somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ধাক্কা

২১ শে এপ্রিল, ২০০৯ দুপুর ১:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মৃণালকান্তি দাস ।। পাকুড়
অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ধাক্কা

এই ছাউনির নিচের উত্তাপ এখন ৩৫ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই তীব্র দাবদাহের মধ্যে এই ছাউনি ছাড়া কার্যত বিশ্রাম নেওয়ার মতো কোনো ছায়া নেই। পাকুড় জেলার তাপমাত্রা এখন ৩১ডিগ্রি সেলসিয়াস হবে। কিন্তু, মালপাহাড়ির পাথর-খাদানের গরম আরো বেশি। ঝাড়খণ্ডের শিল্পাঞ্চলের খোঁজে এসে পড়েছি এই পাথর খাদানে। এই মার্চেই পাথর থেকে যেন আগুন ঠিকরে বেরুচ্ছে। তবে এই পাথর খাদানের অগ্নিকুন্ডে যে গুটিকয় মেয়ে কাজ করছে, এই দাবদাহে তারা সবাই খালি পায়ে।
ছাউনির নিচে বসে বছর চল্লিশের সোনে ওঁড়াও। কোলে বছর দেড়েকের ছেলেটা নাকি প্রথম পক্ষের। পেটটা ঢাকের মতো ফুলে গেছে। সারা গা হলুদ। গোটা শরীরে শিকড় বাকড়, লাল, কালো, হলুদ সুতোয় বাধা। সোনে ওঁড়াও না বললে বোঝার উপায় নেই কোলের ছেলেটা মাস দুয়েক বাদে ৪বছরে পড়বে। ভয়াবহ অনাহার-অপুষ্টির শিকার সুশানের পাঁজরের হাড় গোনা যায়। মা হারানো ছেলেটাকে দেখলে মনে হবে বৃদ্ধিটা থমকে গেছে ৬মাসের মাথায়। মৃত্যুভয় এখন চোখে মুখে।
এতোবড়ো পাথর খাদানেতে জনাকয়েক মহিলা শ্রমিককে দেখে অবাকই হয়েছিলাম। এই খাদানেতে দিনমজুরের কাজ করতেন সোনে ওঁড়াও। কাজ করতো আরো শ’খানেক। মাস দুয়েক আগে, ঠিক বছর শুরুতেই সব ছাঁটাই হয়ে গেছে। সোনে ওঁড়াওয়ের নাম ছিলো সেই কাজহারাদের তালিকায়। ‘কাজ নেই, কিন্তু রোজ মন টানে এই খাদানে। খাদানের এই ছাউনিতে ভুখা পেটেই দিন কাটে। আগে কাঁদতো, এখন সুশানও কাঁদে না। দেখুন পেটের জ্বালা কেমন গা সওয়া হয়ে গেছে’।
পাকুড় জেলার এইসব পাথর খাদানে থেকে নাকি কলকাতার মেট্রোরেলের জন্য পাথর গেছে। মাস কয়েক আগে এখানকার পাথর রপ্তানি হতো নাকি বিদেশেও। হঠাৎই সবই থমকে। মন্দার মানে বোঝেন না সোনে ওঁড়াওরা। জানেন শুধু বিক্রি নেই, তাই খাদানেও বন্ধ। কাজ নেই, তাই অনাহারেই মরছেন পাথর খাদানের শ্রমিকরা। যারা আপনার সঙ্গে একসময় হাতেহাত লাগিয়ে পাথর ভাঙতেন তাঁদের কোনো খোঁজ জানেন? মুখের দিকে তাকিয়ে সোনে বললেন, ‘ওদের খোঁজ নিয়ে কি হবে? মরক লেগেছে আশপাশের গাঁয়ে। বহুদূরের গাঁয়েও। সেই কাঠিকুন্ড, চিরাঙ্কায়। আমার মতো ওরাও মরছে। এতো মরন কি সহ্য হবে?’
খিদের জ্বালায় জন্মভূমি ছেড়ে পালিয়েছে অনেকেই। বাঁধা পড়েছে হয়তো কোনো ইট ভাঁটায়। যেখানে ধুলোর পুরু আস্তরণের মধ্যে বিপজ্জনক এক শ্বাসকষ্ট ভেতরে ভেতরে চালায় ক্ষয়ের কারুকাজ। পেটের জ্বালায় দু’মুঠো ভাতের জন্য মরছে সেখানেও। কম বয়েসে বাবার হাত ধরে বিহারের এক ইট ভাটায় কাজ করতে গিয়ে ইট বওয়ার দক্ষতাও অর্জন করেছিলেন সোনে ওঁড়াও। অমানসিক সেই পরিশ্রম করার জোড় আজ শরীরে নেই।
সোনেদের মতো কাজহারাদের পাশে এ রাজ্যের সরকার দাঁড়ায় নি। পাকুড় জেলার এই পাথর খাদানেগুলিতে আসার আগে একপ্রস্থ কথা হয়েছিলো ঝাড়খণ্ড সি আই টি ইউ-র রাজ্য সম্পাদক রামানন্দনের সঙ্গে। তিনিই বলেছিলেন, ঝাড়খন্ডে অর্থনৈতিক সঙ্কটে ক্ষতিগ্রস্থ শ্রমিক-কর্মচারীদের জন্য সহায়তা প্রকল্প ঘোষণা করতে হবে। দাবি জানিয়েছে সি পি আই (এম)। গত পাঁচমাসে রাজ্যের প্রায় ৫লক্ষ মানুষ কাজ হারিয়েছেন। শুধু মাত্র জামশেদপুরেই টাটা মোটরর্সের কারখানাতেই ৬৫হাজার কর্মীকে ছাঁটাই করা হয়েছে। পাশাপাশি এর অনুসারি শিল্পে আরো ৫৫হাজার কর্মরত শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। জামশেদপুর, আদিত্যপুর এবং গামহারিয়ায় বেড়েই চলেছে বেকারের সংখ্যা। একই চিত্র অন্যান্য শিল্পক্ষেত্রেও।
