতে ইসলামি সংস্কৃতি গবেষণা ও চর্চা, মুসলমান লেখকের বই ও রচনা প্রকাশে কবির সুপারিশ, শান্তিনিকেতনে মুসলমান ব্যক্তিত্বের সংবর্ধনা-অভ্যর্থনা ইত্যাদি নানা কর্মসূত্রে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মুসলমান সমাজের সম্পর্কের পুরো ও বিস্তৃত খতিয়ান এখনও তৈরি হয়নি। তবে আমাদের সৌভাগ্য, কবিকে লেখা এসব চিঠিপত্রের একটি বড় অংশ রবীন্দ্রভবন মহাফেজখানায় সংরক্ষণ করা হয়েছে। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীর পরিচালনার ভার গ্রহণ করার সময় থেকে কবি প্রেরিত চিঠির সচিব-কৃত অনুলিপি রাখা হতো। শিবনারায়ণ রায় রবীন্দ্রভবনের ডিরেক্টর পদে যোগ দেওয়ার পর বিশ শতকের অষ্টম দশকে এসব চিঠিপত্র ও কবির জবাবের অনুলিপি পত্রপ্রাপকদের নামের আদ্যাক্ষরের বর্ণনানুক্রমে স্বতন্ত্র ফাইলবন্দি করে সুশৃঙ্খলভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। তবে সব চিঠি ও জবাব এখনও রবীন্দ্রভবন মহাফেজখানা সংগ্রহ করতে পারেনি।
এখানে সংকলিত অধিকাংশ উপাদান রবীন্দ্রভবন মহাফেজখানা থেকে সংগৃহীত। কয়েকটি চিঠির প্রতিলিপি নানা দুষপ্রাপ্য ও লুপ্ত সাময়িকপত্র থেকেও উদ্ধার করা হয়েছে।
এসব চিঠি পাঠ করে আমরা উপলব্ধি করতে পারব রবীন্দ্রনাথ কত ধৈর্যশীল ও সহনশীল ছিলেন। তিনি কোনও কোনও পত্রলেখকের অসঙ্গত আবদারও রক্ষার চেষ্টা করেছেন তাঁর সহস্র কর্মব্যস্ততার মধ্যে। অবশ্য এমন ভাবাযুক্তিসঙ্গত হবে না যে, মুসলমান বলেই কবি তাঁদের প্রতি সৌজন্য প্রকাশ করেছেন, তিনি সবার প্রতিই এমন আচরণ করতেন। তবে মুসলমান পত্রলেখকদের প্রসঙ্গক্রমে রবীন্দ্রনাথ তৎকালের ভারতবর্ষের বিরাজমান হিন্দু-মুসলমানের জটিল সম্পর্ক বিষয়ে, উভয়পক্ষের সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভেদ সম্পর্কে, বাংলা ভাষায় আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দ ব্যবহার বিষয়ে তাঁর অভিমত অকপটে ব্যক্ত করেছেন। মুসলমানদের সঙ্গে কবির এই যোগাযোগ সবসময় সুখকর হয়নি। বিশ্বভারতীতে ইসলামি সংস্কৃতি বিভাগের একটি অধ্যাপক পদের ব্যয় বহনের অনুরোধ জানিয়ে আগা খানের সহযোগিতা প্রার্থনা করেছিলেন কবি। ধনকুবের আগা খান সৌজন্যবশত জবাব দিলেও শেষ পর্যন্ত সহযোগিতার হাত বাড়াননি, কবির আহ্বানে উপযুক্ত সাড়া দেননি। বরীন্দ্রনাথ আগা খানের কাছে যে আচরণ পেয়েছিলেন, তাতে অপমানিত বোধ করেছেন বলে নিজেই এক চিঠিতে স্পষ্ট উল্লেখ করেছিলেন।
দুই
এখানে গ্রথিত পত্রপঞ্চকের প্রথমটির তারিখ ২৪ জুন ১৯২৪। লেখক রাজশাহীর কলেজ রোড নিবাসী হোমিওপ্যাথ ডাক্তার কবি এম এ (মীর আজিজুর) রহমান। রবীন্দ্রনাথকে লেখা মুসলমানদের সংরক্ষিত পত্রাবলির মধ্যে এটিই প্রাচীনতম। এর আগে রবীন্দ্রনাথ সারা তৈফুরের (শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের ভাগ্নি হুরুন নেসা সারা খাতুন ১৮৮৮-১৯৭১) স্বর্গের জ্যোতি, একরামউদ্দীনের রবীন্দ্র-প্রতিভা (১৯১৪) ও এয়াকুব আলী চৌধুরীর নুরনবী (দ্বি-স ১৩২০ বঙ্গাব্দ)- এই তিনটি বইয়ের সম্পর্কে তাঁর অভিমত জানিয়েছিলেন। উল্লিখিত তিনজন সম্ভবত চিঠিসহ বই পাঠিয়ে কবির মতামত প্রার্থনা করেছিলেন। কিন্তু এঁদের চিঠি রবীন্দ্রভবনে রক্ষিত হয়নি। তবে ১৯২২-এর ১২ মে কবি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগের লেকচারার মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে (পরে ডক্টর) স্বতঃপ্রবৃত হয়ে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংসদের (ম্যানেজিং কমিটি, পরে সিন্ডিকেট) সদস্যরূপে বরণ করে চিঠি লিখেছিলেন। ১৯২৪-এ রবীন্দ্রনাথ শহীদুল্লাহর যে চিঠির উত্তর লিখেছিলেন সেই চিঠিটিও রবীন্দ্রভবনে সংরক্ষিত হয়নি।
