somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কফিল আহমেদ তোমাকে দেবোনা ভুলেও লাল জবা ফুল

০৯ ই মে, ২০০৯ দুপুর ২:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



হাজারকি হাঁক দিলে
ঝাঁক ঝাঁক গুড়ামাছ উড়া দিতো বিলে!

চিলকাক তাক করে, দুহাতে থাপ্পা দিয়ে আকাশে উদাম
পক্ষী তাড়ানো দেখা যাচ্ছে। আহার বিহারী চিল আজো অনাহারী
সাতপাড়া চিরিয়া ডাকে ঘুরে ফিরে।

উড়ে যেতে না পারলেও জালুয়ার কিস্তিনাওয়ের তলপেটে পাবদাপুঁটি লাফিয়ে লাফিয়ে মরে।

ভোঁ ভোঁ মাছি তাড়াতে তাড়াতে ডালায় মাছের ভাগা নিয়ে তুলশি দাস শেষপর্যন্ত ডেকে যায়- লৈয়া যান। লেমুপাতা দিয়া ভালা লাগবো। পঁচা মাছের সাথে মাঝেসাঝে প্রয়োজনে লেবুপাতা মিশাবার, বুদ্ধিজীবিতার গ্রামীণ সৎকার। কোনো নিতান্ত সুশীল আল্লাদ নয়। জীবনের সুধাময় মৃত সঞ্জিবনী স্বাদ। তা অবশ্যই মানুষের একরকম অর্জন। কাকচিলেরা তা পারে নাই।

তবে এখনতো মাছের আর পঁচবার তেমন সুযোগ নাই। নাও থেকে, ঘাট থেকেই পাইকাররা জ্যান্তমরা সব নিয়ে যায়। আর বরফকল ডিপফ্রিজতো বেপারিদের ধারেকাছেই। কিন্তু মাছ আর না পঁচতে পারলেও নদীনালার পানিটানি মরে গিয়ে এতোদিনে পঁচতে শুরু করেছে।

পঁচা গাঙ্গে মিঠাপানি! পঁচা পানিমাছটা ডিপফ্রিজে খুব টাটকা দেখাচ্ছে?

নাকি চোখ দুটি হিমাগারে আটকা পড়েছে? ইলেক্ট্রিক হিমযুগে এসে ওরা ঘুমিয়ে পড়েছে! সুপ্তকণার ইলেক্ট্রনিক্্র তো এ দেশে সবেমাত্র উঁকিঝুকি দিচ্ছে।

কিন্তু ওসবের আগে তো প্রয়োজন গাঙ্গের টাটকা জীবন। সে জীবনে কেউ আর আগেভাগে মরবে না। পঁচে যাওয়া তো অন্যায় কথা।

কিন্তু অমৃতপুর এখন কসাইভিটে।

অমিত বলছিলো সত্যি সত্যি অমৃতপুর নামের একটা জায়গার নাম নাকি কসাইপট্টি হয়ে গেলো! ভাবছি অমৃতপুর, এমন প্রমিত উচ্চারণ লোকমুখে একটু কঠিন কঠিন লাগতো! শুনেছি সে নাম মুখস্থ করাবার জন্য এককালে নাকি জোড়াজোড়া পাঁঠা-মোষ, এমনকি মানব শিশুকেও জোর করে মহাশুন্যের হা-মুখে এক কোপে প্রদীপ জ্বালিয়ে... অন্ধকারে ডুবিয়ে মারা হতো।

এ-‘ভাবে’ সে নাম স্পষ্ট হয় নাই। মুখে মুখে স্পষ্ট শোভা পায় নাই। নাকি বাস্তবতার আসল চেহারাটা প্রকাশ করতে মানুষের জিহ্Ÿা একদিন আর একটুও আটকালো না। কসাইপট্টিই তো! আসল নামটাই মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে।
তবু অমৃতপুর, সে কথা মুখে পুরে মানুষগুলি আর মুখ খুলছে না। শব্দটা গিলে খেয়ে সে আর মুখ খুলছে না। কিন্তু অমৃতপুর, সে নামের স্বপ্নটা, স্বপ্নরূপটা তো বিরাট সুন্দর। মুখে কতোশতো স্বপ্নের বিরাট মোড়ক। সে মোড়ক ছিঁড়েখুঁড়ে মুখ তার লশলশা জিভ আর দগদগে চোখ তুলে ... লিকলিকে ফণা তুলে আছে।