পশ্চিম সিংভূম জেলার লৌহ-ইস্পাত শিল্প এবং পরিবহন শিল্পের সঙ্গে যুক্ত কর্মীরা প্রতিদিনই উদ্বৃত্ত শ্রমিকে পরিণত হচ্ছেন। রাজ্যের ২৩টি স্পঞ্জ আয়রন কারখানার মধ্যে ২২টিতে তালা ঝুলেছে। প্রতিটি কারখানায় ৭০০ থেকে ৮০০ শ্রমিক কাজ করতেন। সিমেন্ট ও ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পও মন্দার ধাক্কায় জেরবার। গতবছরও এই সময়ে সারেন্ডা জঙ্গল এলাকার খনি অঞ্চলে দিনে ৩৮হাজার ট্রাক-ডাম্পার চলাচল করতো। সেখানে আজ সেই সংখ্যা নেমে দাঁড়িয়েছে হাজার পাঁচেক। কাজ হারিয়েছেন গাড়ির চালক, খালাসীরা। মাল বোঝাইয়ের কাজ করতেন এমন হাজার চারেক শ্রমিক থেকে শুরু করে দিনে ৯০টাকা মজুরি এমন বহু শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। কয়লাখনিতে যুক্ত শ্রমিকরাও কাজ হারাচ্ছেন। বেসামাল নির্মান ক্ষেত্রও। থমকে গেছে বড়বড় নির্মান প্রকল্পের কাজ। রাজ্যে বহুজাতিক সংস্থা এবং শপিং মলে কর্মরত কর্মীদেরও কাজ থেকে ছাঁটাই করা হচ্ছে।
সি পি আই (এম)-এর রাজ্য সম্পাদক জ্ঞানশঙ্কর মজুমদারের কথায়, ঝাড়খণ্ডের মানুষের জন্য প্রয়োজন ৪৫লক্ষ টন খাদ্যশস্য। ভরা মরসুমে এরাজ্যে মাত্র ২৩লক্ষ টন খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়। ফলে অর্থনৈতিক মন্দার কোপ যে তীব্রভাবে ঝাড়খণ্ডে আঘাত হানবে তা বোঝাই যাচ্ছিল। গোটা রাজ্যের খাদ্য নিরাপত্তাটাই ভেঙে পড়েছে।
মন্দার ধাক্কা টের পেয়েছিলাম পাকুড় জেলার সর্বত্র। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন আদিবাসী মানুষ। কারণ, কয়েক ক্রোশ দূরে হাঁটা পথ পেরিয়ে তাঁরা যে খনি কিংবা পাথর খাদানেতে কাজ করতে যান সেখানে কাজের কোনো নিরাপত্তা নেই। ঠিকাদার মনে করলেই ছাঁটাই। ‘এখানকার মাটি তো তেমন সোহাগি নয়, যে জল পরলেই মাথা তুলবে। বন্ধ্যা মাটিতে চাষ নেই। খেতমজুরের কাজও নেই।’ কথা বলতে বলতেই পথ চলেছি বনিতাদের গ্রামে। পাথর খাদানেতে কাজ হারিয়ে বনিতা এখন হাটে কাঠ বেচে। পড়াশুনা না জানা বছর পনেরর মেয়েটা ৩০কেজি জ্বালানি কাঠ মাথায় বয়ে নিয়ে যায় ৩০কিলোমিটার দূরের হাটে। হাতে পায় ৩০টাকা। দিন কয়েক আগে দাম পেত ৫০টাকা। মহাজনরা বলছে দাম কমাতে হবে। দাম কমতে কমতে তিরিশে এসে ঠেকেছে। তবুও পাহাড়ের চড়াই-উৎরাই দীর্ঘ পথ পেরিয়ে সপ্তাহে অন্তত একবার হাটে আসতে হয়, শুধু বেঁচে থাকার জন্যে। বনিতার মতো আরো অনেক আদিবাসী মেয়েকে। কেউ বেচে শালপাতা, কেউ মধু। দূরের বাজারে দাম পাওয়া যাচ্ছে না, এই অজুহাতে মহাজনরা সবকিছুর দাম কমিয়ে দিয়েছে। ‘সত্যিই কি তাই’, জিজ্ঞাসা করে বনিতা। নিশ্চুপ আমি তখন তাকিয়ে দেখছি বনিতাদের গ্রাম।
ছড়িয়ে ছিটিয়ে লাল মাটির দেওয়ালের ঘর। খাপরার চাল। শুয়োর, মুরগির পাশে ধুলো মাখছে ন্যাংটো, আধন্যাংটো শিশুরদল। পাহাড়ের বাঁকে, জঙ্গলে ঘেরা বনিতাদের গ্রাম বিদ্যুতের স্বপ্ন দেখে না। কিন্তু জল না হলে তো চলে না। ঘাড় মটকানো চাপাকলের গায়ে লেখা— স্থাপন কাল ৮৮-৮৯। নলকূপ বলতে এখন যেটা আছে, জল ওঠে ঠিকই। তবে ওই ঘোলা জলে পেটের অসুখ নিশ্চিত। পানীয় জল মেলে প্রায় আধ কিলোমিটার দূরের নালা থেকে। নালা শুকিয়ে গেলে দু’কিলোমিটার দূরের পাহাড়ি নদীর জলই তখন ভরসা।
বনিতারা স্বপ্ন দেখে, একদিন বিরসা মুন্ডা ফিরবে, ফের লড়াইয়ে শামিল হবে ওদের পাহাড়িয়া জনগোষ্ঠীর আদিবাসীরা। ফিরবে সম্মান। ফিরবে জঙ্গল-জীবন। পাহাড়িয়ারা ওই শাল-পিয়ালের বনের দিকে তাকিয়ে বলবে,‘ও জঙ্গল হামারা...’। সেই স্বপ্ন দেখতে ভালোই লাগে! ফিসফিস করে বলেছিলো পাহাড়িয়া বনিতা।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে এপ্রিল, ২০০৯ দুপুর ২:৪৭
১৫টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