রবীন্দ্রনাথকে লেখা মীর আজিজুর রহমানের চিঠির বিষয়বস্তু কিঞ্চিৎ কৌতুকাবহ। কবি সাহেব শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথকে স্বরচিত কাব্যের পান্ডুলিপি থেকে শোনাবার অভিপ্রায়ে। পরে রচিত আত্মজীবনীতে রহমান সাহেব স্মৃতিচারণ করে (অপ্রকাশিত) জানিয়েছেন, মাস্তানা কাব্যের কবিতা আবৃত্তি শুনে ‘রবীন্দ্রনাথের চক্ষুদ্বয় হতে অঝোরে অশ্রম্নধারা নামিয়া দীর্ঘ শ্বেত শ্মশ্ররাজি অভিষিক্ত’ হয়েছিল। মাস্তানা কাব্য সম্পর্কে প্রশংসামূলক কিছু লিখে দিয়েছিলেন। সেই প্রশংসাবাণীটি হারিয়ে যায়, ‘অবশ্য তার নকল রেখেছি’- উল্লেখ করেছেন কবিযশোপ্রার্থী। এবার পত্রাঘাতে লক্ষ করি যদি দয়া করে “তোমার নিজ হাতের লেখাটা আবার দাও তবে ‘ব্লক’ করে নিতুম।” যাহোক, রবীন্দ্রনাথ আরেকটি সার্টিফিকেট দিলেন। কিন্তু এম এ রহমানের চিঠির তারিখ ২৪/৬/২৪ আর রবীন্দ্রনাথের চিঠির তারিখ ৩১/১২/৩৮। সম্ভবত এম এ রহমানের তারিখ খ্রিস্টাব্দের আর রবীন্দ্রনাথের বঙ্গাব্দের।
বইটি প্রকাশের পর (১৯৩৯) কবিকে উপহার পাঠানো হয়েছিল, বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে মাস্তানা ক্যাটালগভুক্ত হয়েছিল (সংখ্যা ৮১ আ ব)। রবীন্দ্রনাথ মাস্তানা সম্পর্কে যে প্রশংসাবাণী দিয়েছিলেন সেটি এখানে উদ্ধৃত হলো :
কবি, তোমার মাস্তানা পড়ে আনন্দিত হয়েছি। তোমার গভীর হৃদয়ের রসোন্মত্ততা প্রত্যেক শ্লেকে ছন্দের তরঙ্গে উদ্বেল হয়ে উঠেছে। তোমার পেয়ালা চিরদিন পরিপূর্ণ থাকুক, সাকির কল্যাণে কোনোদিন তোমার নেশায় কিছুমাত্র অবসাদ না ঘটুক এই কামনা করি। ইতি ৩১/১২/৩৮ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
দ্বিতীয় চিঠির লেখক সে সময়ের কলকাতা আলিয়া মাদরাসার শিক্ষক কাজী কাদের নওয়াজ। ১৯৩৬-এর ২৮ অক্টোবর ওয়েলেসলি, কলকাতা থেকে কাজী সাহেব রবীন্দ্রনাথকে এই চিঠি লেখেন। চিঠির সূচনাতে বেলঘোরিয়ার উল্লেখ আছে, প্রকৃতপক্ষে এটি হবে বেলেঘাটায় অনিলকুমার দে-র ‘প্রফুল্লকানন’ বাড়ি। ওই বাড়িতে এগারোই অক্টোবর শরৎচন্দ্রের সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই অনুষ্ঠানেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কাদের নওয়াজের সাক্ষাৎ পরিচয়ের সুযোগ হয়। কবিকে তিনি তাঁর মরাল কাব্য উপহার দিয়েছিলেন বলে এই চিঠিতে উল্লেখ করেছেন। বিশ্বভারতী গ্রন্থাগারে মরালের যে কপিটি আছে সেটি কাদের নওয়াজ ১৯৩৭-এর ১৩ ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথকে উপহার দিয়েছিলেন এই কথাগুলো লিখে :
পরামারাধ্য কবি শাহানশাহ
শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গুরুদেবের
শ্রীচরণকমলে আমার নগণ্য
মরাল মুক্তিলাভ করিয়া
ধন্য হউক।
দরজ প্রার্থী
কাদের নওয়াজ
১৩/১২/৩৭মরাল কাব্যগ্রন্থের প্রকাশক মৌলবী মৌলা নওয়াজ বিএ। সাহিত্যকুঞ্জ, মঙ্গলকোট থেকে বইটি প্রকাশিত। বইয়ের ভূমিকা লেখেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১১ বৈশাখ ১৩৪১)
‘বিচিত্রা’, ‘বসুমতী’ প্রভৃতি কাগজে কবি কাজী কাদের নওয়াজের অনেকগুলি কবিতা প’ড়ে অবধি কবির সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ খুঁজছিলুম। কবির ‘মরাল’ নামক কাব্য গ্রন'খানির ভূমিকা লেখার সূত্র ধ’রে ভাগ্যক্রমে সেই সুযোগ পেয়ে গেলেম। এই বইখানিতে কবির বাহিরে বাহিরে যে পরিচয় তার চেয়ে অনেক মূল্যবান অন্তরের পরিচয় পাওয়ার সুযোগ তিনি পাঠকদের দিয়েছেন। এই উভয় দিকে পরিচয়ের সঙ্গে সঙ্গে সুদূর আরব্য পারস্য দেশের জনকয়েক মহাকবির লেখার ও ভাবের সঙ্গে পরিচয় ক’রে নেবার সুযোগ এই বইখানিতে পাওয়া যাবে।...
