somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কেমন আছি সৌদি আরবে –দ্বিতীয় পর্ব

০৬ ই মে, ২০০৯ বিকাল ৫:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কেমন আছি সৌদি আরবে –দ্বিতীয় পর্ব
পরদিন সকাল নটায় হেটেই অফিস গেলাম।মাত্র তিনটে বিল্ডিং পরই ছিল আমাদের অফিস।তখন অফিসে ছিল একাউন্টান্ট জামালসহ তিন জন মিশরীয়,একজন ইঞ্জিনীয়ারসহ দুইজন ইন্ডিয়ান। আমি সেখানে পৌছতেই আমাদের পরিচয় পর্ব শেষ করে আমাকে নানান প্রশ্ন তারা করতে লাগলো।আমার জন্য ছিল এক মহা অভিজ্ঞতার পালা।ইতিপূর্বে আমি না দেখেছি আরবীয়ান নাইবা ইন্ডিয়ান।ভাষাও জানিনা পুরোপুরি তাই একটু একা থাকতে চাইছিলাম।ঠিক তখনই বস ফোন করে আমাকে বললো,আমি যদি শহরটা ঘুড়ে দেখতে চাই তবে যেন ফোরম্যানকে নিয়ে বাইরে যাই।আমি খুবই খুশীতে রাজি হয়ে গেলাম।তখন আমার পাসপোর্টটা অফিসে জমা রেখে,একটা কাগজে আরবীতে কিছু টাইপ করে তাতে আমার ছবি যুক্ত করে হাতে ধরিয়ে দিল। তারা এটাও বলে দিল এই কাগজ(অরাগা)আমাকে আকামা(রেসিডেন্স কার্ড)না পাওয়া পর্যন্ত সর্বদাই সংগে রাখতে হবে।আমি মিশরীয় ফোরম্যানকে সংগে নিয়ে নীচে নেমে এলাম।তার নাম মোঃনুর বয়স ষাটতো হবেই,গায়ের রঙ এবং চুল ধব ধবে সাদা তবে একটা চোখ কানা।অফিসের সামনেই বেশ লম্বা সাইজের এ্কটি ক্যাপরিস গাড়ী দাড়িয়ে ছিল,আমরা তাতে উঠে বাসলাম।নুর বসলো ড্রাইবিং সিটে,গাড়ীতে উঠেই ভাবতে লাগলাম কাজী আনোয়ার হোসেনের লেখা মাসুদ রানার বইয়ের কথা।কতো পরেছি এই সব বড় বড় গাড়ীর নাম আর এখন!যাইহোক মোঃনুর মোটেই ইংরেজি জানেনা সে আরবী আর ইংরেজীর সংমিশ্রনে কথা শুরু করল। প্রথমেই তার নিজের পরিচয় দিলেন এই কোম্পানীর অংশিদার হিসেবে।তার কথায় আমাদের চলতে হবে!সৌদিরা বোকা,তারা কোন কা্জই বুজেনা।তাই সব মিশরীয়রা এসে কাজ শিখাচ্ছে ওদের অর্থাত সৌদিদের।এরপর আমার পালা,আমাদের দেশে এরকম ভালো বাড়ী,গাড়ী,রাস্তা,সুপার মার্কেট ইত্তাদি আছে কিনা।আমি সত্তিই ইঞ্জিনিয়ার কিনা,আমাদের দেশে কতটা ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ আছে,আমার অভিজ্ঞতাই বা কতোটুকু, বুজলাম অশিক্ষিত লোকের পাল্লায় পরেছি।যাইহোক ঘুরে ফিরে দুপুরে অফিসে ফিরলাম।বস তখনো আসেনি শুনলাম তিনি শুধুমাত্র রাতের বেলা অফিস করেন।এখানে বলে রাখা ভালো যে রোজার মাসে অফিস টাইম হচ্ছে দিনে চার ঘন্টা আর রাতে দুই ঘন্টা আর কনস্ট্রশন সাইট চলে দিনে একনাগারে ছয় ঘন্টা।তাই দেড়টা বাজতেই সকলেই অফিস ছেরে রুমে ফিরে চললাম।সেদিন বাসার সামনে পরিচয় হলো প্রতিবেশী বাংলাদেশী আইয়ুবের সংগে

