somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রিয় কলামিস্ট, কবি, রাজনীতি বিশ্লেষক ফকির ইলিয়াসের লেখাঃ লন্ডন-নিউইয়র্কে রমরমা যাদু-টোনা ব্যবসা

২৬ শে এপ্রিল, ২০০৯ সকাল ১১:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাংলাদেশের একজন জনপ্রিয় বাউল শিল্পী ক্বারী আমিরুদ্দীন আহমদের লেখা একটি গান আছে-‘জানলে তোমরা বলে দাও গো করে দেখি কিয়া-কন্নি.../ যাদু-টোনা কেউ জানোনি...’। এই বাউল কবি যাদু-টোনা বা বশীকরণের মাধ্যমে তার প্রিয় বন্ধুর সান্নিধ্য পেতে চেয়েছেন। জুয়েল আইচ। বাংলাদেশের খ্যাতিমান যাদুশিল্পী। যার খ্যাতি বিশ্বজোড়া। তিনি যাদুকে ম্যাজিক বলেই আখ্যায়িত করতে ভালোবাসেন। এটাকে তিনি শিল্পমাধ্যম বলেই প্রচার করেন। এর বেশি কিছু নয়।

উপমহাদেশে যাদু-টোনা বা বশীকরণ একটি সম্মোহন শক্তি বলে বিশেষভাবে পরিচিত। ‘কামরূপ কামাক্ষা’র দক্ষ যাদুবিদদের কর্মশক্তির কথা বাংলার আনাচে-কানাচে শোনা যায়। এই যাদুবিদ্যার নানা ধরন আছে। মন্ত্র, পানি পড়া, তাবিজ, কবজ থেকে শুরু করে অষ্টধাতুর আংটি, ষোলরতির মালা কিংবা বিশেষ ধরনের কোন তৈল পর্যন্ত।

বাংলাদেশে এ ধরনের বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন সাধক, গুরুজীদের সংখ্যা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। সংকট মোচনের এই ব্যবসা এখন ত্বরিত গতিতে প্রসারিত হতে শুরু করেছে ইউরোপ-আমেরিকায়ও। বিশেষ করে বাঙালি অধ্যুষিত যুক্তরাজ্যের লন্ডন এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে এরকম বিশেষ ‘আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্নরা হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার হাজার পাউন্ড-ডলার।

একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলতে চাই। ১৯৯৭ সালের কথা। লন্ডনে বেড়াতে গিয়েছি। আমার লন্ডন যাওয়ার সংবাদ বন্ধু সাংবাদিকদের কৃপায় স্থানীয় বাংলা পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়ে গিয়েছিল লন্ডনে আমার ফোন নম্বরসহ। এক দুপুরে হঠাৎ এক মধ্যবয়সী মহিলার ফোনে আমি চমকে উঠলাম। অপরিচিত কণ্ঠ শুধুমাত্র হ্যালো-শব্দটি বলেই তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তারপর আমি কিছু জানতে চাওয়ার আগেই বলতে শুরু করলেন তার বেদনার কাহিনী। তার কাহিনীর সারাংশটি হচ্ছে, মহিলার একমাত্র ব্রিটিশ সিটিজেন মেয়েটিকে বিয়ে করিয়ে বাংলাদেশ থেকে একজন পাত্রকে লন্ডনে এনেছিলেন। ছেলেটি এখন লন্ডনে তার স্থায়ীভাবে থাকার কাগজপত্র পেয়ে গেছে। কিন্তু মেয়েটির সঙ্গে তার চলছে চরম দাম্পত্যকলহ। মেয়েটির মা অর্থাৎ ওই মহিলা আমাকে এ কথাটিই অনুরোধ করতে চাইলেন আমি যেন তাদের দাম্পত্য কলহটি মিটিয়ে সুখী জীবনযাপনের একটি ব্যবস্থা করে দিই।

বিস্তারিত ঘটনা শুনে আমি কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে পড়লাম। পরক্ষণে বুঝতে পারলাম আমার নামের প্রথম অংশটিই, এই ঘটনার জন্য দায়ী। অর্থাৎ মহিলা আমাকে ‘বিশেষ আধ্যাত্মিকতা’সম্পন্ন একজন মানুষ হিসেবেই ধরে নিয়েছেন আমার নামটি দেখে। তাকে বিনীতভাবে বললাম এরকম কোনো সমস্যার সমাধান দিতে আমি অপারগ। কিন্তু মহিলার কাকুতিমিনতি শুনে আমি খুব বেদনাক্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম নিঃসন্দেহে। এটা হয়ত ছিল আমার মানবিক অনুভূতি। মানুষের এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশের বাইরে এই বিদেশেও গড়ে উঠেছে একটি যাদু-টোনা ব্যবসায়ীচক্র। যাদের খপ্পরে পড়ে শুধুই আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন হাজার হাজার প্রবাসী বাংলাদেশী।

