somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বৃষ্টিরা জানে কখন ঝরতে হয়: অস্টম শতকের চিনের কবি দু ফু-র কবিতা

১৪ ই এপ্রিল, ২০০৯ সকাল ১০:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


কবি দু ফু। চিনের কবি। দুঃখী কবি। বেঁচে থাকতে কবি হিসেবে মর্যাদা পাননি। লিখেছিলেন: “ বাতাসে আমার দুঃখগুলি লিখছি এক আঙুলে ।” একাদশ শতকে তাঁর কবিতা আবিস্কৃত হলে হইচই পড়ে গেছিল। তাঙ যুগের কবি দু ফু। তাঙ রাজাদের সময়কাল ৬১৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৯০৭ খ্রিস্টাব্দ। সেই সময়কালের ঘটনাবলী দু ফুর কবিতায় রয়েছে- সে জন্য দু ফু-র অভিধা- ঐতিহাসিক কবি। কবির বড় ইচ্ছে ছিল রাজকর্মচারী হওয়ার। মন্দ ভাগ্য। ৭৫৫ খিস্টাব্দে চিনে ভয়ানক এক বিদ্রোহ হয়েছিল: এন লুশান বিদ্রোহ। কোটি কোটি মানুষ নিহত হয়েছিল সে বিদ্রোহে। ৭৫৫ খিস্টাব্দ থেকে পরের ৭/৮ বছর দু ফু আর তাঁর পরিবারকে কাটাতে হয়েছিল চরম অনিশ্চয়তায়। সেই অভিজ্ঞতা দু ফু-র ‘পেং-আ সড়ক’ কবিতায় রয়েছে।

আমার মনে আছে -
আমরা উত্তরাঞ্চলের ভয়ঙ্কর গিরিখাতের ভিতর দিয়ে
বিদ্রোহীদের কাছ থেকে পালিয়ে যাচ্ছিলাম।
মধ্যরাত্রির চাঁদটা জ্বলজ্বল করছিল
সঙ্কীর্ণ পেং-আ সড়কে
আমরা হাঁটছিলাম; বিধস্ত-প্রায়-
পথে আগুন্তকদের মুখোমুখি হতে
আমাদের সঙ্কোচ হচ্ছিল।
অল্প সংখ্যক পাখি ডাকছিল উপত্যকায়
নীড়ে ফেরা পাখিদের অবশ্য চোখে পড়েনি।
আমার ক্ষুধার্ত মেয়েটি আমায় কামড়াচ্ছিল
খিদের জ্বালায় চিৎকার করছিল
নেকড়েদের কানে যাবে বলে
আমি ওর মুখ চেপে ধরি
ও ছটফট করে কাঁদতে থাকে।
আমার ছেলেটা পরিস্থিতি বোঝে
ও আশেপাশে খাবার খুঁজছিল।
তারপর শুরু হল প্রবল বৃষ্টি
একটানা পাঁচ দিন ...
ঠান্ডা কাদা ঠেলে আমরা হাঁটছি
আমাদের পোশাক নেই, আশ্রয় নেই
আমরা ভিজে শীতল পোশাক পরে আছি
এভাবে ধুঁকতে ধুঁকতে প্রতিদিন
এক মাইল দু’-মাইল এগোন যায়।
বুনো ফলমূল খাচ্ছি
গাছের ডালই আমাদের ছাদ
ভোরে নদী পেরুলাম
সন্ধ্যায় দূরে তাকিয়ে ধোঁওয়া সন্ধান করলাম
তারপর একটা জলাভূমির কাছে পৌঁছলাম
জায়গাটা পেরুনোর সময়ই সুনের সঙ্গে দেখা
সুনের ক্ষমতা আকাশ-ছোঁওয়া
আমরা অন্ধকার থেকে এসেছি
দরজা খুলে প্রদীপ জ্বালিয়ে দিল
ভৃত্যরা আনল গরম জল
আমরা আমাদের আহত পাগুলি ধুয়ে নিলাম
আমাদের সম্মানে তারা কাগজের ব্যানার টাঙ্গাল।
সুন তার বাচ্চাদের নিয়ে এল
বাচ্চারা আমাদের দুর্দশা শুনে কাঁদল।
আমার বাচ্চারা ক্লান্ত; ঘুমিয়ে পড়ল
পরে ওদের খেতে ডাকলাম।
আমার আশ্রয়দাতা শপথ করল:
সে চিরদিন আমার ভাই হয়েই থাকবে;
আর, তার ঘরটা আমাদের ঘর হবে
আমাদের সুখের নিমিত্তে।
এমন দুঃসময়ে কে ভাবতে পারে
আকস্মিক এমন উদ্ধার সম্ভব?
সেই ভয়াল রাতের পর এক বছর কেটে গিয়েছে।
এখনও বর্বরেরা যুদ্ধ করছে!
আমার যদি হাঁসেদের মত ডানা থাকত
আমি তার কাছে উড়ে যেতাম!