আইয়ুবের সঙ্গে খুবার কর্ণিশে
তিনি একটি কনস্ট্রশন কোম্পানীতে কাজ করেন,তাদের কোম্পানীতে সব মিলিয়ে প্রায় বিশজন বাংলাদেশী আছেন বাকী ষাট জনই বিদেশি।বাংলাদেশী সবাই প্রায় লেবার একজন ড্রাইভার ও কিছু টেকনিশিয়ান।আমার পরিচয় পেয়ে খুশিতে জরিয়ে ধরলেন।সেই সাথে আমার কোন কোথা না শুনেই আমাকে ইফতারের দাওয়াত করলেন।রুমে গিয়ে আমার আর সময় কাটে না। ইফতার পর্যন্ত কি করবো;ঠিক করলাম চিঠি লিখবো। আব্বাকে, আম্মাকে লিখতে বসে চোখে পানি এসে গেল;কিছুক্ষন ঢুকরে কাদলাম।কেন যেন সেদিন আমাকে খুব অসহায় মনে হচ্ছিল। এখানে আসার পর কি কি ঘটলো সবই আব্বা আম্মাকে লিখে ফেললাম।সন্ধ্যার আগেই আইয়ুব এসে টেনে নিয়ে গেল ওদের ক্যাম্পে।তাদের রুমে প্রায় আটজন থাকে।চারটি খাট দোতলা বেড।ফ্লোরের মাঝখানে কাগজ বিছিয়ে ইফতারগুলো সাজিয়েছে। ফলমুলগুলো চোখে পড়ার মতো।গতকালও দেখেছিলাম ফলের বাহার।লক্ষ্য করলাম এখানে সবাই খুব ফল খায় যেমন আঙ্গুর, মাল্টা (অরেঞ্জ),সামাম(আরবী বাংগী),তরমুজ,খেজুর ইত্যাদি ইত্যাদি।এছারাও তেলে ভেজে মুড়ি,ছোলা,পিয়াজুতো রয়েছেই।ইহা ছারা পানীয় ছিল লেবান(প্যাকেট মাঠা)ও ট্যাং সরবত।খেতে খেতেই সবার সংগে পরিচয় হলো।ওরা প্রায় পাচবছর যাবত এদেশে এসেছে।আগে রিয়াদ মিলিটারী বেইজে কাজ করতো এখন দাহরান বেইজে কনস্ট্রাকশনের কাজ করে।দুই বছরে ছুটির কন্ট্রাকট থাকলেও সময়মতো পা্ননা।বেতনও পায় দুই বা তিন মাস অন্তর অন্তর।ইতিমধ্যে নামাযের জন্য সবাই মসজিদের দিকে রওয়ানা দিল।আমিও তাদের সংগী হলাম।রাস্তাতেই তারা আমাকে বিভিন্ন দেশী- বিদেশীদের সংগে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল।লক্ষ্য করলাম আমাকে মহনদিস পরিচয় করিয়ে তারা গর্ববোধ করছিল।নামাজ শেষে আয়ুবকে জিজ্ঞেস করলাম তোমরা আমাকে মহনদিস মহনদিস বলে কি বলছো? সে বললো এদেশে বাংলাদেশী মহনদিস(ইঞ্জিনিয়ার) খুবই কম,তারা মনে করে আমাদের দেশে শুধু লেবার/ড্রাইভার আছে।তাই তাদেরকে দেখাচ্ছিলাম আমাদেরও আছে!এই আয়ুবের বাড়ী ফরিদপুরের টূংগীপাড়ায়,সে বি,এ পাশ।কিন্তু লেবার ভিসায় এখানে এসে অফিসে কাজ করছেন।তিনি অফিসে আরবীয়ানদের সঙ্গে কাজ করে বেশ আরবি শিখে ফেলেছিলেন,তাই তাকে অনুরোধ করলাম আমাকেও কিছু আরবী শিখাতে ।
এশা ও তারাবিহ নামাজের পর আবারও অফিস গেলাম।সেখানে গিয়ে দেখি আঃসাত্তার সাহেবও বসে আছেন।আমাদের সকল স্টাফকে ডেকে এনে মালিক ব্রিফিং দিলেন।তিনি সবেমাত্র কোম্পানী খুলেছেন,তাই আমরা যেন সবাই নিজের মনে করে বেশি বেশি কাজ করি।কাজের উপড় সন্তুষ্ঠ হলে তিনি সবাইকে বোনাস দেবেন বলেও ঘোষনা দিলেন।সেদিনই ঠিক হলো আমি দিনের বেলা সাইট করবো এবং রাতেও অফিস করব।আমাকে মোঃনুর তার গাড়ীতে সাইটে নিয়ে যাবে ও ফেরত আনবে। অন্যরা কোম্পানীর বাসে যাবে।আমার বেতনও সাত্তার সাহেবের কথানুযায়ী ঠিক থাকলো।আমাদেরকে সেই রাতেই হাতখরচের জন্য অগ্রিম বেতন দিলেন।আমি অফিস থেকে বের হয়েই আঃসাত্তারকে বললাম একটূ মার্কেটে নিয়ে যেতে। ইতিমধ্যে আমার জানা হয়ে গিয়েছিল রোজার মাসে রাত আরাইটা পর্যন্ত মার্কেট খোলা থাকে।যাক প্রয়োজনীয় অনেক কিছুর সংগে একটা ডেকসেট ও কিছু গজলের ক্যাসেট কিনে নিলাম,যদিও সাত্তার সাহেব সৌদির প্রথম টাকায় আমাকে এটা কিনতে মানা করছিলেন।কিন্তু রাতের একাকীত্বের সংগী গান আমার চাইই।
সকাল আটটার সময় মোঃনুর গাড়ির হর্ণ বাজাতেই রুম থেকে বেরিয়ে এলাম।তার গাড়ীতে রেডিওতে ভড়াট গলায় আরবী সংবাদ হচ্ছিল।আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো সৌদি-আমেরিকান তেল কোম্পানী আরামকোর কর্মকর্তা-কর্মচারিদের জন্য নির্মীয়মান মডেল সিটি আল-দোহাতে।সেখানে প্রচুর নুতন বাড়ী তৈরী হচ্ছিল।তারই কয়েকটি আমাদের কোম্পানীর।আমার শ্রমিকরা অনেক আগে থেকেই কাজ করছিল।আমাদের বেশিরভাগ শ্রমিকই ইন্ডিয়ান, কেরালা ও মাদ্রাজের আর বাংলাদেশী কিছু সংখ্যক।আশপাশে আরো অনেক কোম্পানির শ্রমিকরাও তাদের নিজ নিজ সাইটে কাজ করছে।তাদের মধ্যে পাকিস্তানি, ফিলিপিনী, মিশরিয়,লেবানিজ,ইয়ামেনী সহ অনেক দেশের আনেক জাতি,আমি অবাক নয়নে তাদের কাজ করার ধরন দেখছিলাম।এখানে এসে আমার সবই নুতন নুতন লাগছিল।

