somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মেয়েটাকে পুঁজি করে আমিও বেঁচে থাকি।

০৭ ই মে, ২০০৯ বিকাল ৪:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রাত জাগাটা এখন অভ্যাস-কোনো কাজ না থাকলেও শুয়ে শুয়ে অনেক রাত পার করে দেই। শেষ রাত না হলে ঘুম আসে না। কিছু রাত যায় এমনিই, একঘেয়ে বিরক্ত নিয়ে, কিছু রাতে ভবিষ্যৎ-পেশা-সংসার-পৃথিবী-মানজীবন আমার ঘুমের চারপাশে এসে জেঁকে বসে, তাদের সাথেই নিশি ভোর হয়ে যায়। আর কিছু রাতে অন্ধকার জমাট বাঁধে, তার খাঁজে খাঁজে লুকিয়ে থাকা বিষবাষ্প সাপের জিহ্বা হয়ে নিঃশব্দ চাবুক চালায় রাতভর। তার আঘাত নেই, যন্ত্রণা আছে। নিঃসঙ্গ মানুষ যেমন করে শরীরের ক্ষত আর অসহায়ত্ব নিয়ে কাতরায়-নির্ঘুম কিছু রাত এমনি করেই যায়। মাহাকালের পাথুরে প্রান্তরে খুরধ্বণি ছুটিয়ে চলে যাওয়া ঘড়ির কাঁটা, কার যেন কফগোলানো কাশি- সমস্তই অসহায়ত্বের কারাগারের প্রহরী হয়ে ওঠে। তাদের হাতে তীর বল্লম আছে বলেও সংশয় হয়। আবার যখন গোঁ গোঁ গর্জন তুলে কোন বাস সেই রাত তিনটায়ও ছুটে যায় রাস্তা ধরে-মনে পড়ে সেই অবয়বহীন দানবের কথা। এই সমস্ত প্রহরীদের চোখে ফাঁকি দিয়ে গেট টপকে গেলেওতো সেই দানোর খপ্পরে পড়তে হবে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকেই যে গর্জে উঠছে। ওই রাস্তাতেই তো আমি দেখেছিলাম ঘটনাটা। ছায়ান্ধকার শেষ সন্ধ্যায়-যেখানে দিনের শেষ আলোটুকুরও অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না আকাশে-কেবলই অন্ধকারের আবেশ। সেখানেই দেখলাম-হায় বিশ্বভূবন, কেন আমি দেখলাম সেই দৃশ্যটি-সেই দৃশ্যই যে আমার চোখ হয়ে উঠেছে এখন। দেখা ভুবন-আকাশ- সবুজ-সমুদ্র-লালবেগনি সমস্তই এখন কেবল ছায়ান্ধকার, সেখানে দুটি অবয়ব মিলিয়ে গিয়ে প্রবল অন্ধকার হয়ে উঠছে আমার চোখে। এমনকি সেই কালো কালো আঁধার আমার চোখ বেয়ে মুখে, ঠোঁট নাক গলে গলায় আটকে থাকে। এবং এরপর থেকে আমি আসলে কিছু বলি না-বা আসলে বলতে চাই না। কেবলই সেই ঘটনার বর্ণনা বেরিয়ে আসে আর মুখ থেকে।