পদে পদে নানা মৃত্যু, নানান মারামারির মৃত্যুবীজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
কেউ কেউ সে মৃত্যুবীজ নিয়ে খুব সাজিয়ে গুছিয়ে বসে। এদেশে সেদেশে দুর্বৃত্তরাও নাকি অনেক বেশি সাজানো গোছানো। পৃথিবীর ঘোর জঙ্গলেও ওরা নাকি সুন্দর বাগানবাড়ি বানিয়েছে। আর তারাও নাকি শাসক! ওখান থেকেই সব শাসনের সাম্রাজ্য সাজিয়ে তারাওতো নিজেকে সম্বোধন করে বলেন- প্রশাসক!

দিকে দিকে ছড়ানো ছিটানো সব জীবন আর জীবনীকে জড়ো করে, আবার সবকিছু এলোমেলো করে, সবকিছু তছনছ করে, সেসব আরে সজ্জিত করে কেউ কেউ আবার সর্বত্রই তার শোষণের বাগান ছড়াতে থাকে। বাগানের বাজার আর তার শাসন ছড়াতে থাকে।

শাসনের কোম্পানি ছড়াতে থাকে।

প্রাইভেট কোম্পানি আরো বড়ো আরো মজবুত হতে হতে ন্যাশনাল মাল্টিন্যাশনাল হতে থাকে। সে সবের সামনে যুগে যুগে মানুষের বেঁচে থাকবার প্রেম। কতো অসুখ- বিসুখ। কতো আলিঙ্গন। লড়াই।

লড়াই নিরবে, একা এবং সরবে আরো অনেকের সাথে।

কিন্তু ওরাতো সবাইকে এক সাথে হতে দেবেনা। তা সত্য।

আবার যারা লড়ছে, কখনো তারাও সবাই একসাথে খুব একা হয়ে যায়?

না। কোনো লড়াইয়েই সবাই একসাথে একা হয়ে যায় না।

যদি কাজের উৎসমূলে, সঙ্গে বা সামনে একে একে আরো অনেকে জড়িত হতে থাকে... জড়িত হবার, জড়িত করবার মনইচ্ছা ও যোগ্যতা থাকে- তবে সে আর একা থাকে না।

কিন্তু মনে যার অমৃতধারার উস্কানি আছে সেও কিনা একদিন একা হয়ে গেলো। কসাইপট্টিতে খুব একা কেউ জবাই হয়ে গেলো! সে গরু কিংবা মানুষ।

আজ যখন অলিগলি পাড়া জুড়ে একসঙ্গে শতসহস্র কোরবানির হইচই, তখন নিরবতার ঠান্ডা বোবা স্তব্ধতাও নামে। এদেশে হিন্দুরা নাকি এদিন সারাদিন লুকিয়ে থাকে। লুকিয়ে একা হতে চায়?

আবার কেউ কেউ নাকি লুকিয়েই এটা সেটা খায়।

কেবল হিন্দুরা কেনো? কেবল এদিন কেনো?

অনেকেতো সারাটা বছরই নানাভাবে একা হয়ে আছে। আর যারা খুব হইচই করছে তারাও তো একটু বাদেই ভিতরে ভিতরে খুব ফাঁকাই হয়ে থাকছে। কাউকে কাউকে বলতে ভাবতে শুনি... খারাপ লাগছে। আর কিই বা করবার আছে?

শহরের উপর আকাশের চিল ঘুরছে। একা। ভিখিরির কয়েক টুকরা জোগাড় করবার বন্দোবস্ত রীতি আছেই। তবে তাকেও ঘুরতে হয়। ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে ঘুরতে হয়। না পারলে পথের মোড়েই কোথাও শুয়ে বসে আছে। এক দুই টুকরা তার মুখেও জুটতে পারে। কাকচিলেরা তো আরো অনেক দূরের। তবে ওরাও উড়ছে ঘুরছে। বহু দূর থেকে ওরা নিরব ইন্দুরমরা, না হয় আরো নিথর পঁচালচা খুঁজছে।

