somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অচলায়তন – ১

১৩ ই এপ্রিল, ২০০৯ ভোর ৫:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রাত ১২টা বাজে। একটু আগে ডিনার করে আসলাম। এখন এক মনে বসে সবাইকে নিয়ে ভাবছি। নিজেকে নিয়ে, চারপাশের মানুষদের নিয়ে, এমন কি যাদের নিয়ে ভাবার কারন নেই তাদের নিয়েও। চারদিকের পরিবেশে কেমন যেন একটা নিরবতা। আপাত সাধারন এই নিরবতার মাঝে একটা অন্যরকম শব্দ আছে। খুব সাবধানে কান পাতলে শোনা যায়। দূর দিয়ে চলে যাওয়া দু-একটা গাড়ির শব্দ। বাসার সামনের রাস্তাটা দিয়ে মাতাল হয়ে থাকা বান্ধবীবে সামলে নিয়ে এগিয়ে চলা ছেলেটার ভালোবাসার যন্ত্রনা। পাশের রুমের মেয়েটার নুতন বয় ফ্রেন্ড হয়েছে। গতদুই দিন ছেলেটা আমাদের বাসায় রাতে থাকে। মধ্য রাতে ওদের অস্পষ্ট হাসিও বেশ লাগে শুনতে। খুব ছিমছাম একটা জগৎ। চারদিকে ভালোবাসার বিনিময় হচ্ছে। যে যে যার যার মত জীবন নিয়ে ব্যস্ত। আর আমি নিরব রাতে সেই জীবনকে কাঁটাছেড়া করছি।

ইদানিং একটা প্রশ্ন আমাকে খুব ভাবাচ্ছে। বলা যায় রীতিমত তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। এই যে পড়ালেখা করছি, এর পর কি হবে? জীবনের লক্ষ্যটাই বা কি হওয়া উচিত। অনেকে বড় চাকরী পেতে চায়, অনেক টাকা আয় করতে চায়। অনেকে পারেও। কিন্তু প্রশ্নটা তবুও থেকেই যায়। তার পর? কিছু মানুষ আছে যারা জীবনটাকে হেয়ালীর মত করে কাটিয়ে দিচ্ছে। যা খুশি করছে, রাস্তায় মদ্যপ হয়ে পড়ে থাকছে। দেখে খুব খারাপ লাগে। এই কি তবে জীবনের সার্থকতা? আবার কিছু মানুষ আছে যারা ঈশ্বরের পথে জীবনকে উৎসর্গ করে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে মনে হয়, এটাও কি জীবনের সার্থকতা হতে পারে? একজন বিজ্ঞানী তার আবিষ্কার দিয়ে সভ্যতাকে অনেক এগিয়ে নিচ্ছে, অর্থনীতির নুতন নুতন তত্ত্ব বিশ্বের উন্নয়নকে তরান্বীত করছে। কিন্তু সেই আবিষ্কার হিরোশিমায় সভ্যতাও ধ্বংস করেছে, সেই অর্থনীতির তত্ত্বগুলো বর্তমান বিশ্বে ক্রেডিটক্রান্চের কারনও হয়েছে। তাহলে সার্থকতা কোথায় রইলো? এই চিন্তাগুলো আমাকে অনুপ্রানিত করে না বরং হতাশ করে।

আমি এখন মুক্ত আকাশের দিকে এক মনে রাতে তাকিয়ে থাকি। তারা দেখি। আসলে তারা না। তারার আড়ালে কারা আছে তাদের দেখি। এই মহাবিশ্ব কি নিতান্তই এক দূর্ঘটনা? কিছু রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে তৈরী হয়ে গেলো প্রোটোপ্লাজম নামের এক উপাদান যা সৃষ্টি করেছে 'জীবন' নামের এক স্বত্বাকে, নাকি এর পেছনে আরো কারন আছে? সূর্যটা ঠিক অতটুকু দূরে না থাকলে কি পৃথিবীতে জীবন সৃষ্টি হতো না? কি হতো তাহলে? আমরা আজ মঙ্গলে বসে পৃথিবীকে দেখতাম? সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো লাগে। অনেক কিছু খুঁজে পাই, কিন্তু জীবনের স্বার্থকতাটাই যেন শুধু দেখতে পাই না।

