somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তিনি শিবিরের লোক

১৪ ই মে, ২০০৯ দুপুর ১২:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঘটনাটা ১৯৯৭ সনের। আমি তখন সিলেট এম সি কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। বাসা থেকে যাওয়া আসা করা কষ্টকর বলে এবং ইতোমধ্যে একবার জন্ডিসে আক্রান্ত হওয়ায় কলেজ হোস্টেলে থাকি। আমাদের হোস্টেলে ছয়টি ব্লক। আমি থাকি ৩য় ব্লকে। আমার রুম নাম্বার ৩১১।

ছাত্র রাজনীতি পছন্দ করিনা বলে কোন সংগঠনের সাথে জড়িত হইনি। অবশ্য আমার সহপাঠি প্রায় সবাই কোন না কোন সংগঠনের সাথে জড়িয়ে পড়েছে। এমনিতে ব্যক্তিগতভাবে সবার সাথেই আমার খুব ভাল সম্পর্ক। দল মত নির্বিশেষে সবার সাথেই আমার সমান চলাফেরা। অন্যান্যরাও আমাকে ভাল চোখেই দেখে।

আমাদের ব্লকে আমরা যারা সহপাঠী তাদের মধ্যে মজার একটা মিল ছিল। আমরা যাই করতাম সবাই একসাথে। গোসল করতে একসাথে, খেতে একসাথে, পত্রিকা পড়তে একসাথে এমনকি টয়লেটেও একসাথে। এমনি একদিন দুপুরে মসজিদ থেকে নামায পড়ে ডাইনিং-এ খেতে বসেছি। আমরা সবাই একটা টেবিল দখল করে বসেছি। সামনে টেস্ট পরীক্ষা। পরীক্ষার বেশি বাকি নেই। আমরা আমাদেও মধ্যে আলাপ-আলোচনা করছি প্রিপারেশন নিয়ে। সিনিয়র ভাই ক’জন আমাদের পরীক্ষার এবং প্রিপারেশন কার কেমন এসব খবর নিলেন। আমি ডান পা ভাজ করে চেয়ারে তুলে আরাম করে বসলাম। খাওয়া এখনও শুরু হয়নি। এমন সময় কিচেন দিয়ে ডাইনিংএ প্রবেশ করলেন রশীদ ভাই।

রশীদ ভাই সম্পর্কে কিছু তথ্য জানিয়ে রাখা ভাল। রশীদ ভাই আমাদের ব্লকের প্রিফেক্ট (ছাত্রাধীনায়ক)। প্রতি ব্লকে একজন প্রিফেক্ট আছেন। গত বছর আমাদের ব্লকের প্রিফেক্ট ছিলেন ছাত্রলীগের বদরুল ভাই। এবছর রশীদ ভাই নির্বাচিত হয়েছেন। উনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র। থাকেন ৩০৬ নং রুমে। প্রিফেক্ট হওয়ার আগের ও পরের রশীদ ভাই- এ দুয়ের মাঝে আকাশ-পাতাল তফাত। প্রিফেক্ট হওয়ার পর ওনার চালচলন, কথাবার্তা, এমনকি হাটার স্টাইল পর্যন্ত বদলে গেছে। এনিয়ে আমাদের মাঝে ব্যাপক হাসাহাসি। ও হ্যাঁ রশীদ ভাই ছাত্রশিবিরের কর্মী।

আমাদের খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আমি আর মোবারক খাওয়া শেষ করে বাইরে যাচ্ছি। এমন সময় রশীদ ভাই আমাকে ডাকলেন। আমি কাছে গিয়ে বললাম-”জ্বী”
”তুমি যে চেয়ারে পা তুলে বসলা, তুমি জাননা ডাইনিং-এ পা তুলে বসা নিষেধ?”
”সিনিয় ভাইরা তো প্রায় প্রতিদিনই চেয়ারে পা তুলে খায়---”
কথা সত্য। সিনিয়র ভাইদের অনেকেই চেয়ারে পা তুলে বসেন। তবে সবাই নয়। এমনকি রশীদ ভাইর সাথে বসে খায়। যাই হোক আমার কথা শেষ করার আগেই রশীদ ভাই বললেন-
”সিনিয়ররা পা তুললে তুমিও তোলবা?”
”নিয়ম তো ভাই সবার জন্য”
এবার রশীদ ভাই প্রায় হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন-
” বেয়াদব, তুমি জান কার সামনে দাড়িয়ে কথা বলছ? আমি চাইলে এক্ষুনি তোমাকে হোস্টেল থেকে বের করে দিতে পারি----”
ওনার হুঙ্কারের তোয়াক্কা না করে আমি বললাম-
”আপনার কথা শেষ হয়েছে? আমি গেলাম”
ডাইনিং ভর্তি লোক ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব। তারচেয়ে বড়কথা আমার এ ধরনের আচরনের সাথে কেউ পরিচিত না। সবাই আমাকে খুব শান্ত-শিষ্ঠ বলেই জানে। আমার এমন আচরন তাও আবার প্রিফেক্টের সাথে?

