আমাদের দেশে বিকৃত ইতিহাস পরিবেশনের জন্য ইংরেজদের দোষ দেওয়া হলেও তাঁদের কূটনৈতিক জ্ঞান ও সুদূরপ্রসারী চিন্তাধারার কথা অস্বীকার করা যায় না । তাঁরা বুঝেছিলেন, ইতিহাসে ভেজাল দিয়েই ভারতবাসীকে অন্ধকারে রাখা সম্ভব, এবং এই ইতিহাসের মাধ্যমেই হিন্দু-মুসলমানের বিভেদ সৃষ্টি করা যাবে । সেই উদ্দেশ্যে ইতিহাস-স্রষ্টা মুসলিম জাতির অক্লান্ত পরিশ্রমের রচনা-সম্ভার আরবী, ফারসী ও উর্দু ইতিহাস বইগুলোর প্রায় প্রত্যেকটি অধ্যয়ন, গবেষণা ও অনুবাদ করতে তাঁরা যে অধ্যবসায় ও পরিশ্রমশীলতার দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তা অনস্বীকার্য এবং উল্লেখযোগ্য ।
উদাহরণ হিসেবে কয়েকটা উল্লেখ করা হলোঃ
১. আবুল ফজলের আকবর নামার তৃতীয় খন্ডের অনুবাদ করেছেন মিঃ হেনরী বেভারীজ ।
২. আইন-ই-আকবরীর দ্বিতীয় ও তৃতীয় খন্ডের অনুবাদ করেছেন মিঃ এইচ এস জারেট এবং প্রথম খন্ড অনুবাদ করেছেন মিঃ এইচ ব্লকম্যান ।
৩. আল-বেরুনীর কিতাবুল হিন্দ অনুবাদ করেছেন মিঃ ই.সি সাচান ।
৪. মুসলিম মহিলা ঐতিহাসিক গুলবদন বেগম লিখিত হুমায়ুন নামার ইংরেজী অনুবাদ করেছেন মিসেস বেভারিজ ।
৫. জনাব মির্জা হায়দারের লেখা রশীদীর ইংরেজী করেছেন মিঃ ই.ডি রস ।
৬. পর্যটক ইবেনে বতুতার পর্যটনের কাহিনী লিখিত গ্রন্হের ইংরেজী অনুবাদ করেছেন মিঃ এইচ. এ. আর. গিবন
- প্রভৃতি । খুব অল্প কয়েকটি নাম উল্লেখ করা হলো ।
মূল তথ্যের সঙ্গে কোন কায়দায় কোন ভেজাল কিভাবে সংমিশ্রণ করতে হয় এ বিষয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনুবাদকগণ নিপূণ শিল্পীর পরিচয় দিয়েছেন । কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো- মূল গ্রন্হের ভাষা আরবী, উর্দু, ফারসী না জানার জন্য ইংরেজীতে অনূদিত বিভিন্ন পুস্তকের সহায়তা নিয়েই এবং শুধু সেগুলোকে কেন্দ্র করেই ভারতের অধিকাংশ সরকারী ইতিহাস রচিত হয়েছে বা হচ্ছে ।
এ প্রসঙ্গে ভারতের ইতিহাসের দিকপাল শ্রীমতি রোমিলা থাপার বলেনঃ
'স্কুল কলেজের পাঠ্য ইতিহাসের বই সত্যিই সেকেলে এবং অজস্র ভূল তত্ত্ব ও তথ্যে ভরা । কিন্তু পাঠ্যপুস্তকের অনুমোদন সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকার কিংবা শিক্ষা পর্ষদের এখতিয়ার । অথচ ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইতিহাসের লোক নন- হয় আমলা, নয় রাজনীতিবিদ; যাঁরা কখনও ইতিহাস পড়েন নি অথবা ৬০/৭০ বছর আগেকার দু একটা বই নামোঃ নামোঃ করে পড়েছেন । রাজনীতিবিদদের ইতিহাস-চেতনার কথা আর নাই বললাম ; ইতিহাসের মধ্যে নিজের দল, গোষ্ঠীর বা সম্প্রদায়ের স্বার্থ খোঁজাই এদের কাজ ।"
