somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে লোকজ জীবনের অন্বেষা

১৪ ই এপ্রিল, ২০০৯ রাত ১১:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এই নিবন্ধটি ১০ এপ্রিল দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত হয়েছে। এই ব্লগের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।




বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে লোকজ জীবনের অন্বেষা
তপন বাগচী

বাংলাদেশে লোকজ জীবনের অনুসন্ধিৎসা নিয়ে খুব বেশি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়নি। সৈয়দ হাসান ইমামের ‘লালন ফকির’, তানভীর মোকাম্মেলের ‘লালন’, চাষী নজরুল ইসলামের ‘হাসন রাজা’ প্রভৃতি চলচ্চিত্র লোকসংগীতনির্ভর জীবনযাত্রা তুলে ধরা হয়েছে। লোকসম্প্রদায়ের জীবন নিয়ে নির্মিত হয়েছে কাজী মোরশেদের ‘ঘানি’-র মতো হাতে গোনা কয়েকটি চলচ্চিত্র। লোকগাথা বা লোককাহিনীর চলচ্চিত্র থেকে লোকজীবনের কিছু চিত্র আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি। লোককাহিনীনির্ভর চলচ্চিত্রের প্রতিষ্ঠিত কাহিনীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে গিয়ে ফ্যাটাসি কিংবা কল্পনার জগতে নিয়ে যাওয়া হয়। বাস্তবের জীবন সেখানে অনুপস্থিত থাকে। তবে সংলাপে, দৃশ্যপটে এবং সংগীতের মাধ্যমে লোকজ জীবনের স্বাদ পাওয়া যায়। লোকজীবনের সঙ্গে মানুষের নাড়ির স্পন্দন জড়িত থাকে। তাই লোককাহিনীভিত্তিক চলচ্চিত্রের মধ্যে নাড়ির স্পন্দনধ্বনির কিছুটা হলেও অনুভব করা হয়।
লোকজ জীবনের সূক্ষ্ম উপকরণের অনুপুক্সক্ষ চিত্র অংকন করতে হলে কাহিনীবিন্যাসের জন্য ব্যাপক অধ্যয়ন ও ক্ষেত্রগবেষণার প্রয়োজন হয়। কিন্তু গবেষণালবদ্ধ তথ্য ব্যবহার করে লোকজীবনের উপস্থাপনা করা হলে, তার বাণিজ্যিকভাবে কতটা সফল হবে, সে ব্যাপারে সংশয় থাকে। তাই ব্যাপক পুঁিজ বিনিয়োগের আগে প্রয়োজক তার ব্যবসায়িক সফলতার কথাও ভাবে। সে কারণেই হয়তো লোকজ জীবনের উপস্থাপনাকে প্রাধান্য দিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রতি প্রয়োজকরা অনীহা প্রকাশ করে। কিন্তু জাতীয় স্বার্থে ও ঐতিহ্য রক্ষার স্বার্থে, এ ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণে সরকারের পক্ষ থেকে আন্তরিক পৃষ্ঠাপোষকতা দিয়ে হলেও পরিচালকদের আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে। লোকজ জীবনের উপস্থাপনার মাধমে গোটা বাংলাদেশকেই তুলে ধরা যায়।
আজকে বহির্বিশ্বে বাংলার বাউলগানের কদর বেড়েছে। জাতিসংঘ ইউনেস্কো’র মাধ্যমে বাউলগানকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিয়েছে। এই স্বীতৃতি ব্যাপক অর্থে যাবতীয় লোকসংস্কৃতিরই স্বীকৃতি। বাউলগানের মাধ্যেমে যেমন আমাদের দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হচ্ছে, তেমনি চলচ্চিত্রের মাধ্যমেও দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করা সম্ভবপর, একথা আর উদারণ দিয়ে বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশের যে কটি