মৃত মানুষের মুখে নাকি জীবন ভোলানো গন্ধ জমা হয়ে থাকে। ওই ঘটনা দেখার প্রতিক্রিয়া স্বরুপ আমারও মনে হয় আমি কি মরে গেছি, না হলে আমার মুখে এমন গন্ধ কেন। না না গন্ধ নয়, না বলা ঘটনা। শব্দ আর গন্ধে পার্থক্য কি যখন তা একই অনুভূতি তৈরি করে। কিন্তু সেই অনুভূতিকে মৃত্যুসম ভাবছি কেন। কারণ উপায়হীনতা। যে কৃষ্ণচূড়া গাছটির নীচে ঘটনাটি ঘটেছে-সকাল হলেই সে লালে হেসে উঠবে-দলিতের যন্ত্রণা ক্ষণিকের তরে হলেও ভুলে থাকার মন্ত্রণা দিবে। কিন্তু আমি, আমারতো লাল নেই, সোনালুর মতো আমি হলুদ নই-ছায়া বিলাই না। আমি কেবলই পিচঢালা সেই রাস্তাটি-এবড়ো থেবড়ো, ক্ষতবিক্ষত, তবুও সে একটুও এপাশ ওপাশ করে না-কেবল সয়ে যায়। আমিও কেবল দেখে যাই। আর মানুষ হিসেবে চাইলে বলতে পারি। কি হবে ঘটনাটি বলে। মধ্যবিত্তীয় কথার বলকানি তৈরি ছাড়া-বিরোধীতার ছুরিতে একে কাটা ওকে খোঁচানো ব্যতিত আর কি হবে। তত্ত্বের সুঁইসুতোয় যা তৈরি হবে তা যে কেবল বিভৎসতার দৃশ্যকাব্যই তৈরি করবে, এ-তো জানা কথা। তাহলে আর বলে কি হবে-তাহলে কেন আমি নিজেকে জীবিত ভাববো।

কিন্তু বেঁচে থাকতে চাই-মানুষ আস্ফালনেই নিজের অস্তিত্ব প্রকাশের সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। সেই আস্ফালনের চৌহদ্দিতে চুপ করে বসে থাকাটা যে মৃত্যুই। মরতে চাই না- এই ঘটনা আরেকবার করে বলার মধ্য দিয়ে বেঁচে উঠতে চাই। যে মুক, আমাদের সমাজে কে তাকে মানুষ ভাবে-আমিও মুক হয়ে থাকতে চাই না। ওগলানোর দমক জাগছে শরীর জুড়ে। হাতপামনমগজ জুড়ে একই সুর-ঝেড়ে দাও, ফেলে দাও-উগড়ে দাও। কি হবে এ সমস্ত স্মৃতি রোমন্থনে-কি হবে এর বারংবার দৃশ্যায়নে। কি করবে তুমি, তুমি ওই রাস্তারও অধম, মেয়েটি নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য তোমার ওপর ভর করে দৌড়াবে না কখনোই, তুমি ওই ইটবালির দালান নও যে সে সেখানে দীর্ঘশ্বাসটুকু ফেলবে। তুমি কেবলই এক মানুষ, হাতপাপেট আর যৌনাঙ্গ সম্পন্ন ওই পুরুষটির মতোই। কেবল ভদ্রতার আড়াল আর প্রতিষ্ঠানের শিক্ষায় যে পার্থক্য তৈরি হয় তাতে বেঁচে থাকার দাবি তুমি করতেই পারো। তাই বলে ফেলো, জানিয়ে দাও কি দেখেছো, কোথায় থাকো -জীবনের মানে কি। কতোজনই-তো বলছে -ব্যবসা করছে-বিখ্যাত হচ্ছে। শব্দের ছুটোছুটিতে অমন কতো মেয়ের কান্না ঢাকা পড়ছে-বিকৃত হচ্ছে। যে পুরুষটি কাম যন্ত্রণায় দানব হয়ে উঠছে-তাকে শিকার করছে আরো কতো কতো দৈত্য-টাকার পাহাড়ে চড়ে বসছে-ক্ষমতার ছড়ি ঘোরাচ্ছে। তুমি বললেই কি আর না বললেই কি।