তখন আমি বলছিলাম। বেঁচে থাকতে কবি হিসেবে মর্যাদা পাননি। একাদশ শতকে তাঁর কবিতা আবিস্কৃত হলে হইচই পড়ে গেছিল। হইচই পড়ার কারণ শেষের দুটো চরণে নিহিত বলে আমার বিশ্বাস।



যা হোক। তাঙ রাজবংশের রাজধানী ছিল চাঙান।


মানচিত্র। দু ফুর সময়ে চিন।

দু ফুর জন্ম চাঙান। জন্মের পরই মা মরে গিয়েছিল। বাবা আবার বিয়ে করেন। অনেকগুলি ভাইবোন ছিল। তাদের কথা কবিতায় এলেও সৎমায়ের কথা আসেনি। ছেলেবেলায় নিশ্চয়ই কবিতা লিখতেন। সেই কবিতাগুলি পাওয়া যায় নি।



দু ফুর গ্রামের বাড়ি

রাজকীয় পদ গ্রহনের উদ্দেশে তরুণ বয়েসে পড়ালেখা করে কাটান। বিশেষ করে, কনফুসিয়াসের রচনাবলী। দেশভ্রমনে বেরুলেন। চাঙান ফিরে চাকরির জন্য পরীক্ষা দিলেন- ব্যর্থ হলেন। পরের যুগের পন্ডিতেরা এ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তাঁরা মনে করেন দুবোর্ধ্য গদ্য লেখাই দু ফু-র ব্যর্থতার অন্যতম কারণ। অনেকে অবশ্য মনে করেন দু ফুর মামা-কাকার জোর ছিল না। যাক। মনের ভিতরে ব্যর্থতার বিষাদ। আবার দেশভ্রমনে বেরুলেন। পরে আবার রাজধানী ফিরলেন। বিয়ে করলেন। পাঁচটি ছেলেমেয়ে হল। যাদের কথা ‘পেং-আ সড়ক’ কবিতায় রয়েছে। দু ফু-র হাঁপানি ছিল। সেই কষ্ট। যাক। ৭৫৫ খ্রিস্টাব্দে চাকরি পেলেন। মন্দ ভাগ্য। এন লুশান বিদ্রোহ সূত্রপাত হল। যে বিদ্রোহ দমন করতে ৮ বছর লেগেছিল। দু ফু সরকারী কর্মচারী- বিদ্রোহীদের লক্ষ। তাইই পালিয়ে যাওয়া-
৭৭০ খ্রিস্টাব্দে চ্যাঙশা প্রদেশে কবির মৃত্যু।

এবার দু ফুর আরও কটা কবিতা পাঠ করা যাক।

তুষারের মুখোমুখী


যুদ্ধ, কান্না- আরও অনেক ভূত
আমিও বুড়িয়ে গেছি- বিষন্ন হয়ে পাঠ করছি কবিতা।
বুনো মেঘের দল নিচু হয়ে স্পর্শ করছে ক্ষীন সন্ধ্যাকে ।
ঘূর্নায়মান বাতাসে দ্রুত তুষারেরা নাচছে
পরিত্যক্ত কলস; পানপাত্রে নেই সবুজ মদ
শূন্য উনুনে অবশ্যি আগুন এখনও লালাভ
কোনও সংবাদ নেই, প্রদেশগুলি বিচ্ছিন্ন
বাতাসে আমার দুঃখগুলি লিখছি এক আঙুলে ।

ভগ্ন রেখা

নদীটা এতই নীল হয়ে রয়েছে যে- পাখিদের সাদা মনে হয়
সবুজ পাহাড়ের ফুলগুলো রক্তবর্ণের
বসন্ত কি ফুরিয়ে যাচ্ছে?
আমি কি বাড়ি ফিরতে পারব?


