somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভারতবর্ষে মুসলমানদের চেপে রাখা ইতিহাস !! - ৩ --সভ্যতা ও বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান

১৪ ই মে, ২০০৯ বিকাল ৪:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
[ওমর খৈয়াম ]

পৃথিবী বিখ্যাত গণিত বিশারদদের ভেতর ওমর খৈয়ামের স্হান উজ্জ্বল রত্নের মতো । ঠিক তেমনি নাসিরুদ্দিন তুসী এবং ইবনে সিনার নামও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ।


[ইবনে সিনা ]


আকাশ জগৎ পর্যবেক্ষণ করার জন্য বর্তমান বিশ্বের মানমন্দির আছে ব্রিটেন এবং আমেরিকায় । কিন্তু কে বা কারা এগুলোর প্রথম আবিস্কারক প্রশ্ন উঠলে উত্তর আসবে জনাব হাজ্জাজ ইবনে মাসার এবং জনাব হুনাইন ইবনে ইসহাক । এরাই পৃথিবীর প্রথম মানমন্দির আবিস্কারক । সেটা ছিল ৭২৮ খ্রিষ্টাব্দ । ৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে জন্দেশপুরে দ্বিতীয় মানমন্দির তৈরী হয় । বাগদাদে হয় তৃতীয় মানমন্দির । দামেস্ক শহরে চতুর্থ মানমন্দির তৈরী করেন আল-মামুন ।

আর ইতিহাসের ঐতিহাসিকদের কথা বলতে গেলে মুসলিম অবদান বাদ দিয়ে কল্পণা করা মুশকিল । এমনকি, মুসলমান ঐতিহাসিকরা কলম না ধরলে ভারতের ইতিহাস হয়তো নিখোজ হয়ে যেত । অবশ্য ইংরেজ ঐতিহাসিকদের সংখ্যাও কম নয় । তবে দারুণভাবে মনে রাখবার কথা, ইতিহাসের স্রষ্টা বিশেষত মুসলমান । তার অনুবাদক দল ইংরেজ ঐতিহাসিকরা । আর আমাদের ভারতীয় ঐতিহাসিকগণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ঐ ইংরেজীর অনুবাদ করেছেন । যেকোন ঐতিহাসিক কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক অন্তত 'জানি না' বলতে পারবেন না, নিশ্চয় স্বীকার করবেন যে, মূল ঐতিহাসিক বেশিরভাগই মুসলিম । যেমন- আল-বেরুণী, ইবনে বতুতা, আলবিনি হামিদ, বাইহাকী, উৎবী, কাজী মিনহাজুদ্দিন সিরাজ, মহীউদ্দীন, মুহাম্মদ ঘোরী, জিয়াউদ্দিন বারানী, আমীর খসরু, শামসী সিরাজ, বাবর, ইয়াহিয়া-বিন-আহমদ, জওহর, আব্বাস শেরওয়ানী, আবুল ফজল, বাদাউনি, ফিরিশ্তা, কাফি খাঁ, মীর গোলাম হুসাইন, হুসাইন সালেমী ও সইদ আলী প্রমুখ মনীষী । আরো লম্বা ফিরিশ্তি হলে অসিহষ্ঞু পাঠক পড়তে বিরক্তি বোধ করবেন, তাই ঐতিহাসিকদের নাম ছেড়ে দিয়ে বিখ্যাত মূল ইতিহাস গ্রন্হের নাম জানাচ্ছি ।

[ ইবনে বতুতা ]

তারিখ-ই-সিন্ধু, চাচানামা, কিতাবুল-ইয়ামিনি , তারিখি মাসুদী, তারিখি-ফিরোজশাহী, তারিখূল হিন্দ, তা'জুম্মাসির, তবকত-ই-নাসিরি, খাজেনুল ফতওয়া, ফতওয়া উস সালাতিন, কিতাবুর-রাহলাব, তারিখি মুবারক শাহী, তারিখে সানাতিনে আফগানদ, তারিখে শেরশাহী, মাখজানে আফগান, আকবর নামা, আইনি আকবরি, মুনতাখাবুত তাওয়ারিখ, মুনতাখাবুল লুবাব, ফতহূল বুলদান, আনসাবুল আশরাক ওয়া আখবারাহো, ওয়ুনুল আখইয়ার, তারিখে ইয়াকুব, তারিখে তাবারী, আখবারুজ্জামান, মারওয়াজুজ জাহাব, তামবিনুল আশরাফ, কামিল, ইসদুল গাবাহ, আখবারুল আব্বাস, কিতাবুল ফিদ-আ, মুয়াজ্জামুল বুলদান প্রভৃতি ইতিহাস গ্রন্হগুলোর নাম পৃথিবী যতদিন থাকবে মুছে যাবে বলে মনে হয় না ।