নিজের ভেতরে এই ঘটনা ক্রমশ ক্ষত বিস্তৃত করতে থাকে-যন্ত্রণার তীব্রতায় প্রলাপ ছুটে। রাতেই কাকে যেন বলি-কিংবা আমার রুমের ফাঁকা মেঝেটায় কারা যেন বসে থাকে-তাদেরকে বলে ফেলি ঘটনাটা। তাদের শরীর জুড়ে সঘন ঘামগন্ধ-চিতি পড়া জামা কাপড়, জীর্ণ শরীর, মলিন মুখ। তাদের সবাইকে বলে ফেলি ঘটনাটা। আমি দেখেছি আমার সামনেই হেঁটে যাওয়া দুটো নারীপুরুষকে-নারীটিকে বালিকা বলাই শ্রেয়। বয়েসসন্ধির চাঞ্চল্যকে সে কেমন পেটেপায়ে দমিয়ে রেখেছে। যৌবনের ধলপ্রহরে সে শংকিত-নিরুপায়। কারণ পুরুষটির হাত তার কোমর পেঁচিয়ে আছে। বিদ্যুৎ নেই-ছায়ান্ধকার চারপাশ। পেছনে আমি-সামনে ওই দুজন-তার সামনে আর কেউ নেই। মাত্রই তারা গার্মেন্টস থেকে বেরুলো। বাকিরা চলে গেছে। ওরা কি ইচ্ছে করেই সবার পেছনে। জানি না-ঠিক ওদের দিকেও আমার উন্নাসিক দৃষ্টি নেই-তা অভ্যাসবশত তাদের এড়িয়ে সামনেই নিরিক্ষণরত। চোখের কোণেই হঠাৎ পুরুষটির হাত ছোবল মারে-যৌবনের প্রকাশের সলজ্জতাকে খামচে ধরে। চমকে ওঠে মেয়টি-ঝটকা দিয়ে হাত সরিয়ে নেয়। পেছনেই আমার উপস্থিতি টেরে পেয়ে পুরষটা সচকিত হয়- গেয়ে ওঠে-আর মেয়েটি আমার উপস্থিতি বুঝতে পেরে মাটি মাথায় এক হয়ে যেতে থাকে। আমি জানি না-ওরা প্রেমিকপ্রেমিকাও হতে পারে। কিম্বা পুরুষটার সাথে মেয়েটার সম্পর্ক এমনই। কারণ মেয়েটা কোন প্রতিবাদ করেনি। এবং সেই পুরুষ এতো প্রচন্ড, আমাকে কেবলই নপুংসক করে তোলে।

আমি কেবল আটকা পড়তে থাকি ওই দৃশ্যায়নের কারাগারে। মেয়েটি কি আমাকে দেখেছিল-নিশ্চয়ই দেখেছে। ভেবেছে আমি তাকে কি মনে করছি-নিশ্চয়ই বাজে মেয়ে মনে করছি। নিশ্চয়ই ভাবছি এদের জন্যেই ঢাকা শহরটা কেমন নোংরা হয়ে যাচ্ছে। নিশ্চয়ই মেয়েটি বাসায় ফিরে অনেকবার স্নান করেছে। প্রার্থনা করেছে তার সমস্ত নারীত্বের অবলুপ্তি ঘটে যেন। হায়, যে কিশোরীর যৌবনের রোমাঞ্চে শিহরিত হওয়ার কথা-দুলে দুলে ওঠার কথা হাসির দমকে। চোখের নিশায় ছুটে যাওয়ার কথা কল্পনার রাজ্যে। বর্ষার জলের মতো খলবলিয়ে ওঠার কথা। সে-ই কেমন নিজের শরীরে নারীত্বের অস্তিত্বকে ঘেন্না করতে থাকে। তার শরীরই তাকে মর্যাদাহীন করে তোলে-ভোগ্য আর পণ্য করে তোলে। পেটেভাতে যাদের দিনগুজরান তাদের জীবনে বৈশাখবসন্ত আসে না-জারুল হিজল আসে না। কেবল আসে পুরুষের হাত। কাম লালার গন্ধে হীনজীবি বেঁচে থাকে আমাদের সমাজের বিশাল অংশের নারীরা। তারপরওতো আকাশে রংধনু চড়ে-হেসে ওঠে কতো কতো নারী, বর্ণচ্ছটার দুনিয়ায়। এটাই জীবন। তাইতো আমিও বলে ফেলি-আমিও দেখেছি।