কাদের নওয়াজ ‘আমার কথা’য় উল্লেখ করেন :
... আমার মরালে’র কবিতাগুলি মোটামুটি বিভক্ত তিন ভাগে যথা (১) ব্যথা (২) পল্লী (৩) পরকীয়া। ১১৪ পৃষ্ঠার এই কাব্যে ১৯টি কবিতা ও তিনটি প্রবন্ধ আছে।
রবীন্দ্রনাথ মরাল কাব্য সম্পর্কে তাঁর প্রতিশ্রুত মতামত জ্ঞাপন করেননি তবে কাদের নওয়াজকে ৩১-১০-৩৬ তারিখে এক চিঠিতে জানিয়েছেন :
কল্যাণীয়েষু,
তোমার চিঠিখানি প’ড়ে আনন্দ পেয়েছি। তুমি তোমার সাহিত্য-সাধনার দ্বারাতেই তোমার জন্মভূমির মঙ্গল সাধনা করচ- তোমার এই ব্রত উত্তরোত্তর ফলবান হতে থাক। জনসাধারণের ক্ষেত্রে মুসলমান সম্প্রদায়ের সঙ্গে বহুকাল থেকে আমার ঘনিষ্ঠ স্নেহের সম্বন্ধ আছে। শিক্ষিত ছাত্রদের নিকটপরিচয় আমি কামনা করেছি। দুর্ভাগ্যক্রমে ঘটেনি। মাঝে মাঝে যখন কলকাতায় ছাত্র-মিলন-সভায় আবৃত্তি করেছি, সাহিত্য আলোচনা করেছি তখন যদি মুসলমান ছাত্রদের কাছে যেতাম অত্যন্ত খুসী হ’তুম। শান্তিনিকেতনে আশা করি কোনো অবকাশে তুমি আসতে পারবে। তখন দেখতে পাবে এখানে মুসলমানের আসন প্রস'ত হয়ে আছে। কোথাও লেশমাত্র বাধা বা সঙ্কোচ নেই। আমার আশীর্বাদ গ্রহণ কর। ৩১-১০-৩৬
উত্তরায়ন শুভার্থী
শান্তিনিকেতন শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
(উদ্ধৃত, সেলিনা বাহার জামান সম্পাদিত নির্বাচিত বুলবুল, কলকাতা ১৪১২ পৃ ৪৫৭)
রবীন্দ্রনাথ-সম্পাদিত বাংলা কাব্যপরিচয় সংকলনে কাদের নওয়াজের ‘হারানো টুপী’ কবিতাটি গৃহীত হয়েছে।
এখানে সংগৃহীত তৃতীয় চিঠির লেখক এ কে এস পরে আ কা শ নূর মোহাম্মদ। মালদহ জেলা স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র এই কিশোর রবীন্দ্রনাথকে লেখা চিঠির সূচনায় ছয় চরণের একটি কবিতা লিখেছে। কবিতায় কবি-কিশোর রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশে বলেছে :
লহ এ ক্ষুদ্র কবির শত নমস্কার।
নূর মোহাম্মদ এই চিঠিতে কবির শিষ্য হতে চেয়েছে। জানিয়েছে, সে কয়েকটি কবিতার বই লিখেছে কিন্তু অর্থাভাবে প্রকাশ করতে পারেনি। তার কবিতা মালদার স্থানীয় সাময়িকপত্রে প্রকাশ পেয়েছে। তবে তার কবিতাকে সকলেই চিনলেও তাকে চেনে কি-না এ ব্যাপারে সে নিজেই সন্দিহান। পত্রলেখকের জিজ্ঞাস্য কবির শিষ্য হতে হলে তাকে কী কী নিয়মকানুন অবলম্বন করতে হবে। এই পঞ্চদশ বর্ষীয় বালকের (জ. ১৯২৩) পড়াশোনা ভালো লাগে না এবং ‘কবিতা আজ আমায় মাতোয়ারা করেছে।’
নূর মোহাম্মদ চিঠির সঙ্গে একটি কবিতা পাঠিয়ে অনুরোধ করেছে, রবীন্দ্রনাথ যেন কোনও পত্রিকায় সুপারিশ করে কবিতাটি ছাপার ব্যবস্থা করেন। কোন পত্রিকায় তার কবিতা মুদ্রিত হলো, তাও জানাতে অনুরোধ করেছে। এবং জবাব দেওয়ার জন্য ডাক-টিকিট পাঠাতেও কার্পণ্য করেনি। নিজেকে রবীন্দ্রনাথের ভবিষ্যৎ শিষ্য অভিহিত করে নূর মোহাম্মদ চিঠির নিচে স্বাক্ষর করেছে।
এই চিঠিটি রবীন্দ্রভবনে সংরক্ষিত আছে এবং চিঠির ওপরে কবির সচিব উল্লেখ করেছেন, গুরুদেব উত্তর দিয়েছেন ২৪/২/৩৮।