বিলেগাঙ্গে হাজারকিদের হল্লা শুনেছি। এ অঞ্চলে বহুকাল ধরে মানুষেরা একজোট হয়ে বিলেগাঙ্গে মাছ ধরতে যেতো। কিন্তু জেলে হাজারকিরা, কৈবর্তরা বেশিরভাগই নিরীহ হিন্দুজন। গাঙবিলে একজোট হয়ে ওরা মাছ ধরে বাঁচে।
হাজরাকিদের বহুদিনের পেশা আর ঘরবেসাতি তছনছ করে সেখানেও একদিন নিলামঅলার শাসন প্রতিষ্ঠিত। বিপরীতে হাজারকিদের মরণপণ হাঁকডাক, লড়াইÑতাও শুনেছি। সরকার তার বন্দোবস্ত আইনে বিলগাঙ ইজারা নিলামে ভাড়া দিয়েছে স্থানীয় ঠিকাদার জোতদারদের কাছে।

তখন জেলেÑকৈবর্তরা যেনো গাঙবিলের বুকে বহু উদ্বাস্তু কাকচিল। কিন্তু তাদেরতো আর পাখা নাই যে শুধু শুন্যভরে উড়বে ঘুরবে। তাদের আছে হাত। আছে মুখ। তাইÑ‘জেলে যে জলা তার’ দাবি নিয়েই সেখানে তরুণ দাবির প্রতিজ্ঞাঘন আন্দোলনের শুরু। সে দাবির মুখে নিলামঅলাদের মাথা কাটা যেতে পারে, এমন পরিস্থিতিতে সরকারের খোদ প্রশাসন পর্যন্ত বিচলিত। আর এদিকে মামলা মোকদ্দমা জেল জালিয়াতির মুখে মরণপণ যুদ্ধ করতে করতে, সে যুদ্ধ অসমাপ্ত রেখেই আন্দোলনকারীরা একদিন যার যার জীবনযাপণ নিয়ে এদিকে সেদিকে।

দু’হাতে থাপ্পা দিয়ে কাকচিল তাড়ানো সহজ। কিন্তু নিলামঅলাদের উচ্ছেদ করা তো মোটেও সহজ কথা নয়। এদের শক্তি গ্রামÑরাষ্ট্র হয়েই নাকি সারা দুনিয়াব্যাপী। তবু জেলে যে জলা তার এই দাবি নিয়ে প্রায় একযুগেরও আগে ‘বেঙলার জেলে আন্দোলন’... বাঙলার এই হাজারকি আন্দোলন নিলামঅলাদেরকে উৎখাত করবার জন্য গাঙ্গের বুকে জেলে-হাজারকিদের পতাকা উড়াবার সঠিক খবর দিয়েছিলো।

কেউ বলবেন এদেশে নিলামঅলাদের ভিত্তি এখন আরো সাঙ্ঘাতিক। দিনেদিনে ওরা এখন আরো পোক্তা হয়েছে। বিলÑগাঙ্গÑহাটÑঘাটÑবনÑবন্দরÑমাঠ সবকিছুই তো দিনে দিনে আরো নিলামে উঠছে।

হাটে মুরগি গরুÑবেচা লোক, তাকেও হাসিল দিতে হয় গাঁয়ের ইজারাঅলাকে। ঘাটে ঘাটে গাঙ পারাপারে বাড়তি ইজারা ভাড়া দিতে হয় পথচারীকে। নদীর তলানি থেকে পাহাড়ের মাথা পর্যন্ত যা যা আছে, যা যা দেখা যায়, যা কিছু দেখা যাচ্ছে নাÑমাটির তলার সম্ভাবনা তেলÑকয়লা, সকল সম্ভাবনা, অনুমান কিংবা অনুধাবন তাও ইজারা নিলামে বন্ধকী দেয়া হচ্ছে। এক থেকে শুরু করে একশো বছরের জন্য বন্দোবস্ত চুক্তির নানান স্বাক্ষর নিয়ে খুব তৎপর আর বেপরোয়া হয়ে উঠছে নানান কোম্পানিগোষ্ঠীর লোক।