কি হলো আপনাদের এই ঘটনা বলে-তল পেটের তীব্র যন্ত্রণা প্রশমনেওতো আনন্দ আছে। কিন্তু শরীরময় ছড়িয়ে থাকা এই ঘটনার বর্ণনায় প্রাপ্তি কার। দেখেছি-ভেবেছি-বলেছি, সবই আমার। মেয়েটিতো জানলো না-কোন মেয়েই জানে না। ধর্ষণ-হয়রানি কেবলই খবর। কেবলই কিছু মানুষের বেঁচে থাকার নিদর্শন। আর খবর বলে বেড়ানোতেই আমাদের বেঁচে থাকা হয়। যারা কবিতা লিখেন তারাওতো খবরই লিখেন, এটাও সেই বেঁচে থাকারই লক্ষণ আর উপলক্ষ্য যাই বলেন না কেন। আমিও বেঁচে আছি। আরেকটি মেয়েকে পুঁজি করে আমিও বেঁচে আছি।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মে, ২০০৯ রাত ২:১৫
৩৬টি মন্তব্য ৩৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ভণ্ড মুসলমান

লিখেছেন এম ডি মুসা, ২০ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:২৬

ওরে মুসলিম ধর্ম তোমার টুপি পাঞ্জাবী মাথার মুকুট,
মনের ভেতর শয়তানি এক নিজের স্বার্থে চলে খুটখাট।
সবই যখন খোদার হুকুম শয়তানি করে কে?
খোদার উপর চাপিয়ে দিতেই খোদা কি-বলছে?

মানুষ ঠকিয়ে খোদার হুকুম শয়তানি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আসবে তুমি কবে ?

লিখেছেন সেলিম আনোয়ার, ২০ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪২



আজি আমার আঙিনায়
তোমার দেখা নাই,
কোথায় তোমায় পাই?
বিশ্ব বিবেকের কাছে
প্রশ্ন রেখে যাই।
তুমি থাকো যে দূরে
আমার স্পর্শের বাহিরে,
আমি থাকিগো অপেক্ষায়।
আসবে যে তুমি কবে ?
কবে হবেগো ঠাঁই আমার ?
... ...বাকিটুকু পড়ুন

(রম্য রচনা -৩০কিলো/ঘন্টা মোটরসাইকেলের গতি )

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২০ শে মে, ২০২৪ দুপুর ২:৫০



একজন খুব পরিশ্রম করে খাঁটি শুকনো সবজি( দুষ্টু লোকে যাকে গাঁ*জা বলে ডাকে) খেয়ে পড়াশোনা করে হঠাৎ করে বিসিএস হয়ে গেলো। যথারীতি কষ্ট করে সফলতার গল্প হলো। সবাই খুশি। ক্যাডারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কোথাও ছিলো না কেউ ....

লিখেছেন আহমেদ জী এস, ২০ শে মে, ২০২৪ রাত ১০:১৯




কখনো কোথাও ছিলো না কেউ
না ছিলো উত্তরে, না দক্ষিনে
শুধু তুমি নক্ষত্র হয়ে ছিলে উর্দ্ধাকাশে।

আকাশে আর কোন নক্ষত্র ছিলো না
খাল-বিল-পুকুরে আকাশের ছবি ছিলো না
বাতাসে কারো গন্ধ ছিলোনা
ছিলোনা... ...বাকিটুকু পড়ুন

#প্রিয়তম কী লিখি তোমায়

লিখেছেন নীল মনি, ২১ শে মে, ২০২৪ সকাল ৭:৫১


আমাদের শহর ছিল।
সে শহর ঘিরে গড়ে উঠেছিল অলৌকিক সংসার।
তুমি রোজ তাঁকে যে গল্প শোনাতে সেখানে ভিড় জমাতো বেলা বোস, বনলতা কিংবা রোদ্দুর নামের সেই মেয়েটি!
সে কেবল অভিমানে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×