এ কে এস নূর মোহাম্মদ পরে আ কা শ নূর মোহাম্মদ নামে পূর্ব পাকিস্তানে ও বাংলাদেশে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কবিতা প্রকাশ করে মোটামুটি পরিচিতি লাভ করেছিলেন। তিনি মালদহের গায়েশবাড়িতে ১৯২৩-এর ১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। মালদহ জিলা স্কুলে পড়তেন, ওই স্কুল থেকে ১৯৪০ সালে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। তিনি আইএ পর্যন্ত পড়েছিলেন। দেশভাগের পরে পূর্ববঙ্গ (পরে পূর্ব পাকিস্তান ও বাংলাদেশে) সরকারের তথ্য বিভাগে কর্ম নেন। তাঁর চারটি কাব্যগ্রন্থ (১৩৪৬-৬৪), একটি উপন্যাস আসছে বছর (১৩৫৯) ও গল্পগ্রন্থ এই স্বাধীনতা প্রকাশ করেন। তিনি ১৯৮৪তে দিনাজপুরে মৃত্যুবরণ করেন। রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে তাঁর একটি প্রবন্ধের সন্ধান পাওয়া যায় : “বস্তুবাদী রবীন্দ্রনাথ” (আল-ইসলাহ, সিলেট, জ্যৈষ্ঠ ১৩৫৬)। মাসিক মোহাম্মদী, আল-ইসলাহ ও মাহে-নও পত্রিকায় তাঁর কবিতা ও প্রবন্ধ প্রকাশ পায়।
রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৮-এর ২৪ ফেব্রুয়ারি শান্তিনিকেতন থেকে পত্রের প্রাপ্তি-স্বীকার করে ও আশীর্বাদ জানিয়ে একটি ক্ষুদ্র চিঠি লেখেন :
কল্যাণীয়েষু, শান্তিনিকেতন
তোমার পত্র পেয়ে খুশি হলুম। তুমি আমার আশীর্বাদ গ্রহণ করো। ইতি ২৪/২/৩৮
শুভার্থী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কবি অবশ্য এই দুছত্রের ছোট চিঠিতে তাঁর শিষ্য হতে ইচ্ছুক নূর মোহাম্মদকে শিষ্য হলে তার করণীয় সম্পর্কে কিছু বলেননি এবং তার কবিতা প্রকাশের সুপারিশ করা বিষয়েও নিশ্চুপ।
৪র্থ চিঠিটি লিখেছিল বগুড়ার কিশোরী স্কুল ছাত্রী জেব-উন-নেছা। তখন তার বয়স মাত্র সাড়ে এগারো। বগুড়া থেকে ১৯৩৮-এর ১৫ জুন জেব-উন-নেছা যখন কবিকে তার কাঁচা হাতের লেখায় এই চিঠি পাঠায় তখন কবি ছিলেন কালিমপঙে। সেসময় জেবু-উন-নেছা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী। তার ক্লাসের ছাত্রীরা সোনার তরী কাব্যের নামের অনুসরণে একটি হাতে-লেখা পত্রিকা বের করেছে, জেব-উন-নেছা তার সহ-সম্পাদিকা।
জেব-উন-নেছা পরিণত বয়সে কবি স্মৃতিচারণে উল্লেখ করেছে : স্কুলে পড়ার সময়েই সে জলরঙে কবির একটি প্রতিকৃতি এঁকেছিল। ইচ্ছে ছিল কলকাতায় কলেজে ভর্তি হতে যখন যাবে তখন শান্তিনিকেতনে কবির হাতে ছবিটি দেবে। কিন্তু কবির প্রয়াণে তার ইচ্ছে পূর্ণ হতে পারেনি। তাকে লেখা কবির চিঠির পুরো বয়ান :
কল্যাণীয়াসু,