দু ফু-র কবিতা

গ্রামের নদী

গ্রামটাকে ঘিরে ফেলতে স্বচ্ছ নদীটি বেঁকে গেছে
এই দীর্ঘ গ্রীস্মে এখানেই সবই উদ্বেগহীন
পাখিরা আসে আর যায় চিরকালের মতোই
হাঁসেরা ছটফট করছে জলে
আমার বউ ছবি আঁকছে
আমার ছেলে বড়শীঁতে সুতো ভরছে
আমার বন্ধুরা যতদিন আমাকে আশ্রয় দেবে
আমার তুচ্ছ শরীর আর কী চাইবে।

বসন্তের রাতে বৃষ্টি

বৃষ্টিরা জানে কখন ঝরতে হয়।
ভরা বসন্তেই বৃষ্টিরা আসে ...
বাতাসে ভেসে এসে রাত্রিতে বিলীন হয়ে যায়
শব্দহীন ভিজিয়ে দেয় সব।

কালো নির্জন পথ- কালো মেঘ
নদীতে নৌকা; সেই আলো শুধু।

ভোরে সবই লাল আর ভেজা
ফুলে ফুলে ভরে আছে চারপাশ



দু ফুর কুঁড়েঘর

চন্দ্রিমা রাত

আজ রাতে ফুঝুনের আকাশে উঠেছে চাঁদ
আমার বউ একাই দেখবে
অনেক দূরে আমি আমার সন্তানের কথা ভাবছি
যাদের চাঙান-এর কথা মনে নেই।

সুগন্ধী কুয়াশায় মেয়েটি নম্র চুল ছড়ায়
স্বচ্ছ জ্যোস্নায় শীতল নিটোল বাহু
শূন্য পরদার মাঝখানে কখন আমরা ঝুঁকব?
আমাদের মুখে শুস্ক কান্নার আলো।



কবির কবিতার লিঙ্ক

http://www.blackcatpoems.com/f/du_fu.html
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা অক্টোবর, ২০০৯ রাত ১:০৮
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারতে পচা রুটি ভাত ও কাঠের গুঁড়ায় তৈরি হচ্ছে মসলা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩০

আমরা প্রচুর পরিমানে ভারতীয় রান্নার মশলা কিনি এবং নিত্য রান্নায় যোগ করে খাই । কিন্তু আমাদের জানা নেই কি অখাদ্য কুখাদ্য খাচ্ছি দিন কে দিন । এর কিছু বিবরন নিচে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মন যদি চায়, তবে হাতটি ধরো

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৩

মন যদি চায়, তবে হাতটি ধরো
অজানার পথে আজ হারিয়ে যাব
কতদিন চলে গেছে তুমি আসো নি
হয়ত-বা ভুলে ছিলে, ভালোবাসো নি
কীভাবে এমন করে থাকতে পারো
বলো আমাকে
আমাকে বলো

চলো আজ ফিরে যাই কিশোর বেলায়
আড়িয়াল... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাকরি বয়সসীমা ৩৫ বৃদ্ধি কেনো নয়?

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪২



চাকরির বয়সসীমা বৃদ্ধি এটা ছাত্র ছাত্রীদের/ চাকরি প্রার্থীদের অধিকার তবুও দেওয়া হচ্ছে না। সরকার ভোটের সময় ঠিকই এই ছাত্র ছাত্রীদের থেকে ভোটের অধিকার নিয়ে সরকার গঠন করে। ছাত্র ছাত্রীদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঁচতে হয় নিজের কাছে!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৮

চলুন নৈতিকতা বিষয়ক দুইটি সমস্যা তুলে ধরি। দুটিই গল্প। প্রথম গল্পটি দি প্যারবল অব দ্যা সাধু।  লিখেছেন বোয়েন ম্যাককয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জার্নালের ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। গল্পটা সংক্ষেপে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×