somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এই পথ আমাদেরওঃ এই শহরের আমি ও কয়েকজন

২৪ শে এপ্রিল, ২০০৯ রাত ১১:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ইটের পাশেই ঘাস, মাটি, ধুলো। সিরামিকের ইটের গাঁথুনি, বিন্যস্ত ঘাট। এই হ্রদের পাশে নগর। বা এই নগরের পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে গেছে প্রাগোতীত হ্রদ। নীল ছিল এর পানি বোধহয় এক কালে। এখন শ্যাওলাটে ময়লা; পলিথিন, এবং প্লাস্টিকের বোতল। সজ্জা স্বভাবতই নাগরিকের উচ্ছিষ্ট দিয়ে। এবং এই নগরযাপিত সকল ময়লা ধারণ করছে হ্রদ, নিজের বুকে। খানিকটা নীরবেই এর বুকের ওপরে শহুরে সেতুমালার সেলাই, আমরা এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়েছি কবেই! এখন তার শরীর পাঁশুটে, ম্লান, ক্ষীয়মান। সন্ধ্যে নেমে আসার আগেই আঁধার জমা হতে থাকে হ্রদের বুকে।

আমি যখন একটা সেলাইফোঁড়ের উপর দিয়ে হেঁটে ঘাটের দিকে এগুলাম, দেখলাম চৌকো চৌকো কংক্রীট পাথর ফেলা হচ্ছে হ্রদের পাড়ে। ধ্বস ধ্বস করে আমার বুকেই পড়ছে যেন ওগুলো! মাঝে দেয়া হচ্ছে অমোচনীয় সিমেন্ট। যেন পৌরাণিক কোন বন্য পশুকে বেঁধে ফেলার সকল উদ্যোগ আগেই সেরেছি আমরা, কিন্তু তারপরেও তার সূক্ষ্ণ হুটোপুটি চলছে। স্থানে স্থানে বেরিয়ে আছে কালো মাটি, কাদা, ঘাসের মখমলী একটু একটু। সেটাকেও ঢেকে ফ্যালো, মুড়ে দাও, শেকলে বাঁধো! হত্যার জান্তব দৃশ্য আমার স্নায়ু ভেঙে দেয় বলে আমি স্ল্যাবজমানো শ্রমিক আর সিমেন্টের থালা মাথায় মহিলাটিকে এগিয়ে ঘাটের দিকে এগিয়ে যাই দ্রুত!!

এই ঘাটে আজ মানুষের মেলা। কালো মানুষ আমরা, শরীরে ক্ষীণকায়, ময়লা ত্বক আমাদের, চুলে প্রসাধন নেই, পায়ের চপ্পলেরও টুটাফাটা দশা। জামার ভাঁজহীনতা বলে ওটি বেশ কয়েকদিন হলো ধোপার কাছে যায়নি। তারপরেও আমাদের চোখে মুখে উজ্জ্বলতা! নীরবেই আমরা অর্ধবৃত্তাকার ঘাটের পাশে জমা হয়েছি! ঘাটের সীমানায় চারটা থাম, সামনে ইটবাঁধানো চত্বরেই কয়েকজন যন্ত্রপাতি সাজাচ্ছেন। বড়ো, কালো স্পীকারে টুংটাং টিউনিং চলছে। এখানে থামের গায়ে বড়ো একটা ব্যানার। ব্যানারে নিচে কয়েকজন দাঁড়িয়ে, তাদের সামনে ইটের সিঁড়ি জুড়ে প্রচুর মানুষ! আমি নিজেই এসে একটু ভড়কে গেলাম। ভেবেছিলাম অল্প কিছু ভলান্টিয়ার আর হ্রদে বৈকালিক ভ্রমণে আসা বহুমূত্রাক্রান্ত প্রৌঢ়-প্রৌঢ়াদের দেখবো। হাঁটার ক্লান্তিতে হয়তো তারা সেখানে জিরোচ্ছেন, এমন। কিন্তু দেখলাম টগবগে উচ্ছল একদল নানারঙের মানুষ শান্ত হয়ে বসে আছেন। বন্ধু, বান্ধব, ভাই, বোন, প্রেমিক, প্রেমিকা, পিতা, সন্তান, মাতা। এরা সকলেই নিবিড় ঘনো হয়ে বসেছেন। মাটিতেই, অন্তত কিছুক্ষণের জন্যে জামাকাপড়ে শান্ত ধুলো লাগলেই বা কি? কয়েকটা ফ্রকপরা শিশুও দৌড়ে বেড়াচ্ছে। আহা! ওরা তো আমাদের মতো উদাম খেলার মাঠ পায়নি। বাসার ব্যালকনি, ছাত, বড়োজোর পার্কিং লট। তার বাইরে হিংস্র রাস্তা আর ভয়ানক গতির যান-দৈত্য! ওদের গিলে খাবে বেরুলে। এখানে এই সিরামিকের বৃত্তাকার ঘাটে ওরা পিতামাতা, বড়ো ভাইবোনদের চক্রের মাঝে নিশ্চিন্তে হাসে, দৌড়ায়, আর খিলখিলিয়ে ওঠে আমার বিকেলটা।