তোমার সুন্দর চিঠি খানি পেয়ে বড়ো আনন্দ পেয়েছি। দাদু সম্ভাষণে তুমি আমাকে আত্মীয় সম্বন্ধের বন্ধনে বাঁধতে চেয়েছ, সে আমি উপেক্ষা করতে পারি নে। মাঝে মাঝে বিরক্ত করবার অধিকার তোমাদের হোলো, কিন্তু সব সময়ে সাড়া যদি না পাও তো জেনো তোমার দাদুর বয়স তোমার চেয়ে কিছু বেশি। আর কবিতার মধ্যে যদি তার ঠিকানা পাও তাহলে জেনো সেটাই সব চেয়ে পাকা ঠিকানা- সেই ঠিকানাই আশা করি অনেকদিন কায়েম থাকবে- আমার এখনকার ঠিকানায় বেশি দিন চিঠি পৌঁছিয়ে দেবার আশা কোরো না। আমার কবিতা তোমার ভালো লাগে, সেই ভালো লাগার সম্বন্ধও টিঁকে থাকবে, সেজন্যে আমারও টিঁকে থাকবার দরকার রইবে না। তোমার চিঠি পড়েই জবাব দিলুম সময় হিসাব করবার সময় মনে রেখো আছি দূরে, পথ ঘাট বর্ষার ধারায় প্রায় ভাঙচে- যদি রাগ করতে হয় বর্ষার আকাশের পরে কোরো; তাতে তার বিশেষ দুঃখ হবে না কিন্তু আমার উপর যদি করো তবে অন্যায় বিচার হবে। ইতি আষাঢ় ১৩৪৫
দাদু
কিশোরী জেব-উন-নেছার চিঠি পেয়ে কালিমপঙ, দার্জিলিং থেকে ৫ আষাঢ় ১৩৪৫ তারিখে এই অনিন্দ্যসুন্দর চিঠিটি লিখেছিলেন কবি। এই চিঠিটি ছাড়াও ১৯৪০-এর শেষের দিকে রবীন্দ্রনাথ জেবুকে আরও দুটি চিঠি লিখেছিলেন। এই প্রসঙ্গে জেব-উন-নেছা পরে জানিয়েছেন :
চিঠিগুলি আমারই পত্রোত্তর। প্রথমটি, দ্বিতীয় ও তৃতীয় চিঠির চেয়ে বড়ো এবং প্যাডে লেখা। অন্য দুটি অপেক্ষাকৃত ছোট ও কার্ডে লেখা। তৃতীয় চিঠিখানি হারিয়ে গেছে; দ্বিতীয়টির অংশবিশেষ আছে। প্রথমটিও কালের স্পর্শে অস্পষ্ট এবং বহু হস্তক্ষেপে মলিন ও ছিন্ন হয়েও টিকে আছে।
(দ্র. রবীন্দ্রনাথের একগুচ্ছ পত্র, পুনর্মুদ্রণ, ঢাকা : বাংলা একাডেমী, ১৯৯৫ পৃ ১৩৪)
জেব-উন-নেছা ১৯২৬ সালে বগুড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৩-এ আইএ পরীক্ষায় বাংলায় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলেন। চট্টগ্রাম গার্লস কলেজে অধ্যাপনা করেন ১৯৫৮-৬৩ সালে।
তিনি বাংলাদেশে ‘গীতিকার’রূপে পরিচিতি লাভ করেন; হাজার দেড়েক গান লিখেছেন। আমার যত গান নামে তাঁর একটি গীতিসংকলন প্রকাশ পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপের কৌতূহলোদ্দীপক বিবরণ দিয়েছেন ‘আমার চিঠির উত্তরে রবীন্দ্রনাথ’ স্মৃতিচারণের (সাপ্তাহিক সচিত্র সন্ধানী,
১০ মে ১৯৮১)
সংকলিত পঞ্চম চিঠির লেখক ঢাকা ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজের শিক্ষক আমীনুদ্দীন আহমদ। এই চিঠির (রবীন্দ্রভবনে সংরক্ষিত) সঙ্গে আমীনুদ্দীন রবীন্দ্রনাথকে একটি স্বরচিত কবিতাও পাঠিয়েছিলেন। কবিকে অনুরোধ করেন, ‘একবার চোখ বুলিয়ে যেতে’। এই চিঠির বছর সাতেক আগে ১৩৩৯ বঙ্গাব্দের পৌষ সংখ্যা সেকালের মর্যাদাবান পত্রিকা বিচিত্রায় আমীনুদ্দীন আহমদ বিএ ‘রবীন্দ্রনাথ’ শিরোনামে একটি কবিতা প্রকাশ করেন :
রবীন্দ্রনাথ
আমীন উদ্দীন আহমদ বি-এ
বাণী-বর-পুত্র কবি হে রবীন্দ্রনাথ
ত্রিভুবনে করিয়াছ তব রশ্মি পাত-!
রূপে সুরে ছন্দে গানে দিয়ে নব প্রাণ
হে ভারত-ঋষি-কবি পূর্ণ তব দান।
বাণী তব ব্যাপ্ত আজি বিশ্ব চরাচরে-
আমাদেরি নহ, -তুমি বিশ্বে প্রতি ঘরে।
যেই গান শুনে নাই যুগযুগান্তর
অভিশপ্ত ভারতের ব্যথিত অনত্মর
সেই সান-গান সুর- অপূর্ব্ব সে ধ্বনী
শুনাইলে তুমি ঋষি কবি-চূড়ামণি!