মানিক ও কামালী ডাইনিং-এর বাইরে অপেক্ষা করছিল। তারাও হতবাক। আমি কোন কিছু না বলে সোজা আমার রুমে চলে গেলাম। পেছন পেছন আমার রুমে ঢুকল মোবারক, মানিক ও কামালী। কামালী ফিস ফিস করে জানতে চাইল কি হয়েছে? কিছুন পর রুমে ঢুকল মিসবাহ আর সাইদুর, তাদের খাওয়া মাত্র শেষ হয়েছে। সবাই শঙ্কিত যদি সত্যি সত্যি হোস্টেল থেকে বের করে দেয়? সারা বিকাল আমরা সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া ও আমাদের পদক্ষেপ নিয়ে আলাপ আলোচনা করলাম।

সন্ধ্যায় মিন্টুদা-র দোকান থেকে চা-নাস্তা সেরে মানিকের রুমে (৩০৫) বসে আমরা আলাপ করছিলাম। কিছুন পর রশীদ ভাই-র রুমমেট সাইদুর রুমে ঢুকল। সে এসেছে রশীদ ভাইর একটা প্রস্তাব নিয়ে। প্রস্তাবটা হচ্ছে, ”যদি আমি আমার কৃতকর্মের জন্য মা চাই তাহলে উনি কোন এ্যাকশন নিবেননা। তানাহলে আমাকে হোস্টেল ছাড়তে হবে।”
আমি সাফ জানিয়ে দিলাম, অসম্ভব। আমার কথা স্পষ্ট, নিয়ম সবার জন্য সমান। জুনিয়র বলে আমাদের নিয়ম মানতে হবে আর ওনারা সিনিয়র বলে নিয়ম ভাঙ্গবেন তা হতে পারেনা। সাইদুর গিয়ে আমর মতামত জানাল।
হোস্টেলের উপর টিনের চাল তাই পাশাপাশী রুমের এ ঘরের কথা ও ঘরে যায় একটু জোরে বললে। সাইদুর চলে যাওয়ার কিছুণ পর রশীদ ভাই জোরে মোবারককে ডাকলেন ওনার রুমে যাওয়ার জন্য। মোবারক গেল। এ ঘর থেকে আমরা বুঝতে পারলাম কিছু একটা বোঝাচ্ছেন কিন্তু কি তা বোঝা গেলনা। অনেক্ষন পর মোবারক ফিরে এল। সে এসেও ওই আগের প্রস্তাবটাই একটু অন্যভাবে বোঝাতে চাইল। মোবারক আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করল, ঝামেলা করে কি লাভ তারচে ওনার প্রস্তাব মেনে নাও ওনি কাউকে বলবেন না, সম্পূর্ন গোপন রাখবেন এ নিশ্চয়তা দিয়েছেন। মোবারকের কথা শুনে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। আমি প্রায় চিৎকার করে বললাম-
”অসম্ভব। আমি কোন অপরাধ করিনি যার জন্য আমি ক্ষমা চাব। আর হোস্টেলে আমি কারও দয়ায় সিট পাইনি, আমার যোগ্যতায় পেয়েছি। হোস্টেলে ইন্টারমিডিয়েটের সবার চাইতে আমার মার্ক বেশী। কাজেই উনি চাইলেই আমাকে হোস্টেল থেকে বের করে দেবেন তা হবেনা। সিনিয়ররা যখন চেয়ারে পা তুলে খায় তখন নিয়ম কোথায় থাকে?”
মোবারককে সাফ বলে দিলাম- ”আমি ক্ষমা চাইতে পারবনা, উনি যদি কিছু করতে পারে করুক।”