‘জেলে যে জলা তার’Ñএই দাবি নিয়ে বেঙলার তরুণ হাজারকি আন্দোলন অগ্রসর হলে এদেশে নিশ্চয় এতোসব জীবনÑবিরোধী বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে একটা সুন্দর দৃষ্টান্ত, পথ আরো বাস্তবিক সম্ভাবনার হয়ে উঠতোই। একথা স্বীকার করতেই হবে।

‘জেলে যে জলা তার’Ñকথাটা এদেশের মানুষের জীবনে এখনো কার্যকর না হলেও, সে দাবি কার্যকর করবার জন্য লোকালয়ের তরুণ মন ঠিকই আন্দোলিত হয়েছিলো। শ্রমিক যে কারখানা তারÑএ কথাটা এখনো স্পষ্ট বলা যাচ্ছে না, কারণ নাকি কারখানার তো একটা মালিকানা ব্যবস্থারীতি আছেই। ওখানে ব্যক্তি কিংবা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকিং পূঁজির ইনভেস্টমেন্ট আছে। কারখানা শ্রমিকেরÑএ কথাটা বলতে গেলে নাকি চলতি বিধানরীতির বিরুদ্ধে জীবনের ডাকটা খুব সরাসরি হয়ে যেতে পারে।

জলাভূমি... যদিও তা সকলের জন্য কখনোই সমান খোলামেলা ছিলো না, তবু সে জলাভূমি ঘিরে বহুকাল আগে থেকেই সে পাড়ের অসংখ্যের জীবনযাপন। তা নিয়েই তো মানুষের আরো কতো রকমের কাজ, আরো কতো স্বপ্নসাধ। সে অসংখ্যের নামই হাজারকি। দেশ চালাতে টাকা লাগে। সে কথা জেলে কৈবর্তরাও জানে। আর সে জন্য তো সরকারের তহবিলে নিয়ম করে তা দেবার মন ইচ্ছা আর প্রতিশ্র“তি প্রকৃত জেলেদের ছিলোই। তারাতো চেয়েছিলোÑতারাও বাঁচুক, আর দেশের সরকারও ভালো থাকুক। কিন্তু সেদিকে সরকারের প্রশাসনের কোনো খেয়াল নাই। তাই জলাভূমির উপর ব্যক্তিগোষ্ঠীরা ‘একটু পূঁজি’র ইনভেস্ট করেই- অসংখ্যকে উদ্বাস্তু বানিয়ে নিলামে-নিলামে একটা বন্দোবস্তে ডেকে আনে। ‘সে ডাকে’ও অনেক সরকারি ফাঁকি। ঘুষ। প্রশাসনের নানান স্থানীয় সরকারি জোচ্চুরি।

‘চাষা যে, মাঠ তার’- সে কথা বলবার মুখেও ভূঁইয়া-ভূস্বামীরা বক্তার মুখ বেঁধে, তাকে জেলখানায় দিতে

চাইবে। উপায়ান্তুরে হত্যাকাণ্ডও ঘটাতে পারে। এদেশে খাস জমি চেয়ে ভূমিহীনরা, দিনমজুররা নানাভাবে লড়াই সংগ্রামও করেছে। সেসব লড়াই সংগ্রামও কোনো সুন্দর পরিণতি পায়নি। ভূমিছাড়াদের নানান আন্দোলন আর ‘রক্তদান’-তাও জীবনের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পথ ধরে বেশিদূর এগুতে পারেনি। তা সত্য।