চলচ্চিত্রের বহির্বিশ্বে সম্মানিত হয়েছে, তা কোনও-না-কোনওভাবে লোকজ জীবন সম্পর্কিত। ‘সূর্য দীর্ঘল বাড়ি’ কিংবা ‘মাটির ময়না’র উদাহরণ এক্ষেত্রে বেমানান মনে হবে না। আমাদের লোকজ জীবনের অনুষঙ্গ চলচ্চিত্রে রূপ দিয়ে চলচ্চিত্রের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা যায়। উর্দু চলচ্চিত্র থেকে বাংলা চলচ্চিত্রের দিকে মুখ ঘোরাতে সালাহ্উদ্দিনের ‘রূপবান’ যেমন ভূমিকা রেখেছিল, তেমনি আজকের অশ্লীলতা ও ভাঁড়ামি থেকে সুস্থতার দিকে যাত্রা করতে খুঁজতে হবে লোকজীবনমুখী চলচ্চিত্র কার্যকর হতে পারে। আমাদের এজন্য খুঁজতে হবে গ্রামগঞ্জে লোকমুখে টিকে থাকা নতুন কোনো গাথা ও কাহিনী।
‘রূপবান’ গ্রামবাংলার প্রচলিত ও জনপ্রিয় লোককাহিনী থেকে নির্মিত চলচ্চিত্র। লোককাহিনীর রূপায়ণ বলে ‘রূপবান’ মূলত লোকজীবনকেই তুলে ধরেছে। রূপবান কাহিনীতে লোকাচার ও লোকঅনুষ্ঠান হিসেবে গুরুত্ব পেয়েছে বিয়ের অনুষ্ঠান, বাসররাত, লোকবিশ্বাস প্রভৃতি। লোকসুরের আধিক্য এবং দ্বন্দ্বমুখর কাহিনীর কারণে রূপবান ‘রূপবান’-এর বাঙালির লোকজীবনের চিরায়ত রূপরেখা হয়ে উঠেছে।
‘বেহুলা’ চলচ্চিত্র চিরায়ত পৌরাণিক কাহিনীর ওপর ভিত্তি করে নির্মিত। পুরাণের কালের জনজীবনের চিত্র আমাদের লোকজীবনেরই চিত্র। তাই যে কোনও পৌরাণিক কাহিনীর চিত্রায়ণকে আমরা লোকজ জীবনের চিত্রায়ণ বলে বিবেচনা করতে পারি। বেহুলার সতীত্ব পরীক্ষার পদ্ধতিতেও রয়েছে লোকÑঅনুষ্ঠান। সতী নারী আগুনে পোড়ে না, এই বিশ্বাসেরই জয় ঘোষিত হয়েছে। বেহুলার কাহিনী সনাতন জীবনধারায় এমনি নিবিড়ভাবে মিশে আছে। তারই বিশ্বস্ত রূপায়ণ ঘটায় বেহুলা ও তৎকালীন জীবনচিত্র সাধারণ মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় ঠাঁই পেয়েছে।
‘রাখালবন্ধু’ কাহিনীতে লোকজ জীবন প্রতিফলিত। বিশেষত লোকসঙ্গীতের প্রয়োগের মাধ্যমে এই কাহিনীকে লোকজীবনঘনিষ্ঠ করে তোলা হয়েছে। দরবেশের ভবিষ্যদ্বাণীতেই সকল ঘটনা ঘটে। রাখালবন্ধু চলচ্চিত্র ফোকফ্যান্টাসিতে পূর্ণ। কাহিনী শেক্সপিয়র থেকে নেয়া হলেও প্লট ও চরিত্র মিলিয়ে দেশীয়ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। গ্রামের পরিবেশ, নদীতীর, গরুচরানোর মাঠ, নৌকাবিলাস, পালকিযাত্রাÑ সবকিছু মিলিয়ে লোকজ আবহ সৃষ্টির চেষ্টা রয়েছে।
‘সাতভাই চম্পা জাগো রে’ এই গাানের সুর প্রতিটি বাঙালির কানে লেগে আছে। একটি প্রচলিত লোককাহিনীকে চলচ্চিত্রায়ণ করে দিলীপ সোম বাঙলার লোকসংস্কৃতিকে লালনের দায়িত্ব পালন করেছেন। ‘সাতভাই চম্পা’ চলচ্চিত্রের লোকজীবনের আখ্যান বর্ণিত হয়েছে।
‘কাজলরেখা’ লোককাহিনী এবং লোকগীতির সমন্বয়ে নির্মিত। কাহিনী হিসেবে এটি রূপকথার অন্তর্গত। এর গানের এবং লোকবিশ্বাস, দরবেশ-বাবার লোকপুরুষ প্রভৃতি ক্ষেত্রে লোকচেতনা রয়েছে। কিন্তু পুরোটাই একটি ফ্যান্টাসি। তাই লোককাহিনীর উপর ভিত্তি করে নির্মিত ‘কাজলরেখা’ এক ‘ফোকফ্যান্টাসি’ ধরনের চলচ্চিত্র হিসেবে গুরুত্ব পেতে পারে। এতে লোকশিক্ষার কিছু উপাদান থাকায় সাধারণ মানুষের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছিল বলে ধারণা করা যায়। তবে মূলকাহিনীর শুকপাখি এই চলচ্চিত্রকাহিনীতে অন্তর্হিত।