আমার সিদ্ধান্তে অন্যরা কেমন যেন চুপসে গেল, মনে হচ্ছে ওরা কিছুটা ভয় পেয়েছে। অবশ্য ভয় কিছুটা পাওয়ার মতই। কারন প্রিফেক্টের ক্ষমতা কম না। ব্লক টিচারকে ম্যানেজ করা ওনার জন্য কোন ব্যাপারইনা। বরং আমার আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ না দিয়েই ব্লক টিচার তার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিতে পারেন। আর যদি তাই ঘটে সেক্ষেত্রে আমার একার পক্ষে কিছুই করার নেই। তখন সিট বাঁচাতে হলে পলিটিক্যাল হ্যাল্প নিতে হবে। কিন্তু এতকিছু জেনেও আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল থাকলাম। তার কারন হল আমার কাছে আমি পরিষ্কার। আমি জানি আমি কোন অন্যায় নয় বরং অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছি। আর এতে যদি সিট চলে যায় তো যাক। পরেরটা পরে দেখা যাবে।

খুব একটা গুমোট পরিস্থিতিতে কয়েকটা দিন কাটল। খুব উৎকণ্ঠার মধ্যে ছিলাম এই ভেবে, এই বুঝি ব্লক টিচার খবর পাঠাল। স্যারের বাসার সামনে দিয়েই প্রতিদিন বালুচর বাজারে মিন্টুদার দোকানে যাই চা-নাস্তা খেতে। দুয়েক বার স্যারের সাথে দেখাও হয়েছে, স্যারকে সালাম দিয়েছি কিন্তু স্যার এসব বিষয়ে কোন কথাই বলেননি।
আস্তে আস্তে ব্যাপারটা খুব নরমাল হয়ে আসল। কিন্তু রশীদ ভাইর সাথে কথা বন্ধ। প্রতিদিনই ওনার সাথে দেখা হয় কিন্তু কেমন আছেন, আমি ভাল আছি টাইপের স্বাভাবিক কথাবার্তাও হয় না। এভাবে প্রায় একবছর ওনার সাথে কথা বন্ধ ছিল।

এ ঘটনাটা নিয়ে পরে অনেক ভেবেছি কিন্তু এ প্রশ্নের কোন উত্তর খুঁজে পেলাম না- কেন রশীদ ভাই কোন এ্যাকশন নিলেননা? উনি কি ভীত ছিলেন? নাকি সৎ সাহসের কাছে পরাজিত হয়েছেন?
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একাত্তরের সংগ্রামী জনতার স্লুইস গেট আক্রমণ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৯ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২১


(ছবির লাল দাগ দেয়া জায়গাটিতে গর্ত করা হয়েছিল)

শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

২৩শে এপ্রিল পাক সেনারা ফুলছড়ি থানা দখল করে। পাক সেনা এলাকায় প্রবেশ করায় মানুষের মধ্যে ভীতিভাব চলে আসে। কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাড়ির কাছে আরশিনগর

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ০৯ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৫০


বাড়ির কাছে আরশিনগর
শিল্পকলা একাডেমির আশেপাশেই হবে চ্যানেলটার অফিস। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করল মৃণাল। কিন্তু খুঁজে পাচ্ছে না সে। এক-দু'জনকে জিগ্যেসও করল বটে, কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারছে না।

কিছুদূর এগোনোর পর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি ভালো আছি

লিখেছেন জানা, ০৯ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯



প্রিয় ব্লগার,

আপনাদের সবাইকে জানাই অশেষ কৃতঞ্গতা, শুভেচ্ছা এবং আন্তরিক ভালোবাসা। আপনাদের সবার দোয়া, সহমর্মিতা এবং ভালোবাসা সবসময়ই আমাকে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে শক্তি এবং সাহস যুগিয়েছে। আমি সবসময়ই অনুভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতার সুফল কতটুকু পাচ্ছে সাধারণ মানুষ

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৯ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:২৮

(১) আমলা /সরকারের কর্মকর্তা, কর্মচারীর সন্তানদের জন্য আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব হতাশাজনক। মুক্তিযুদ্ধের ১৯৭১ সালের রক্ত দেওয়া দেশের এমন কিছু কখনো আশা কি করছে? বঙ্গবন্ধু এমন কিছু কি আশা... ...বাকিটুকু পড়ুন

এলজিবিটি নিয়ে আমার অবস্থান কী!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১০ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:১৫

অনেকেই আমাকে ট্রান্স জেন্ডার ইস্যু নিয়ে কথা বলতে অনুরোধ করেছেন। এ বিষয়ে একজন সাধারণ মানুষের ভূমিকা কী হওয়া উচিত- সে বিষয়ে মতামত চেয়েছেন। কারণ আমি মধ্যপন্থার মতামত দিয়ে থাকি। এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×