প্রজাতির শেষ জীবিত প্রাণ !

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫১



বিবিসির একটা খবর চোখে এল সেদিন । উত্তরাঞ্চলীয় সাদা গন্ডার প্রজাতির শেষ পুরুষ গন্ডারটি মারা গেছে । তার নাম ছিল সুদান । মৃত্যুর সময় তার বয়স ৪৫। বিবিসির সংবাদটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর মধ্যে সে একজন ।।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯



আপনারা কতজন Umma Kulsum Popi চেনেন, আমি ঠিক জানি না। আমার পর্যবেক্ষণ মতে, বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের একজন হলেন উনি। যদি বলি দেশের সেরা পাঁচজন কনটেন্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিস অস্বীকার করে রাসূলের (সা.) আনুগত্য সম্ভব

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৩ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সূরাঃ ৪ নিসা, ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস কর তবে তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আর আনুগত্য কর রাসুলের, আর যারা তোমাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

=কবিতাগুলো যেনো এক একটি মধুমঞ্জুরী ফুল=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:২০



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনের মাধুরী মিশিয়ে যে কবিতা লিখি
কবিতাগুলো যেনো আমার এক একটি মঞ্জুরী লতা ফুল,
মনের ডালে ডালে রঙবাহারী রূপ নিয়ে
ঝুলে থাকে কবিতা দিবানিশি
যে কবিতার সাথে নিত্য বাস,
তাদের আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

পোষ্ট যদি ক্রমাগতভাবে ০, কিংবা ২/১'টি মন্তব্য পেতে থাকে, বুঝবেন যে, সোনাগাজী সেমি-ব্যানে আছে!

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৭



আপনার পোষ্ট যদি ক্রমাগতভাবে ০ কিংবা ১'টি মন্তব্য পেতে থাকে, তখন খোঁজ নিলে দেখবেন যে, সোনাগাজী সেমি-ব্যানে আছে!

কোন বিষয়ের উপর অনেক মানসম্পন্ন পোষ্ট লিখলেও সামুতে আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×