পৃথিবীর বুকে সভ্যতার আলোকবর্তিকার গোড়া হচ্ছে 'কলম', তার পরের ধাপ হচ্ছে গ্রন্হ প্রণয়ন, গ্রন্হাগার নির্মাণ এবং বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় স্হাপন প্রভৃতি ।

মুসলমান ও আরব সভ্যতা এ বিষয়ে কতটা অগ্রসর ছিল তার সামান্য আভাস দিচ্ছি । মুসলমান সভ্যতা কেন এদিকে ঝুঁকেছিল তার কারণ কুরআনে যে সাড়ে ছয় হাজারের বেশি বাক্য আছে তার মধ্যে প্রথম বাক্যটি হচ্ছে, 'পড়, তোমার প্রভূর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন' আর তৃতীয় বাক্যে আছে, 'পড় যিনি তোমাদের কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন ।'

তাছাড়া মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) ও বলেছেন, 'যে জ্ঞানার্জন করে তার মৃত্যু নেই ' , ' চীনে গিয়ে হলেও জ্ঞান অনুসন্ধান করো ' , ' প্রত্যেক নর -নারীর জন্য ইলম বা বিদ্যা শিক্ষা করা অবশ্য কর্তব্য ' , ' সারা রাতের উপসনা অপেক্ষা এক ঘন্টা জ্ঞান চর্চা করা উত্তম ' , ' যে জ্ঞানীকে সম্মান করে সে আমাকে সম্মান করে ' ।

সুতরাং নবী করিম (সাঃ) এর কথার ফলাফল তার জীবদ্দশাতেই আরম্ভ হয়ে গেল । পরবর্তীকালে বাগদাদ, মিসরের কায়রো, সালেনা ও কর্ডোভায় বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠল । [দ্রঃ The Spirit of Islam , সৈয়দ আমীর আলি, পৃষ্ঠা- ৩৬১-৩৬২]

আদর্শ তালিবি ইলম বা বিদ্যানুসন্ধিৎসু দল হিসেবে তাঁরা ছিলেন পৃথিবীর উন্নত মার্গে । [দ্রঃ History of the Arabs, পৃষ্ঠা ২৪০, ছাপা ১৯৫১, লেখক - Philip Hitti ]

মহানবী (সাঃ) এর পরলোকগমনের ১১৮ বছর পর ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকা তথা স্পেন হতে আরম্ভ করে একেবারে ভারতের সিন্ধুনদ পর্যন্ত ইসলাম সভ্যতা বিস্তার লাভ করে ।

আরব সভ্যতার ধারক ও বাহকরা শুধু দেশ জয়ই করেন নি, বরং সেখানে মুসলমান পন্ডিতদের বসিয়েছেন গবেষণা করতে এবং গ্রন্হাগার ভর্তি করেছেন নতুন ও পুরাতন পুথিপত্র ও পুস্তক সম্ভারে । [দ্রঃ বিজ্ঞানের ইতিহাস, ১১০ পৃঃ]

মুসলিমরা সমস্ত ভারতে সংখ্যালঘু হতে পারে , কিন্তু তারা কি বিশ্বের বুকে একটি সর্বজাগতিক জাতি নয় ? তা বিচারের ভার সুধী সমাজের । এ প্রসঙ্গে একটি কথা বলা যায় , ইব্রাহীম (আঃ) এর অপূর্ব আত্নত্যাগের কারণে আল্লাহ পাক উনাকে জাতি সমূহের নেতা করেছেন এবং আমরা প্রতি নামাজে দরুদের মাধ্যমে উনার প্রতি দরুদ ও সালাম পেশ করি । আল্লাহ পাক বাইবেলে উল্লেখ করেছেন যে, আমি তোমার সন্তানদের মধ্য থেকে একটি উত্তম জাতি সৃষ্টি করব এবং তোমার সন্তানের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বের সমগ্র জাতিকে পথ দেখাব । বর্তমানে মনে হচ্ছে মহান স্রষ্টার এ কথার বাস্তব প্রতিফলন প্রকাশ পেয়েছে ।

গ্রন্হ বা পুস্তক সংগ্রহ মুসলমানদের জাতীয় স্বভাবে পরিণত হয়েছিল । বন্দরে বন্দরে লোক প্রস্তুত থাকত, কোন বিদেশী এলেই তার কাছে যে বই পত্রগুলো আছে সেগুলো নিয়ে অজানা তথ্যের বইগুলো সঙ্গে সঙ্গে অনুবাদ করে তার কপি তৈরী করে তার বই ফেরত দেওয়া হতো আর তাদের অনিচ্ছা না থাকলে তা কিনে নেওয়া হতো । [দ্রঃ Guide to the Use of Books and Libraries (Megrow Hill, 1962), পৃষ্ঠা ১২]