ধন্য তুমি! ধন্যা ধরি’ বক্ষে বসুমাতা
ধন্য মোরা- সিক্ত তাই হর্ষে আঁখি পাতা।
যুগেযুগে রূপ-সৃষ্টি কল্প-দীপালীতে
প্রণমিবে স্রষ্টা কবি তোমারে আদিতে।
তিনি মলয়দূত কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন (১৩৪৭)। এই কাব্যে সম্ভবত উল্লিখিত কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশে রচিত কবিতাটি পাঠ করে কবি ১৩৪৭-এর ১১ জ্যৈষ্ঠ আমীনুদ্দীনকে ঢাকায় প্রেরিত এই চিঠি লেখেন :
তোমার মলয়দূত কাব্যে তুমি আমার উদ্দেশে যে অভিনন্দন প্রকাশ করিয়াছ তাহা পাঠ করিয়া আনন্দিত হইয়াছি এবং এই উপলক্ষে তোমাকে আমার শুভকামনা জানাইলাম। ইতি ১১ই জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৭। (উদ্ধৃত, অমিতাভ চৌধুরী, একত্রে রবীন্দ্রনাথ, কলকাতা, ১৯৮৩ পৃ ৫৩৪)
আমীনুদ্দীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় ১৯৩৮-এ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে মুহম্মদ আবদুল হাই প্রমুখের সঙ্গে কবি-সন্দর্শনে শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন। তখন তিনি কয়েকটি স্বরচিত কবিতা উপহার দেন কবিকে। ৩১/১২/৩৮ তারিখে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন থেকে আমীনুদ্দীনকে ঢাকায় ডক্টর শহীদুল্লাহর ঠিকানায় এই চিঠি লেখেন :
আমীনুদ্দীন আহমদ
C/o Dr. Sahidullah
Dacca University
Dacca
ওঁ
শান্তিনিকেতন
কল্যাণীয়েষু,
তুমি আমার কাছে তোমার রচিত যে কবিতাগুলি রেখে গেছ পড়ে আমি বিশেষ আনন্দ লাভ করেছি। তোমার লেখনীমুখে বেদনার যে ধারা প্রবাহিত হয়েছে তা উপাদেয়। আমার আশীর্বাদ গ্রহণ করো।
ইতি ৩১/১২/৩৮
শুভার্থী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১৯৩৮-এর ৩১ ডিসেম্বর এই চিঠি লেখার মাস পাঁচেক আগে ৬ আগস্ট শান্তিনিকেতন থেকে রবীন্দ্রনাথ আমীনুদ্দীনকে ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজের ঠিকানায় দুই ছত্রের আরেকটি চিঠি লিখেছিলেন :
কল্যাণীয়েষু
তোমার কবিতা পড়ে আমি বিশেষ আনন্দ লাভ করেছি। তুমি আমার আশীর্বাদ গ্রহণ করো। ইতি ৬/৮/৩৮
শুভার্থী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমীনুদ্দীন ১৯০৬ সালে কুমিল্লার শর্মাকান্দা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৩২-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবি সাহিত্যে অনার্স ও ১৯৩৩ সালে এমএ পাস করেন। ১৯৩৬-এ ঢাকা ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজে শিক্ষক পদে যোগ দেন। ১৯৪৩-এ ঢাকায় মিটফোর্ড হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।
তিনি সওগাত, মোহাম্মদী, বুলবুল, বঙ্গভূমি, বিচিত্রা সাময়িকপত্রে রচনা প্রকাশ করেন। দিওয়ান-ই-মাস্তান নামে তাঁর একটি অপ্রকাশিত কাব্য আছে। তিনি কয়েকটি উপন্যাস, নাটক ও কাব্য প্রকাশ করেন।
Bogra
15.6.38
Malda
22.2.38
পত্র : তিন
সাকীদের আঁখি তুমি সবার খানায়,
মাতোয়ারা করে দিলে কবিতা নেশায়;
এই সোনার বঙ্গে হে বিশ্বের কবি,
এঁকেছ কি মনোরম কল্পনার ছবি-
লহ হে পূজারী তুমি লহ আরবার।
লহ এ ক্ষুদ্র কবির শত নমস্কার ॥
হে বিশ্ব বরেণ্য কবি-
আজ চিঠি লিখছি আপনাকে; ক্ষুদ্র জনের লেখা বলে নিক্ষেপ করবেন না আশা করি।
আমি আপনার শিষ্য হ’ব আর আপনি হবেন গুরু আমার-
আমি কয়েকখানা কবিতার বই লিখেছি কিন্তু অর্থাভাবে একটীও প্রকাশ করতে পারি নাই।
আমার কবিতা মালদার পত্রিকায় উঠে, তাই চিনে আমার কবিতাকে সকলেই কিন্তু সন্দেহ আছে আমায় চিনে কি না?
আপনার শিষ্য হ’লে আমার কি কি নিয়ম অবলম্বন করতে হ’বে জানাবেন?
আমি অতি গরীব পিতৃহীন বালক আমার জন্ম ১৯২৩ সালের ১লা জানুয়ারী।
পড়াশুনা ভাল লাগে না। কবিতা আজ আমায় মাতোয়ারা করেছে।
আমি আমার একখানা কবিতা পাঠাইলাম। আশা করি আমার পক্ষ হ’তে সুপারিস করিয়া সেটী কোন এক পত্রিকায় তুলাইয়া দিবেন। একখানা টিকিট পাঠাইলাম। আগামীতে আবশ্যক মত উত্তর দিবেন।
কোন পত্রিকায় আমার কবিতাটী উঠাইলেন অথবা উঠাইলেন কিনা তাহাও জানাবেন।
আবার বলি
“শিষ্য হলে আমায় কি কি করতে হ’বে? আজকার মত শেষ হে গুরুদেব!
