হৃতরাজ্য পুনরূদ্ধার এবং শত্রুর উপর অকল্পনীয় বিজয় লাভ করার আনন্দে উদ্বেলিত হিরাক্লিয়াস বায়তুল মোকাদ্দাস জিয়ারত করতে এসেছিলেন । ঠিক এ সময়টাতেই হযরত নবী করিম সল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের দূত দেহইয়া বিন খলীফা কালবী (রাঃ) হযরত নবী করিম সল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের পত্র সহ বাইতুল মোকাদ্দাসে পৌছেন । ভরা দরবারে হযরত দেহইয়া বিল খলীফা (রাঃ) প্রিয় নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের পত্রটি সম্রাটের হাতে অর্পণ করেন ।
[পত্রটি বর্তমানে আবুধাবীর যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে]
পত্রের বিষয়বস্তু নিম্নরূপঃ
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম !
'আল্লাহর বান্দা ও রাসূল মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষ থেকে রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের বরাবরে । ন্যায়পথের অনুসারীগণের প্রতি সালাম । অতঃপর আমি আপনাকে ইসলামের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি । যদি শান্তি লাভ করতে চান তবে ইসলামে দীক্ষিত হোন । যদি আপনি ইসলাম গ্রহণ করেন, তবে আল্লাহতা'য়ালা আপনাকে দ্বিগুণ প্রতিফল দিবেন । আর যদি প্রত্যাখান করেন তবে আপনার সকল প্রজা সাধারণের ভ্রষ্টতার দায়ও আপনার উপর-ই পতিত হবে ।
হে আহলে কিতাবগণ! বিতর্কিত সকল বিষয় স্হগিত রেখে আস আমরা এমন একটি বিষয়ে ঐকমত্যে পৌছি যে বিষয়ে তোমাদের এবং আমাদের মধ্যে কোন মতপার্থক্য নেই । আর তা হচ্ছে, আমরা এক আল্লাহ ছাড়া আর কারও এবাদত করব না । অন্য কোন কিছুকে-ই তার শরীক সব্যাস্ত করব না । আল্লাহ ছাড়া কাউকে-ই আমাদের উপাস্যরূপে গ্রহণ করব না । যদি এ বিষয়গুলো আপনি অস্বীকার করেন তবে শুনে রাখুন যে, সর্বাবস্হায়-ই আমরা আল্লাহ একত্বে বিশ্বাসে অটল থাকবো ।' - মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ ।
এই মোবারক পত্র পাঠ শ্রবণ করে সম্রাট হিরাক্লিয়াস কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন । তার মনোজগতে তখন যেন ঝড় বয়ে যাচ্ছিল । দরবারের লোকদের নির্দেশ দিলেন, আরবের কোন বাণিজ্য কাফেলা বাইতুল মোকাদ্দাসে অবস্হানরত থাকলে তাদের মধ্য থেকে দু'একজন বিজ্ঞ লোককে যেন দরবারে ডেকে আনা হয় । ঘটনাক্রমে সে সময় কোরাইশদের প্রধান ব্যাক্তি আবু-সুফিয়ান বাণিজ্য উপলক্ষে বাইতুল মোকাদ্দাসে অবস্হান করছিলেন । তিনি তখনও মুসলমান হন নি । তাকেই দরবারে হাজির করা হলো ।
সম্রাট তার সাথে হযরত নবী করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তার বংশ মর্যাদা, তার চরিত্র, তার প্রচারিত দ্বীনের মৌল শিক্ষা, এই ধর্ম যারা গ্রহণ করেছেন তাদের অবস্হা সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা করলেন ।
আবু সুফিয়ানের সাথে রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের যে কথোপকথন হয়েছিল, বুখারী শরীফের বর্ণনা অনুযায়ী তা ছিল নিম্নরূপ-
সম্রাট কায়সারঃ তোমাদের শহরে যিনি নবুয়তের দাবী করেছেন, তার বংশ মর্যাদা কিরূপ ?
আবু সুফিয়ানঃ অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত ।
কায়সারঃ নবী-রাসূলগণের সবাই উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছেন যেন কেউ তার আনুগত্য করতে গিয়ে নিজেকে ছোট করা হচ্ছে এমনটা ভাবতে না পারে ।
উনার বংশে কি অতীতে অন্য আরও কেউ নবী হওয়ার দাবী করেছেন বা কেউ কি রাজত্ব করেছেন ?
আবু সুফিয়ানঃ না কখনও না ।
কায়সারঃ যদি এমনটি হতো তবে এরূপ মনে করার অবকাশ ছিল যে, পারিবারিক ধ্যান-ধারণার প্রভাবে এ ব্যাক্তি নিজেকে নবী বলে প্রচার করছে । কিংবা সে তার পূর্ব-পুরুষের বাদশাহী পুনরূদ্ধার করার লক্ষ্য নিয়ে এমন একটি দাবীর আশ্রয় গ্রহণ করেছে ।
যারা তার ধর্ম মত গ্রহণ করেছে তারা সমাজের প্রভাবশালী শ্রেণীর , না দুর্বল শ্রেণীর ?