তারপরে আমি কিছু পরিচিতমুখ দেখি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু, ছোটভাইয়েরা অনেকেই ভলান্টিয়ার, তারা বেশ ব্যস্ত। কুশলালাপের পরেই চলে যায়। আমি আর দত্ত’দা-ই খালি শ্রোতা। বসে পড়লাম একটু জায়গা বানিয়ে। পাশেই অপরিচিত মানুষ। অতিসাধারণ, আমার দেশের নিরীহ নাগরিক। এখানে তাদের সাথে আমিও এসে গেছি। আমরা কত সাধারণ সেই সত্যটা টের পাই। কিছুই ‘করি’ না আমরা কখনো!
বসুন্ধরায় আগুন, আমরা দেখি (টিভিতে বা পান্থপথে ঘাড় উঁচিয়ে)।
র‌্যাঙ’স ভবন ভাঙা হয়, আমরা দেখি। ওখানে লোহার শিকে মানুষ গেঁথে যায়, তারপরেও আমরা কেবল দেখি।
রাস্তায় জ্যাম, ধোঁয়া- তবুও আমরা নিষ্পলকে তাকিয়ে থাকি, তাকিয়েই থাকি!
আরও অনেক কিছু আমাদের সামনেই ঘটেঃ রাজাকারেরা বিবৃতি দেয়, যুদ্ধাপরাধী নাই দেশে। শুয়োরবৎসাকাচৌ অশলীল হাসে টিভিপর্দায়, আমরা তাকিয়েই থাকি।

এসব প্রলয়ঙ্কারি ঘটনাও আমাদের চোখের সামনে সহজাত হয়ে গেছে। আর সাধারণ নারীর লাঞ্ছনা, রাস্তাঘাটে বা কর্মক্ষেত্রে তার উপরে ঘটে যাওয়া টিটকারি, ঈভটিজিঙয়ের বিরুদ্ধে একটা পদযাত্রা হয়েছে শহরে আজকে, তাতে কী যায় আসে। শুনেছি ঢাকা শহরে বাতাসে সীসা, সেই সীসায় আমাদের কান, চোখ, মুখ, ইন্দ্রিয়গুলো ঢেকে বুঁজে গেছে!

এই পদযাত্রার কথা শুনে আমার পঁচাগলা শহরের অনেকেই ভুরু উঁচিয়ে ফেলেছেন! পুরুষাঙ্গে ঈষৎ নাচন ঘটেছে, আহা! গ্রোপিং, আর শ্লীলতাহানি! এগুলা কী, একটু বিশদে বলো- শুনি। কীভাবে নারীর লাঞ্ছনা ঘটে? তাই নাকি?? ছি ছি মানুষ এতো খারাপ!- এগুলো বলে আমরা পা নাচাই তৎসম নাচনেই। সেই ভ্রু-লিঙ্গ-পদনাচন উপেক্ষা করেও অনেকে এসেছেন। পরিবারের সবাইকে নিয়েই এসেছেন। আমার বোন পথে হাঁটে, প্রেমিকা বাসে চড়ে, মা-ও চাকরি করে। আমার অনেকগুলো সহপাঠী বান্ধবীও পড়াশোনা শেষ করে এখন চাকরিতে ঢুকেছে, ওরাও রোজ রাস্তায় যানবাহনে চড়ে। এদের জন্যে হলেও আমি আজকে বিকেলে হ্রদের পাশে গিয়েছি। এবং হতবাক হয়েছি কিছুটা, খুশি তারচেয়েও বেশি। কীভাবে আমরা নীরবেও কত কিছু ‘করি’। না হোক তা একটা বিকেল, একটা পদযাত্রা, একটা সন্ধ্যা। এই নেমে আসা আঁধারের রেশ থাকতেই আমার মনে হয় আস্তে আস্তে একটা আলো জ্বলছে কোথাও কোথাও!