ইতি
ভবিষ্যৎ শিষ্য
এ, কে, এস, নূর মোহাম্মদ
মালদহ জিলা স্কুল
নবম শ্রেণী; (মালদহ)
পত্র : চার
পরম পূজনীয় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়
সমীপে-
‘দাদু’,
তোমাকে ‘দাদু’ ব’লে ডেকে ধন্য হলুম। তুমি আমার দাদু হবে ত? এ্যাঁ? -কি বল? তোমাকে আমার খু-উ-ব ভালো লাগে। এই এত্‌-ত বড় পৃথিবীর তুমি কবীন্দ্র মনে হ’লে আনন্দে, গর্ব্বে প্রাণ ভ’রে যায়। আমাদের বাঙ্গালী জাতির গৌরব তুমি! ভগবান তোমায় দীর্ঘজীবি করুন এই আমার প্রার্থনা।
আমি একটু আধ্‌টু কবিতা লিখতে চেষ্টা করি। ভাল পারিনে অবশ্য। আচ্ছা দাদু, তুমি কি ক’রে অত সুন্দর কবিতা লেখ আমায় ব’লবে?...
আমাদের স্কুলে কিছুদিন আগে Prize distribution-এ তোমার ‘কথা ও কাহিনী’র “সামান্য ক্ষতি”টি মূক অভিনয় হয়েছিল। সবাই খুবই প্রশংসা ক’রেছিলেন। তোমার কবিতার মাঝে একটা জীবন্ত রূপ আছে। তোমার বই পেলে ত আমি খাওয়া ঘুমোন পর্য্যন্ত ভুলে যাই। এতই তোমার কাব্যের গুণ।
আমরা ক্লাসের মেয়েরা সবাই মিলে একটী হাতে লেখা মাসিক পত্রিকা বের ক’রছি। নাম তার “সোনার তরী”। আমি হয়েছি তার সহঃসম্পাদিকা ও চিত্রশিল্পী। তোমার একটী বইয়ের একটী কবিতার নাম ত সোনার তরী- না? আমরা ওই নাম দিয়ে ধন্য মনে ক’রছি নিজেদের।
তুমি কেমন আছ দাদু? জানিও কিন্তু। আমি ভালই আছি। তোমাকে দেখতে আমার ভা-আ-রী ইচ্ছে করে।
তোমায় বিরক্ত করলুম না? তা তোমার আদরের নাত্‌নীটি যদি একটু তোমায় বিরক্তই করে তা হ’লে তুমি রাগ করবে কি? বল না! জানি তোমার সময় খুবই কম তবুও আশা রাখি তোমার স্নেহলিপি হ’তে বঞ্চিত হব না। আমার মনের খুঁটীনাটি তোমায় জানালুম। কিছু মনে ক’র না, বুঝলে? লেখা যা বিছ্‌ছিরি হাসবে না ত? তুমি আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম নাও- দাদুমণি আমার। উত্তর না দিলে কিন্তু ভা-রি অভিমান ক’রব। আসি। ইতি
তোমারই অতি স্নেহের
-জেব্‌-উন্‌-নেছা=।
C/o Dr. K. Talukder
M.B.
Thana Road
Bogra
* চিঠি প’ড়েই উত্তর দেবে।
আমি চিঠির আশায় এই
বসে রইলুম। উত্তর দিও=
কিন' *
পত্র : পাঁচ
ঢাকা ইসলামিক ইন্টার মেডিয়েট কলেজ- (ঢাকা)
২রা আগস্ট, ’৩৮ইং
পরম শ্রদ্ধাষ্পদেষু-
যথোপযুক্ত ভক্তিশ্রদ্ধা নিবেদন করবার যোগ্য ভাষা আমার নাই, ইহা অকপটে ও অকুণ্ঠিতচিত্তে স্বীকার করতে আমি মোটেও লজ্জিত নই। তথাপি শিশু যেমনি তার আধফোটা ভাষা দিয়ে তার মনকে নিতান্ত আপনজনের কাছে ব্যক্ত করে, কতকটা তেমনিই নিজেকে আপনার কাছে ব্যক্ত করছি।
আপনার কাব্য ও সাহিত্য আমাদের কি দিয়েছে, কি দেয় নাই, তা এই পত্রে বা অন্য কোথাও ব্যক্ত করবার শক্তি আমার হবে না। জীবনের অব্যক্ত আনন্দ অব্যক্তই থাক্‌- এর জন্য বেদনা নাই। তবে আপনি যা দিয়েছেন তার প্রতিদানে আমরা কি কি দিব? একান্তই যদি কিছু না দিই- দেবার চেষ্টাও না করি, তা’হলে আমাদের যে অমার্জ্জনীয় অপরাধ হবে- এই কথাটা আমরা ভুল্‌ব কি করে?-
সীমাহীন সিন্ধুর দান হয়ত এই বিরাট-বক্ষা ধরণী; কিন্তু সিন্ধুকে কিছু দেবার মতন সাহস আছে কার?- ধরণীর বুক চিরে যে যে কচি ঘাস বেরোয় সে ঘাসের ডগায় যদি এক ফোঁটা শিশির দোলে, আর তা-ই যদি সিন্ধুর বুকে ফেলে দিয়ে পুষপ যদি উল্লাসিত হয়ে উঠে- আমি দিয়েছি- আমি দান করেছি বলে তাইলে কি তাকে দোষ দেওয়া যায়,- তার অহমিকা- বা অজ্ঞতাকে? আমিও না হয় কতকটা তেমনি! এই যুগের- যারা আমরা নাতি-শ্রেণীর, তাদের অন্যায়-অধিকার কত যে বেশী তার অহঙ্কারেই আমরা বাঁচি না।
কাব্য আমার প্রাণপ্রিয়- যদিও আমি কবি নই। আপনার কাব্য পড়াতে গেলে যে- কাব্য পড়ানোই হয় না, এটা অন্য কেউ বুঝুক আর নাই বুঝুক- আমার বুঝতে মোটেই বাকী নাই। ছেলেদের এ দিয়ে পরীক্ষা পাস হবে- এ যেন স্বপ্ন আর কি? অথচ বিশ্ববিদ্যালয় পাশ চায়! কাব্য আপনার উপভোগ- এবং উপলব্ধি করতে চায় না- বুঝতে চায়- এটাই আমার কাছে বড় বিড়ম্বনা। তবু যখন আমার মনে হয় নিতান্ত একেলা বসে আপনার কাব্য ও আপনার মনকে অনুসরণ করতে চাই- তখন নির্লিপ্ত আনন্দে মনটা এমনি ভরে উঠে যে তা ভাষায় ব্যক্তই হবার নয়। কলেজ ক্লাসের বিচিত্র আবহাওয়ায় আপনার কাব্যকে টেনে আনতেই হবে, এর যেমন নিষ্ঠুর যুক্তি আছে- আপনার কাব্যকে ডিসেকশান করে পাশ করতে হবে, এরও তেমন কোন যুক্তি আমি পাইনি তথাপি নাচার, পড়াতেই হবে!