তবুও ‘জেলে যে জলা তার’-এই স্লোগান দাবির সাথে ‘শ্রমিক যে কৃষি তার, কারখানা তার’Ñহয়ে উঠবার পথে জীবনধারাকে আরো সাবলীল ও সামগ্রিক করবার জন্য, তাকে আরো সত্য করে বলতেই হয়Ñজলাধারের উৎসমুখ আর তার প্রবাহ যেনো কাছের দূরের সব স্থল ও পাহাড়দেশ পর্যন্ত... তা আরো জীবনে যুক্ত হয়। সম্পর্কিত হয়। এই সম্পর্কে, যা আছে, যা যা আসেÑসেখানে অবশ্যই জলটুকু আছে। জল ছাড়া তো জলার অস্তিত্বের কথা ভাবা যায়না। আর জলধারার উৎসমুখে তো পাহাড়দেশ জড়িত হয়েই আছে। তা থেকে তো ছিন্ন হওয়া যায় না। সে পথে বাঁধ দিয়ে, নানান বন্ধকীর বাঁধা দিয়ে তো পথে পথে নানান মৃত্যুবীজ বপন করাই হচ্ছে। জলার গভীরে যারা থাকে, যারা আসে... তারা মাছ, ঝিনুকশামুক। জলদেশে যারা বাস করে তারা ফুলকলমি, পদ্মশালুক। জল জুড়ে যারা উড়ে তারা পানকৌড়ি, বকচিল। বিলে এবার হাঁস এসেছে... এমন খবর পেয়ে জালুয়ারা যেনো অন্ধকারে আকাশ জুড়ে ওদেরকে আর ঘেরাও না দেয়। সে ধারার ঘেরাও-নীতি মানুষের মনে বহুদিন গোপনে ঘাপটি মেরে খুব হাসাহাসি করে। শত আইন করেও নাকি সে হাসি থামানো যাচ্ছে না। মানুষ জাল বুনতে চায় গোপনে হাসি ধরবার জন্য। ব্যক্তি কোম্পানি বানাতে চায়, আর কোম্পানিও রাষ্ট্রনীতি বানাতে চায় তার জাল দিয়ে মানুষগুলিকে ধরবার জন্য। ভিতরে ভিতরে লালসা আরো ঘন, সঙ্কট আরো জমাট হয়েই আছে। পাড় ধরে ধরে আরো কতো কিছুর জীবন।

সে পাড়ে দেশি গরুর মুখ আর খুব বেশি দেখি না। প্রশ্ন আসে গরু-মোষের আবার দেশি-বিদেশি হবার কি আছে? চোখ মুখের শিঙের গড়নে আমাদের দিকে তার বহুদিনের তাকিয়ে থাকা। তার কতোই না কথা। সে কথা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আজও বলাই হয়নি।

সে কেবল নিতান্ত মাংস মুদ্রা নয়। কোম্পানীর হাইব্রিড প্র্যাকটিসের লোভে সত্তার মরণ দশা দেখছি। এ দশার প্রজনন প্রথাই তো বিচ্ছিন্নতাবাদ। একের সাথে অপরের ভালো মতো দেখা হবার, কথা হবার কোনো সুযোগই নাই ওদের। খুব নিষ্ঠুর রকমে ছিন্ন করা হচ্ছে জীবনের সহাবস্থানকে। পারস্পারিকতাকে। জন্ম মাত্রই, জন্মাবার আগেই নানান বন্ধকীতে আটকা পড়ছি সবাই। কেউ বলবেন, আমরা তো গাঙপাড়েই থাকতে পারছিনা, এসব নিয়ে ভাবি কখন?

নদীতে নৌকা দেখি।

পাহাড়দেশ থেকে নিয়ে আসা পাথর বোঝাই ইঞ্জিনের নৌকা।

একসময় ধানপাটভরা নৌকা নিয়ে পাড় ধরে ধরে গুন টানতে টানতে বয়ে নিয়ে যেতে হতো।

আরো কতো রকমারি নৌকাই না আসতো যেতো। ডাকাইতের নাও, পাকবাহিনীর নাও, মুক্তিবাহিনীর নাও স্রোতের বিপরীতে নাও বাওয়া, গুন টানা অনেক পরিশ্রমের। কতো শক্তিই-না ক্ষয় হয়েছে।

এখন ইঞ্জিনের নাও। মাঝিমাল্লা গুনটানা কামলার আর দরকার পড়ে না।

পানিতে কিলবিল করতো জোঁক। পোকামাকড়ের জন্য সন্ধ্যায় কূপি জ্বালানোই কঠিন ছিলো। আরো কতো কঠিন দুর্দশার জীবন ছিলো মানুষের। কাদা পানিতে শীতের সকালে গরুমোষ নিয়ে মাঠের চাষে নামতে হতো।

কিন্তু সেসব মাঠ আর চাষাদের থাকলো না। মজুরেরও হয়ে উঠলো না। মাঠ এখন খামারঅলার। বড়ো বড়ো মাঠগুলি দিনেদিনে ব্যবসায়ীদেরই হয়ে গেলো। যে যতো বড়ো ব্যবসায়ী, সে ততো বড়ো খামারি, মাঠের মালিক। বন্দোবস্তটা ওরা আবারো সেই জমিদারির মতোই চিরস্থায়ী প্রতিযোগীতার করে নিচ্ছে। টাকার জোরে। টাকার শাসনের জোরে। কিন্তু সেই মাঝিমাল্লা কামলা চাষীরা...তারা গেলো কই?