আবু সুফিয়ানঃ সাধারণ সমাজের দুর্বল শ্রেণীর লোক ।
কায়সারঃ নবী-রাসূলগেণর অনুসারী প্রথমাবস্হায় সাধারণত গরীব লোকেরাই হয়ে থাকে । তাঁর অনুসারীর সংখ্যা দিন দিন বর্ধিত হচ্ছে না কমে যাচ্ছে ?
আবু সুফিয়ানঃ তার অনুসারীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বর্ধিত হচ্ছে, কমছে না ।
কায়সারঃ ঈমানের আকর্ষণ এমনটাই হয়ে থাকে; তা দিন দিন শুধু বর্ধিত হয় । আচ্ছা ! এ পর্যন্ত কি কেউ বিরূপ হয়ে তাকে পরিত্যাগ করে গেছে ?
আবু সুফিয়ানঃ এ পর্যন্ত কেউ এমনটি করেনি ।
কায়সারঃ ঈমানের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে এই যে, শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে নয়, বরং সত্যের প্রভাবেই তা মানব হৃদয়ে দৃঢ়মূল হয় । আর একবার তা হৃদয় স্পর্শ করলে আর কখনও তা বিচ্যুত হয় না । আচ্ছা নুবয়তের দাবী উত্থাপন করার আগে কি তোমরা এই লোকটিকে সত্যবাদী বলে মনে করতে না কখনও তাকে মিথ্যায় জড়িত হতেও দেখা গেছে ?
আবু সুফিয়ানঃ সে কখনও মিথ্যা বলতো না ।
কায়সারঃ যে ব্যাক্তি কোন সময় মানুষের সাথে মিথ্যা বলেনা, সে কেন সৃষ্টিকর্তার নামে মিথ্যা বলতে যাবে ? নবীগণ কখনও মিথ্যা বলেন নি, কাউকে প্রতারণাও করেন নি । ইনি কি কখনও কোন চুক্তি বা ওয়াদা-অঙ্গীকারের অন্যাথা করেছেন ?
আবু সুফিয়ানঃ এখনও পর্যন্ত তো এমন কোন ঘটনা ঘটেনি, তবে সম্প্রতি তার সাথে একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে (হুদায়বিয়ার সন্ধি) দেখা যাক, সেটির মর্যাদা তিনি রক্ষা করেন কি-না ?
কায়সারঃ পয়গম্বর কখনও চু্ক্তি ভঙ্গকারী হন নি । তোমাদের সাথে কি তার কখনও যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে ?
আবু সুফিয়ানঃ জ্বী হ্যাঁ, কয়েকবার-ই যুদ্ধ হয়েছে ।
কায়সারঃ যুদ্ধের ফলাফল কি হয়েছে ?
আবু সুফিয়ানঃ কখনও আমরা জয়যুক্ত হয়েছি, কখনও তিনি জয়যুক্ত হয়েছেন ।
কায়সারঃ আল্লাহর প্রেরিত নবী-রাসূলগণের অবস্হা সাধারণতঃ এমনটি হয়েছে । কিন্তু শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত জয় তাঁদেরই হয়ে থাকে । তার শিক্ষার মূল কথাগুলো কি ?
আবু সুফিয়ানঃ তিনি বলেন, তোমরা এক আল্লাহর এবাদত কর । অন্য কাউকে আল্লাহর সাথে শরীক করো না । চারিত্রিক বিশুদ্ধতা রক্ষা করে চল । পূর্ব-পুরুষদের অংশীবাদী রীতি-নীতি পরিত্যাগ কর । নামাজ পড় ।
কায়সারঃ প্রতিশ্রুত যে নবীর কথা আমরা জেনে আসছি, তার শিক্ষা হবে এরূপ-ই । আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, অতি সত্বর-ই একজন নবীর আর্বিভাব ঘটবে । তবে এমন ধারণা ছিল না যে, তিনি আরবের বুকে আর্বিভূত হবেন । হে আবু সুফিয়ান ! যদি তুমি মিথ্যা বলে না থাক, তবে সেই দিন বেশী দূরে নয়, যেদিন আমি যে স্হানটায় বসে আছি, এটিও তার পদানত হয়ে যাবে । হায় ! আমি যদি তার নিকট পৌছতে পারতাম তবে তার পা ধুয়ে দিতাম । (বুখারী শরীফ, ১ম খন্ড, তারীখে-তাবারী, তয় খন্ড)
আবু সুফিয়ান পরে বর্ণনা করেছেন, আমার একবার ইচ্ছা হয়েছিল যে, মুহাম্মদ (সাঃ) যেহেতু আমাদের দীন ধর্মের শত্রু , সুতরাং তার সম্পর্কে সম্রাটের মন বিষিয়ে দেই । কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিবেকের তাড়নায় সত্য কথাই আমাকে বলতে হয়েছে । আমি সম্রাটের প্রতিটি প্রশ্নের-ই জবাবে সঠিক উত্তর দিয়েছি । তবে এতটুকু বলতে ছাড়িনি যে, মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহান কুরাইশ গোত্রের মধ্যে মোটেও কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নন এবং তার প্রচারিত ধর্মমতটি এমন কিছু নয়, যা নিয়ে মাথা ঘামাবার মত কিছু থাকতে পারে !