গতবছর র‌্যান্ডি পাউশ মারা যায়। তিব্র ক্যানসার কার্নেগী মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রাঞ্জল প্রফেসারকে নিয়ে যায় অন্য কোন জগতে। কিম্বা আমাদের জগতেই, কিন্তু ব্যাকটেরিয়ার ভাঙ্গনের দ্বারা অন্য কোন রুপে। পদার্থের অন্তত বিনাশ নাই, বিজ্ঞান তাই বলে। কিন্তু পাউশতো শুধুই একদলা মাংশ ছিলনা। সে একটা মানুষ ছিল। তার হাসতে হাসতে দেয়া সেই 'দ্যা লাস্ট লেকচার' দেখে চোখে অশ্রু চলে এসেছিল। ডাক্তার হঠাৎ করে পাউশকে জানায় সে ক্যান্সার আক্রান্ত এবং সময় বেশি নেই। কী আজব! যুক্তরাষ্ট্রের মত একটা দেশে মাত্র ছয় মাসের 'সুস্থ সময়' বেধে দিল ডাক্তাররা পাউশকে। তারপর এক দিন শুনলাম পাউশের পরিবার জানালো সে আর নেই। একটা হাসিখুশি মানুষ, হঠাৎ নাই হয়ে গেলো। আচ্ছা, পাউশ কি তার জীবনকে সার্থক করে যেতে পেরেছিল? প্রশ্নটা কিন্তু থেকেই যায়।

জেড গুডীর নাম শুনি ২০০৭ সনে যখন সে শিল্পা শেঠীকে 'পাকি' বলে সম্বোধন করে লন্ডন ভিত্তিক বিগ ব্রাদার শো-তে। পরবর্তিতে তার উত্থান-পতন পড়েছি। তবে ধাক্কাটা পেয়েছি এক বছর আগে যখন দেখি ইয়াহু'র ইউকে-আয়ারল্যান্ড পেইজের মূল সংবাদ গুডীর ক্যান্সার। গুডী কাঁদতে কাঁদতে মিডিয়াকে বলেছিল 'আমি বাঁচতে চাই।' নিয়তী সেটা চায়নি। এ বছরের ২২ ফেব্রুয়ারী সে বিয়ে করে আর ২২ মার্চ হঠাৎ স্কাই নিউজে অনেক মানুষের ঢল দেখে চোখটা রাখতেই দেখতে পাই একটা কফিন। মেয়েটা আমার থেকে এগারো মাস তিন দিনের বড় ছিল। আজ কেবল এক দলা পঁচে যাওয়া মাংস। জীবনের সার্থকতার প্রশ্নটা এবারও আমাকে তাড়িয়ে গেলো।

বাবার কথা মনে পড়ে। টানটান বিছানাটায় এক মনে শুয়ে বাবা কি জানি ভাবতো। আমি মাঝে মাঝে চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। কোন ক্ষোভ দেখতে পেতাম না, হতাশাও না। কেমন যেন তাচ্ছিল্য ছিল বাবার চোখে। পৃথিবীর নিষ্ঠুর মানুষগুলোর প্রতি। বাবা আমাকে নিয়ে দরজা বন্ধ করে বেশ কিছু মিটিং করেছিল। মিটিংগুলো খুব অদ্ভুত ছিল। জীবনে চলার সময় আমি মানুষকে কি ভাবে বিচার করবো, কে কে আমাদের ক্ষতি করতে পারে ভবিষ্যতে, কার কাছ থেকে আমরা বিপদের সময় সাহায্য পেতে পারি ইত্যাদি বিষয় বাবা বলতো। হয়তো বাবা জানতো সময় ঘনিয়ে আসছে, শুধু বুঝিনি আমরা।

লেখাটা শুরু করেছিলাম সৃষ্টি দিয়ে, কিন্তু বারবারই কেন যেন মৃত্যুর দিকে চলে যাচ্ছি। আচ্ছা মৃত্যুও কি একটা সৃষ্টি নয়? নাহ। ভুল বললাম। সৃষ্টি বা ধ্বংস বলে আসলে কিছু নেই। সবটাই রুপান্তর। এক রুপ থেকে অন্য রুপে চলে যাওয়। এই রুপান্তরের মাঝে সার্থকতা খোঁজার কি কোন স্বার্থকতা আছে? সম্ভবত নেই। তবুও খুঁজে চলি। আসলে জীবনটাই কেন জানি এমন; অর্থহীনতার মাঝে অর্থপূর্নতার খোঁজ। ধ্যাত। এই এক ঝামেলা। রাতগুলো বড় বেশি অস্থির করে দেয় আমাকে। এ সব লেখার থেকে হাতগুটিয়ে বসে থাকাও ভালো। অন্তত পাঠকের চোখকে যন্ত্রনা দেয়ার হাত থেকে মুক্তি দেয়া যাবে। আর এ সব লিখে হবেই বা কি? মনের সেই কাঁটাটাতো থেকেই যায়।