কেউ কেউ নাকি বিলেগাঙ্গে মাছের আড়তে চিলদৌড়ানির চাকরি করে। জীবন পারাবারে মাঝিমাল্লা, নৌকা একদিন মরমিয়ার আধ্যাত্মিক প্রতীক হয়ে মনে জায়গা করে নিলেও, আসলে তো বেশিরভাগ মাঝিরই নিজের কোনো নৌকা নাই। ছিলো না। সত্তরের ইলেকশনে নৌকাটা জাতির মরমি মার্কায় স্থান পেলেও- সেসব মঝিমাল্লা আর গুণটানা কামলাÑমজুরের হাত থেকে বৈঠা, বুকের তলার নদীজল আর পায়ের নিচের উদাম মাটি কিংবা বসতবাটি দিনে দিনে আরো নাই হয়ে যেতে লাগলো। মাঠের ধানের শীষ আর চাষবাসের লাঙ্গলকেও কেবল ‘মার্কাপ্রতীক’ বানিয়ে, লুটপাটের মহা কাড়াকড়ি চললো সারাদেশ জুড়ে। সে কাড়াকাড়িতেও লাভবান হলো ঠিকাদার ইজারাঅলা আর কোম্পানিঅলারা। দিনে দিনে সবই আরো নিলামজাত হতে লাগলো। সরকার গুদাম বানালেও, সেসব গুদামও দিনে দিনে নিলামে নিলামে ব্যক্তিমালিকানায় আরো আটকজাত হতে থাকলো।

চুনাবিষ দিয়ে জোঁক মারা গেলো। কিন্তু জলধারা বিপদমুক্ত হলো কি?

অনেকেরই পা থেকে এখনো জোঁকে খাওয়া রক্তচোঁয়া ক্ষত সারেনি। কাদামাখা কামলারা, কৃষকেরা পায়ের সে দাগ নিয়ে কোনো সরকারী চাকুরি পাবে না। কিন্তু তাদেরই ছেলেরা বড়ো কষ্টে কোনোমতো হাত-পা ধুঁইয়ে সরকারি হবার জন্য বুকের মাপজোক দিলো। কারো কারো পায়ে কাদার বদলে বুটজুতা ঢুকলো। কিন্তু সে চাকরি আর কতোজনের জোটে? তাও কম না। নিলামঅলাদের জান আর সম্পদ পাহারা দেয়ার জন্য, এসবের মন্ত্রী আর মন্ত্রণালয় রক্ষার জন্য, আদেশ জারি ও তা কায়েম করার জন্য, ভোটাভুটির হাঙ্গামা নিভানোর জন্য কোটিজনতা-প্রতি কমপক্ষে একলক্ষ সৈনিক-কেরানি-কর্মচারি তো প্রয়োজন। বাকিরা তো মাটিকাটা রাস্তাঘাট আর বিল্ডিং নির্মাণের দিনকামলা, গার্মেন্টের মাসকামলা, আরো কতোশতো রোগাসোগা ‘তুখোড়’ ফেরিঅলা, সেবাসদনের রকমারি মাঠকর্মী। কর্তারা সবাই ‘সুশীল’। আরো কতো লোভী সমাজ। কেবল মৌলভি নয়। সাংস্কৃতিক মৌলভি সমাজও আছে।

সাহেব আলী মৌলভি হাত-পা ধোয়া আরামি লোক। সমাজের সেলামি পেতে চায়। সুশীলরা কেবল সালাম নয়, সাথে একটু আদাব নমস্কারও পেতে চায়। এখানে ওরা এটুকুই এগিয়ে। একটু সাংস্কৃতিক! কিন্তু সে সংস্কৃতির মৌল চাহিদা নাকি শান্তির নিমিত্তে অর্থ খয়রাতির নানান অন্বেষা, প্রপাগান্ডা, নানা জাতীয় ও আর্ন্তজাতীয় পুরস্কার প্রাপ্তির দলিল প্রদর্শন।