হযরত উমর (রাঃ) এর বিরুদ্ধে একটা মিথ্যা অভিযোগ আছে যে, তাঁর আদেশে আমর ইবনুল আস আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরির লাখ লাখ গ্রন্হের গ্রন্হাগারে আগুন লাগিয়ে ভস্মীভূত করে দেন । কিন্তু এই কাহিনীটি সঠিক নয় । এ প্রসঙ্গে মিঃ হিট্টি বলেছেন- 'ওটা কিংবদন্তী হতে পারে তবে ইতিহাস হিসেবে বর্জনযোগ্য ।' [দ্রঃ History of the Arabs, পৃষ্ঠা ১৬৬]

মহানবী (সাঃ) এর সাহাবী হযরত আলী (রাঃ) প্রশাসন , বিদ্রোহ দমন প্রভৃতি প্রয়োজনে কর্মব্যস্ত থাকলেও তার চেষ্টায় কুফার জামে মসজিদ জ্ঞানকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল । দেশ ও বিদেশের ছাত্ররা সেখানে জ্ঞানার্জন করার জন্য ছুটে যেতেন । হযরত আলী স্বয়ং ছিলেন সেখানকার অধ্যক্ষ । [দ্রঃ মুজীবর রহমানের লেখা 'হযরত আলী' পুস্তকের ৩৬০ পৃষ্ঠা, ছাপা ১৯৬৮ ]

উমাইয়া বংশের আমলে ব্যাকরণ লেখা, ইতিহাস লেখা এবং স্হাপত্য বিদ্যার অগ্রগতি শুরু হয় । মিঃ হিট্টির মতে উমাইয়া আমল হচ্ছে উন্নতির যুগে 'ডিমে তা দেওয়ার যুগ' । [দ্রঃ History of the Arabs, পৃষ্ঠা ২৪০]

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস যখন পরেলোকগমণ করেন তখন এক বড় উট বোঝাই বই রেখে গিয়েছিলেন । গবেষকদের চিন্তা করতে হবে, তখন বই সংগ্রহ করা এ যুগের মতো সহজ ছিল না, কারণ সবই ছিল হাতের লেখা । [প্রমাণ, মাওঃ নূর মুহাম্মদ আজমীর ' হাদীসের তত্ত্ব ও ইতিহাস' পুস্তকের ৮১ পৃষ্ঠা, ১৯৬৬]

হযরত আবু হুরাইরার সঙ্গে বহু গ্রন্হ পাওয়া গেছে, নূর মুহাম্মদ সাহেব যেগুলোকে খাতা বলেছেন । নবী (সাঃ) এর একটা তরবারির খাপে অনেক পুস্তিকার উপকরণ সংরক্ষিত ছিল [দ্রঃ উপরের গ্রন্হ ]

[আবু রুশদ ]

আরবের বিখ্যাত বক্তাদের সারা জীবনের সমস্ত বক্তৃতাগুলো লিখে নেওয়ার মতো লেখক ও প্রেমিকের অভাব ছিল না । লিখতে লিখতে কাগজ ফুরিয়ে গেলে জুতোর চামড়াতে লেখা হতো । তাতেও সংকুলান না হলে হাতের তালুতে লিখতেও ভ্রুক্ষেপ ছিল না । [দ্রঃ উপরের গ্রন্হ ]

সর্বাপেক্ষা বিশুদ্ধ বক্তার মুখ এবং মস্তিক নিঃসৃত বাণী লিখে সংগ্রহ করেছিলেন আবু আমর ইবনুল আ'লা যা একটি ঘরের ছাদ পর্যন্ত ঠেকে গিয়েছিল । [প্রমাণঃ Encyclopedia of Islam Vol-1, 127 ]

(চলবে )

সূত্রঃ চেপে রাখা ইতিহাস, গোলাম আহমদ মোর্তজা, মদীনা পাবলিকেশন্স ।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মে, ২০০৯ সকাল ৯:৪০
২৪টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

নিউ ইয়র্কের পথে.... ২

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২


Almost at half distance, on flight CX830.

পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডেল্টা ফ্লাইট - নিউ ইয়র্ক টু ডেট্রয়ট

লিখেছেন ঢাকার লোক, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:২৬

আজই শ্রদ্ধেয় খাইরুল আহসান ভাইয়ের "নিউ ইয়র্কের পথে" পড়তে পড়তে তেমনি এক বিমান যাত্রার কথা মনে পড়লো। সে প্রায় বছর দশ বার আগের ঘটনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রিয়ট যাবো,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×