আবু সুফিয়ানের সাথে সম্রাটের আলোচনা দরবারীদেরকে রীতিমত ক্ষুদ্ধ করে ফেলেছিল । হযরত রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের পত্রের প্রতি সম্রাটের মুগ্ধ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে দরবারীদের ক্ষোভের মাত্রা চরমে পৌছেছিল ।
এরূপ প্রতিকূল অবস্হায় সম্রাট হযরত দেহইয়া (রাঃ) কে লক্ষ্য করে বললেন, যদি আপনজনদের ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া এবং তাদের হাতে আমার জীবন বিপন্ন হওয়ার আশংকা না থাকত তাহলে আমি অবশ্যই তোমাদের নবীর আনুগত্য গ্রহণ করতাম । নিঃসন্দেহে তিনি সেই প্রতিশ্রুত নবী, আমরা যার অপেক্ষা করছি । (বুখারী শরীফ, ১ম খন্ড, তারীখে তাবারী, ৩য় খন্ড)
সুত্রঃ মাসিক মদীনা, মার্চ-২০০৯ সংখ্যা ।
----------------------------------
.....প্রাসঙ্গিক মনে হওয়ায় এখানে আমি আমার নিজস্ব পর্যবেক্ষণে অনুধাবণ করত অথর্ববেদের কুন্তাপ সুক্তের ১১ নং শ্লোকটি উল্লেখ করে তা পাঠকদের চিন্তা করতে অনুরোধ করলাম ।
স্তুতিকারী গায়ককে ইন্দ্র জাগাইয়া দিয়া
চর্তূদিকে লোকদের কাছে দিলেন পাঠাইয়া
ইন্দ্রের মাহাত্ন কীর্তন করিতে বলিলেন
যাহাতে ধার্মিকগণ ইহা জানিতে পারেন
তাহা হইলে ঈশ্বর তারে করিবেন পুরস্কৃত
ইন্দ্রের মাহাত্ন যদি হয় প্রচারিত
..আমার কেন জানি মনে হয় এই শ্লোকে৭ম হিজরীর মুহররম মাসে (৬২৯ খ্রীঃ) মহানবী (সাঃ) মদীনার আশেপাশের বিভিন্ন রাজন্যবর্গ বরাবর যে দাওয়াতী পত্র সমূহ প্রেরণ করেন এবং তাতে উনি সবাইকে মহান আল্লাহর ইবাদত করতে বলেছেন, সেটাই উল্লেখ করা হয়েছে । খেয়াল করুন -
১. স্তুতিকারী গায়ক - মহানবী (সাঃ) - যিনি মহান স্রষ্টার সর্বাপেক্ষা প্রশংসা করেছেন ।
২. চর্তুদিকে লোক পাঠাইয়া দিলেন- লোক সহ পত্র প্রেরণ করেন ।
৩. ইন্দ্রের মাহাত্ন কীর্তন করিতে বলিলেন - অংশীবাদ ত্যাগ করে শুধু আল্লাহর ইবাদত করতে প্রতিটি পত্রে উল্রেখ করেছেন ।
৪. ধার্মিকগণ ইহা জানিতে পারেন - আহলে কিতাবধারীদের কথা বলা হয়েছে ।
৫.ঈশ্বর তারে করিবেন পুরস্কৃত - যে উনার অনুসারী হবে তাকে-ই মহান আল্লাহ পুরস্কৃত করিবেন, পত্রে তিনি তা উল্রেখ করেন ।
আরও জানতে দেখুনঃ
১. http://www.cyberistan.org/islamic/letters.html
২. Click This Link
(সকল পত্রের ইংরেজী অনুবাদ)
এ সম্পর্কে বিস্তারিত লিখে আরেকটি পোষ্ট দেয়ার ইচ্ছা আছে ।
আমার কুন্তাপ সুক্তের পোষ্টটি Click This Link
এখান থেকে পড়তে পারেন ।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই এপ্রিল, ২০০৯ দুপুর ২:২০