কিন্তু দেশে শ্রমিকজনেরা তার কাজের মাসিক পাওনাটুকু না পেয়ে একজোট হলে মৃত্যুবরণ করতে হয়, জেলে যেতে হয়। সে খবর ধামাচাপা দেয়ার জন্য মালিকপক্ষ সমিতি করে, বিবৃতি দেয়। রাষ্ট্র আরো রিজার্ভ ফোর্স বাড়ায়। শ্রমিকরা বেতন পাচ্ছেনা। তা নিয়ে রাষ্ট্রের শ্রমআইনের কোনো কার্যকর উদ্দ্যোগ ভূমিকা কিংবা কোনো সংশোধনী নাই। রিজার্ভ ফোর্স কেবল বেতন নয়, পেনশনও পায়। তা অবশ্যই পাওয়া উচিত, তবে তা শ্রমিকের জন্য নয় কেনো? এই ছোট দেশের অধিকাংশ মানুষেরই জীবনে ঘুমাবার মতো সামান্য বসতভিটে পর্যন্ত নাই। যেটুকুন অল্পবিস্তর খোলা জায়গা আছে, তার বেশিরভাগই ক্যাম্প আর ক্যান্টনমেন্ট। জায়গা দখলের প্রতিযোগীতায় নানান বিশ্ববিদ্যালয় আর রকমারি মাদ্রাসাও পিছিয়ে নেই। কথা হচ্ছে ওসব পাস আর চাকরি-বাকরি নিয়ে আমরা কার জন্য কোথায় কি করছি? কার কাজে আসছি? অবশ্য বলতেই হয়, একজন সাধারণ সৈনিকÑকর্মীÑকর্মচারীর প্রাপ্তি কোনো নিলামঅলা মালিক ব্যবসায়ীর আয়রুজির তুলনায় এতোটাই সামান্য যে, এ দুয়ের বৈষম্য এতোটাই সামান্য যে, এ দুইয়ের বৈষম্য-ব্যবধানের কোনো হিসাবই রাষ্ট্র আজোবধি দেয় নাই। দিতে পারে নাই। তাহলে প্রজাতন্ত্রের গণসম্পর্কের জায়গাটা কোথায় আটক? সে আটক কে ভাঙবে?

সেদিনো কানসাটে বিদ্যুৎ চাইতে গিয়ে মানুষ মরলো। কথা হচ্ছে বিদ্যুৎ প্রশ্নে গণসম্পর্কের জীবনবোধের জায়গাটা আসলে কি এবং কেমন হওয়া উচিত? কেবল বারান্দা আলোকিত করবার জন্য বিদ্যুৎ? বাজারে দোকানদারি করবার জন্য বিদ্যুৎ? স’মিলে গাছগাছড়া চিরবার জন্যই বিদ্যুৎ? জনমনে সে সব প্রশ্নের যথাযথ মীমাংসা হওয়া চাই। বিদ্যুৎব্যবস্থাকে গণসম্পর্কিত করবার বিষয়টি অবশ্যই নির্ভর করছে প্রধানত কৃষি ও শিল্পখাতকে গণমুখীন করবার পথে। কিন্তু সে খাত দুটি তো এখনো পর্যন্ত আটক আর অচলজাত হয়ে আছে। মানুষের মনোপ্রাণে এসব প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব জন্মানো চাই। শুধু মনে জবাব জন্মানোই না, তা নিরসনের প্রত্যক্ষ কাজটিই জীবনের পক্ষের সৃজন।