‘গুনাইবিবির পালা’র জনপ্রিয় কাহিনীর পুর্নবিন্যস্ত চিত্ররূপ। চিত্রায়ণের প্রয়োজনে মূলকাহিনীর কিছু বিচ্যুতি ঘটলেও তাতে প্রকৃত রস ও সুর নষ্ট হয়নি। গুনাই ও তোতার বাল্যপ্রেমের ওপর ভিত্তি করে এই কাহিনী গড়ে উঠেছে। এতে রূপায়িত প্রতিটি দৃশ্যই লোকজীবন থেকে নেয়া। লোকগাথার রূপায়ণের কারণে ‘গুনাইবিবি’ জনমনে আকর্ষণ সৃষ্টি করেছে।
বেদে সম্প্রদায় একটি জীবিকানির্ভর লোকসম্প্রদায়। নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদী ও নৌকাজীবন ও লোকজ জীবনের রূপক হয়ে উঠেছে। ‘বেদের মেয়ে জোসনা’র জনপ্রিয়তার পেছনেও হয়তো বাঙালি দর্শকের ঐতিহ্যপ্রীতি ক্রিয়াশীল। সর্পবিশ্বাসও এই অঞ্চলের মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। বিষ নামানোর দৃশ্য এবং বেদেনৃত্য গ্রামীণ মানুষের আকর্ষণের বিষয়। সাপুড়ের গান এবং ‘বেদের মেয়ের জোসনা আমায় কথা দিয়েছে’ গানের সুর ও শারীরিক কসরতও একশ্রেণীর মানুষকে প্রেক্ষাগৃহে টেনে নিয়ে গিয়েছে। সর্বোপরি লোকজ জীবনের চিত্রায়ণই এই চলচ্চিত্র দর্শকপ্রিয়তা পাওয়ার কারণ হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশের লোককাহিনীভিত্তিক চলচ্চিত্রে লোকজীবনের চিত্র যতটুকু ফুটে আছে তার মধ্যে মোটাদাগে সনাক্ত করার বিষয় হচ্ছে লোকসঙ্গীত। বাঙালির প্রাণের এই সম্পদ লালন ও প্রচার করার ক্ষেত্রে আলোচিত চলচ্চিত্রগুলোর ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। লোককাহিনীর প্রয়োজনীয় রূপান্তর কোনো কোনো সাধিত হলেও লোকজ আবহ ধারণ করার ভেতর দিয়ে এই সকল চলচ্চিত্রের সাফল্য খচিত হয়েছে। সামজিক চলচ্চিত্রেও লোকজীবনের কথা প্রস্ফুটিত হলেও সেখানে আধুনিক ও জটিল জীবনযাত্রার নানান অনুষঙ্গ প্রাধান্য পাওয়ায় লোকজীবনের সনাতন চলচ্চিত্র সেখানে দৃষ্টিগ্রাহ্যরূপে ধরা পড়ে না। তাই আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্যমণ্ডিত লোকজীবনের ও লোকসম্পদের কথা জানতে লোককাহিনীভিত্তিক চলচ্চিত্রের কাছে বারবার ফিরে যেতে হয়। যতটুকু কাজ হয়েছে, তার নিরিখেই, কাহিনীবিন্যাসে ও নির্মাণদক্ষতার প্রশ্ন আড়ালে রেখে আমরা সহজেই বলতে পারি যে, লোকজীবনের অকৃত্রিম উপস্থাপনার ক্ষেত্রে আমাদের চলচ্চিত্রের নির্মাতারা বিশেষ মনোযোগ প্রদান করেছেন।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই এপ্রিল, ২০০৯ রাত ১১:২৪
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

সচিব, পিএইচডি, ইন্জিনিয়ার, ডাক্তারদের মুখ থেকে আপনি হাদিস শুনতে চান?

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:৪৫


,
আপনি যদি সচিব, পিএইচডি, ইন্জিনিয়ার, ডাক্তারদের মুখ থেকে হাদিস শুনতে চান, ভালো; শুনতে থাকুন। আমি এসব প্রফেশানেলদের মুখ থেকে দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, বাজেট,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×