অনেক বাজে-কথা বকে ফেলেছি-। আশা করি অনুগ্রহপূর্ব্বক ক্ষমা করবেন। প্রশংসাবাদ ভক্তি-জ্ঞাপন নয়, এই কথা জেনে পত্র এইখানেই সমাপ্ত করতে চাই। বিধাতার নিকট এই প্রার্থনাই জানাই-
-যাঁর কল্যাণ- পরাধীন ভারতে বাস করেও মুক্তির আনন্দ লাভ করবার সৌভাগ্য অর্জ্জন করেছি আমরা,- তাঁকে তুমি যা দিয়েছ- তার চাইতে আরো বেশী দাও- যা তোমার শ্রেষ্ঠতম মানবকে দাও- তাই তাঁকে দাও!-
কবিতার আকারে যা পাঠাচ্ছি, তা হয়ত কবিতা নয়- মনের অস্ফুট বাণী, গোপন সাধনার একটী কমল- আপনার চরণ পদ্মে রাখছি- রাখবার সাহস করছি- বহু কারণে- কোনটীই না বলা ভাল। আশা করি একবার চোখ বুলিয়ে যেতে অনুগ্রহ করবেন। বিশেষ আর কি- আমার অন্তরের অজস্র ভক্তি শ্রদ্ধা যা জানাবার ভাষা নাই- তাই মনে মনে জানিয়ে পত্র শেষ করি।
একান্ত অনুরক্ত ভক্ত
-আমীনুদ্দীন
তথ্যসূত্র: সাপ্তাহিক ২০০০
Click This Link

সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মে, ২০০৯ রাত ২:০৫
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সীমানা পিলার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ৩১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৮



বৃটিশ কর্তৃক এদেশে ম্যাগনেটিক পিলার স্থাপনের রহস্য।
ম্যাগনেটিক পিলার নিয়ে অনেক গুজব ও জনশ্রুতি আছে, এই প্রাচীন ‘ম্যাগনেটিক পিলার' স্থাপন নিয়ে। কেউ কেউ এটিকে প্রাচীন মূল্যবান ‘ম্যাগনেটিক’ পিলার... ...বাকিটুকু পড়ুন

মাথায় চাপা ভূত ভূত ভূতং এর দিনগুলি

লিখেছেন শায়মা, ৩১ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৫


এই যে চারিদিকে এত শত কাজ কর্ম, ঝামেলা ঝক্কি, ক্লান্তি শ্রান্তি সব টপকে আমার মাথায় আজও চাপে নানান রকম ভূত। এক ভূত না নামতেই আরেক ভূত। ভূতেদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায় (দ্বিতীয় অংশ)

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ৩১ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:০৫


আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায় (প্রথমাংশ)
আমাদের সদ্য খনন করা পুকুরটা বৃষ্টির পানিতে ভেসে গেল। যা মাছ সেখানে ছিল, আটকানোর সুযোগ রইল না। আমি আর দুইবোন শিউলি ও হ্যাপি জালি... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিজের পাসওয়ার্ড অন্যকে দিবেন না ;)

লিখেছেন অপু তানভীর, ৩১ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:৫৭



কথায় আছে যে পাসওয়ার্ড এবং জাঙ্গিয়া অন্যকে দিতে নেই । মানুষ হিসাবে, বন্ধু হিসাবে প্রেমিক/প্রেমিকা হিসাবে অথবা আজ্ঞাবহ হওয়ার সুবাদে আমরা অন্যকে ব্যবহার করতে দিই বা দিতে বাধ্য হই।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শৈল্পিক চুরি

লিখেছেন শেরজা তপন, ০১ লা জুন, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭


হুদিন ধরে ভেবেও বিষয়টা নিয়ে লিখব লিখব করে লিখা হচ্ছে না ভয়ে কিংবা সঙ্কোচে!
কিসের ভয়? নারীবাদী ব্লগারদের ভয়।
আর কিসের সঙ্কোচ? পাছে আমার এই রচনাটা গৃহিনী রমনীদের খাটো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×