নিউইয়র্কের এস্টোরিয়া এলাকার আরেকজন বাঙালি মহিলার ঘটনাবলী আরো মর্মবিদারক। তিনি আমাকে বলেছেন তার প্রতারিত হওয়ার দুঃখজনক কাহিনী। তার একটি ষোড়শী মেয়ে, যে একটি হাইস্কুলে পড়ে। ওই মেয়েটির একটি কৃষ্ণাঙ্গ বয়ফ্রেন্ড আছে। গেল দু’বছর যাবৎ মেয়েটির সম্পর্ক ছেলেটির সঙ্গে। মেয়েটি যাতে ওই কৃষ্ণাঙ্গ ছেলেটির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে দেয় তার জন্যই মেয়েটির পরিবার আশ্রয় নেয় যাদু-টোনা তত্ত্বের। ‘যাদুতত্ত্ববিদ’ যিনি নিজেকে বিশেষ আধ্যাত্মিক সাধক বলে দাবি করে থাকেন- তিনি শুরু করেন তদবীর। বিভিন্ন ধরনের তাবিজ, কবজ, তৈলমর্দন প্রভৃতি ওই মেয়েটির প্রতি প্রয়োগ করেন ওই যাদুতত্ত্ববিদ। দেড় বছর যাবত চিকিৎসা হয়েছে। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। মেয়েটির সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি। বরং যাদুতত্ত্ববিদ হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় পাঁচ হাজার ডলার।

এ তো শুধু দু’একটি ঘটনা। লন্ডন বা নিউইয়র্কের কিছু পত্র-পত্রিকায় এসব সাধক, গুরুজীদের পূর্ণ পৃষ্ঠা-অর্ধ পৃষ্ঠা বিজ্ঞাপন পড়লে রীতিমতো শঙ্কিত হতে হয়। হেন কোনো রোগ নেই, যা তারা সারাতে পারেন না। বিয়ে, প্রেম, বিচ্ছেদ, সন্তান প্রাপ্তি থেকে শুরু করে বহুমুত্র, এইডস, হাপানির মতো জটিল রোগেরও অভিজ্ঞ চিকিৎসক তারা। ‘মুখ দেখেই মনে খবর বলে দিতে পারেন’- এমন গ্যারান্টিসহ অশ্লীল কথাবার্তা ও পরিলক্ষিত হয় এদের বিজ্ঞাপনে। ভাবতে অবাক লাগে বিজ্ঞ সম্পাদকবৃন্দ ইউরোপ আমেরিকার মতো এত সুসভ্য, অগ্রণী দেশে বসবাস করেও এসব কাল্পনিক বাণী সম্বলিত বিজ্ঞাপন তাদের সাপ্তাহিকীগুলোতে ছাপতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন না।
লন্ডনে এক পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, এসব যাদুতত্ত্ববিদ কারো কারো সাপ্তাহিক আয় দশ হাজার পাউন্ডেরও বেশি। আর বর্তমান প্রজত্মের তরুণ তরুণী এবং তাদের মা-বাবার পকেটের অর্থই তাদের আয়ের মূল উৎস। এদের আবার কিছু ‘রক্ষিত’ও রয়েছে। যারা ‘অমুক সাধকজীর কাছ থেকে আমি উপকার পেয়েছি বলে পত্র-পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। এসব ভুয়া বিজ্ঞাপন আরো অনেককেই আকৃষ্ট করে নিয়ে যাচ্ছে ওসব যাদু ব্যবসায়ীদের কাছে।

মানুষ যখন জটিল সমস্যাক্রান্ত হয়, তখন তা সমাধানের জন্য বিভিন্ন পথ খুঁজে। এসব দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এবং বিদেশের বাংলা পত্র-পত্রিকাগুলোতে প্রচার পাওয়ার সুযোগে ব্যাঙের ছাতার মতো এসব সাধকেরা বেড়ে উঠছে এই দূর বিদেশে। অবৈজ্ঞানিক এবং কাল্পনিক মাধ্যমে এরা স্বঘোষিত ‘সাধক সম্রাট’ সেজে প্রতারণা করছে হাজারো প্রবাসীদের সঙ্গে। এদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার। বিদেশের বাঙালি প্রজন্মকে এ বিষয়টি বোঝা উচিত, যাদু-টোনা করে কারো হদয়ের প্রেম পাওয়া যায় না। আর এসব কাল্পনিক তত্ত্ব, কোনো সমস্যার সমাধানও দিতে পারে না। তা ছাড়া লন্ডন-নিউইয়র্কে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে যারা এ ধরনের ব্যবসা করছে- তাদের এমন ব্যবসার আইনগত বৈধতা আছে কি না তাও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গোচরে আনা যেতে পারে।
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডেল্টা ফ্লাইট - নিউ ইয়র্ক টু ডেট্রয়ট

লিখেছেন ঢাকার লোক, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:২৬

আজই শ্রদ্ধেয় খাইরুল আহসান ভাইয়ের "নিউ ইয়র্কের পথে" পড়তে পড়তে তেমনি এক বিমান যাত্রার কথা মনে পড়লো। সে প্রায় বছর দশ বার আগের ঘটনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রিয়ট যাবো,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

চরফ্যাশন

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫৯



নয়নে তোমারি কিছু দেখিবার চায়,
চলে আসো ভাই এই ঠিকানায়।
ফুলে ফুলে মাঠ সবুজ শ্যামলে বন
চারদিকে নদী আর চরের জীবন।

প্রকৃতির খেলা ফসলের মেলা ভারে
মুগ্ধ হয়েই তুমি ভুলিবে না তারে,
নীল আকাশের প্রজাতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কর কাজ নাহি লাজ

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪


রাফসান দা ছোট ভাই
ছোট সে আর নাই
গাড়ি বাড়ি কিনে সে হয়ে গেছে ধন্য
অনন্য, সে এখন অনন্য।

হিংসেয় পুড়ে কার?
পুড়েপুড়ে ছারখার
কেন পুড়ে গা জুড়ে
পুড়ে কী জন্য?

নেমে পড় সাধনায়
মিছে মর... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×