ওখানে গান পরিবেশন করলেন কয়েকজন শিল্পী। গানের আগে পরেও তাঁরা বললেন- নিজেদের নারী হওয়ার কারণে প্রাপ্ত ঠ্যালা, গুঁতা, চিমটি, টিটকারির কথা। তারা অন্তত একটা মাইক্রোফোন পাচ্ছেন। আর অন্যেরা তো তা-ও পাচ্ছে না। এ দেশের অর্ধেক মানুষই মেয়ে, তারা কেউ পাচ্ছে না। আমরা বাকি অর্ধেকের, পুরুষের, সেটা চোখেও পড়ে না। রাস্তায় কেউ পড়ে গেলে কয়েকজন “আহা, আহা!” করে ওঠেন। কেউ কেউ এগিয়ে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করেন। যে ঠ্যালা দিয়ে, ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে তাকে উত্তম-মধ্যম দেয়ার লোকেরও অভাব হয় না। কিন্তু একটা মেয়েকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে আমরা বীরত্বের হাসি দেই! কী চমৎকার অনুভূতি আমার। তাকে কেউ তুলতে যায় না, গেলেও লোভ জাগে নরোম বাহু চেপে ধরার। টেনে তুলে ‘সাহায্য’ করে আমরা পুঙ্গব হই। শিশ্নে দৃঢ়তা পাই! এই কথাগুলো চিন্তা করতে করতে আমার বুকেও ঐ স্ল্যাবগুলো সিমেন্টের গাঁথুনিতে বসতে থাকে।

এভাবে একদিনের প্রোগ্রামে কিছু হয় না। কয়েকজনের মনে যে শিখা আদৌ জ্বলে ওঠে, সেটাও পরেরদিন জোরালো জীবনের ঝাপটায় নিভু নিভু হয়ে যায়। কিন্তু আজকে আমার মনে হলো, যদি তাই হবে, তাহলে এতোগুলো মানুষ কেন এভাবে একত্রিত হলো? এখানে তো কোন জনপ্রিয় কেউ আসে নাই, পয়সা পাতি বিলানো হয় নাই। যারা কথা বললেন, এমন কেউকেটা কেউ নন। যে গান গাওয়া হলো, সেগুলোও নেহায়েৎ সাদামাটা, মোটেই ধুমধাড়াক্কা কনসার্ট নয়। তাহলে নিশ্চয়ই সেই নির্বাপিত শিখার একটা রেশ কারো কারো মনে ছিল। কেউ কেউ সেই আলোটাকেই আবার উস্কে দিতেই এসেছেন। সাথে হয়তো পরিচিত মানুষদেরও নিয়ে এসেছেন! সীমিত হাতের দৈর্ঘ্য আমাদের তাই আমরা বেশিদূর হাত বাড়াতে পারি না। কিন্তু হাতে হাতে ধরে একটা বাঁধন তৈরি করতেও পারি, করতেই পারি! এই কথাটা মাথায় আসতেই স্ল্যাবের চাপ একটু হালকা হলো।

আরো কত কত চিন্তাও মাথায় আসছিল। ফেরার পথে দত্ত’দার সাথেই ফিরছিলাম। কথায় কথায় বললাম, আদৌ কীভাবে এই মানুষগুলো নিরাপদে রাস্তায় হাঁটতে পারবে? কোনদিন পারবে কী? আমার শহরের রাস্তায় আমি যতটুকু নির্ভার হয়ে হাঁটি, আমার বয়েসী একটা মেয়ে কবে সেইরকম নির্ভরতায় হাঁটতে পারবে?

আমিও কেমন, বে-আদবের মতো স্বপ্ন দেখি!

===
১১ এপ্রিল, '০৯
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জানুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৩:২৭
১৮টি মন্তব্য ১৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×