একদিকে উত্তরবঙ্গকে মরুভূমি ঘোষণা দিয়ে, সেই ভুমির তলানি খুঁড়ে কয়লা লুটবার জন্য বিশ্ববাজারির ঝাপসা বন্ধকীনীতি, অপরদিকে নদীমুখে স্লুইসগেট করে ফসলি জমি ঘিরে ঘের বানিয়ে ভবদহের লক্ষ লক্ষ মানুষকে বহু বছরব্যাপী পানিবন্দি রাখবার এক দুঃসহ মৃত্যুবীজ রোপন করছে যারাÑতারাও কিন্তু এদেশেরই স্বেচ্ছাচারি। উদ্দেশ্য টাকাÑটাটকা। সেজন্য যারপরনাই স্বেচ্ছাচারিতা। আধিপত্য। আধিপত্য মানুষের উপর, গোটা প্রাণী-প্রকৃতির উপর। নদী-বিলের নাব্যতাকে গলাচিপা করে জীবনধারাকে নানান লিখিত অলিখিত বন্ধকীতে আটকে রেখেছে এদেশেরই গোটাকয় ‘চিংড়ি-মালিক’। ব্যক্তিমানুষকে কেবল সব দখলের একটা সর্বনাশা ঘূর্ণিপাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, সবাইকে নানান দিকবিদিক প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দিয়েছে আজকের পৃথিবীর, দেশের, গ্রামের, এমনকি একটি পরিবারেরও টাকাসর্বস্ব^তা। টাকাসর্বস্ব প্রতিযোগীতা। সে প্রতিযোগীতায় সবাই, সকল অস্তিত্বই নিতান্ত সম্পদ না হয় সম্পত্তি। কোম্পানি আর তার জন্য নির্মিত শাসকবর্গের সুবিধাটা এখানেই। যেখানে সম্পত্তির প্রতিযোগীতা সেখানে কোম্পানি আরো ধূর্ত। আরো দুর্বৃত্ত।

আমরা প্রিয় কবিতার কথাও শুনি। বলি প্রেম বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির কথাও। বাতাস, বিদ্যুৎ আর আলোকের ঢেউয়ে ঢেউয়ে রচিত যে স্যাটেলাইট নেটÑতাতে এতোসব প্রেম, মৃত্যু, আর কাড়াকাড়ির ছবিটা কি ঠিকমতো ধরা পড়ছে? সে নেটওয়ার্কও তো এখনো পর্যন্ত সুবিধাভোগেরই দূর্বৃত্তয়ানের সংস্কৃতির নিতান্ত প্রতিযোগীতার মাধ্যমমাত্র হয়ে আছে। কসাইপট্টির হইচইয়ের অন্তরালে এতোসব আগেভাগের মৃত্যুদশা, প্রতিলগ্নের বিচ্ছিন্নতা থেকে সবকিছুর একসাথে খুব একা হবার বোবামৃত্যুদশা।

এতোদিনের এই জীবনÑনন্দনকলা, আর তার দিকে ভালোবেসে তাকিয়ে থাকবার হাতছানিটাও যেনো কোনো অমৃতপুরের মুখের নিরবে খুব ছোটখাটো এক ভুল ফুল বন্দনাÑ

তোমাকে দিলাম এক লাল জবাফুল, আর সাথে সাদা দুধের বাটি
সাদা দুধের বাটিতে তোমাকে দিলাম তুলে লাল রক্তজবা ফুল!

সে বেলার এক নতমুখী
আজো সে দেখে নাইÑকি বিরাট এক আকাশের তলে

পাছে ম্লান হয়ে যায় প্রিয় জবা গাছফুল!

অমৃতপুরের খুব গহীনে কসাইপট্টির এই প্রকাশ্য গুমোট পার্বনমেলা থেকে বেরুবার জন্য তবু আশেপাশের তোমার দিকেই একটু ভালো করে ভালোমতো তাকাই। তাকাতে চাই।

যদি জীবের জীবন দিয়ে, আর জনতার জীবনী দিয়ে দেশে দেশে গ্রামকাঠামোর কাঁচামাল রচিত হয়, তবে জীবজনতা কেমন আছোÑদেখি আমার জন্যই তোমার দিকে একটু ভালোমতো তাকাতে পারি কিনা!

৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আজ রমনায় ঘুড়ির 'কৃষ্ণচূড়া আড্ডা'

লিখেছেন নীলসাধু, ১৮ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:২৬




আজ বিকাল ৪টার পর হতে আমরা ঘুড়ি রা আছি রমনায়, ঢাকা ক্লাবের পর যে রমনার গেট সেটা দিয়ে প্রবেশ করলেই আমাদের পাওয়া যাবে।
নিমন্ত্রণ রইলো সবার।
এলে দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???



আপনারা যারা আখাউড়ার কাছাকাছি বসবাস করে থাকেন
তবে এই কথাটা শুনেও থাকতে পারেন ।
আজকে তেমন একটি বাস্তব ঘটনা বলব !
আমরা সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×