লেখাটা শেষ করছি একটা গল্প বলে। গল্প না ঠিক। এটাও একটা অনুভুতি। আমি যখন অনেক ছোট ছিলাম, তখনকার একটা সাদাকালো ছবি আছে। আম্মু-আব্বু আর আমি। আমার ছোট বোন তখনও হয়নি। এই ছবিটা আমাদের বাসায় এখনও টাঙানো আছে। আমি বড় হবার পরও জীবনে যখনই কোন বিপদ আসতো, সেই ছবিটার সামনে গিয়ে দাড়াতাম। আমার মনে হতো আব্বু-আম্মু আমাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে রেখেছে। আমি অদ্ভুত এটা শান্তি অনুভব করতাম। আমার মনে হতো আর কোন বিপদই আমাকে স্পর্শ করতে পারবে না। এখন আব্বু কেবল ছবিরই মানুষ, আম্মুরও শরীরটা ভালো যাচ্ছে গত কিছুদিন। দেশ থেকে হাজার মাইল দূরে দাড়িয়ে আমি আজ ঐ ছবিটাকে খুব মিস করছি। ছবিটা আমার আজ বড্ড বেশি দরকার। খুব ইচ্ছে করছে ছবিটার সামনে গিয়ে দাড়াই। সেই শান্তিটুকু অনুভব করি। আমার ঐ ছোট্ট পরিবারই যেন আমার এ জীবনের স্বার্থকতা।

১৩ এপ্রিল ২০০৯
ডবলিন, আয়ারল্যান্ড।
৯টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অতিরিক্ত বা অতি কম দুটোই সন্দেহের কারণ

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ৩১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৩০

অনেক দিন গল্প করা হয়না। চলুন আজকে হালকা মেজাজের গল্প করি। সিরিয়াসলি নেয়ার কিছু নেই৷ জোসেফ স্টালিনের গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। তিনি দীর্ঘ ২৯ বছর সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান নেতা ছিলেন। বলা... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সীমানা পিলার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ৩১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৮



বৃটিশ কর্তৃক এদেশে ম্যাগনেটিক পিলার স্থাপনের রহস্য।
ম্যাগনেটিক পিলার নিয়ে অনেক গুজব ও জনশ্রুতি আছে, এই প্রাচীন ‘ম্যাগনেটিক পিলার' স্থাপন নিয়ে। কেউ কেউ এটিকে প্রাচীন মূল্যবান ‘ম্যাগনেটিক’ পিলার... ...বাকিটুকু পড়ুন

মাথায় চাপা ভূত ভূত ভূতং এর দিনগুলি

লিখেছেন শায়মা, ৩১ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৫


এই যে চারিদিকে এত শত কাজ কর্ম, ঝামেলা ঝক্কি, ক্লান্তি শ্রান্তি সব টপকে আমার মাথায় আজও চাপে নানান রকম ভূত। এক ভূত না নামতেই আরেক ভূত। ভূতেদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায় (দ্বিতীয় অংশ)

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ৩১ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:০৫


আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায় (প্রথমাংশ)
আমাদের সদ্য খনন করা পুকুরটা বৃষ্টির পানিতে ভেসে গেল। যা মাছ সেখানে ছিল, আটকানোর সুযোগ রইল না। আমি আর দুইবোন শিউলি ও হ্যাপি জালি... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিজের পাসওয়ার্ড অন্যকে দিবেন না ;)

লিখেছেন অপু তানভীর, ৩১ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:৫৭



কথায় আছে যে পাসওয়ার্ড এবং জাঙ্গিয়া অন্যকে দিতে নেই । মানুষ হিসাবে, বন্ধু হিসাবে প্রেমিক/প্রেমিকা হিসাবে অথবা আজ্ঞাবহ হওয়ার সুবাদে আমরা অন্যকে ব্যবহার করতে দিই বা দিতে বাধ্য হই।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×