ইটের সাইজগুলো চারগুন বড় হবে, সাটারিং কাজ বাশের বদলে কাঠ,কাঠ-পাটির বদলে প্লাইউড,ঢালাই আসছে গাড়ী করে আবার ঢালাইও দিচ্ছে ১৫০ফূট লম্বা পাম্প গাড়ী দিয়ে! যেন, পৃথিবী বদলে গেছে –যা কিছু নুতন লাগে।
এইসব দেখতে দেখতেই যোহর নামাজের আজান হয়ে গেল।আর সব কাজ ছেরে শ্রমিকরা কেউ নিকটবর্তী মসজিদে নামাজ আদায় আবার কেউবা রেস্টে চলে গেল।আর আমাকে নেয়ার জন্য মোঃনুরও চলে এলো।সময় এখানে সত্যিই ঘড়ির কাটার সংগে পাল্লা দিয়ে চলে।বিশাল চওড়া রাস্তা দিয়ে গাড়ী চালাতে চালাতে বুড়ো মোঃনুর আমাকে তারা দিচ্ছিল ড্রাইবিং লাইসেন্স বানানোর জন্য।আমি রাস্তা দেখি আর ভয়ে তাকিয়ে বলি আগেতো সব চিনে নিই।এদেশে গাড়ীও চলে উল্টা পথে,যেমন বাংলাদেশে ড্রাইবার বসে ডান দিকে কিন্তু গাড়ী চলায় রাস্তার বামদিক দিয়ে।এখানে বামদিকে বসে ড্রাইভার আর গাড়ী চলায় রাস্তার ডানদিক দিয়ে।রাস্তার মোড়ে মোড়ে রয়েছে সিগনাল কন্ট্রোল।তিন লেনের রাস্তায় প্রতিটি লেনের স্পীড নির্ধারিত করা রয়েছে।আর রয়েছে অসংখ্য লেন-উপলেন,নুতন জায়গা আর প্রায় সবই অচেনা।এসব দেখেশুনে,নুতন আইনকানুন শিখে তবেই ড্রাইবিংয়ে যাওয়ার ইচ্ছে আমার।মনে মনে নুতন গাড়ী পাওয়ার আনন্দও যে লাগছেনা তা নয়। (চলবে)

সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ বিকাল ৪:১৬
৮টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারতে পচা রুটি ভাত ও কাঠের গুঁড়ায় তৈরি হচ্ছে মসলা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩০

আমরা প্রচুর পরিমানে ভারতীয় রান্নার মশলা কিনি এবং নিত্য রান্নায় যোগ করে খাই । কিন্তু আমাদের জানা নেই কি অখাদ্য কুখাদ্য খাচ্ছি দিন কে দিন । এর কিছু বিবরন নিচে... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাফসান দ্য ছোট ভাই এর এক আউডি গাড়ি আপনাদের হৃদয় অশান্ত কইরা ফেলল!

লিখেছেন ব্রাত্য রাইসু, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫২

রাফসান দ্য ছোট ভাইয়ের প্রতি আপনাদের ঈর্ষার কোনো কারণ দেখি না।

আউডি গাড়ি কিনছে ইনফ্লুয়েন্সার হইয়া, তো তার বাবা ঋণখেলাপী কিনা এই লইয়া এখন আপনারা নিজেদের অক্ষমতারে জাস্টিফাই করতে নামছেন!

এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঁচতে হয় নিজের কাছে!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৮

চলুন নৈতিকতা বিষয়ক দুইটি সমস্যা তুলে ধরি। দুটিই গল্প। প্রথম গল্পটি দি প্যারবল অব দ্যা সাধু।  লিখেছেন বোয়েন ম্যাককয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জার্নালের ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। গল্পটা সংক্ষেপে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা

লিখেছেন জানা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৬



২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×