মনীষী রবীন্দ্রনাথ বলেছেনঃ "ভারতবর্ষের যে ইতিহাস আমরা পড়ি এবং মুখস্হ করিয়া পরীক্ষা দেই, তাহা ভারতবর্ষের ইতিহাসের এক দুঃস্বপ্নের কাহিনীমাত্র ।"
সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, আমাদের দেশের প্রচলিত ইতিহাসকে সর্বাংশে সঠিক বলে মনে করা সত্যের অপলাপ ছাড়া আর কিছু নয় ।
ভারতবর্ষের ক্যানসারের মত সবচেয়ে বড় ব্যাধি হলো সাম্প্রদায়িকতা । আর এই সাম্প্রদায়িকতার তিক্ততা অন্যান্য সম্প্রদায়ের চেয়ে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বেশি প্রকট । এটাকে নির্মূল করতে হলে, আমাদের ধারণায়, সর্বাগ্রে সঠিক ইতিহাস পরিবেশন অবশ্য কর্তব্য । তাছাড়া এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক জানাজানির , আদান-প্রদানেরও বিশেষ প্রয়োজন আছে ।
তবে সঠিক ইতিহাস পরিবেশনের পূর্বাহ্নে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার উচ্ছেদ সাধনে ইসলাম , কুরআন ও মুসলমান সম্পর্কে কিছু ধারণা দেওয়া আবশ্যক ।
ইসলাম, কুরআন ও মুসলমানঃ
আদি মানব হযরত আদম (আঃ) ছিলেন ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক । এই ইসলাম একটি ধর্ম ও ইজম -এর নাম । যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই ইসলাম আরো পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত হয়ে পরিপূর্ণতা লাভ করে হযরত মুহাম্মদের (সাঃ) এর সময় । তাঁর ৫৭০ খ্রীষ্টাব্দে বিশ্বাগমন এবং ৬৩২ খ্রীষ্টাব্দে হয় পরলোকগমন । কুরআন হলো মহানবী (সাঃ) এর উপর অবতীর্ণ আসমানী কিতাব, যা আজো বিশুদ্ধ ও অবিকৃত রয়েছে । আর শেষ নবীর বাণী, কাজ এবং সমর্থিত মতামতগুলো হাদীসের মধ্যে গণ্য । যারা কুরআন ও হাদীসের উপর বিশ্বাস রাখেন তারাই মুসলমান ।
পরিতাপের বিষয়, নানা পুস্তক, প্রবন্ধ, নাটক প্রভৃতির মাধ্যমে ভারত জনমানসে দেখানো হয়েছে এই মুসলমান জাতি বিদেশী, বাকি সব স্বদেশী; অতএব তারা আমাদের মিত্র নয় । সারা ভারতবাসীই যে এ চক্রান্তের শিকার হয়েছে তা অবশ্যই নয় । সর্ষের মত একটি বটের বীজের মধ্যে লুকিয়ে থাকে যেমন বিশাল বপু বৃহৎ একটি বট গাছ, তেমনি এই ভেদটুকুর ভেতর লুকিয়ে আছে বিরাট অকল্যাণ । এর সংক্ষেপ সমাধান হচ্ছে , মুসলমান স্বদেশী না বিদেশী এই নিয়ে বিষমন্হন না করে মনে রাখা ভালো, ভারতে মুসলমান আগমন এবং আর্য আগমন অভিন্নভাবে বিচার্য ।
(চলবে )
সূত্রঃ-চেপে রাখা ইতিহাস, গোলাম আহমদ মোর্তজা । মদীনা পাবলিকেশন্স ।